‘দাঁওন’ ও ‘নবান্নের উৎস সন্ধানে
অনুপ মুখার্জী
অগ্রহায়ণ। হায়ণ অর্থে বছর। অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস। মার্গশীর্ষ। বর্ষার আকাশ শরৎ পেরিয়ে একটু একটু করে হেমন্তের এই দ্বিতীয় অর্ধে কখন রঙ বদলে ফেলেছে তা অবলোকন করবেন ফসলের মাঠের রূপে আর কৃষি লোকাচারগুলি পালনের মধ্য দিয়ে,যা নাগরিক সমাজ দেখেও দেখেন না! সুদূর অতীতে এই মাস থেকেই বছর গণনা শুরু হতো। শৈশবে গাঁ (সালারের নিকট দত্তবরুটিয়া/মুর্শিদাবাদ) এর প্রবীণদের কাছে শুনেছি এটি আবার বাঙালির অতিথি আপ্যায়ন ও সৎকারের মাস। নতুন ধানের পুষ্ট সোনালী আভা ক্ষেত জুড়ে তার খিলখিলানি হাসি ছড়ায়। এই হাসি ফুটে ওঠে আপামর কৃষিজীবি মানুষের ঘরে।কদিন পরেই গৃহে পদার্পণ হবে স্নেহের দুলালীর। এক চিরন্তনী সুবাসে মুখরিত হয়ে ওঠে দশদিশি। কত স্ত্রীআচার,সঙ্গে দাঁওন,নবান্ন। শুরু হয় ফসল কাটার মরসুম। কেদে (কাস্তে) কুটানোর পালাকে কেন্দ্র করে কামারশালাগুলিতে তার ক’দিন আগে থেকেই ব্যস্ততা।
ভাতের কথাঃ-
বাঙালিদের এই ধান-চাল বা ভাতের ইতিহাস কতদিনের? প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা অনুযায়ী,নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের স্থায়ী বসত গড়া ও পুরোদস্তুর কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে খাদ্য বস্তু ভাতের ইতিহাস সম্পর্কিত। আবার পি,এন,এ, এসের (Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাত হিসেবে গ্রহণযোগ্য চাল উৎপাদন ধানের বয়স প্রায় ৮-১৩ হাজার বছরের মতো। জানা যায়,চীনের পার্ল উপত্যকা থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম বিস্তার ঘটেছিল ভাতের। এর আগে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে ধরা হতো চীনের ইয়াংতেজ উপত্যকায় প্রথম ধান চাষ শুরু হয় এবং সেইমতো খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ভাতের ইতিহাসেের সেখানেই শুরু।যদিও পরেশ দাশগুপ্ত তাঁর ‘এক্সক্যাভেশনস অ্যাট পান্ডু রাজার ঢিবি’ গ্রন্থে বলেছেন,ধানের চাষ বাঙলাতেই শুরু হয়েছিল এবং সেখান থেকেই চিনে যায়।
ঐতিহাসিক সূত্রঃ-
প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনেকে মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে ভারতে খাদ্যশস্য হিসেবে ধানের গুরুত্ব ছিল। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ধাপের নগরায়ণেও ধানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অতুল সুর মহাশয়ের অনুমান,সিন্ধু উপত্যকায় বাঙালিরাই চাল ও মাছ নিয়ে যায়-যা বাঙালির অতি প্রিয়। ভারতের অনেক প্রত্নস্থান থেকে ধানের তুষ,পুড়ে যাওয়া ধান ও চালের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। একইভাবে অনেক স্থানে মৃৎপাত্রের গায়েও ধান-চালের নিদর্শনের খোদিত চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে,যা খাদ্যদ্রব্য ভাতের ইতিহাস বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গে ধানঃ-
খাদ্য হিসেবে ধানের উৎপাদন বঙ্গের আদিম অধিবাসী অস্ট্রিক ভাষাভাষীদেরই অবদান বলে পণ্ডিত ব্যক্তিদের ধারণা। এই প্রাচীন জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রথমে নবোপলীয় অর্থাৎ কৃষির বিকাশ এবং তাম্রাশ্ম যুগের বিপুল নিদর্শন মেলে।যে সময় নর্ডিকরা পশুপালন করত।
পান্ডু রাজার ঢিবি খুঁড়ে খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ সালের ধানের নমুনা পাওয়া গিয়েছে। মহাস্থানগড়ে ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ধান মজুদের তথ্য পাওয়া যায়। আরও আগে,২০০০ খ্ৰীস্টপূর্বাব্দ থেকে বঙ্গদেশে ঝুম পদ্ধতিতে ধানচাষের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। অর্থাৎ আদিকাল থেকেই বঙ্গদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ধান চাষের প্রচলন ছিলো।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুযায়ী,খ্রীষ্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ থেকেই ধান চাষ বঙ্গ জীবনের অঙ্গ।
অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আবিস্কৃত বাঙলার প্রাচীনতম নগর বন্দর চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া খ্রীস্টিয় ১-৩ শতাব্দীকালের,লেখাগুলিতে এক চরম উন্নত কৃষি অর্থনীতি ও বিকাশের সাক্ষ্য মেলে। যার উল্লেখ রয়েছে গ্রীক সাহিত্যেও।লেখাগুলির বক্তব্য বিভিন্ন ধরনের,যেমন,কৃষি উৎপাদন,বণিক সমাজ,ধর্ম ও তদানুষ্ঠানের আচার,নিয়ম,প্রতিষ্ঠান,কৃষি ও গৃহস্থালির ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। কতকগুলি সিল বা মোহরে,ফলকে চিত্রিত এই ঘটনার ব্যাখ্যা রয়েছে। গঙ্গারিডি রাজ্যের সেই আন্তর্জাতিক আবহ গঠনে নিম্ন বঙ্গের সুফলা কৃষি,অদূরের সিংভূমের তামা, চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাপ্ত সিলেও সমুদ্র পোতের ছবি ও তার সঙ্গে মিশ্র খরোষ্টী লিপিতে স্পষ্ট সমুদ্র যাত্রার উল্লেখ আছে। একইভাবে ধান ও অন্যান্য খাদ্য শষ্য রপ্তানির প্রমাণ মেলে।
চন্দ্রকেতুগড়ের অদূরে আবিষ্কৃত আরো দুটি প্রত্ন নিদর্শনের একটি হলো খনা মিহিরের ঢিপি। দিলীপকুমার মৈত্রের সংগ্রহশালায় রয়েছে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের আবিস্কৃত তৃতীয় স্তরের সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষিত বস্তুটি-যেটির একপাশে মধ্যিখানে একটি যন্ত্রের ছবি,ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখ ‘সা ৯০ কাহন’। অক্ষরের উপর দিকগুলি ধানের শষ্য-শিষের মতো করে দেওয়া।এর ধার ঘেঁষে আরেকটি লেখা,যাতে রাজ্য বা রাজত্বের উল্লেখ।অন্যদিকে রয়েছে একটি পীঠস্থান থেকে শষ্য-শীর্ষ বের গিয়ে আসার ছবি। এবং মিশ্র লিপিতে লেখতে গন্তব্যের উল্লেখঃ তিরজাব (আ) ত। আর বস্তুটির উলটোদিকের সীমানা ঘেঁষে খরোষ্টী অক্ষরে লেখা একটি পম্পদের যানের কথা-নাম দহনাদজ। মনে করা হয় একদিকে রাজত্বের অন্যদিকে স্থানীয় কতৃপক্ষের মোহর। নামোল্লেখকারী বণিককে ৯০ কার্ষাপণ মূল্যের শষ্য নিয়ে যাওয়ার বা বিক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।আর স্থানীয় শাসনের মোহরে মিশ্র লিপির ব্যবহার বহিরাগত সম্প্রদায়ের প্রভাবের প্রমাণ। অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্তের মতে,চন্দ্রকেতুগড়ের শষ্য বাণিজ্যের নিদর্শন ‘ওল্ডেস্ট একজাম্পল অফ কর্প ট্রেড’। বঙ্গের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির উৎকর্ষতায় আনুষঙ্গিক শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ও প্রকাশে ভূমিকা রেখেছিল।
বাঙলার সমৃদ্ধিতে তখন কাদের ভূমিকা সর্বাগ্রে? কৃষি ও শিল্পের আদি বিকাশের এই পর্বে বাঙলায় পোদ,কৈবর্ত ও বাগদি জাতির প্রাধান্য ছিল। আর ছিল হাড়ি,ডোম,বাউড়িদের পূর্বপুরুষেরা। গ্রীক রচনা থেকে জানা যায়,মৌর্যদের সময়কাল পর্যন্ত বাগদিরাই ছিল রাঢ়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। তাম্রাশ্ম যুগের কৃষি অর্থনীতিতে আজকের সদগোপ জাতির পূর্বপুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এবং উত্তর রাঢ়ে তাদের প্রাধান্য ছিল,আর কৈবর্তদের আধিপত্য ছিল দক্ষিণ রাঢ়ে। বাঁকুড়াই মল্লদের আধিপত্য স্থল।
বাঙলায় গ্রাম দান ও পরিবেশঃ-
লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া,গোবিন্দপুর,তর্পণদীঘি প্রভৃতি তাম্রশাসনের আরম্ভ শ্লোকে বলা হয়েছে:
“ফনিপতি মণিদ্যুতি যাহাতে বিদ্যুৎ স্বরূপ,
বালেন্দু ইন্দ্র ধনুস্বরূপ, স্বর্গতরঙ্গিনী বরিস্বরূপ,
শ্বেত কপালমালা বলাকাস্বরূপ, যাহা ধ্যানাভ্যাসরূপ
সমীরণের দ্বারা প্রেরিত এবং যাহা ভবার্তিতা
ধ্বংসকার- সম্ভুর রূপ সেই মেঘ তোমাদের
শ্রেয়ঃ শস্যের অঙ্কুরোদ্গমের হেতু হোক।”
উপরোক্ত তাম্রশাসনে যেমন,তেমনি কেশবসেনের ইদিলপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায়,অনেক গ্রাম ব্রাহ্মণগণ রাজার কাছ থেকে পেয়েছিলেন; এ সমস্ত গ্রাম সুন্দর সুন্দর শস্যক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ছিল এবং তাতে প্রচুর ধান উৎপন্ন হতো। বিদ্যাকর সংকলিত “সুভাষিতরতড়বকোষ” কাব্যে বিবৃত বিভিন্ন শ্লোকের বিভিন্ন স্থানে আবহমান বাংলার চিরায়ত শস্য ধান্য ফসল সম্পর্কে বলা হয়েছে,
“নতুন জলে প্লাবিত ধানক্ষেত গুলিতে ব্যাঙ কর্কশ স্বরে ডাকছে। কর্দমাক্ত শিশুরা লাঠি হাতে নিয়ে ধানক্ষেতের মাছ ধরতে ছুটছে।”
‘আর্যাসপ্তশতী’ তে শালি ধানক্ষেতে হরিণের উপদ্রবের কথা জানা যায়:
“কোমল শালিধানের লোভে চঞ্চল হরিণ, নিজেকে ধরা দেওয়ার ছলনায়,তরুণ পথিককে এখানে কমলগোপীর নিকট আনয়ন করে। হরিণের এরকম কৌশলের উদ্দেশ্য,পথিক ও গোপী যখন প্রেম চর্চায় রত থাকবে,তখন সে নির্ভয়ে ইচ্ছামত শালি ধান ভক্ষণ করতে পারবে।”
সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাবঃ-
ভাতের গন্ধ নিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালির ইতিহাস,অর্থনীতি,সভ্যতা,সংস্কৃতি যার প্রতিতুলনা ইতিহাসে বিরল। বাঙালি শিশু অন্নপ্রাশনে সিদ্ধ চাল মুখে দিয়ে জীবন ধারনে খাদ্য গ্রহনে প্রস্তুত হয়। ধান,দূর্বার আর্শীবাদ আমাদের জীবনের পাথেয়। বঙ্গ জীবনের অধিকাংশ ব্রত ও লোকাচার কৃষি কেন্দ্রিক। আমন ধান বাঙালির সামাজিক বন্ধনের চিরায়ত রক্ষা সূত্র। এগুলির বেশিরভাগ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম অপেক্ষা পূর্বাগত। জোত-জমি-জোয়ান এই নিয়ে কৃষিজীবি পরিবারের যাবতীয় লব্বাই -ফর্তায়।এখন সে দিন অবশ্য নেই। কৃষি প্রধান দেশে কৃষিই গৌণ। তাছাড়া গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে উচ্চ ফলনশীল,উচ্চতায় ছোটো ধানের ব্যাপক আবাদ,আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আমন চাষের ঐতিহ্য লালিত পরম্পরায় ঘা দেয়। পুরানো স্বাদ গন্ধের ধানের আবাদ এখন মোট আবাদীর ১০-১২ শতাংশ হবে হয়তো। এখন খড় খাটো ও নাজুক হওয়ায় খড়ের ছাউনির ঘর ক্রমেই বিরল। ব্যাপক সার,বিষের প্রয়োগের ফলে গামলা ভর্তি ভাত,মুড়ি খেয়ে হজম করা জোয়ান মরদের সংখ্যাও কম। চাষের খরচ তুলতে হিমসিম খেয়ে অনেকেই বলছেন,জমি না যম।
নবান্নঃ-
এমন কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান নেই যার সংস্কারে ধান বা ধান্যজাত দ্রব্যের ভূমিকা নেই। এমনি এমাসের অনুষ্ঠান নবান্ন।মনে করা হয় নতুন ধানের চালের তৈরি দ্রব্য যাদের প্রথম উৎসর্গ করা হয় প্রয়াত পিতৃ পুরুষ প্রতি। তাঁরা বায়স রূপ নিয়ে তা গ্রহন করেন। সর্বত্র আলপনা। মাঝ উঠোনে বড়ো করে মারুলি দিয়ে আলপনায় মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। ঢেঁকি কোটানো নতুন ধানের চালগুঁড়ো। তাতে খাঁটি দুধ,নানান কুচালো ফল,বাতাসা,খেজুরের গুড়,নারকেল কোড়া,মুলো,আখের কুচি,সঙ্গে বোধহয় একটু কর্পূর। স্নান করে ছালের কাপড় পরে,বড়ো একটি প্রাচীন পাথরের গামলায় মা মাখতেন। তারপর কলাপাতায় দিয়ে সেটি প্রথম একটি ঘরের চালের উপর পিতৃপুরুষদের উৎসর্গ করে,একে একে গোলার পাড়ন, খিড়কি,তুলসীবেদী,গোয়াল ঘর,বাড়ীর ঘাটের চাতাল সর্বত্র দিতেন। সেদিন দুপুরে পাতে পড়ত কত রকমের সবজি,ভাজাভুজি,পায়েস। আমরা কাউকে রাগাতে বলতাম,লবানের ভাজাভুজো,সব খেয়েচে অমুক কুঁজো! শাক-সবজি এত রকমের হতো যে আগের দিন সব কেটে রাখা হতো। মানুষের হজম ক্ষমতা ছিল ঈর্ষনীয়। তেমনি শক্ত চেহারার গড়ন।গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে লাইট-প্যান্ডেল-সাউন্ড ছাড়াই ঘরে ঘরে এই উৎসবের আয়োজন। সর্বস্তরের মানুষের কী আবেগ। কৃষি ভিত্তিক সংস্কৃতি এমনই যা শত অভাবেও সেদিন ম্লান হয়নি।
নবান্নের সঙ্গে প্রাক কৃষি সংস্কৃতি জড়িত। আদিমকালে পুরুষেরা শিকার করে ফিরতে দেরি করলে খিদের তাড়নায় নারীরা বৃক্ষের ফল মূল খেত। তখন তাদের কল্পনায় আসে সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়া। ভূমি বন্য অবস্থায় শষ্য ফলিয়ে আসছে জননী মাতার ন্যায়। পুরুষ যদি নারী রূপ ভূমি বা ক্ষেত্র (যা সকল স্মৃতি শাস্ত্রে মেয়েদের এরূপে বর্ণনা করা হয়েছে) কর্ষণ করে সন্তান পেতে পারে,তাহলে মাতৃ স্বরূপা পৃথিবী কর্ষণ করে শষ্য পাওয়া সম্ভব। লিঙ্গবৎ যষ্টি তৈরী করে শুরু হয় ভূমি কর্ষণ। এই লিঙ্গ থেকে লাঙল। অতঃপর নারীর হাত ধরেই কৃষি কর্ষণের সূচনা। অতুল সুর মহাশয় বলেছেন,’যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল,তখন পুরুষরা তাই দেখে অবাক হল। ফসল তোলার পর যে প্রথম ‘নবান্ন’ উৎসব হল সেই উৎসবে জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। এই আদিম উৎসব থেকেই উদ্ভব হয়েছিল শিব ও শক্তির পূজা।’ এবং এই আরাধনা তন্ত্রধর্মের উদ্ভব ঘটায়।
এমন ঐতিহ্যের অধিকারী নবান্ন রীতির সঙ্গে দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতির বন্ধন কিছুটা থাকলেও গোবলয়ে এ-রীতি বিরল। আবার অন্যদিকে মহালয়ার সঙ্গে পারম্পর্য রেখে চলে।
মুঠ আনাঃ-
শৈশবে দেখছি মাস পরার সঙ্গে সঙ্গেই হয়েছে ‘মুঠ আনা’। জমির ঈষান কোণের আড়াই গাছি ধান,আড়াই প্যাঁচে কেটে পট্ট বস্ত্র জড়িয়ে মস্তকে নিয়ে গৃহে লক্ষ্মীর আটনের পাশে স্থাপন করা। অঞ্চল ভেদে এ রীতির সামান্য প্রভেদ থাকতে পারে।এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা যায় পাকা ফসল ঘরে আনার এক শুভ মহরত।
প্রাচীন কাল থেকে গ্রামের মানুষ দূরত্ব কমাতে বেছে নিতেন আলপথ। এই পথের উপর দুই ধারের জমির শিষগুলো রাতের আঁধারে শিশিরের ভারে মুখোমুখি নুইয়ে পড়ে আলের চরণ রেখার পাশের নরম ঘাসের বুকে! বেলাবেলি গতায়তে সেগুলি পায়ের পাতার গুছি হালকা চিরে দিত। নিহরে ধুইয়ে দিত দুই পা। নিরক্ষর নেংটি পরা,ছেঁড়া তেনায় কোনোমতে দেহের ঊর্দ্ধাংশ ঢাকা অমিত কাকাকে বলতে শুনেছি,এ সবই উনার ঘরে আসার পেরারথনা ! এমন দার্শনিক উপলব্ধিই বলে দেয় পুরুষানুক্রমে জন্ম-জন্মান্তরের পেটের খিদেও ভুলিয়ে দিতে পারেনি মাটির মানুষদের আপন সাংস্কৃতিক ধারা।
ধান কাটাঃ-
অতঃপর কৃষকেরা ভূঙের(জমির) একটি নির্দিষ্ট কোণ বা দিক থেকে ধান কাটতে শুরু করেন। কয়েকটি গোছ একত্র করে জমিতেই শুইয়ে দেন। দ্বিতীয় ভাগে সেই গুছিগুলিকে আঁটি বেঁধে একই ভাবে রাখা হয়। পরের পর্বে,অর্থাৎ তৃতীয় পর্যায়ে সেগুলি ৪-৬ পণ গরুর গাড়ীর ক্ষেত্রে এবং মোষের গাড়ী হলে ৬-৮ পণ এমত পালা দেওয়া হয়। আমরা জানি ৪ টিতে ১ গন্ডা,২০ গন্ডায় ১ পণ,আর ১৬ পণে ১ কাহণ। এই পালা কেমন হতো সে ধারনা এ প্রজন্মের হয়তো নেই। এখন চাষ ট্রাক্টরে,ফসল বহে ওরই ট্রলি। এতদ্ভিন্ন ঘরের পাশের আরশি নগরের পড়শির খবর রাখার সময়েরও অভাব!
তো যা বলছিলাম,ঐ খেতের পালা দেখতে দূর থেকে অনেকটা উল্টানো ধামার মতো। তার মধ্যিখান বরাবর আনু,১২ বাই ৮ ফুট ফাঁকা যায়গা রাখা গরু-মোষের গাড়ী রাখার জন্য। সেই গাড়ীর উপর সুনুরি(দক্ষ) কৃষক ঠিকঠাক ধান সাজিয়ে তুলে তার মাথায় এক বিরাট জোতের বাঁশ গাড়ী বরাবর লম্বালম্বি রেখে দড়ি দিয়ে সামনে ও পিছনে খুব শক্ত করে টান দিয়ে বেঁধে দিত।এটি এমনই এক শৈলী যা সবার আয়ত্তাধীন নয়। একটু ভুলচুক হলে টালমাটাল যাত্রাপথে কাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। যাতে হালের (চাষের) প্রাণী খাম না হয় সে দিকে চরম সতর্কতা। তখন গো-শকট ভারী হতো খুব। বিভিন্ন জমির আল কেটে লিকের ধুলো,পথের ধুলো গো ক্ষুরের আঘাতে উড়ে আমাদের দেহ মাথা ভর্তি হতো। যে সকল মানুষ আঁধার থাকতেই মাঠে গিয়ে দিনভর জমিতে খেটে সাঁঝবেলা ঘরে ফিরে গা-গতরে চবচবে করে সরষের তেল মেখে পুকুরে বা ডোবায় স্নান সেরে ভাতের গামলা নিয়ে বসত,তখন পাশের জনকে কইতে শুনেছি,’মাথাখান হাঁজুরে লেগা,লইলে বোয়ালি গজাবে’। এর অর্থ ধুলা-তেল-জলে মাথা যেন কাদানো জমি,তাতে ঝরা ধান আটকে থাকলে চারা হবে।কী সূক্ষ্ম রসানুভূতি!
এইভাবে জমির ধান কেটে মনিবের বাড়ীর খামারে আরেকপ্রস্থ পালা দিয়ে তারপর চওড়া পাটায় সেই ধান পিটিয়ে মালিকের গোলায় তুলে তবেই কৃষকের নিষ্কৃতি। বর্ষায় উপরওয়ালার হুমকি তর্জন গর্জন উপেক্ষা করে আবাদ সেরে যেই একটু জিরানোর পর্ব অমনি নিদারুণ ভাদ্রের অভাবী হুমকি। বুদ্ধদেব বসুর কথায়,’আমি বসে ভাবি সংসার কিসে চলবে’। শুরু দাদন নেওয়ার পালা। ধান ওঠার সময় মুনিষ খেটে শোধ। অভাবের ২ টাকা,তখন ১০ টাকার সমান।শ্রম শোষণ কী নিদারুণ, যে না দেখেছে বা উপলব্ধি করেছে সে কোনোদিনই এই ইতিহাস জানবে না। আর যারা জানে তারা ভাগ্যের দোহাই পেরে দিন কাটায়। ভাগ চাষীও একইভাবে অভাবে নেওয়া ধান পরিশোধ করে একরকম শূণ্য হাতেই ঘরে ফিরত আগামীর আশায়।পুনরায় দু-চার মাস বাদে একই জীবন। গত শতকের সত্তরের দশকের শেষে যার একপ্রস্থ সাময়িক অবসান। তবে তাতে অনেক ঘাম রক্তের ইতিহাস ও সাহিত্য আছে এ যাবৎ কালের ঐ সর্বংসহা মানুষদের নিয়ে।আর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে উত্তরোত্তর কৃষি ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের তারতম্য সামান্য হওয়ায় পেট পালনই দায় হয়ে পড়ে। এ প্রজন্মের কৃষিজীবি পরিবারের সন্তানেরা একটু ভালোর আশায় বিকল্পের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে নগরে এমনকি দেশান্তরী হতেও শুরু করে। ফলে গ্রাম্য চিরায়ত লৌকিক সংস্কৃতিও আজ সার্বিক ক্ষয়িষ্ণুতার মুখে।অবশ্য এর ভালো সার্বিক ব্যাখ্যা দেবেন সমাজ তাত্ত্বিকরা।
দাঁওনঃ-
যে কথা বলা হচ্ছিল ,যে দিনটিতে বাড়ীতে মাঠের শেষ ধানের বোঝা আসত সেদিন গৃ্হস্থ ‘দাঁওন’ দিতেন। বাংলা সাহিত্যে নবান্ন নিয়ে অনেক লেখা আছে,দাঁওন কই? একমাত্র তারাশঙ্করের একটি পত্রে মেলে (১৯৬৩-৬৮ পর্যন্ত যুগান্তরে প্রকাশিত গ্রামের চিঠি র ১৭১ সংখ্যক চিঠিটি,সম্পাদনাঃঅভ্র ঘোষ)। আমার ধারনা,প্রথমত,নবান্ন এক বা একাধিক গ্রামে এক বা দুই দিনে অনুষ্ঠিত হয়,দাঁওন সেক্ষেত্রে যে কোনো দিন। দ্বিতীয়ত,নবান্ন ভূমিহীন কৃষক থেকে শুরু করে ভূস্বামী সকলের অনুষ্ঠান,দাঁওন জমি মালিকের ইচ্ছাধীন অনুষ্ঠান। তৃতীয়ত,লক্ষীর পাঁচালি গানে পায় দশরথের নবান্ন পালনের কথা-
‘সবের আনন্দিত মন
দশরথ নবান্ন করে ঐন অযোধ্যা ভবন।’
যা থেকে হয়ত পরবর্তীতেও তার প্রভাব থেকে যায় উপরতলার সংস্কৃতিতে।
এবার মূল কথায় আসা যাক। দাঁওন হচ্ছে মাঠের ধানের শেষ আঁটিটি,যা পরম মমতার সঙ্গে গৃহস্থের বাড়ীতে এনে চাষী সেই বাড়ীর চালের উপর অথবা গোলার চালের উপর সংস্থাপন করে দিতেন। নিকান উঠান। চৌকাঠ,মাঝ উঠান,গোলার পাড়ন,ঘাটের সিঁড়ি,খিড়কিদুয়ার,গোয়ালঘর সর্বত্র আলপনা। এটি একটি কৃষি ভিত্তিক লোকাচার। নিবেদন করা হয় খগোল বাসীদের উদ্দেশ্যে। এই পক্ষীপ্রীতি একমাত্র আদিবাসী সমাজ থেকেই আসা সম্ভব। দাঁওনের দিন গৃহস্থের পরিবারে ধানকাটার মরসুম শেষ হওয়া উপলক্ষে এই কদিনের উদয়াস্ত পরিশ্রমী কৃষি শ্রমিকদের তৃপ্তি বর্ধন করা হতো। বাদ যেতোনা জ্ঞাতি কুটুম্ববর্গ ও পারিপার্শ্বিক কাজের মানুষেরাও। খাদ্যসূচি হলো শাক,পাঁচ ভাজা,দুটো সবজি,মাছের ঝোল আর থাকতো পুরানো তেঁতুলের পাঁচমিশালি বা খান মাছের টক। সামান্যতেই খুশি মানুষগুলো ভোজন শেষে দু হাত তুলে গিন্নিমাকে ধন্য ধন্য করতেন।
কৃতজ্ঞতাঃ
১) ইতিহাস,তথ্য ও তর্ক (ফে বু গ্রুপ), ১/৬/১৯, রানা চক্রবর্তী।
২) পূজা-পার্বণের উৎসকথা -পল্লব সেনগুপ্ত।
৩) (নিম্নবঙ্গের প্রচীন ইতিহাসের নতুন উপাদান/ত্রিদিব সেনগুপ্ত। প্রতিক্ষণ,২-১৬ সেপ্টম্বর,১৯৮৯)।
৪) বাঙলা ও বাঙালির বিবর্তন-ডঃঅতুল সুর।
*****************************************
অনুপ মুখার্জি পরিচিতিঃ
শিক্ষক পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র,চিরতরুণ অনুপ বাবুর বিদ্যালয় শিক্ষা দক্ষিণখন্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্নাতক স্তরের পঠন পাঠন বহরমপুর শহরে কৃষ্ণনাথ কলেজে।লোকসংস্কৃতি,ইতিহাস এবং গ্রামবাংলার বিভিন্ন জনজাতির আচার,সংস্কার,জীবনযাত্রার ওপর বিস্তর পড়াশোনা রয়েছে অনুপ বাবুর। সম্পূর্ণ শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার সীমানায় দত্তবরুটিয়া গ্রামে। লেখালেখির পাশাপাশি ভ্রমণ ও ফটোগ্রাফি তাঁর নেশা।