তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পর্যটন স্পট কক্সবাজার
অরুণ শীল
কলকাতার তরুণ প্রজন্ম বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়, বাংলাদেশকে চিনতে চায়। তাদের আগ্রহ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কলকাতা, হুগলি,শন্তিনিকেতন যেখানে গেছি, তরুণরা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশে কক্সবাজার যেতে হলে ঢাকা থেকে কোন ট্রেন ধরতে হবে? অনলাইনে পাওয়া ঝিনুকের আদলে গড়া কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনের ছবি দেখিয়ে বলেছে, অসাধারণ সুন্দর রেলওয়ে স্টেশন। ট্রেনের তথ্য অনলাইনে না পেয়ে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছে। সংক্ষেপে বলতে হয়েছে, শীঘ্রই ট্রেন সার্ভিস চালু হবে, মাত্র রেললাইন বসেছে। ভারতের মতো আমাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা অত শক্তিশালী নয়। আমাদের বাস সার্ভিস উন্নতমানের। আমার জবাবে, তরুণের সন্তুষ্ট হয়েছে কি না জানি না। তবে তাদের আগ্রহ আর আলাপে একটা আলাদা উচ্ছ্বাস লক্ষ করেছি। বাংলাদেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজারের নাম হয়ত কলকাতায় সবাই জানেন। কিন্তু জানেন না যে, এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। যা প্রায় ১২০ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত। কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত, দৈর্ঘ্যে ১২০ কি.মি । ব্রাজিলের ২১২ কি. মি. দীর্ঘ কাসিনো সমুদ্র সৈকত বিশ্বের প্রথম এবং অষ্ট্রেলিয়ার ১৫১ কি.মি. দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত বর্তমানে পৃথিবীর ২য় দীর্ঘতম সৈকত। তবে তার বেশ কিছু অংশ মানুষের সৃষ্ট বা কৃত্রিম। সেই হিসেবে কক্সবাজার তৃতীয়। কাদামুক্ত সম্পূর্ণ বালুকাময় দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত শুধু কক্সবাজারেই রয়েছে। তাই কক্সবাজার পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। কোথাও কৃত্রিমতা নেই, কাদা নেই, রূপালী ঢেউয়ের দেশ কক্সবাজার। সমুদ্র পাহাড় পরিবেষ্টিত কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা এখানে ভিড় করে। সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউ, মন চঞ্চল করা সৈকত, সাগরের জলে জলকেলি, সবুজ ঝাউবীথি, দৃষ্টিনন্দন হোটেল মোটেল, রঙ্গিন ছাতার নিচে বিশ্রামের ছোটো ছোটো চৌকি, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের রেসিপি, আকর্ষণীয় সব খানা-পিনার সুব্যবস্থা পর্যটককে উতলা করে তোলে।প্রকৃতির সাথে মানুষের শৈল্পিক সব আয়োজনে ভ্রমণ পিপাসুরা মুগ্ধ হয়। লাবণী বীচ, সুগন্ধা বীচ, কলাতলী বীচ ছাড়াও কক্সবাজার শহরের সাথেই রয়েছে হিমছড়ি সৈকত, একটু দক্ষিণে প্রায় ১০/১২ কি. মি. জুড়ে ইনানী প্রবাল বা পাথুরে সৈকত। সুদৃশ্য মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে সহজেই ইনানী প্রবাল গঠিত সৈকতে যাওয়ার সু ব্যবস্থার কারণে পর্যটনের জন্য এই সৈকত খুব আকর্ষণীয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো এখানেও প্রবাল পাথরের দেখা মেলে। চমৎকার ছিমছাম নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত ইনানী খুব সুন্দর। এখানে দাঁড়িয়ে বা পাথরের উপর বসে পর্যটকেরা সাগর দেখে। সূর্য উদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য এখানে আনন্দ চিত্তে উপভোগ করা যায়। ইচ্ছে হলে অদূরে দ্বীপ সেন্টমার্টিনেও ঘুরে আসা যায়, বিভিন্ন ট্যুর প্রোগ্রাম সবসময় তৈরি থাকে, আছে জাহাজের সুব্যবস্থা। পাশের উপজেলা রামুতে রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ পল্লী ও সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার। সেখানে একশত ফুট দীর্ঘ সিংহশয্যায় গৌতম বুদ্ধের মুর্তি রয়েছে। চেরাংঘাটা বড় কেয়াং, রাইখেনদের কেয়াং, লামারপাড়া প্রাচীন কেয়াং, মেরুংলোয়া কেন্দ্রীয় সীমা বিহার ও রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার। রাংকুট বাংলাদেশে অন্যতম বৌদ্ধ বিহার, যা মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট অশোকের সময়ের বলে ধারণা করা হয়। এখানে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি চিহ্ন এবং পাশে রাম সীতার বনবাসের পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত কিছু মন্দির।
কক্সবাজার বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর ও শুকনো মাছ শুটকীর জন্য বিখ্যাত। শুটকী মাছ অনেকের প্রিয় খাদ্য। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার চাহিদা আছে। কক্সবাজারের আদি নাম হচ্ছে পালংকি। এক সময় প্যানোয়া নামেও ডাকা হতো। প্যানোয়া মানে হলুদ ফুল। অতীতে এই এলাকায় প্রচুর হলুদ ফুল ঝলমল করতো। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর নামে ব্রিটিশ আমলে ১৭৯৯ খ্রিঃ একটি বাজার স্থাপন হয়েছিল। সেই থেকে অন্যসব পরিচিতি ক্রমে মুছে গিয়ে হয়েছে এই কক্সবাজার। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন্ট হোস্টিং কর্তৃক এই পালংকির শাসক নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন কক্স আরকান শরনার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান পুরাতন সংঘাত নিরসনে কাজ করেন এবং সফল হন। তার এই অবদানকে স্মরণ করে প্রতিষ্ঠিত হয় কক্স সাহেবের বাজার। মুঘল আমলে কক্সবাজার আরকান রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। নবম শতাব্দীতে হরিকেলের রাজার দ্বারা শাসিত চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার ৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানের রাজার অধীনে যায়। ১৬৬৬ খ্রিঃ এ মুঘলেরা দখলে নেন। মুঘল সম্রাট শাহ্ সুজা পাহাড়ী রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে একটি ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। মুঘলদের পরে আরাকান ও কিছুদিন পর্তুগীজরা এই এলাকা শাসন করেছে। পরে ব্রিটিশ আমলে এই এলাকা পর্যটনের জন্য পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫৪ সালে কক্সবাজার থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে মহকুমা। এখন কক্সবাজার জেলা। পাশের টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালী উপজেলায় রয়েছে বিভিন্ন বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। মহেশখালী বিখ্যাত আদিনাথ শিব মন্দির। হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থ। এই মন্দিরে প্রচুর পুণ্যার্থী সমাগম হয়। কথিত আছে রাক্ষস রাজা রাবণ হিমালয়ের কৈলাস থেকে শিবলিঙ্গ লংকায় নিতে গিয়ে এখানে বিশ্রাম করেন। পরে এই শিবলিঙ্গ মাটি থেকে তুলতে রারণ ব্যর্থ হন। সেই থেকে এই আদিনাথ শিব মন্দির, যা হিন্দুদের অন্যতম তীর্থ ভূমি। সব তীর্থ পরিভ্রমণের পর যদি আদিনাথে না আসে, তা হলে কোন পুণ্য হবে না বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করেন। সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর এই মহেশখালী দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। টেকনাফে রয়েছে কুমারী মাথুনের মৃত্যুকূপ। যা চিরন্তন প্রেমের স্মৃতি চিহ্ন। উখিয়ায় রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার স্মৃতি বৌদ্ধ কেয়াং ও জাদী।মূলতঃ পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে এই শহর ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে অনেক হোটেল মোটেল, রির্সট। বর্তমানে সৈকত ঘেঁসেই রয়েছে কয়েকটি ৫ তারকা মানের হোটেল। আছে সামুদ্রিক বিভিন্ন জিনিসের সমাহারে ঝিনুক মার্কেট এবং শৌখিন জিনিসপত্রের বার্মিজ মার্কেট নামের বিপনী বিতান। বার্মিজ মার্কেট নামে খ্যাত এই সব মার্কেটে মিয়ানমার, থ্যাইল্যান্ড ও চীনের বাহারী সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়। পর্যটকদের জন্য এখানে বাড়তি সব অনুসঙ্গ যুক্ত হয়েছে। বিশাল ফিস এ্যাকুরিয়াম, প্যারাসেলিং, ওয়াটার বাইকিং, বীচ বাইকিং, কক্স কার্ণিভাল সার্কাস শো, দরিয়ানগর ইকোপার্ক, কমিউনিটি বিল্ডিং, স্ন্যাক্সবার সহ কত সব বিনোদনের ব্যবস্থা। বিশ্বের সব মানের বিনোদন এখানে দিন দিন সহজলভ্য হচ্ছে। কক্সবাজারে রেল চালু হলে পর্যটনের আরেক নতুন দিগন্ত সূচিত হবে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আরো আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলছেন। সাগরের বুকে বিমান অবতরণের দৃশ্যটিও অনেক আকর্ষণীয় সুন্দর।
কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজাতি বা নৃ-তত্বিক জনগোষ্ঠী বাস করে। যা কক্সবাজারকে করেছে রঙিন ও বৈচিত্র্যময়। উপজাতিদের মধ্যে রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যায় বেশি। তাদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন শপিং মল ও মার্কেটে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ করা যায়। তারা খুবই দরদ দিয়ে কাস্টমারদেরকে সন্তুষ্ট করতে চায়। তাদের সদাহাস্য মুখ ও মার্জিত ব্যবহারে পর্যটকেরা সন্তুষ্ট হয়। নিজস্ব সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যময় পোষাক ও জীবনধারার প্রতি তাদের অনুরাগ এবং শ্রমের ফলে তারাও পর্যটনের একটি বিরাট অনুসঙ্গ। কক্সবাজার শহরে রয়েছে তাদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির। শহরের মূল মন্দিরটিতে রয়েছে দূর্লভ কিছু বুদ্ধ মুর্তি ও হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের চিত্রপট। এই মন্দির এবং রাখাইনদের সংস্কৃতি পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কক্সবাজার স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পে যা কিছু আয় তার মূলে রয়েছে কক্সবাজার। তাই, বর্হিঃবিশ্বে কক্সবাজার একটি পরিচিত নাম ও তরুণদের পছন্দের পর্যটন স্পট।
অরুণ শীল,কবি ও সাহিত্যিক।
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
অতি সুন্দর, তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদন ,ভ্রমণ পিপাসু রে কোনো পর্যটকের জন্যই খুব কার্যকরী গাইড।