Shadow

প্রমাণ – বিদ্যুৎ পাল

PC: Wikimedia Commons

প্রমাণ 

বিদ্যুৎ পাল

শহরের মাঝখান দিয়ে রেললাইন গেছে। আসলে মূল শহরের পাশ দিয়ে রেললাইন তৈরি হওয়ার পর তার ওপারেও প্রায় ততখানিই ছড়িয়ে পড়েছে শহর। ওপারে ছড়িয়ে পড়ার কারণ,এপারে তো রেললাইনের উল্টোদিকে নদী! পিঠ ঠেকে আছে! বাড়বে কী করে?
যাহোক ওপারটাই আমাদের এপার। আর মূল শহরটা ওপার। অফিস ধরতে,কলেজ বা বড় স্কুলে পৌঁছোতে ওপারে যেতে হয়। এমনকি এপারে যাদের ব্যবসাপত্তর তাদেরও মাল যোগাড় করতে ওপারে যেতে হয়। আর সবার একে অন্যের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যখন ছুটির দিনে সিনেমা,থিয়েটার দেখতে বা পার্কে,ময়দানে ঘুরতে,দামী বাজারে কেনাকাটা করতে ওপারে যেতে হয়। তারপরও আছে। মাঝেমধ্যে সার্কাস আসে,সেও ওপারে। মেলা বসে,ওপারে। এমনকি দুর্গাপুজোর মরশুমে বড়,নামকরা মন্ডপগুলোও সব ওপারে। গঙ্গার ওপারে যেতেও আগে শহরের ওপারে যেতে হয়। ট্রেন ধরতে অবশ্য, খুব বেশি জিনিসপত্তর না থাকলে ওপারে যেতে হয় না। নৌকো বেয়েই স্টীমারঘাটায় পৌঁছোনোর মত,রেলগেটে ঢুকে রেললাইন ধরে প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়া যায়,ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা কামরায় ঢুকে পড়া যায়। হ্যাঁ,ঠিক সেরকমই! বলতে গেলে, রেললাইনটাও তো আমাদের জন্য আরেকটা নদীই! পাড়া থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছোলে দুদিকে বেশ কিছুটা গিয়ে দুটো ঘাট,মানে দুটো লেভেলক্রসিং বা রেলগেট,ওপারে যাওয়ার; ভবিষ্যতে দুটো উড়ালপুল হবে।
                         খুড়তুতো ভাই অন্য শহর থেকে এখানে বেড়াতে এসেছে। ঘুরতে  যাবে।  আমার সময় নেই তাই ওকে রাস্তাটা বাৎলে দিচ্ছিলাম। ভীড় এড়াতে কোন পথে যেতে হবে।
সামনের বাড়ির দিদা বসে গল্প করছিলেন মায়ের সঙ্গে। ভিড়ের কথা শুনে ঘুরে বললেন,“তোর দাদু যখন এখানে বাড়ি করল, এইটুকু এক ঘরের বাড়ি,তখন এখানে শেয়াল কাঁদত। ওইদিকের পাড়ায় কিছু সরকারি কোয়ার্টার ইংরেজ আমলের আর এদিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু ক্ষেত আর নালা। ডাকাতদের রাজ্য ছিল,ক্ষেতের আল খুঁড়তে গেলে কঙ্কাল বেরোত।”
খুড়তুতো ভাই ফস করে জিজ্ঞেস করল,“ওঁর ভয় করে নি?”
“নাঃ,জোয়ান,সাহসী মানুষ ছিলেন,বাংলার জলে সাঁতার কেটে গতর করেছিলেন দেখার মত…লোকে দূর থেকে দেখলে চিনত ‘ওই যে মোহনবাবু আসছেন’। সারাদিন ওপারে স্টেশনের কাছে দোকানে বসতেন আর আমি একবছুরে খোকাকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়ে বসে থাকতাম।”দিদার স্মৃতির তোড়ে দেরি হচ্ছে দেখে ভাইকে বললাম,“তুই বেরিয়ে পড় তাড়াতাড়ি। ওই বড় গুমটি (লেভেলক্রসিংকে গুমটি বলি আমরা) ধরেই যাস। ভিড় বেশি, বাজারে কাদাফাদা থাকতে পারে তবে রাস্তা চিনতে অসুবিধে হবে না; চট করে পৌঁছে যাবি। কিন্তু ওকে যেনো ইতিহাস চর্চায় পেয়েছে। উঠবার কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না।গ্যাঁট হয়ে বসে দিদাকে প্রশ্ন করতে লাগলো,
“তারপর? লোকজন আসতে শুরু করল কবে থেকে?”
লোকজন?
– লোকজন কই? শুধু এদেশীয় গোয়ালাদের তিনচারটে বসত,ছোট বড় কিছু কুঁড়েঘর। তাও আমাদের ঘরটা থেকে একটু দুরেই; আল চওড়া করে মাটির রাস্তা, সে পেরিয়ে পৌঁছোতে হয়। তোদের দাদুর বাড়ি করার পাঁচ বছর পর বড় কুঠিটা তৈরি হল। ইংরেজ আমলের পুলিশ দারোগা, কাজের জন্য খেতাব। বলল, ‘এখানেই থাকব, দেখি ডাকাত কী করে!”
অনাদিবাবুর সে, কী যেন বলে ভালো বাংলায়,দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ আর নেই। তবে তাঁর স্ত্রীর প্রতাপ এখনও অক্ষুণ্ন। সকলে বড়মা বলে ডাকে। পাড়ার কোথায় কী খবর সব ওঁর নজরে আসা চাই। পনের বছর আগে এ পাড়ায় ভাড়া আসার পর প্রথম কালীপুজোর রাতে পুজোমন্ডপে সবাই ‘বড়মা বড়মা’ করে গিয়ে প্রসাদ চাইছে দেখে আমিও চাইলাম। ভুরু কুঁচকে চোখ কটমটিয়ে বললেন,“তুই কে রে ছোঁড়া?” খুব খারাপ লেগেছিল। নতুন এসেছি বলে কি ওঁর কাছে নাম লিখিয়ে আসতে হবে নাকি? এক টুকরো প্যাঁড়া দিয়েছিলেন। পরে দেখলাম ওঁর জন্য একটা টিফিন ক্যারিয়ারে প্রসাদ রিজার্ভ রাখা থাকে!
আমি আবার ভাইকে তাড়া দিলাম,“তোর দেরি হয়ে গেছে…এক কাজ কর…এখান থেকে বড় রাস্তায় ওঠ। ওখানেই বাঁদিকে পড়বে একটা কালভার্ট। নীচে বড় নালা। রাস্তাটা টপকে নালার বাঁ পাশ ধরে এগোবি। দেখবি একটা ইঁটের দেয়াল,ওপারে রেললাইন। ওই দেয়ালেই দেখবি দু’মানুষ সমান একটা গর্ত বা ছিদ্র। ব্যস গর্ত পেরোলেই ওপার।
“ওটা বন্ধ করে দিয়েছে না?” দিদা আবার শুরু হওয়ার তোড়জোড় করছেন মনে হল। মা হাতে চা নিয়ে কনুই দিয়ে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। আমি পর্দাটা তুলে ধরে জবাব দিলাম,“কোথায়? …আবার ভাঙা হয়ে গেছে। লোকে মানবে কেন? কত তাড়াতাড়ি হয় কাজের সময়। সরকার বন্ধ করার দুদিন পরেই ভেঙে দিয়েছে।”
ভাই ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“তা দু’দুটো লেভেলক্রসিং থাকতে দেয়াল ভেঙে যাওয়া আসা কেন? রাতবিরেতে অসাবধানে ট্রেনে কাটা পড়বে যে!
আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। বাবার সঙ্গে ডানদিকের লেভেলক্রসিংটার ধারে বাজারে যেতে বা রেললাইনের ওপারে যেতে সব সময় দেখতাম হৈ-হট্টগোল,কাদা,ছাই,নোংরা আবর্জনা,তারই মধ্যে ট্রাক,ট্যাঙ্কার,ঠ্যালাগাড়ি সকলে মিলে তারস্বরে চিৎকার করছে সকাল থেকে রাত অব্দি!…তারপর যখন হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করলাম,বাস ধরতে শিখলাম। শহরে নতুন শুরু হওয়া রিং সার্ভিসের বাস। ওপারে গিয়ে ধরতে হত। তখনই একদিন এক বন্ধু দেয়ালের ছিদ্রপথ দেখিয়ে দিল।  বড়োসরো ছিদ্রপথে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে,এদিক-ওদিক ট্রেন আসছে কিনা দেখে সবাই ছুটে পেরিয়ে যায় বাস ধরতে। ছুটতে গিয়ে লাইনদুটো পেরোতেই অনেকের পা ফাঁসে সিগন্যালের তারে,হুমড়ি খেয়ে পড়ে।আমিও পড়েছি। বাস যায় সেক্রেটারিয়েট হয়ে,আমাদের স্কুলের পাশ দিয়ে দূরের আধা শহরগুলোর দিকে। বাস যায় শহরের ভিতর হয়ে পুরোনো পত্তনি শহরটার দিকে। আবার কেউ কেউ সাইকেল শুদ্ধু রেললাইন পেরোয়। বগলে বা ঘাড়ে তুলে পার করা।লেভেলক্রসিং বন্ধ থাকলে তো পাশের লোহার ঘোরা-গোলটা সাইকেল মাথায় তুলেই পার করতে হয়। …প্রথম প্রথম সাবধানে দেখে পেরোতাম। তারপর ভয় কেটে গেল। মাঝপথে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলেও অন্য অনেককে দেখে নিচের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতে শিখলাম। একবার তো ঢুকেছি হামাগুড়ি দিয়ে আর ওদিকে বাঁশি বেজে উঠল; ঘেমে নেয়ে গেছিলাম।
স্কুল থেকে কলেজ। তখনও ওই গর্ত। হ্যাঁ, তখনও সাইকেল বগলদাবা করে পেরোই। বার বার রেলবিভাগের লোক এসে বন্ধ করে দিয়ে যায়…আর পরের দিনই–যেন নিজেই ধসে গেছে নতুন গাঁথা ইট–লোকে নির্বিকার,আসে যায়।
তারপর চাকরির চক্করে ঘুরে ঘুরে একটা কাজে ঢুকেছি। আর ছিদ্রপথ  পেরোবার দরকার পড়ে না। সকাল সাতটায় বাঁদিকের লেভেলক্রসিংটা পেরিয়ে আরো উত্তরপশ্চিমে চলে যাই কারখানাগুলোর দিকে। তবে বাসরুট নয়,ভিতরের রাস্তাগুলো দিয়ে।
“এ গুমটিটাও শুনছি বড় করবে?” দিদা জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ,শুনছি আমিও” জামাটা গলাতে গলাতে বললাম,“আমাকেও বেরুতে হবে।” ভাইকে জোর করে ওঠালাম,“চল,তোকে আদ্ধেক রাস্তা এগিয়ে দিই।”
কালভার্টের পাশ দিয়ে গিয়ে দেওয়ালের গর্তটা পেরোলাম। আসার সময় বাঁদিকে গৌড়ীয় মঠটা দেখাতে ভুললাম না। দিদার বৃত্তান্তে এটা ছেড়ে গিয়েছিল। আমাদের সময়েই তৈরি হয়েছে। বস্তুতঃ মঠটার তৈরি হওয়া দেখতে দেখতেই নাম শুনে ধন্ধ জন্মেচ্ছিল। মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম গৌড় বলে একটা জায়গা আছে বাংলায়, বৈষ্ণব বলে একটা মত,সম্প্রদায় কিসব যেন আছে, আবার বিপরীতে শৈবও আছে। তার আগে একটাই মঠ জানতাম,গোসাঁইজির মঠ,বাবা-মা যার শিষ্য, লোভনীয় মুড়ি,তরকারির জলখাবার জোটে সকালে আর উৎসবে,দুপুরে এত ভালো খিচুড়ি যে পোলাওয়ের জন্য পেটে জায়গা রাখতে ইচ্ছে করে না।
দুই রেললাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে ভাইকে দেখালাম,ডানদিকে ওই দূরে দেখ বড় গুমটি, তারপর স্টেশন। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছিস? আর বাঁদিকে–এই দৃশ্যটা দেখতে খুব ভালো লাগে,ওকেও দেখালাম–প্রথমে সামনের গুমটিটা,রিক্সা, গাড়ি, মানুষজন পেরুচ্ছে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার…তা ছাড়িয়ে দূরে আরেকটা গুমটি,যানবাহন,মানুষ একটু অস্পষ্ট…তারপর অনেক দূরে আরেকটা গুমট…লোকজন ভাসা ভাসা…শহর তারপরেও দূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। সেসবের পর ছিল আমার স্কুল। সেখান থেকেই পিছনের আমবাগান পেরিয়ে রেললাইন ধরতাম অনেক সময় বাড়ি ফেরার পথে। সঙ্গে থাকত ডোমনজির কাছ থেকে চাওয়া বিনিপয়সার ঝালনুন আর কাঁচালঙ্কা, মুখের বেস্বাদটা কাটাতে…এভাবে বাসে ফেরার পয়সাটা বাঁচত। সে পয়সায় সেবার স্টেশনে হুইলারে গিয়ে কিনেছিলাম দেব সাহিত্য কুটিরের পুজোর বই ‘অরুণাচল।
————
এটাই ছিল পুরনো পাড়ার পুরনো গল্প। পঞ্চাশ বছরের পুরনো। এখন আমার বয়স সত্তর বছর। এখনো সে পুরনো পাড়ায় যাই মাঝে মধ্যে। শহর ভরে গেছে উড়ালপুলে। নদীর ওপর উঠেছে দু’দুখানা পুল। আরো একটা তৈরি হচ্ছে।
একদিন অটোরিক্সায় স্টেশন অব্দি গিয়ে হেঁটে পার হলাম। উড়ালপুলের একপাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম, অন্যপাশ দিয়ে নামলাম। যাওয়ার ছিল নিজের পুরোনো পাড়ায়। কী শখ হল,কালভার্টটা পেরিয়ে ডানদিকে নালার পাশে নেমে গেলাম। গিয়ে দেখি সেই ছিদ্র। এখন আবার রেলবিভাগই সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছে!
ওই যে উর্দুতে বলে,‘কওন কহতা হ্যয় কি আসমান মেঁ সুরাখ হো নহীঁ সকতা/এক পত্থর তো তবিয়ত সে উছালো ইয়ারো’! আমার শৈশবের পাড়াটা হাতেকলমে প্রমাণ দিল যে ঠিক মত অবাধ্য হতে পারলে সরকারে তো ছিদ্র করাই যায়। আকাশ–দেখা যাবে! এক চমকে সেই ১৯৬৭র কোনো এক দিন দুপুরে দেখা,ওদিকের পেট্রল পাম্প থেকে ওঠা ধোঁয়া আর আগুনের হলকাগুলোর কথা মনে ভেসে উঠল। তারপরেই তো তৈরি হল নতুন সরকার! পরে জেনেছিলাম শুধু বিহারে নয়,নয়টা রাজ্যে নতুন ধরনের সরকার তৈরি হয়েছিল।।
****************************************

বিদ্যুৎ পাল পরিচিতি
জন্মতারিখ ২৪শে জুলাই ১৯৫২। জন্মস্থান পাটনা (বিহার)। পড়াশুনো সবটাই পাটনায়। চাকরি  ব্যাঙ্কে,বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিনের ব্যস্ততায় শামিল নিজের লেখালিখি,পড়াশুনো,বিহার হেরল্ডের সম্পাদনা,দেশবিদেশের সঙ্গীত শোনা,বইপত্র সম্পাদনা। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা,গল্প ও প্রবন্ধ (প্রবন্ধটা অবশ্য বাংলা,হিন্দী এবং ইংরেজি,তিন ভাষাতেই লিখতে হয়) প্রকাশিত। আপাততঃ ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরল্ড’এর সম্পাদক,ও বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র যুগ্মসম্পাদক।

 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!