নিহারির আত্মা
জলি চক্রবর্তী শীল
ঘরে ঢুকতে গিয়েই আচমকা হোঁচট টা খায় নিহারি| থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে| এতজোরে হোঁচট খাওয়ার পরেও কোন ব্যথা অনুভূত হয় না তার| আচমকাই শুকনো মুখে ভীষণভাবেই সে বিষম খায়| কেউ নিশ্চয় তাকে মনে করছে ভীষণভাবে| নিশ্চয় ভিল| আর তখনি সে শুনতে পায় তার ঘরে কেউ যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে| কি হল যে সবাই এমনভাবে কাঁদছে| মাঝির কি ইন্তেকাল হয়ে গেল| মনটা উচাটন হয়ে ওঠে তার| দ্রুত ঘরের মধ্যে ঢুকে ভিরমি খেতে গিয়ে সামলে নেয় সে| একি কান্ড সামনের একটা নতুন খাটিয়ায় তাকে শুইয়ে রেখেছে| একমাথা মেঠে সিঁদুরে মুখ -মাথা ভর্তি| পায়ে চওড়া করে আলতা| নতুন শাড়ি‚ কপালে চন্দনের ফোঁটা| তাকে ঘিরে পাড়ার মেয়ে-বউরা দাঁড়িয়ে আছে | কেউ কেউ কাঁদছেও| ওদিকে ভিল তার শরীরটার সাথে লেপ্টে আছে| ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাটা ভিলই কাঁদছে| ওদিকে মাঝি মাঝে মাঝে কপালে চাপড় মেরে মেরে কাঁদছে | তার বাবা-মা-ভাই সবাই কাঁদছে|
‘আরে কি জ্বালা বল দেকি‚ তুরা কানছিস ক্যানে‚আমি তো মরি নাই‚এই দেক দিকি আমার দিকে আমি তো বেইচে আছি’,বলে নিহারি| শব্দগুলো তার কানে গমগম করে বাজতে থাকে প্রতিধ্বনি হয়ে| কিন্তু সবাই যে যেমন কাঁদছিল তেমনই কেঁদেই চলেছে|
‘তু চলে ক্যানো গেলি নিহারি? আমি কি তুকে চলে যেতে বলেছিলুম রে? কোন ঘরে না সোয়ামী-ইস্তিরির মধ্যে ঝগড়া হয় তু ক দেখি| তাই বলে কি কেউ এইভাবে চলে যায়? মুকের কথাটাই তোর মনে ধইরলো আর মনের মদ্যটায় একবারও ঝাঁকি দিয়ি দেকলিনে| সেকানটাতে তুর জন্য যে মনটা সরবদা আঁকুপাঁকু করে|’
নিহারির সব মনে পড়ে যায়| সে রাতে অন্য রাতগুলোর মতই বাংলা খেয়ে এসে বড় হুজ্জতি করছিল ভিল| রোজ রোজ সহ্য হয় না নিহারির এইসব মাতলামো| শুধু মাতলামো হলেও কথা ছিল‚ তারওপর লড়কিবাজি ‚ না সেটা সে মেনে নিতে পারে না| মদের ঠেকের টুনিবাঈ-এর সাথে নাকি এখন খুব পিরিত ভিলের| এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না| দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয় তুমুল| তখনই ভিল বলেছিল‚ ‘তু মরতে পারিস না‚ তুকে মুই দেকতেই পারছি না| রোজ রোজ তু মোর সাথে ঝগড়া করিস| তুর মরণ হলে বাঁচি’।
কথাগুলো শুনে মাথাটা গরম হয়ে যায়| ‘যার জন্য করি চুরি‚ সেই কয় চোরা! মদ যখন তুর এত প্রিয় তবে তু মদ নিয়েই থাক| আর কি কইলি‚ আমারে দেকলে তুর একন আর ভালো লাগে না‚ তা লাগবে ক্যান? আমি কি মদের ঠেকের টুনিবাঈ নাকি? বুক ঠেলে‚ ছোট কাপড় পড়ে‚ পা তুলে বসে বসে মদ বেইচছি? আমার শরম আচে‚ ওদের মত বেশরম নই আমি|’
‘তু মর‚তু মরলে আমি একটু শান্তি পাই’ মদের ঘোরে কথাগুলো বলেছিল ভিল|
কিন্তু সহ্য হয় না নিহারির‚ঐ রাতেই সে বেরিয়ে পড়ে ট্রেনলাইন ধরে এগিয়ে যেতে থাকে| মনের মধ্যে একরাশ অভিমান| সে মরবেই| ট্রেনলাইন বরাবার চলতে চলতেই এক আলোর তীব্র ঝলক আর যান্ত্রব শব্দের ঘড়ঘড়ানির মধ্যে চাপা পড়ে যায় তার চিৎকার| তারপরটা সে আর মনে করতে পারে না| সে মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই কিছু তার মনে পড়ে না|
তার মানে সে মরে গেছে! নিজেকে সে একবার চিমটি কাটে| না একটুও লাগে না তার| সে সত্যিই মরে গেছে‚ তাই সবাই কাঁদছে| বড় আফশোস হয় তার| ভিলের মনের ভেতরটা যদি একবার দেখতে পেত‚তবে সে মোটেই মরতে যেত না| দিন গড়িয়ে দুপুর হয়‚নিহারির খাটিয়া রওনা হয় শ্মশানের দিকে| নিহারিও সেই খাটিয়ার সাথে রওনা হয়| তার শরীরের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু আত্মার মৃত্যু হয়নি| সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরীরের পুড়ে যাওয়া দেখে| অমন সুন্দর শরীরটার পুড়ে যাওয়া দেখতে তার বড় খারাপ লাগে‚কিন্তু কিছু যে করার নেই| সে একবার চেষ্টা করেছিল শরীরটার মধ্যে ঢুকে যাওয়ার| তারপর দেখল এ এমন এক রাস্তা বের হওয়া যায় ঢোকা যায় না| যদ্দিন না একটা হিল্লে হয় তদ্দিন এই হালকা-পলকা শরীরটা নিয়েই তাকে ঘুরতে হবে| শরীর নেই অথচ আত্মা আছে‚ জল আছে কিন্তু পাত্র নেই-এর মত যেন| পাত্র না থাকলে জল রাখা যায় না‚ তেমনি শরীরহীন এই আত্মা নিয়ে সে কি করবে ভেবে পায় না| তার খুব কান্না পায়‚কিন্তু চোখ দিয়ে জল ঝরে না| ধীরে ধীরে সে ফিরে চলে তার বাড়ির দিকে যেখানে ভিল থাকে| ভিলের সাথেই সে থাকবে| ভিলকে পাহারা দেবে| আগলে আগলে রাখবে| আগলহীন পুরুষ বড় বেপরোয়া হয়| আবার আফশোস হয় তার‚ মরে গিয়ে ভিলের রাস্তা সে পরিষ্কার করে দিয়েছে| এখন ভিল টুনিবাঈয়ের ওখানে দিন-রাত পরে থাকলেও সে কিছু করতে পারবে না| কেন পারবে না‚ভয় তো দেখাতেই পারে| ভয় দেখিয়েই সে ভিলকে ঐ কুচুটে মহিলার কাছ থেকে সরিয়ে রাখবে।
অপঘাতে মৃত্যু তাই চারদিনেই কাজ করে শুদ্ধ হয়ে যায় ভিল| কাজে ফেরে সে| দিনভর কারখানায় কাজ করে শুঁড়িখানার পথ ধরে সে| এখন সে মুক্ত বিহঙ্গ| রাতভর বাড়ি না ফিরলেও কেউ কিছু বলবে না| মাঝি আছে অবশ্য| কিন্তু মাঝির কথা থোরাই শোনে সে| তার ওপর আছে টুনিবাঈয়ের ডাগর শরীর| এতদিন ঐ শরীরের সুখ সে নিতে পারেনি নিহারির জন্য| রোজ রাতে নিয়ম করে তাকে বাসায় ফিরতেই হত| কিন্তু এখন যখন নিহারি নেই‚ সে তো আজাদ| তার যা ইচ্ছে হবে করবে| পয়সা কামাচ্ছে খরচ করবে বলেই না| সে দ্রুত পদক্ষেপে শুঁড়িখানার দিকে এগিয়ে চলে| কিন্তু কিছুটা এগোবার পর‚ শুরু হয় এক ঝোড়ো হাওয়া‚ কিছুতেই সে এগোতে পারে না| এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে সে ‚ কই বাতাস তো বইছে না‚ গাছের পাতা তো নড়ছে না‚ তবে তার সামনে ওমন ঝোড়ো হাওয়া কেন? সে দুহাতে চেষ্টা করে হাওয়া ঠেলে বের হবার‚ কিন্তু হাওয়ার টানে সে ঐ জায়গা থেকে সামনের দিকে আর এগোতে পারে না| এবার সে ভয় পায়| তার মনে হয় এ কোনো অশুভ আত্মার কাজ| সে চায় না যে ভিল এগোক| চকিতে তার মনে আসে‚ এ নিহারির আত্মা ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না| নিহারি চায় না যে ভিল ঐ শুঁড়িখানায় যাক| ভিল পেছু হাঁটতে থাকে ক্রমশ| ঝোড়ো হাওয়াও তার সাথে সাথে পেছোতে থাকে| ভিলের বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে এ নিহারি ছাড়া কেউ নয়| ভিল চিৎকার করে ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে‚যেখানে তার মাঝি আছে| ঝোড়ো হাওয়া কিছুক্ষণ তার পেছু ধাওয়া করে অদৃশ্য হয়ে যায়|
বাড়ি পৌঁছে সে প্রচন্ড উত্তেজনায় অজ্ঞান হয়ে যায়| মাঝি তার মুখে চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে| সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে‚‘মাঝি নিহারির আত্তা মোদের ছেড়ে যায়নি| আমারে তাড়া করেছিল| সে চায় না যে আমি শুঁড়িখানায় যাই’| নিহারিকে মাঝি ছেলের বউ না‚মেয়ে মনে করত| তাই নিহারির কথা শুনে চোখ ভরে জল আসে| ছেলেটাকে অনেকবার বলেছিল‚বৌটাকে কষ্ট না দিতে‚কিন্তু এই লাইনপারে কোন ছেলেই নেশা না করে থাকে না| তারওপর আছে টুনি বাইয়ের আকর্ষণ| মাঝি বরং খুশি হয়‚ নিহারির আত্মার ভয়ে যদি সে শুঁড়িখানা না যায় তবে তারচেয়ে ভালো আর কি হতে পারে|
ভিল একা থাকতে আজকাল ভয় পায়| সবসময় মনে হয় নিহারি তার আশপাশেই আছে| ঘর থেকে কারখানা আর কারখানা থেকে ঘর‚ এর বাইরে সে কোথাও কারও সাথে সময় কাটায় না‚ কোথাও যায়ও না| শুঁড়িখানার রাস্তা সে প্রায় ভুলতে বসেছে| ঘরে যতক্ষণ থাকে‚ মাঝির সাথে লেপ্টে থাকে| মাঝি সাথে থাকলে তার মনে হয় নিহারির অস্তিত্ব সে অনুভব করে না|
এইভাবে প্রায় মাস ছয়েক বিগত হবার পর একদিন মাঝি তাকে ডেকে বলে‚‘বেটা এবার তু বিহা কর| আমার শরীর ভালো যায় না‚কবে কি হয়ে যায়|’
ভিল বিয়ের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়| নিহারি তাকে আদৌ বিয়ে করতে দেবে বলে মনে হয় না|
‘তু কি বলছিস মাঝি? ও নিহারি কি বিহা করতে দিবে? ও তো সবসময় মোর সাইথেই থাকছে|’
মাঝি নিহারিকে যতটা চেনে‚ততটা বুঝি কেউ চেনে না| তাই তিনি মৃদু হেসে বলেন‚‘নিহারি কিছু কইবে না| তু বিহাটা করবি কিনা ক‚আমি তাইলে ঘটক ডাকি’|
একটা চওড়া হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ভিল সে বিয়ে করতে রাজি| সত্যি সত্যি একা একা আর কতদিন থাকা যায়| নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হয়ে যায় ভিলের| ছেলে-ছেলের বউ ঘরে আসলে‚ মাঝি নতুন বউকে আড়ালে নিহারির একটা ছবি দিয়ে বলে‚‘ইকে তু তুর দিদি মানবি‚দেকবি তুর কোনদিন কুনো অসুবিদা হবে না| কুনো অসুবিদা হলে ইকে বলবি‚দেকবি তুর সব অসুবিদা দুর হয়ে যাবে| আর ভিল ও তুকে খুব মেনে চলবে ৷’ নতুন বউ ছবিটায় গড় করে নিজের ব্যাগের একটা শাড়ির নিচে রেখে দেয়|
ঘরের এককোণে থেকে নিহারি সব দেখেশোনে| ভিলের বিয়েতে সে মনখারাপ করলেও এখন তার মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়| আর তাকে ভিলকে আগলে আগলে চলতে হবে না‚ ভিলকে আগলাবার মানুষ এসে গেছে| সে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।।
*************************************
জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতি
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।
জলির লেখাগুলো আমার সব সময়েই ভালো লাগে । ওনার এক ধরনের বিশ্লেষণ খুব নিবিড় ! – ওনার খুব ছোট ছোট ঘটনার বিশেষণ খুব নজর কাড়ে ! এখানেও দেখলাম সেরকম ভাবে সাজিয়েছে । – একটা ছোট্ট কথা – ছোটোগল্পের চমক মিসিং ! – হয়ত ওনার মনে অন্য কিছু বলার ছিল ! – তবু বলবো আমার বেশ ভালো লেগেছে !
মনোজ ভট্টাচার্য
বেশ অভিনব গল্প।