Shadow

মেঘের কোলে রোদ – ব্রতী ঘোষ

PC: shutterstock.com

মেঘের কোলে রোদ

  ব্রতী ঘোষ

গুনগুন ফিরেছে ? “
না – এখনো ফেরেনি ৷ “
“সেকি? রাত দশটা বেজে গেল এখনো বাড়ি  ফিরল না? বড্ড বাড়াবাড়ি করে ! এত রাতে একা একটা মেয়ে বাড়ি ফিরবে !  যেদিন কোন অঘটন ঘটবে সেদিন বুঝবে ৷ “
সুবীরের মাথাটা যে গরম হয়ে গেছে সেটা সুমনা বেশ বুঝতে পারছে কিন্তু সুমনা এই সময় বিশেষ মুখ খোলে না কারণ ও জানে ও যদি এখন কোন কথা  মেয়ের সমর্থনে বলে তবে সুবীর আরো রেগে যাবে ৷ তাই খুব মৃদু স্বরে বলে,” চিন্তা কোর না, এসে যাবে ৷ “
“তোমার জন্যই ওর এই বাড়াবাড়ি, ছোট থেকে যা চেয়েছে সব দিয়ে গেছো, এখনো পর্যন্ত কোনদিন দেখলাম না যে কোন ব্যাপারে না বলতে ৷ এই যে, ও গাড়ি নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় বেরিয়ে গেল,ওকে তো জিজ্ঞাসা করতে পারতে কোথায় যাচ্ছে,কার সাথে যাচ্ছে ? “
সুমনা অনেকবার সুবীর কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে – দেখো মেয়ে বড় হয়েছে, ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে ওকে যদি কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করো যে কোথায় যাচ্ছিস? কার সাথে যাচ্ছিস? সেটা ভালো দেখায় না। আর সারাদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে যদি সন্ধ্যাবেলা ও একটু বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে বেড়াতে যায় – তাতে ক্ষতি কি ! আমরা সারাদিন অফিসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে হেসে খেলে কাজ করি ৷ ওরা তো ওদের কলিগদের চোখেই দেখল না ৷ তো সারাদিন বাড়িতে থেকে  একটানা ওদের  কি কাজ করতে ভালো লাগে ?
কিন্তু সুবীর কথাগুলো বুঝেও ঠিক বুঝতে চায় না ৷ চিরটা কাল এত নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে জীবনটাকে ও কাটিয়েছে যে এ সংসারে প্রত্যেকেই সেভাবে জীবনটা চালাবে এভাবে ভাবতেই ও ভালোবাসে ৷ সুমনা সেটা বুঝে যতটা সম্ভব নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে ৷ কিন্তু গুনগুন কিছুতেই তা মানবে না। বিশেষ করে ওর বাবার এই ঘড়ি ধরে ঘুম থেকে ওঠা, বসা, খাওয়া, ঘুমোতে যাওয়া এগুলো ওর কাছে একদম অসহ্য। আর বাবা ও মেয়ের এই টানাপোড়েনে পড়ে সুমনার অবস্থা প্রাণান্তকর ৷
পরদিন সকালে –
” গুনগুন কখন ফিরল গতকাল ? ”
” সাড়ে দশটায় ৷ ”
” জিজ্ঞেস করেছিলে কোথায় গিয়েছিল ?”
” না – 
“রাত জেগে ফোনে গল্প করবে,বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠবে, বেলা দুটোয় ব্রেকফাস্ট করবে, রাত বারোটায় খাবার অর্ডার দেবে – এটা কি একটা জীবন ? ”
“দেখো আজকের জেনারেশনটাই এরকম। ”
“তাহলে আর কি ? কিছু বোল না ওকে !! তুমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো ৷ বুঝলে ? “ 
আমি কোনদিন ওকে বিয়ের কথা বলবো না ৷ ও নিজে থেকে যেদিন চাইবে সেদিন আমি এগোব – কথাগুলো নিজের মনেই বলে সুমনা ৷
আজ বছর দুয়েক হলো একটা বহুজাতিক সংস্থা থেকে সুবীর রিটায়ার করেছে ৷ তারপর থেকে ওর নিয়মানুবর্তিতা যেন আরো বেড়ে গেছে ৷ 
” ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল এখনো ওকে বিয়ের কথা বলবে না ? ”
সুমনাও সুবীরের মতোই চায় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে থিতু করতে। এক একটা সময় ওর বেশ চিন্তাই হয় ৷ কিন্তু সেই চিন্তা ও সুবীরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না ৷ কারণ ও অনেকবার সুবীরকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে ওদের জেনারেশনটাই  এরকম ৷ কেউই বিয়ে করতে চায় না ৷ তবে সবাই নিশ্চয়ই এক নয় ৷ বিয়ে না করলে যে জীবনে বিশেষ কিছু না পাওয়া থেকে যাবে অথবা করলেই জীবনের মোক্ষ লাভ হবে সেকথা সুমনা বিশ্বাস করে না। বিয়ে করে ক’জন দম্পতি সত্যিকারের সুখে আছেন ? এ জীবনে তো আর কম কিছু দেখা হলো না ৷ তবে একটা বয়স বোধহয় আসে যখন সত্যিই সারাদিনের শেষে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে নিজের সন্তানের মুখটা দেখতে বড় সাধ হয় বা ভীষণ হতাশার মাঝে একটা মানুষকে খুব পেতে ইচ্ছা করে যার বুকে মাথা রেখে কাঁদা যায় ৷  কিন্তু সত্যিই তা পায় ক’জনা? সুমনা নিজেও কি ? …..
“দেখো ! ওদের বুঝতে গেলে ওদের মতো করে বুঝতে হবে ৷ আমাদের মতামত জোর করে ওদের ওপর চাপিয়ে দেবার দিন আর নেই ৷ আর তাছাড়া প্রত্যেকটা মানুষেরই নিজের মতো করে জীবনটাকে গড়ে নেবার অধিকার রয়েছে ৷ ছোট থেকে যে শিক্ষার ভিত গড়ে দেবার চেষ্টা করেছি ওর মধ্যে  তা কখনো বৃথা যেতে পারে না – একথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি – ” একদমে কথাগুলো বলে থামলো সুমনা ৷
দু দিন পর –
“আমার মোবাইলটা বারবার হ্যাং হয়ে যাচ্ছে  ৷ একটু দেখবি  ?”
“ওটা অনেকদিন হলো, এবার পাল্টে একটা নতুন কেনো বাবা  ৷ ”
” সে কি ? মাত্র তো তিন বছর হল । ”
তিনবছর ? কি বলছো তুমি ? ”
“পাল্টাতে হবে না ৷  তুই একটু দেখ্ না !!”
” আমার ফোনটা দেখো এরকম একটা কেনো  ৷”
” কি ? তোর ঐ অ্যাপেল ফোন ?”
“হ্যাঁ – “
” কোন মানেই হয় না – এতো দাম দিয়ে ফোন কিনে পয়সা নষ্ট করার ! ”
” বাবা ! সারাজীবনে অনেক রোজগার  করেছ ৷ এবার তো নিজের জন্য কিছু করো ৷ “
সুবীরের মাথাটা বেশ গরম হয়ে যায় ৷ এই এক মেয়ে হয়েছে। একটু মোবাইলটা দেখে দিতে বললাম আর এত লম্বা চওড়া কথা। ওরা কি বুঝবে কত কষ্ট করে পয়সা রোজগার করতে হয় !!
” তুই আজও ভাত খেলি না ৷ “
” আমার ভালো লাগছিল না  ঐ মাছের ঝোল, আলু পোস্ত, ডাল আমি খেতে পারব না। “
” ঠিক আছে, তা বলে রোজ রোজ কেউ বাইরের  খাবার খায় ! ”
” দেখো বাবা আমি রোজ খাই না, মাঝে মাঝে খাই ৷
” এ সপ্তাহে ক’ দিন খেয়েছিস বল ? ”
” দুদিন ৷ ”
” মিথ্যা কথা বলিস না। পাঁচ দিন খেয়েছিস ৷  খাবি না আগে থেকে বলে দে ৷ তাহলে আর রোজ রোজ খাবার গুলো নষ্ট হয় না ৷ রোজ বিকেলবেলা খাবারগুলোকে ফ্রিজে ঢোকাবো, তারপর পরদিন আমাদের খেতে হয় ৷ “
সুমনা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই পিতাপুত্রীর এই গরম গরম বাক্যবিনিময় শুনতে পায় ৷ কিছু বলে না কাউকে ৷ সোজা নিজের ঘরে ঢুকে যায় ৷
” তুমি কিছু বলবে না ওকে ? ”
” দেখো ! তুমি তো বলছো ৷ আমিও সময় মতো বলবো  ৷ ”
সুমনাও এই সমস্যা নিয়ে বড়ই বিব্রত ৷ ও চেষ্টাও করে মেয়ের মনের মতো রান্না করতে মাঝে মাঝে ৷ কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ৷ ও সত্যিই কি চায় !! প্রত্যেকদিন রান্নার আগে জিজ্ঞাসা করা হয় যে ও কি খাবে ? রোজ কি আর মাংস রান্না করা যায় ?
” তুমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো ৷ বুঝলে সুমনা ? না হলে ও কোনদিনই বুঝবে না ৷ “
কিন্তু বোঝে না বলে দায়িত্বটা কাঁধে চাপিয়ে দিলেই যে সব বুঝবে সেটা আগেকার দিনের মানুষজন বিশ্বাস করলেও সুমনা করে না ৷ আর এটা ও সুবীরকে বুঝিয়ে  ও উঠতে পারে না ৷
দিন সাতেক পরের কথা –
সুবীর একদম কথা বলে না গুনগুনের সঙ্গে ৷ সুমনাও বেশ আপসেট ৷ গত রবিবার তিনজনের একসঙ্গে প্রশান্তদার মেয়ের বিয়েতে যাবার কথা ছিল ৷ গুনগুনকে বলাও ছিল অনেক আগে থেকেই ৷ কিন্তু বিকেল থেকে ও বাড়ি নেই ৷ এ কি কথা ! যাবার সব ঠিক ঠাক অথচ না বলে ও কোথায় চলে গেল? এরকম তো ও কখনো করে না ৷ সুবীর যা বলে ঠিকই বলে ৷ এই জেনারেশনটার কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই ৷ এদের যে কি হবে? ভাবতেও শঙ্কা হয় – সুমনা ভেবে চলে ৷ অনেক চেষ্টার পরে যখন ফোন ধরলো গুনগুন তখন সুমনাকে জানালো যে ওর বন্ধু অভির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে – খবর পেয়ে ও চলে এসেছে ৷ কিন্তু তাই বলে না জানিয়ে ওর চলে যাওয়াটা সুবীরের সঙ্গে সঙ্গে সুমনাও মন থেকে মেনে নিতে পারে না ৷ প্রশান্তদাও বার বার ওর কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন ! মন টা খিচ্ খিচ্ করতে থাকে ৷ মনে হতে থাকে গুনগুন বিয়ে বাড়ি যাবে না বলে ওদের হয়তো মিথ্যে বলেছে ৷ সুমনাকে তো বলতে পারতো যে ওর যেতে ইচ্ছে করছে না ৷
                   **************
আজ সুবীর আর সুমনার  বিবাহবার্ষিকী। দিনটা রবিবার পড়াতে সুমনার সুবিধাই হয়েছে বিবাহ বার্ষিকী নিয়ে আদিখ্যেতা করাটা কোনদিনই সুবীর পছন্দ করে না ৷ সকাল থেকে অনেকবার ভেবেছে আজ বিশেষ কিছু রান্না করবে ৷ কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না ৷ কদিন হয়ে গেল মেয়েটার সঙ্গে ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলেনি সুমনা – সেদিনের পর থেকে ৷ সকাল থেকে ফোনও আসছে একের পর এক – শুভেচ্ছা বার্তা ৷ মনটা ভালো না থাকলেও সবার সঙ্গেই হেসে কথা বলতে হচ্ছে ৷ এই ভাবেই বেলা গড়িয়ে গেল, কিছুই করা হয়ে উঠল না ৷
ছোড়দার ফোনটা এলো – তা এগারোটা নাগাদ – ” চলে আয় দুপুরে আমার বাড়িতে ৷ ”
ছোটবৌদি ও নাছোড়বান্দা – ” গুনগুন কেও নিয়ে আসিস ৷ “
” দেখ !  ছোটবৌদি !  ওর কথা বলতে পারছি না ৷ “
” কেন রে ? ”
” সে পরে বলবো ‘খন ”
সুবীর আর সুমনার লেকটাউন পৌঁছতে তা প্রায় বেলা দুটো বাজলো ৷ বাড়ি ঢুকে হতবাক ওরা ৷ বাড়ি ভর্তি লোক ৷ সবাই হৈ হৈ করে উঠলো ৷ এ একেবারেই অপ্রত্যাশিত ৷
“এ কি ছোড়দা ? তুই  এ সব কি করেছিস ? এতো লোকজন বলেছিস ৷ আমাকে বলিস্ নি তো ? ”
“আমি আর কি করলাম ? করেছে তো গুনগুন। আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করা, খাবারের ব্যবস্থা করা, বাড়ি সাজানো – সব ওর প্ল্যানিং।
সুবীর আর সুমনা একদম বাক্যহারা ৷ কিছুক্ষণ পরেই ঢুকলো গুনগুন ৷ হাতে বিশাল একটা রেড ভেলভেট কেক। সঙ্গে ওর বন্ধুরা – অঙ্কিতা, দীপ আর রূপসা ৷ সবাই হৈ হৈ করে সুবীর আর সুমনাকে ঘিরে ধরলো ৷ সুবীর আর সুমনা মুখ চাওয়াচায়ি করে ৷ স্নিগ্ধাদি, তারকদা সবাই গুনগুনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ
” ভাগ্যি করে মেয়ে পেয়েছিস সুমনা ৷ আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কি সুন্দর করে কথা বলে, যোগাযোগ রাখে
” সুবীরদা – সত্যি এতো সুন্দর করে মেয়েকে মানুষ করেছো ৷ নইলে এখনকার মেয়ে – বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে !”
এরপরই অভি এসে ঢুকলো ৷ ডান হাতে প্লাস্টার করা ৷ বাঁ হাতেই সুবীরকে প্রণাম করতে যেতেই সুবীর হা হা করে উঠে অভিকে জড়িয়ে ধরলো ৷ সুমনা বুঝতে পারে ওর বুক থেকে অভিমানের পাথরটা সরে যাচ্ছে
বাবা মাকে দুহাতে ধরে কেকের কাছে নিয়ে আসে গুনগুন। দুজনের গালেই ছোটবেলার মতো চুমু খায় ৷ মেয়ের ওপর জমে থাকা সব অভিমান কখন যে চোখের জলে ফিকে হয়ে আসে তা টের পায় না দুজনেই ৷ থাক্ না ও নিজের মতন করে ৷ সারাটা জীবন তো লোকে কি বলবে আর কি মনে করবে – ভেবেই আমাদের চলে গেল ৷ ও যদি সে সবের পরোয়া না করে নিজের মতো করে ভালো থাকতে পারে – থাকুক না ৷ আমরাও না হয় আর লোকের কথা শুনবো না !!
*************************************

ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷

 

5 Comments

  • Surajit Sarkhel.

    পরিণত আবেগস্পর্শি কাহিনী।দারুন ঝরঝরে লিখেছ।খুব ভাল লাগল।

    • Madhumita Mitra

      জীবনের আনাচে কানাচে পরিভ্রমণ করা লেখনী ক্রমশঃ পরিণত হচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে ❤️

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!