শ্রুতিনাটক – “অপরাধের শাস্তি – পুরস্কার”
রচনা– গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য্য
[ঘুমের ঘোরে মাষ্টারমশাইয়ের বেতের শব্দ ও বকা শুনতে হয় শুভ’কে। সহপাঠীর ব্যাগ থেকে লোভনীয় ক্যালকুলেটর চুরি করে নেয় সে।]
মাষ্টারঃ Stand up! Stand up on the bench….. হতচ্ছাড়া, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। শেষ পর্য্যন্ত তুই চোর হলি? ছিঃ। এত কষ্ট করে – পরের বাড়িতে কাজ করে, তোর মা তোকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে- কি-না, পড়াশোনা শিখে চাকরি-বাকরি করে মা’র দুঃখ কষ্ট ঘোচাবি… এই তোর পরিণতি, দূর’হ – দূর হয়ে যা – আমার চোখের সামনে থেকে।
[ঘুমের ঘোরে গোঁ গোঁ করতে করতে আঁতকে ওঠে]
শুভ ~ আঁ… আঁ… আঁ… আঁ… ওঃ (হাঁফায়)
মা ~ কি হলো? কি হলো বাবা! শুভ – কি হয়েছে – (শুভ হাঁফায়) শুভ কি হয়েছে বাবা? এরকম করছিস কেন? স্বপ্ন দেখছিলি? কি হয়েছে?
শুভ ~ না, কিছু হয়নি মা ……
মা ~ জল খাবি? দাঁড়া… জলের বোতলটা কোথায় যে রাখলাম!!… এই নে-বোতলটা ধর… (শুভ জল খায়) নিশ্চয়ই ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিস না বাবা!!!
শুভ ~ এ্যাঁ… না… হ্যাঁ হ্যাঁ মা … ও কিছু না…। তুমি শুয়ে পড়ো…।
মা ~ তুইও শুয়ে পড় বাবা… শো। তোকে বলেছি না, ভূতের গল্প পড়বি না… তুই নিশ্চয়ই পড়েছিস।
শুভ ~ না মা, তুমি বলার পর থেকে, আর একদম পড়িনি।
মা ~ বাজে বই পড়বি না, বাজে ছেলেদের সাথে একদম মিশবি না… তাহলে, মন অন্যদিকে চলে যাবে।
শুভ ~ বাঃ-রে – আমি আবার কখন বাজে ছেলেদের সাথে মিশলুম? আমার বন্ধুরা সবাই খুব ভালো।
মা ~ ভালোদের সাথেই মিশবি…। ভালো বই পড়িস – কেমন? তোকে নিয়ে যে আমার অনেক স্বপ্ন বাবা…
শুভ ~ ওঃ মা… তুমি এখন ঘুমোও তো…
মা ~ তোর মাষ্টারমশাইরা বাবাকে কত ভালোবাসতেন। তিনি স্কুলে মালীর কাজ করতেন… কিন্তু তাঁর ব্যবহারের জন্য, সততার জন্য সবাই তাকে ভালবাসত।
শুভ ~ মাষ্টারমশাইরা আমাকেও খুব ভালোবাসেন।
মা ~ সে তো আমি জানি বাবা, তা না হলে… তোর পড়ার খরচের জন্য তাঁরা আমার কাছ থেকে এক পয়সাও নেন না। বই, খাতা, পেন-পেনসিল – এমন কি টিউশনের পয়সাও।
শুভ ~ ওঃ মা, তুমি এখন ঘুমোবে… তোমাকে আবার সকালে কাজে যেতে হবে না!
মা ~ হ্যাঁ – তুইও ঘুমো বাবা… আয়, আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই… বাবা শুভ… আমার স্বপ্ন… তোর বাবার স্বপ্ন… মাষ্টারমশাইদের অবদান – ভুলে যাসনি বাবা… পড়াশুনো করতে হবে… মানুষের মত মানুষ হতে হবে… ভুলে যাসনি শুভ… মনে রাখবি… ছোট বোনকে লেখাপড়া শেখাতে হবে… তোর যে অনেক দায়িত্ব বাবা… সৎ হয়ে বাঁচার মধ্যে…
01
আবহ –
পাতা -১[মাষ্টামশাইয়ের টিউশন ঘর…… মাষ্টারমশাই প্রবেশ করেন]
সবাই ~ নমস্কার মাষ্টারমশাই –
জয়তি ~ সুপ্রভাত মাষ্টারমশাই।
বাবুয়া ~ গুড মর্নিং… স্যার ..
মাস্টার ~ ও,তোমরা এসে গেছো। বোস বোস…। আজ তোমাদের কি পড়া আছে? জয়তী,বইটা দেখি…754জয়তি ~ আজ এই কবিতাটা পড়াবেন বলেছিলেন মাষ্টারমশাই-
মাষ্টার ~ হ্যাঁ দাও।… আমি পড়ছি – তোমরা শোন, কেমন?
রেখো মা দাসে রে মনে এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন কোর নাগো,তব মনঃ কোকনদে।…
এখানে মা বলতে কবি দেশমাতৃকাকে বোঝাচ্ছেন…
দাস কে? না–কবি নিজেকে বলছেন…দেশ আমাদের মা,আমরা সবাই তার দাস।
মিনতি কি? না–অনুরোধ। আমাকে ভুলে যেও না,দেখো- পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ জন্মাচ্ছে,আবার মরে যাচ্ছে। কি–তাইতো?
সবাই ~ হ্যাঁ স্যার।
মাষ্টার ~ আমরা মনে রাখি কাকে? না, যাঁরা এমন কিছু কাজ করেন… তার সেই কৃতকর্মের জন্য… মানুষ তাঁকে মনে রাখে। যেমন ধরো, এই যে কবিতাটা আজ আমরা পড়ছি – এটা কার লেখা? – সুমিত?
সুমিত ~ এটা মাইকেল মধুসূদন দত্তে’র স্যার..
মাষ্টার ~ বাঃ গুড ! তাঁকে আমরা মনে রেখেছি কেন?
লাল্টু ~ তাঁর সৃষ্টির জন্য,তাঁর কবিতার জন্য।
মাষ্টার ~ কবিতার নাম কি? বাবুয়া? বলো…
বাবুয়া ~ ক-বি-তা’র নাম………
মাষ্টার ~ কি হল বল? জয়তী?
জয়তি ~ “বঙ্গভুমির প্রতি” – মাষ্টারমশাই।
মাষ্টার ~ তোমাদের মধ্যে কেউ কি বলতে পারবে – মাইকেল, একটি বিশেষ ছন্দে কবিতা লেখার জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। তার নাম কি?
জয়তি ~ আমি বলবো মাষ্টারমশাই?
মাষ্টার ~ দাঁড়াও। তোমাদের মধ্যে আর কে বলতে পারবে? কেউ না? বলো…
জয়তি ~ আমিত্রাক্ষর ছন্দ… মাষ্টারমশাই।
মাষ্টার ~ বাঃ। বেশ খুশী হলাম। আচ্ছা… মাইকেলের লেখা আর কোনও কবিতার নাম তোমরা কেউ বলতে পারবে? শুভ? … শুভ! … কি ব্যাপার শুভ?
শুভ ~ (চমকে) এ্যাঁ… কি স্যার ?
মাষ্টার ~ কি ব্যাপার শুভ? তখন থেকে দেখছি তুমি খুব অন্যমনস্ক… কি ব্যাপার?
শুভ ~ কই ? না তো স্যার?
পাতা – ২
মাষ্টার ~ না তো স্যার মানে? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
শুভ ~ স্যার… প্রশ্নটা… আর একবার যদি…
মাষ্টার ~ আমি জানি, প্রশ্নের উত্তরটা তুমি দিতে পারবে। কিন্তু কথা হলো – তুমি প্রশ্নটাই শুনতে পেলে না কেন? তোমার মনটা কোথায়?
বাবুয়া ~ ও জানলা দিয়ে আকাশে ঘুড়ি দেখছিল স্যার।
শুভ ~ না স্যার। আমি ঘুড়ি ওড়াই না।
মাষ্টার ~ চুপ করো। শুভ এদিকে উঠে এসো। এসো – কি হয়েছে? মাথা নীচু করে থেকো না। কি হয়েছে বলো-
শুভ ~ কিছু হয়নি স্যার…
মাষ্টার ~ শোন – আমি যতক্ষণ পড়াবো ততক্ষণ কারো যেন অন্যদিকে মন না থাকে!! আমার সময়ের দাম আছে, – যাও, বাড়ী যাও। তোমরাও যাও। আমি আজ আর পড়াবো না। জয়তি – তোমার বইটা রাখো – আমি চললাম। (মাষ্টারমশাই চলে যান)
সুমিত ~ কিরে শুভ? দিলি তো স্যারের মুড্-টা খারাপ করে?
লাল্টু ~ আজ তোর জন্য আমাদের পড়ার বারোটা বেজে গেল।
বাবুয়া ~ কি-রে? ভেড়ুয়ার মত বসে আছিস যে? – পেট খারাপ – না, মন খারাপ?
জয়তি ~ এই চুপ কর। সবাই মিলে ওর পেছনে লাগছিস কেন বলতো?
বাবুয়া ~ পিছনে লাগবো কেন? আমি তো ওর সামনেই বসে – কি রে? (সবাই হাসে)
লাল্টু ~ দেখ শুভ – তুই হ’লি স্যারের best student। তোর মন খারাপ বলে – স্যারেরও মন খারাপ।
সুমিত ~ মাঝখান থেকে আমাদেরও পড়া হলো না।
জয়তি ~ ওঃ। কত একেবারে পড়ে উল্টে দিস্।
বাবুয়া ~ বড্ড শুভ’র হয়ে সালিশি করছিস। কি ব্যাপার রে জয়তি? দেখিস্ বাবা …।
জয়তি ~ (রেগে) বেশী বাঁদরামি করবি তো, স্যারকে বলে দেবো কিন্তু।
বাবুয়া ~ কিচ্ছু হবে না। স্যারের মার হজম হয়ে গেছে।
জয়তি ~ তুই শুধরোবি না। একেবারে গোল্লায় যাচ্ছিস।
বাবুয়া ~ এই শোন্ শোন্… স্যার যখন তাড়াতাড়ি ছেড়েই দিল… চল্ আমার সাথে… এক জায়গায় –
সুমিত ~ কোথায় যাবি বলবি তো?
লাল্টু ~ বুঝেছি – নিশ্চয়ই মালীর বাগানে…।
বাবুয়া ~ চুপ্ – … আর বলতে হবে না… চল্… জয়তি, চলি রে… সুবোধ বালক, আমাদের শুভ বন্ধুকে তোর কাছে রেখে গেলুম্… এই চল্… চল্……
জয়তি ~ বদমাশ একটা। নিজেও পড়াশোনা করবে না – আর সকলকেও… এই শুভ – দাঁড়া – কোথায় যাচ্ছিস্? এদিকে আয়।
শুভ ~ আমি বাড়ি যাচ্ছি।
জয়তি ~ স্কুলে যাবি না?
শুভ ~ যাবো।
জয়তি ~ কি হয়েছে’রে তোর?
পাতা – ৩
শুভ ~ কো-কোথায়?… কি-ই-ছু হয়নি তো!…
জয়তি ~ আমার কাছে লুকোস্ না শুভ – আমার দিকে তাকা – তাকা – কী হ’ল? তাকা আমার দিকে! ……
তুই আমাকে লুকোবি ভাবছিস্? সত্যি করে বল। কি হয়েছে? মা’ কিছু বলেছে?… শরীর খারাপ হয়েছে?… পড়া বুঝতে অসুবিধা হয়েছে?… বই খাতার সমস্যা?……
শুভ ~ (চিৎকার করে) বলছি তো কিছু হয় নি আমার!! তখন থেকে পুলিশের মত জেরা করে চলেছিস্! কি করেছি – কি-করেছি আমি? কিছু করিনি – কারো কিছু নিইনি আমি। ওদিকে হেড-স্যার বেত মারবেন – আর এদিকে তুইও পুলিশের মত জেরা করবি – বলছি তো আমার কিছু হয়নি। – সরে যা – যেতে দে – আমার কিছু হয়নি… কিচ্ছু হয়নি—।
জয়তি ~ শুভ – শুভ শোন্ – শুভ, যাস্ না – শুভ, শুনে যা…।
আবহ –
[স্কুল ছুটির ঘণ্টা… ছেলে-মেয়েদের হৈ-হুল্লোড়……]
বাবুয়া ~ লাল্টু… আরে, এই লাল্টু… শোন্ শোন্… চট্ করে এদিকে আয়।
লাল্টু ~ কি বলছিস্?
বাবুয়া ~ কোথায় যাচ্ছিস্? বাড়ী?
লাল্টু ~ হ্যাঁ… কেন?
বাবুয়া ~ দূর, এত তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে কি করবি? হ্যাঁরে, সুমিত কোথায় রে?
লাল্টু ~ সুমিত? … ঐতো… ঐতো সুমিত…। এই সুমিত, এদিকে শোন্…। বাবুয়া ডাকছে…। বাবুয়া… আমি যাইরে…।
বাবুয়া ~ দাঁড়াতো… বাড়ী গিয়ে কি করবি?
সুমিত ~ কি রে?… কি হ’ল?… ডাকছিলি কেন?
বাবুয়া ~ চল্… সবাই মিলে মালীর বাগানে কামরাঙা খেয়ে আসি।
লাল্টু ~ সামনে পরীক্ষা… মা যদি জানতে পারে যে, ছুটির পর বাড়ী আসিনি!!!
সুমিত ~ আরে! শুভ ওদিকে মাঠের দিকে একলা একলা কোথায় যাচ্ছে? শুভ… শুভ…ও…ও…
বাবুয়া ~ চুপ্! চুপ্! ডাকিস্ না… ওকে যেতে দে… দেখি কোথায় যায়!…
সুমিত ~ আরে! ঐ তো জয়তি-ও এদিকে আসছে… জয়তি… এই জয়তি…
জয়তি ~ কি হয়েছে রে? ডাকছিস কেন?
সুমিত ~ একবার শুনে যা… শিগগির আয়…
জয়তি ~ বল্ … কি বলছিস্ ?
বাবুয়া ~ ঐ দিকে – দেখ…! দেখ… দেখ… তোমার সুবোধ বন্ধু ‘শুভ’… একলা একলা মাঠের ওধারে… মতলবটা কি?…
জয়তি ~ আরে! তাই-তো!… শুভ মাঠের ওধারে… একলা একলা কোথায় যাচ্ছে?
বাবুয়া ~ ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্য লাগছে…
লাল্টু ~ কদিন ধরেই ওকে ঠিক নরমাল লাগছে না… কি ব্যাপার বলতো!!!…
পাতা – ৪
সুমিত ~ চল্… চল্… পিছু নিই…
জয়তি ~ দাঁড়া… সবাই একটু দাঁড়িয়ে যা। ব্যাপারটা আমারও ভালো লাগছে না। তবে, তোদের একটা কথা বলি…। তোরা সবসময় শুভকে হ্যাটা করিস্ কেন বলতো?
বাবুয়া ~ আরে না না… ও একটু মজা করি… দেখিসনা ও কেমন লেবদা লেবদা…
জয়তি ~ লেবদা! লেবদা? ঐ লেবদাই কিন্তু এবারে ক্লাসে সব থেকে বেশী নম্বর পেয়েছে!
সুমিত ~ তাই-তো। এমনিতে ঢ্যাড়স্… আর নম্বর পাওয়ার সময়…!!!
বাবুয়া ~ “সজনে ডাঁটা”
লাল্টু ~ (হাসে) কি বললি… “সজনে ডাঁটা”?
বাবুয়া ~ আরে পরীক্ষাতে মাষ্টারমশাইরা ওকে বেশী নম্বর দেয়– কেন বলতো? – ওর বাপ নেইতো –‘মা’-ও পরের বাড়ীতে কাজ করে…
জয়তি ~ ছিঃ! ছিঃ! বাবুয়া! তুই ওর মা-বাবার সম্পর্কে এরকম কথা বললি!! ও না আমাদের বন্ধু… তুই… দাঁড়া আমি হেড স্যারকে এখনই বলছি…
বাবুয়া ~ না, না, হেড স্যারকে বলিস্ না… আরে… আরে…আমি মজা করে বলেছি… প্লিজ….
লাল্টু ~ জয়তি দাঁড়া। … না, না, হেড স্যারকে বলিস না, তবে বাবুয়া… এটা তুই ঠিক করলি না, ও লেবদা হতে পারে, কিন্তু ওর মনটা খুব নরম।
সুমিত ~ তাছাড়া ‘ও’-তো আমাদের বন্ধু।
জয়তি ~ ভাবতো… ওর বাবা নেই। কত কষ্ট… আমরা যখন যা আবদার করি, আমাদের বাবারা আমাদের সব সখ-আহ্লাদ মেটান। আর ওর মা… কত কষ্ট করেন… কাকীমা আমাদের সবাইকে কত ভালবাসেন।
লাল্টু ~ হ্যাঁ সবসময় আমাকে বলেন – লাল্টু–বাবা… শুভকে দেখিস… তোরা ওর বন্ধু… ভাইয়ের মতো…
সুমিত ~ না, না, বাবুয়া… এটা তুই ঠিক করলি না…
জয়তি ~ তাছাড়া কারুর বাবা-মা’কে নিয়ে কথা বলাটা…
সুমিত ~ এরকম করলে আমরা কিন্তু তোর সাথে খেলবোও না… মিশবোও না…
বাবুয়া ~ সরি .. সরি বস্… আমাদের ভুল হয়ে গেছে… আসলে, আমি অত বুঝে কিছু বলিনি… মজা করতে করতে বলে ফেলেছি…
জয়তি ~ সবসময় অত মজা করতে নেই- তাহলে বোধশক্তি হারিয়ে যায়। শোন্ – আমরা সবাই বন্ধু – ‘ও’ আমাদেরই একজন… বরং সব থেকে ভালো বন্ধু… ও গরীব – কিন্তু ওর ব্যবহারে সবাই খুশি। ও পড়াশুনোতেও ভীষণ ভালো, আজ – ওর কিছু একটা হয়েছে – সেটা তো আমাদেরই দেখা দরকার!
সুমিত ~ ঠিক, ঠিক বলেছে জয়তি। অসময়ে যে বন্ধুর পাশে দাঁড়ায় – সে-ই তো আসল বন্ধু।
লাল্টু ~ একদম ঠিক, আমরা যদি বন্ধুই হই – তাহলে এটা আমাদের কর্তব্য।
জয়তি ~ বাবুয়া – তুই কি বলছিস্?
বাবুয়া ~ আমাকে তোরা মাপ করে দে – আর কক্ষণো আমি এরকম বলবো না – আমাকেও তোরা সাথে নে। চল্… আমরা সবাই মিলে জিজ্ঞাসা করি – ওর কি হয়েছে।
জয়তি ~ বেশ – তাহলে চল্। তবে একটা কথা – কেউ কিন্তু খুব জোর করবি না…ওর মনের কথা ও নিজে থেকেই জানাক।
পাতা – ৫
সুমিত ~ ঠিক… ঠিক…
লাল্টু ~ চল্… চল্…
(আবহ)
[শুভ গাছের নীচে বসে কাঁদে]
সুমিত ~ আরে! ঐ দ্যাখ্… গাছের নীচে মাথা গুঁজে বসে আছে।
লাল্টু ~ দাঁড়া – দাঁড়া… হ্যাঁরে, ওতো কাঁদছে…
জয়তি ~ কাঁদছে!
সুমিত ~ হাঁরে… ঐ তো কেমন ফোঁপাচ্ছে…
বাবুয়া ~ ধ্যাৎ… চলতো দেখি…
জয়তি ~ শুভ… শুভ… ওঠ্… শুভ কথা শোন্…
সুমিত ~ এই শুভ, দ্যাখ্ আমরা সবাই এসেছি…
লাল্টু ~ আমরা সবাই তোর বন্ধু। কি হয়েছে?… আমাদের বল্…।
বাবুয়া ~ কেউ যদি তোকে কিছু বলে থাকে – বা, কিছু করে থাকে, তুই খালি তার নামটা একবার বল্ – দ্যাখ্… কি করি তার।
শুভ ~ চলে যা – চলে যা তোরা – আমার কিচ্ছু হয়নি – আমাকে কেউ কিচ্ছু বলেনি – চলে যা তোরা …।
জয়তি ~ সবাই বোস্… সুমিত বোস্… লাল্টু… বাবুয়া… বোস্ তোরা… ওকে বুঝিয়ে দে – আমরা চলে যাবার জন্য আসিনি। আমরা তোর বন্ধু – তুইও আমাদের বন্ধু। আমাদেরকে বলতেই হবে – কি হয়েছে তোর?
শুভ ~ বলছি তো কিছু হয়নি।
লাল্টু ~ আচ্ছা মুশকিল তো – তুই কাঁদছিস্ কেন বলবি তো!
সুমিত ~ দেখ, আমাদের কাছে কিছু লুকোস্ না –
বাবুয়া ~ বেশী ধানাই ফানাই না করে বলে ফেলনা বাবা… এতগুলো লোক টেনশনে রয়েছে…
জয়তি ~ দেখ্… তুই যদি কিছু না বলিস্ – তাহলে না-হয় হেড স্যার-কেই…
শুভ ~ না-না… হেড স্যারকে কিছু বলিস্ না… হেড স্যারকে…
জয়তি ~ ঠিক আছে। হেড স্যারকে কিছু বলবো না – তুই তাহলে আমাদেরকে খুলে বল্… কি হয়েছে?
শুভ ~ আমি… মানে… (কান্না)… আমি…
জয়তি ~ শুভ! কাঁদিস্ না… বল্… বল্…
শুভ ~ আমি… আমি… চুরি করেছি!!
সবাই ~ চুরি করেছিস্!!!
শুভ ~ হ্যাঁ… ভুল করেছি… আমি ভুল করেছি…
জয়তি ~ কী চুরি করেছিস্?
শুভ ~ ক্যা-ল-কু-লে-ট-র।
জয়তি ~ ক্যালকুলেটর??
পাতা – ৬
সুমিত ~ কোত্থেকে?
লাল্টু ~ কার থেকে?
বাবুয়া ~ কবে? কখন?
জয়তি ~ বল্… বল্, শুভ বল্…
শুভ ~ দোকান থেকে নয়… আমাদের ক্লাসের সজলের। টিফিনের সময়… ওর ব্যাগ থেকে, আমার ব্যাগে… আমি না বলে…
বাবুয়া ~ বেশ করেছিস্। ক্যালকুলেটর’তো – বেশ করেছিস্। আরে ওদের প্রচুর পয়সা… ও হয়তো জানেও না। ওরকম ক্যালকুলেটর ওর দশটা আছে – ছাড়তো…
শুভ ~ না-না, আমি এটা ঠিক করিনি … ভুল করেছি আমি … আমি চুরি করেছি …
বাবুয়া ~ ধ্যাৎ! চুরি করেছি! চুরি তো আমরা প্রতিদিন করি। কোথায় পেয়ারা গ্যাড়ানো… কামরাঙা… করমচা… বাতাবিলেবু ঝাড়া… ওগুলো চুরি না?
জয়তি ~ না! ভুল করছিস বাবুয়া। দুটো জিনিসের মধ্যে তফাৎ আছে। ফুল…ফল… প্রকৃতির সৃষ্টি… না বলে নিলেও লোকে ধরে না। কিন্তু না বলে বন্ধুর ব্যাগ থেকে ক্যালকুলেটর নেওয়া–অন্যায়। তাছাড়া যে কাজের জন্য মনে অনুশোচনা হয়, আপশোস হয়… কান্না পায় – সেটা অন্যায়,পাপ।
শুভ ~ বিশ্বাস কর, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে… আমি বুঝতে পারছি না কি করবো!… এটা আমি ফেরৎ দিয়ে দেবো?
জয়তি ~ শুভ ঠিক কথাই বলছে -। সজলকে সত্যি কথা বলে ফেরৎ দিয়ে দেওয়াই উচিৎ।
শোন্ শুভ… স্যার পড়িয়েছিলেন… মনে আছে – “মানুষ মাত্রই ভুল করে… কিন্তু সেই ভুল শুধরে নেওয়াটাই প্রকৃত মানুষের ধর্ম”। কি – রে-?
শুভ ~ না ভুলিনি। কিন্তু… আমি কিভাবে… ওকে…
জয়তি ~ দেখ, এভাবে মনের মধ্যে কষ্ট পুষে না রেখে ওকে সরাসরি জিনিসটা ফেরৎ দিয়ে দেওয়াটাই কি ভালো না?
সুমিত ~ শুভ, জয়তি ঠিক কথাই বলেছে। এটাই ঠিক।
লাল্টু ~ তাছাড়া মনে কর্… যদি ও পরে জানতে পারে – স্যারকে কমপ্লেন করে!
সুমিত ~ তখন কত অপমান বলতো?
লাল্টু ~ শুধু তাই-ই নয়, তার সাথে শাস্তিও আছে।
বাবুয়া ~ আর মনে কর, তুই ধরা পড়লি না… কিন্তু সারা জীবন তুই মনে মনে কষ্ট পাবি। তার থেকে জয়তি যেমন বলছে, মনে সাহস করে… যার জিনিস তাকে সত্যি কথা বলে সেটা ফেরৎ দিয়ে দে। কি-রে জয়তি তাই-তো?
সুমিত ~ আমরা সবাই তোর সাথে আছি।
লাল্টু ~ হ্যাঁ…
শুভ ~ কিন্তু… আমি…
জয়তি ~ কোন-ও কিন্তু নয়। এটা আমাদের সকলের সিদ্ধান্ত… তোকে মানতেই হবে। আমরা তোর বন্ধু না?… কি-রে?
(আবহ)
পাতা – ৭
[স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আবহ]
মাষ্টার ~ আজ, স্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে, স্কুল কর্তৃপক্ষ – একটি বিশেষ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ক্লাসের অন্য সহপাঠীর ব্যাগ থেকে, না বলে – একটি ক্যালকুলেটর তুলে নিয়ে অন্যায় করেছিল এক ছাত্র। সেই অপরাধের শাস্তি স্বরূপ – স্কুল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের পরিবর্তে পুরস্কার প্রদান হতে পারে – আমার শিক্ষক জীবনে এই প্রথম দেখলাম। আমি মঞ্চে ডেকে নেবো ক্লাস সেভেনের শুভজিৎ দাসকে। তার মুখেই শুনে নেওয়া যাক – কি ছিল তার অপরাধ — আর কেনই বা এই পুরস্কার। শুভজিৎ – এসো।
(****** হাততালি ******)
সুমিত ~ যা… শুভ যা… স্যার ডাকছেন…
লাল্টু ~ কি হলো ওঠ্ – যা-
বাবুয়া ~ আরেঃ,পুরস্কার পাবি… এখনো ঘাড় গুঁজে বসে আছিস্?
জয়তি ~ শুভ ওঠ্। সাহসে ভর করে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়া। সবাইকে খুলে বল্… ওঠ্… যা… যা-না…
(****** হাততালি ******)
শুভ ~ ঝোঁকের মাথায় লোভে পড়ে, বন্ধুর ব্যাগ থেকে… ক্যালকুলেটর নিজের ব্যাগে, না বলে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর থেকেই মনের মধ্যে কেমন যেন কষ্ট হতে থাকে… বুঝতে পারি, চুরি করার মত জঘন্য অপরাধ আমি করে ফেলেছি। মনে মনে কষ্ট পাই… কিন্তু, ফেরৎ দেওয়ার সৎ সাহস করে উঠতে পারিনি।
আজ, এই পুরস্কার আমার প্রাপ্য নয়। আমার সহপাঠী বন্ধুরা… যারা আমাকে সৎ সাহস জুগিয়ে সঠিক পথ দেখিয়েছে, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আর যে বন্ধু, আমার অপরাধ ক্ষমা করে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে – তার প্রতিও – তাদের সবাইকে আমি মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি। এ পুরস্কার আমার নয় – এ পুরস্কার ওদের সবার – (* হাততালি *) প্রথমেই ডাকবো – জয়তিকে– জয়তি… সুমিত… লাল্টু… বাবুয়া…সজল।
[সমবেত হাততালিতে মুখরিত হয় কক্ষ… সবাই এক এক করে মঞ্চে উঠে আসে]
মাষ্টার ~ এসো, এসো… সবাই মঞ্চে এসে দাঁড়াও… তোমাদের বন্ধুত্বের একতার ছবি… সকলের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক… এসো… আজ আমরা সবাই একসঙ্গে রবিঠাকুরের গানে গলা মেলাই… জয়তি, গানটা ধরো…
জয়তি ~ ‘সঙ্কোচের’ বিহ্বলতা… নিজেরে অপমান…
সঙ্কটের কল্পনাতে হ’য়ো না ম্রিয়মান… আ-আ-
সবাই ~ আ-আ-আ…
‘সঙ্কোচের’ বিহ্বলতা… নিজেরে অপমান…
সঙ্কটের কল্পনাতে হ’য়ো না ম্রিয়মান… আ-আ-আ-আ-আ…
মুক্ত করো ভয়… আপনা মাঝে শক্তি ধরো
নিজেরে করো জয়… আ-আ-আ-আ-আ-
(গানটা নীচু স্বরে চলতে থাকবে)
পাতা – ৮
মাষ্টার ~ সবশেষে আমি স্কুলের তরফ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের শুভেচ্ছা বার্তা দিই। সারাজীবন এভাবেই যেন, নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে নিজেদের সঠিক পথে চালিত করতে পারে। অভিনন্দন জানাই – ওদের বন্ধুত্বকে। ঈশ্বরের কাছে কামনা করি – আমাদের প্রাণভরা আশীর্বাদে-ওদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
(সমবেত গান… যেটা নীচু স্বরে চলছিল, সেটা জোরে হবে। দুবার হয়ে শেষ হবে…)
সমবেত গান —- ‘সঙ্কোচের’ বিহ্বলতা… নিজেরে অপমান…
– সমাপ্ত –
****************************************
লেখক পরিচিতিঃ