তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত
।। ফ্ল্যাশব্যাক।।
I have lost my sight,smell,hearing,
taste,touch ;
How should I use therefor your –
closercontact?
(T.S.Eliot – Four Quarters’ ..)
তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ভীড়ে ভীড়াক্কার। বসার কোনও চেয়ার খালি নেই।কয়েকজন আবার নিজের ট্রলিব্যাগ, ব্যাগব্যাগাদি দিব্বি পাশের চেয়ারে তুলে নির্বিকার চিত্ত। চেয়ার না পেয়ে তাই অনেকে প্লাটফর্মে কাগজ বিছিয়ে বসে।এর মধ্যে কয়েকজন আবার সটান শুয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন।ঘটোৎকচের নব্য সংস্করণ!মনে হয়, সারা শহরের মানুষ বোধহয় আজ ট্রেন ধরতে এসেছেন!
শুধু মাথা।দুদ্দাড়িয়ে অনেকে ছুটছে নির্দিষ্ট প্লাটফর্মের দিকে।টেনে নেওয়া ট্রলিব্যাগ কাকে ধাক্কা দিচ্ছে দেখার সময় নেই।পাঁচ ছটা বিভিন্ন বয়েসের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মা চলেছেন সম্ভবত বাচ্চাদের বাবার পিছনে।তাঁর দুহাতে ঢাউস দুটি ব্যাগ,কাঁধে ঝোলা।তিনি ছুটছেন মাথায় মালপত্তর নিয়ে প্রায় দৌড়তে থাকা কুলির পিছনে।কুলিগুলো এত স্পীড পায় কেমন করে,কে জানে।আমি তাই ওদের নম্বর, আর লাল জামা বাদে অন্য পোষাক পরে থাকলে রঙটা দেখে রাখি।মুখটা নয়।কারণ,শাড়ী পরা নারী,পাগড়ি পরা পাঞ্জাবী আর রেলস্টেশনের লাল জামা পরা মালবাহক দের সব্বাইকে যেন একই রকম দেখায়!আমার সঙ্গে অবিশ্যি কোনও মালপত্তর,ঝোলা ব্যাগট্যাগ কিচ্ছুটি নেই।শুধু বগলের হোলস্টারে সার্ভিস … । তাড়াতাড়িতে অফিসে রেখে আসা হয়নি।তাই ফের অফিস হয়ে বাড়ি যেতে হবে!
আজ হয়েছে কি,দুপুরে ক্যান্টিনে খেতে গেছি,আজ জব্বর মেনু।মুসুরডাল,বেগুন ভাজা,মুড়িঘন্ট আর খাসির মাংস।দ্বিতীয় পিস্ টা দাঁতে.. মোবাইলটা বেরসিকের মতন বেজে উঠলো। অনিচ্ছা সত্বেও ফোন তুললাম।একটা অচেনা নম্বর।
-হ্যালো?
তারপর যে ব্যাপারটা ঘটলো তার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না একদম।খাওয়া উঠলো মাথায়।দীর্ঘ প্রতীক্ষায় আমার অবস্থা যেন এলিয়টের সেই ফার কোয়ার্টার্স কবিতার মতন.. আই হ্যাভ লস্ট মাই সাইট .. “! ঘড়ির দিকে তাকাতে মন ভরে গেলো বিরক্তিতে।এখনো পাক্কা তিন ঘন্টা!
।। কোথায় পাবো তারে…?।।
থাকার কথা ঠিক তেইশ নম্বর প্লাটফর্মের মুখে সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁর সামনে।উঁচু পিলারে টাঙানো ঢাউস ঘড়িটার নীচে।সেখানে নেই।আশে পাশে জনা তিনেক একই রকম।সকলেরই উপরে সাদা হাফ স্লিভ আর নীল জিনস!একজনের কপালে সিঁদুর।পাশে সম্ভবত হাবি।সুতরাং বাদ।দ্বিতীয় জন মধ্য বয়সিনী!কথাশুনে বোঝা যায় পাঞ্জাবী!এও বাদ।বাকী রইলো তৃতীয়া।আমি নিঃশব্দে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব তার কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করলাম।একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ছে।
একটু শীত শীত করছে।উদ্বেগ আর আনন্দে। গত একবছর ধরে ফেসবুকের বন্ধু আজ ভার্চুয়াল থেকে সশরীরে মুখোমুখি হবে।বছর ধরে ওর বিভিন্ন পোস্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছি।কবিতা পড়ে মন ভরে গেছে।অসম্ভব মিষ্টি, চর্চিত এবং সুকণ্ঠে ওর গানে মোহিত হয়ে আছি।রাগ রাগিণীর উপরে অনায়াস দখল।ওকে সারপ্রাইজ দেব।তবে দেখলাম ফেসবুক প্রোফাইলের ছোট্ট ছবিতে যতটা সুন্দর মনে হয়,একদম ততটা না।কোথায় মাথা ভর্তি কালো চুল?নাকটা বেশ বোঁচা।গায়ের রঙ আমার চেয়েও এক পোঁচ।প্রথম দর্শনে হতাশ হলেও এগোলাম।গুণ তো ওর কন্ঠে।কলমে।অন্তরে।বাইরের চেহারার মেয়াদ আর কতদিন?ঠিক তিন হাত দূরে অপরাজিতা মুখ তুলে তাকালো।চ্যাপটা মুখ।আমার চোখাচোখি হলো কী?তখনই ফোনটা এলো!ভাবলাম বাজুক।আবার কী মনে হলো।পরে কথার মাঝে ফোনের বিরক্তি এড়াতে ফোনটা ধরলাম।”আমি ব্যস্ত,একটু পরে করুন “বলার আগেই ওপাশ থেকে লাঞ্চের সময়কার মিষ্টি কন্ঠ –
– এই যে মশাই,যাচ্ছেন কোথায়?পিছন ফিরে দেখুন।মিনারেল ওয়াটারের দোকানের সামনে আমি।এই যে আমি এখানে,হাত তুলে আছি!
।। মুখোমুখি।।
ঠিক যেন কল্পনার জগৎ থেকে তুলে আনা একমুঠো রক্তমাংসের বাস্তব। ছবির চেয়ে ঢের সুন্দর।ও একটা মেরুন রঙের ছোট্ট ট্রলি ব্যাগ আর হাতে জলের বোতল ও একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো।পানপাতা মুখ।একঢালা কালোচুল যেন অন্ধকার বিদিশার নিশা,মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য! এই কি জীবনানন্দের সেই বনলতা সেন?তবে বনলতা সেনের বাম গালের মাঝখানে দ্বীপখন্ডের মতন ছোট্ট বাদামী জড়ুলটার কথা কিন্ত নির্জন কবি উল্লেখ করেন নি!চোখ ভরা বনজ্যোৎস্নার আলো নিয়ে ও কাছে এলে হাতে হাত ছোঁওয়ালাম।মরালীর বুকের মতন উষ্ণ নরম স্পর্শে যেন স্তব্ধ হয়ে যাবে আমার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি! মসৃণ ত্বক যেন পদ্মপাতা।জল পিছলে যাবে!ম্যানিকিওর করা আঙুল গুলি ন্যাচারাল নখরঞ্জনী চর্চিত। বাম অনামিকায় ছোট্ট হীরের আঙটি যেন খুসির দ্যুতি ছড়াচ্ছিল।
-কী ভাবছেন এতো?
সম্বিৎ ফিরলো মিষ্টি কন্ঠে।কে বলবে ওকে যে ও একজন ডাক্তারির ছাত্রী? এইমসে এম ডি করছে? কে বলবে এই মেয়েটি কেলুচরণ মহাপাত্রের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী? সঙ্গীতের পাশাপাশি ওড়িশি নৃত্যে যার দেশ জোড়া নাম? কে বলবে দশ বছরের ভার্চুয়াল পরিচয়ের পর আধঘণ্টাও হয়নি এই প্রথম মুখোমুখি? যেন কতদিনের চেনা!
-শুনছেন মশাই? ট্রেন দেড় ঘন্টা লেট।মানে আরও দুঘণ্টা। চা খাবেন?প্রশ্নটা আমারই করার ছিলো।আমি বললাম,কোনও রেস্তোরাঁয় নয়।বরং প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় যাওয়া যাক।চা ওলার কাছ থেকে দু কাপ চা নেওয়া হলো।আবার দু কাপ।ছবি তুললাম।শুকনো খাবার,জলের বোতল,ক্যাডবেরি কেনা হলো।গাড়িতে যে খাবার দেওয়া হয় তা বড়ই এক ঘেয়ে।কি কি সব কথা হয়েছিলো, মনে নেই।মুখে যা যা বলছি,সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে তার দশগুণ বলা হয়েছে!দুমিনিটে দুঘন্টা যে কোথা দিয়ে উড়ে গেল বোঝা গেল না।টু টায়ার এসির দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিলো ও।অনেক দূর পর্যন্ত দেখাগেল।ক্রমশ: দূরে,আরও দূরে মিলিয়ে গেল…..
পার হয়ে বহু বছরের ব্যবধান
কানে ভেসে এলো হারানো দিনের গান।” …
( চিরকুট:মহাদেব সাহা )
ফোনটা পেয়েই আমার মনে পড়লো বাঙলাদেশের বিখ্যাত কবি মহাদেব সাহার কবিতা চিরকুটের লাইনগুলি!জীবনানন্দের বছর কুড়ি পরে নয়।ঠিক দশ বছর সাত মাস এগারো দিন পর দ্বিতীয় বার এলো সেই মুহূর্ত।এই দীর্ঘ সময়ে অপরাজিতার সঙ্গে মুখ পুস্তিকায় আলাপ চারিতা হয়েছে শ’খানেক বার কিন্ত ফোন হয়নি!এর মধ্যে ওর এম ডি শেষ হয়েছে।এইমসে চাকরি হয়েছে।কিন্ত আমদের বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।অবিশ্যি এটা আমার নিজস্ব ধারণা।আমি সেরকমই ভাবি।অপরাজিতার মনে কী আছে,তা আমার জানা নেই।একটা কথা,কে বলেছিলেন, ঠিক মনে পড়ছেনা।কথাটা হলো,”সব ভালোবাসা প্রেম নয়,কিছু ভালোবাসা বন্ধুত্বেরও হয়”।আমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা অনেকটা যেন এরকম!একজাক্টলি ঠিক কীরকম,এক কথায় আমি বলতে পারবনা।
ফোনে লোকেশন অন করা হলো।দক্ষিণ কলকাতার অত্যন্ত অভিজাত এলাকায় বিরাট জমির ওপর একটা কমপ্লেক্স। সতেরো তলা বিল্ডিংয়ের তেরো তলায় ফ্ল্যাট।গীতাঞ্জলী। গুগল সার্চ করতেই বেরিয়ে এলো।সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে দুধারে কেয়ারি করা নানারকম ফুলগাছের মাঝখানে রাস্তা।খুব ধীরে পার্কিংলটে গাড়ি রেখে এগোলাম।এই ডিসেম্বরের শীতেও কপালে ঘাম।ফোন পেয়ে চলে এসেেছি।কে কে সঙ্গে আছে,এটা কার ফ্ল্যাট,কিচ্ছুটি জানিনা।কিছু শুকনো মিষ্টি,ফল,বিস্কিট ,স্ন্যাকস,অপরাজিতার পছন্দের কয়েকটি বই কিনেছি ওর কাছে আসার আগে।পিছনের সীট থেকে ঢাউস প্যাকেট গুলি দুহাতে নিয়ে সামনে রিসেপশনে গেলাম।আমি প্রশ্ন করতে রিসেপশনিস্টের চেয়ারে বসে থাকা সিকিউরিটির ছেলেটি আমার কাঁধ ছাড়িয়ে পিছনদিকে তাকালো।তীব্র বিরক্তিতে আমি কেন জানিনা পিছনে তাকালাম।
অপরাজিতা দাঁড়িয়ে।কাঁচা হলুদ রঙের উপরে গাঢ় বাদামী ছাপ সালোয়ার কামিজ।স্নান করে এসেছে
একটু যেন ওজন বাড়িয়েছে।মুখটা একই রকম উজ্জ্বল।আরও উজ্জ্বল ওর দুুই ভুরুর মাঝখানে ছোট্ট লাল টিপটি।
-কেমন আছো জিতা? আমার কথার জবাব না দিয়ে ওর পাল্টা প্রশ্ন-
– আরে,আপনি ব্যাগ ভর্তি এ্যাতোস্যাতো কী এনেছেন?
-্এ্যাতোস্যাতো কই?দু’একটা বই আর কিছু শুকনো খাবার।তুমি খুব ভালো চা বানাও শুনেছি।যদি এক কাপ মেলে,সঙ্গে খাওয়া যাবে এগুলো।আমার স্মার্ট জবাব।লিফটে উঠে গেলাম।অপরাজিতা ল্যাচ কি’র হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই রুম ফ্রেশনারের গন্ধ ভেসে এলো।মৃদু শব্দে মিউজিক সিস্টেমে বাজছিল সরোদে দেশ রাগ।তারপর…
“গগন মগন হলো গন্ধে
সমীরণ মূর্ছে আনন্দে……..”
(রবীন্দ্রনাথ)
************************************
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।