Shadow

পিতৃঋণ – চন্দ্রকান্তি দত্ত

PC: meng.ru

পিতৃঋণ

চন্দ্রকান্তি দত্ত

ছোট্ট একটা থলিতে সামান্য সবজি নিয়ে বাড়ির পথে চলেছেন কনকলতা। দুুর্গাবাড়ির কাছাকাছি আসতেই মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। কনকলতা সাবধানে পাশে সরে এসে একটা পুরনো বাড়ির রোয়াক ঘেঁষে দাঁড়ালেন। শুধু যে মাথা ঘুরছে,তা নয়।শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছে। কনকলতা ভয় পেলেন। গত তিনদিন ধরে কী যে হচ্ছে শরীরে? কোন খারাপ লক্ষণ নয় তো? একটু জল খেলে ভাল হত। কাছাকাছি কোন দোকান নেই। কাছারি মোড়ে শিন্টুর দুধের দোকান। ও জলও বিক্রি করে। তবে এখন কাছারি মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। হাতে ফোন ছিল। একটু ভেবে কনকলতা শিন্টুকে ফোন করলেন। একটুও দেরী হল না। শিন্টু জলের বোতল নিয়ে হাজির হল। জল খাইয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল,”কি হয়েছে মাসিমা? শরীর খারাপ?”
কনকলতা লজ্জা পেলেন। বললেন,”না,মানে,মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। কি জানি কেন,শরীরটাও ভাল নেই। তাই তোর কাছে জল চেয়ে ফোন করলাম।”
“বেশ করেছেন”,বলল শিন্টু,”কিন্তু মাসিমা,আপনি তো কাঁপছেন। শরীর কি খুব খারাপ? একটা রিক্সা ডাকব?”
কনকলতা বাধা দিলেন। বললেন,”না না,রিক্সা লাগবে না। আমি আস্তে আস্তে চলে যাব।”
– “না মাসিমা,আপনাকে আমি একা ছাড়তে পারব না। রিক্সা যদি না লাগে,তাহলে চলুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি। থলিটা আমাকে দিন।”
শরীর খারাপ হওয়ায় রান্না করতে পারেন নি কনকলতা। পাখাটা জোরে চালিয়ে শুয়ে পড়েছেন। পরে উঠে সেদ্ধ ভাত করে নেবেন। বিকেলে একবার ডাঃ ঘোষের কাছে যাবেন। একটা ভয় ক্রমশঃ তাঁকে ঘিরে ধরছে। কোন বড় অসুখের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে না তো? সেরকম কিছু হলে কি করবেন? কে দেখাশোনা করবে? কনকলতা যে বড় একা।
প্রায় ছত্রিশ বছর একাই থাকেন কনকলতা। একসময় জেদের বশে নেওয়া যে সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল,আজ,জীবনের প্রায় উপান্তে পৌঁছে সেই জেদ যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। সেই সিদ্ধান্তও সঠিক ছিল বলে মনে হচ্ছে না। কনকলতা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন।
              ************************
কনকলতা তখন সবে উনিশ পেরিয়ে কুড়িতে পা দিয়েছে। একদিন সকালে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত দেখা গেল কনকের মা সুমিতা বাড়িতে নেই। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি নিরুদ্দেশের পথে পা দিয়েছেন। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল কনকের মাথায়। বাবা অসুখে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী হলেও,সংসারে সুখ-শান্তির বিশেষ অভাব ছিল না। সুমিতার সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার মত গুরুতর কোন কারণ সে বয়সের কনকলতা খুঁজে পায় নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও,সুমিতা কোথায় গেলেন,কেন গেলেন বা কারও সাথে গেলেন কিনা,সে প্রশ্নগুলো অমীমাংসিতই রয়ে গেল। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কনকলতাকে জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে অন্য ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হল। বাবা-মায়ের অত্যন্ত আদরের একমাত্র সন্তান থেকে সংসার-সমরাঙ্গনের একাধারে যোদ্ধা ও সেনাপতি।
অশোক সরকার এক নামজাদা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। সেই সুত্রে ভাল পরিমাণ পেনশন পান। এ ছাড়া চাকরী জীবনের সু-নিয়ন্ত্রিত সঞ্চয় ও অবসরকালীন পাওনার সুবাদে আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল। তাঁর চিকিৎসার খরচও অনেকটাই ওঠে বীমা থেকে। আর্থিক সচ্ছলতা থাকায় কনকের চিন্তা অনেকটা কম ছিল। তাই নিজের পড়া,অসুস্থ বাবার সুশ্রুষা আর সংসার সামলানো-এই নিয়েই আবর্তিত হচ্ছিল কনকলতার দৈনন্দিন জীবন।
সুমিতা চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরেরও বেশী পেরিয়ে গেছে। অশোকের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর আকার ধারণ করেছে। তাঁর বন্ধুরা এই সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। কনকলতা কিছুটা সাহায্য পেলেও বাবার অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। ডাক্তার আশার বাণী শোনাতে পারছেন না। মনে হচ্ছে এখন শুধু প্রহর গোনা।
সংসারের নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমানতার মাঝে কখনো কখনো কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যায়,যা দেখে সন্ত্রস্ত হতে হয়। মনে হতে থাকে যে,এ ঘটনা,এই ঝড় দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। কনকলতার বৈচিত্র্যহীন রোজনামচায় এই জাতীয় এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল যখন সে পঁচিশের কোঠায়। কনকের বাবার যখন প্রায় যাই যাই অবস্থা,অথচ কনক তাঁকে ভাল রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে,বাড়ির সেই অতি সঙ্গিন মুহূর্তে,অশোকের কথাতেই হয়ত,বন্ধু সৌমেন কনকলতার বিয়ের জন্য একটা সম্বন্ধ নিয়ে এলেন। খবরটা পাওয়ামাত্র কনক শিউরে উঠল। বাড়ির এই পরিস্থিতিতে এরকম অবিশ্বাস্য চিন্তা কার মস্তিষ্কপ্রসূত,অনেক ভেবেও সে এর কুল কিনারা করতে পারল না। বাবার এই অতি জটিল শারীরিক অবস্থায় বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এঁরা এসব ভাবছেন কি করে?
কনকলতার সিদ্ধান্তে অশোক মূহ্যমান হয়ে পড়লেন। পরে অনেক ভেবে কনককে পাশে ডেকে বসালেন। ক্ষীণ কন্ঠে ধীরে ধীরে বললেন,”শোন্ মা। আমার অবস্থা দেখছিস তো। আমি যে কোন সময় চলে যাব। কিন্তু তোর বিয়ে না দিয়ে যদি চলে যাই,তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব না। তুই যে বড় একা হয়ে যাবি মা। বিয়েতে তুই আর অমত করিস না। আমাকে শান্তিতে যেতে দে মা।”
কনকলতাকে রাজি করানো গেল না। বাবাকে ছেড়ে সে কোথাও যেতে পারবে না। তাতে তার লাভ বা ক্ষতি যাই হোক না কেন।
অবশেষে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর কনক একটু নরম হল। বলল,”সৌমেনকাকু,আমি বিয়ে করতে রাজি আছি। তবে একটা শর্তে। বাবা যতদিন আছেন,ততদিন পর্যন্ত আমি শ্বশুরবাড়ি যাব না। ওঁরা এই শর্তে রাজি থাকলে বিয়ে হবে।”
সৌমেন আকাশ থেকে পড়লেন। এরকম উদ্ভট শর্তে কি কেউ রাজি হতে পারে? ভাল পাত্রের জন্য পাত্রীর অভাব হবে না। তা ছাড়া,অশোক অচিরেই মারা যাবেন কিনা কেউ বলতে পারে না। অতএব,এ জাতীয় একটা শর্ত পাত্রপক্ষের উপর কোনভাবেই চাপানো যায় না। বিয়েটা ভেঙ্গেই গেল বলা যায়।
বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়ে কনকলতা হয়ত ভাবল সে একটা যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করে সে গরবিনী। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত অশোকের মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করল,সে খবর কনক রাখল না। অসহায় অশোক নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। উপায়ান্তর না দেখে সৌমেনকেই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হল।
চন্দননগরের ওঁরা সৌমেনের পুর্ব পরিচিত। একরকম বন্ধু স্থানীয় বলা যায়। তাই সেখানে কনকলতার আপত্তি ও মতামতের কথা তুলতে সৌমেনের খুব একটা অসুবিধা হল না। কিন্তু এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া যা হল তার জন্য সৌমেন,কিছুটা হলেও,তৈরী ছিলেন। শংকরের মা আশাপূর্ণা প্রস্তাবটা এক কথায় নাকচ করে দিলেন। বললেন,”বিয়ের পর বৌমা শ্বশুরবাড়ি আসবে না,এরকম অবাস্তব কথা কোন কালে কেউ শুনেছে? আমার ওরকম বৌমা দরকার নেই। আমি ছেলের অন্য জায়গায় বিয়ে দেব।”
সৌমেন লক্ষ্য করলেন,ছেলে নিজে বা তার বাবা কোন মতামত দিলেন না। আশাপূর্ণার কথাকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিতে হল। সৌমেন ফিরলেন।

পরিমলবাবু এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। বললেন,”সৌমেন,তোমাকে আমি কোন আশ্বাস দিতে পারছি না। তবে শংকরের সাথে একবার কথা বলব। দেখি তার নিজের কি মত। মেয়েটির উদ্দেশ্য মহৎ। সেদিকটা বিবেচনা করে একটা চেষ্টা আমি করব।”
            *************************
ঘন্টা দুয়েক পরেও কনকলতা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না। শরীরের অবস্থা একটুও সুবিধের মনে হচ্ছে না। একটু জ্বরও এসেছে মনে হয়। অনেক ভেবে কনকলতা হৈমন্তীকে ফোন করলেন। আজ শনিবার। হৈমন্তী ঘরেই ছিলেন। মিনিট দশেকের মধ্যে হাজির হলেন। বললেন,”কি গো কনকদি? হঠাৎ তলব? সে কি? তুমি শুয়ে আছো কেন? তোমার শরীর খারাপ?”
“হ্যাঁ রে মনা”,বললেন কনকলতা,”সকালে বাজার থেকে ফেরার পথে হঠাৎ শরীরটা খারাপ  হয়ে গেল। হেঁটে আসতে পারছিলাম না। শিন্টু পৌঁছে দিয়ে গেল। এর মধ্যে আবার জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। থার্মোমিটার দিয়ে একটু দেখবি মনা?”
দেখা গেল জ্বর এসেছে। হৈমন্তী উদ্বেগ প্রকাশ করলেন,”ইস,কনকদি,জ্বর তো ভালই এসেছে। সকাল থেকে শরীর খারাপ। তার মানে তোমার তো সকাল থেকেই কিছু খাওয়া হয় নি। আমাকে আগে ডাকো নি কেন?”
কনকলতা অপরাধীর মত গলায় জবাব দিলেন,”না রে,ভেবেছিলাম একটু পরেই কমে যাবে।”
– “যাক গে। তুমি শুয়ে থাকো। আমি তোমার জন্য খাবার আর প্যারাসিটামল নিয়ে আসছি। যাব আর আসব।”
কনকলতা শুয়ে আছেন। পাশে হৈমন্তী একটা বেতের চেয়ারে বসে মোবাইল ঘাঁটছেন। কনকলতা জিজ্ঞাসা করলেন,”কি রে মনা,দুপুরে একটু শুবি না? এভাবে বসেই কাটাবি?”
হৈমন্তী হাসলেন। বললেন,”না গো দিদি। সোমবার থেকে শুক্রবার অফিস থাকে। ঘুমের সুযোগ নেই। বাকি দুটো দিন আর শুই না। অভ্যেস খারাপ করে লাভ নেই। তুমি একটু ঘুমতে চেষ্টা করো। ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। জ্বরটা কমে যাবে।”
ঘুম আসে না কনকের। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। সামান্য একটু শারীরিক গোলমালেই জীবনের নানা ঘটনা মাথার মধ্যে জট পাকাতে থাকে। কনকলতা ভাবেন,তিনি কি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন? হয়তো হ্যাঁ,হয়তো বা না। বুঝতে পারেন না কনকলতা।
হৈমন্তীদের পরিবারের প্রতি কনকলতা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। সৌমেনকাকু ও রীনাকাকিমা যেমন,তাঁদের বৌমা হৈমন্তীও সেরকমই,সবসময় কনকের পাশে থেকেছেন। নিজের সিদ্ধান্তের কারণেই হোক বা অন্য কোন কারণে,কনকলতা নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাত পেলেও সৌমেনকাকুর পরিবারের কেউ কখনও তাঁকে বিন্দুমাত্র দুঃখ দেন নি। কখনও তাঁর কাছ থেকে দূরে সরেও যান নি। কনকলতাও বসু পরিবারকে নিজের পরিবারের অংশ হিসেবেই দেখেছেন।
            **************************
কনকলতার বিয়ে শংকরের সাথেই হয়েছিল। পরিমলবাবু কনকের কৃচ্ছসাধনের ইচ্ছার মধ্যে যে মহত্ব দেখেছিলেন তাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেছিলেন। শংকরও বাবার সাথে একমত হয়েছিলেন। তাঁরও যুক্তি ছিল,অসুস্থ বাবার দেখাশোনার জন্য যাক না দু-চার বছর। বাকি জীবন তো আছেই।
রীনাকাকিমার নির্ভরযোগ্য হাতে বাবাকে সমর্পণ করে কনকলতা শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করেছিল। মাত্র কয়েকদিন। অষ্টমঙ্গলায় জোড়ে এসে একা ফিরে গিয়েছিলেন শংকর। রীনা কনককে আরও কয়েকদিনের জন্য যেতে বলেছিলেন। কনকলতা রাজি হয় নি।
এভাবেই দিন কাটছিল। শংকর মাসে দুমাসে একবার আসেন। দিন কয়েক থেকেও যান। কনকলতা নিরলসভাবে বাবার দেখাশোনা করে। এই নিয়মেই দেখতে দেখতে তিন বছরেরও বেশী সময় পেরিয়ে গেল। অসুস্থ মানুষের সুস্থ হওয়ার বাসনা থাকে। কিন্তু অশোক কায়মনোবাক্যে নিজের মৃত্যু কামনা করছেন। প্রতিনিয়ত চাইছেন কনক শ্বশুরবাড়ি যাক। এভাবে বছরের পর বছর বাপের বাড়িতে কাটানো যায় না। মানব মনন সতত পরিবর্তনশীল। বিয়েটা ভেঙ্গে যেতে পারে। অশোকের এত দুশ্চিন্তাও কিন্তু শরীরে কোন কুপ্রভাব ফেলে না। অশোক যেন ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে উঠছেন।
অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। শংকরের যাতায়াতের ব্যবধানও বাড়ছিল। শংকর একসাথে দুদিক সামলাতে গিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। একদিকে কনকলতাকে যেমন তার অবস্থান থেকে নড়ানো যাচ্ছিল না, অন্যদিকে তেমনই নিজের মাকে সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছিল।
আশাপূর্ণার যুক্তি খুব পরিষ্কার,”তখন বৌমার বাবার কথা বিবেচনা করে আর তোমাদের কথা শুনে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু সে কথা রাখতে অনন্তকাল অপেক্ষা করা যায় না। আমারও বয়স হয়েছে। সংসারের ঘানি আমি আর টানতে পারছি না।”
অনন্যোপায় শংকর সৌমেন বসুর শরণাপন্ন হলেন। সৌমেন ও রীনা নানাভাবে চেষ্টা করেও সমস্যার কোন সমাধান করতে পারলেন না। কনককে তার সংকল্প থেকে একচুলও বিচ্যূত করা গেল না। শংকরের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এর পরও বছরে এক আধবার চিঠি আসছিল। সেখানেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই থাকছিল না। ক্রমে সে যোগসূত্রও ছিন্ন হল। কনকলতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। কিন্তু কোন কারণেই নিজের অবস্থান থেকে নড়ল না।
কনকলতার বিয়ের প্রায় ছ-বছরের মাথায় অশোক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সৌমেন চন্দননগরের ঠিকানায় টেলিগ্রাম করলেন। আশ্চর্যজনকভাবে  কোন জবাব এল না। শংকরও এসে পৌঁছলেন না। কনকলতা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে অবশ্য অন্য চিন্তার অবকাশ ছিল না। সৌমেন ও অন্য পড়শীদের সাহায্যে কনক বাবার পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করল।
শংকরের নীরবতার কারণ, কনকলতা কিছুটা হলেও,অনুধাবন করল। ছ-বছর সময়টা যথেষ্ট বেশী। সম্পর্ক যে উষ্ণতা হারাচ্ছে, পরিবর্তে ভাটার টান প্রকট হয়ে উঠছে, কনকলতা যে সেটা অনুভব করেনি তা নয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বিদ্বেষ যে এতটা প্রবল আকার ধারণ করতে পারে,সে ধারণা কনকলতা করতে পারে নি। যদিও কোন অবস্থাতেই বাবাকে ছেড়ে যাওয়া কনকের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কনকলতা যাই ভেবে থাকুক,নিজের হাতে করা টেলিগ্রামের পরেও ও তরফের অস্বাভাবিক নীরবতায় সৌমেন কিন্তু বিচলিত হয়ে পড়লেন। বাপ-মা হারা মেয়েটাকে তিনি নিজের মেয়ের মতই দেখেন। সেই মেয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে দেখে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। শেষে রীনার সাথে আলোচনা করে,অপমানিত হতে পারেন ভেবেও,কনকের অজ্ঞাতে চন্দননগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
চন্দননগরে এসে দেখলেন,আবহাওয়া থমথমে। শংকরের মা তো বটেই,অন্যরাও কনকের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সৌমেন বিস্মিত হলেন যখন এঁরা কেউ অশোকের মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুললেন না। বাধ্য হয়ে সৌমেন নিজের করা টেলিগ্রামের কথা বললেন। খবরটা পাওয়ামাত্র পরিমলবাবু ও শংকর যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কই,কোন টেলিগ্রাম তো তাঁরা পান নি। সৌমেনের বুঝতে অসুবিধা হল না,রহস্যটা ঠিক কোথায়। এখানে আসার আগে সৌমেন স্থানীয় ডাকঘর ঘুরে এসেছেন। তিনি জেনে এসেছেন, কে সেদিন টেলিগ্রামটা গ্রহণ করেছিলেন। সৌমেন পরোক্ষভাবে সে প্রসঙ্গ তুললে আশাপূর্ণা সরাসরি অস্বীকার করলেন। সৌমেন দেখলেন,আশাপূর্ণা যত জোরের সাথেই অস্বীকার করুন না কেন, অসত্য ভাষণের ছায়া তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। সৌমেনের বুঝতে বাকি রইল না যে,আশাপূর্ণা টেলিগ্রামটা পেয়েছিলেন কিন্তু এই কথা কাউকে জানান নি। সবার অজান্তে সেটিকে হয়ত নষ্ট করে ফেলেছেন। যার অর্থ,কনকলতা এ বাড়িতে আসুক সেটা আশাপূর্ণা চাইছেন না। পরিমলবাবু বা শংকর কি বুঝেছেন,বোঝা গেল না। তবে তাঁদের শীতল ব্যবহারে সৌমেন কোন আশার আলো দেখতে পেলেন না। ব্যর্থ দৌত্য শেষে সৌমেন শিলিগুড়ি ফিরলেন।
           **************************
কনকলতা স্কুল থেকে ফিরছিলেন। পথে থামতে হল। আকাশে মেঘ জমছিল অনেকক্ষণ থেকেই। এবার ঝড় উঠল। কনকলতা তাড়াতাড়ি একটা চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলেন। ওরা সসম্মানে দিদিমণিকে বসতে দিল। সাথে হাজির করল ধূমায়িত এক ভাঁড় চা। ঝড়ের সাথেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। এই সময় এরকম গরম চা মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। কনকলতা আপত্তি করলেন না।
            **************************
সৌমেন ফিরে এসে রীনার পরামর্শ মতো কনকলতাকে চন্দননগরের ঘটনাটা জানালেন। কনকলতা কোনরকম আবেগ বা উৎকন্ঠা প্রকাশ করল না। শুধু বলল,”কেন শুধু শুধু অপমানিত হতে গেলেন কাকু? আমি জানতে পারলে কিছুতেই যেতে দিতাম না।”
কনকলতা দিনকয়েক চিন্তা ভাবনা করে অবশেষে শ্বশুরবাড়ি পর্বে ইতি টানল। স্থানীয় এক বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকের অভাব ছিল। ফলে সহজেই কনকের শিক্ষকতার চাকরী জুটে গেল ।কনকলতা নিজের জীবনপ্রবাহকে নতুন খাতে বইয়ে দিল। নারী  যে অবলা নয়,সে সূত্র প্রমাণ করার একটা তাগিদ তার মধ্যে দেখা দিল।
বছর দেড়েক পরে একদিন কনকলতা স্কুল থেকে ফেরার পরেই রীনা এলেন। বললেন,”কি রে মেয়ে? হাত মুখ ধোওয়া হয়েছে?”
এই অবেলায় কাকিমাকে দেখে কনক একটু অবাক হল। মুখে অবশ্য কিছু প্রকাশ করল না। বলল,“হ্যাঁ কাকিমা। এখন এক কাপ চা খাব। তোমার জন্য বসাই?”
– “বসাবি? আচ্ছা বসা। তোর সাথে একটা জরুরী কথা আছে। চা খেতে খেতে বলব।”
চা ছেঁকে এক কাপ রীনাকে দিয়ে কনকলতা জিজ্ঞাসা করল,”কি কথা বলবে বলছিলে কাকি,বলো।”
রীনা কিছুটা ইতস্ততঃ করে বললেন,”শংকর এসেছে।”
কনকলতা চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল। গম্ভীর স্বরে বলল,”কে শংকর?”
রীনা বিস্ময় চেপে রাখতে পারলেন না। বললেন,“সে কি রে? শংকরকে চিনিস না? তোর বর রে?”
কনকলতা একই রকম গাম্ভীর্য রেখে বলল,”হ্যাঁ। তো? কি জন্য এসেছে?”
রীনা বুঝলেন,বাতাবরণ সুবিধের নয়। নরম গলায় বললেন,”শোন্ মা। আমি তোকে কোন সিদ্ধান্ত নিতে বলছি না। শুধু ও কি বলছে সেটা তোকে জানানো দরকার মনে হল বলে বলছি। তুই শুধু শোন্। মতামত দেওয়া বা না দেওয়া,সম্পূর্ণ তোর ব্যাপার।”
কনকলতা শান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ করল না। বলল,”কি বলছে সে?”
-“ওর মা কিছুদিন আগে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে,বাঁচার কোন আশা ছিল না। তখন তিনি ছেলে আর ছেলের বাবাকে ডেকে নিজের অপকর্মের কথা স্বীকার করেন। টেলিগ্রামটা তিনিই পিয়নের হাত থেকে নিয়েছিলেন। কিন্তু তোর প্রতি প্রতিহিংসাবশতঃ সেটা কাউকে না জানিয়ে তখনি উনুনে ফেলে দিয়েছিলেন।
এখন,মায়ের স্বীকারোক্তির পরে,অনুশোচনা হওয়ার শংকর তোকে নিয়ে যেতে চায়।”
কনকলতা কিছুক্ষণ চুপচাপ চায়ে চুমুক দিল। তারপর বেশ দৃঢ়ভাবে বলল,”দ্যাখো কাকি। বিয়ে আর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যে অধ্যায়টা আমার জীবনে এসেছিল,কাকু চন্দননগর থেকে ফিরে আসার পর আমি ওটাকে পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দিয়েছি। সে অধ্যায়টা আমি আর খুলতে চাই না। তা ছাড়া তোমাদের ওই শংকর,যে নাকি আজ আমাকে নিতে এসেছে,সে কি একজন পুরুষ? সামান্য সময়ের জন্য গিয়েই ওর মায়ের যে মিথ্যা ভাষণ কাকু সহজেই ধরে ফেললেন,সেটা ও এতদিন পরে বুঝতে পারল,তাও তার মায়ের স্বীকারোক্তি শোনার পর। ও একজন পরিণত পুরুষ নয় কাকি। ও হল ওর মায়ের আদরের দুলাল। আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করা ওর উচিত হয় নি। তুমি ওকে এই কথাগুলো বলে দিও কাকি।”
          ****************************
বিকেলে ডাঃ ঘোষ কনকলতার অসুখের ভয়টা একরকম উড়িয়েই দিলেন। বললেন,”খালি পেটে বাইরে রোদ লেগে সামান্য জ্বর হয়েছে। প্রচুর জল খান আর কদিন বাড়িতে বিশ্রাম নিন। আর হ্যাঁ। রোদে বেরনোর সময় ছাতা ব্যবহার করবেন আর খাবার খেয়ে বা প্রচুর জল খেয়ে বেরবেন।”
হৈমন্তীর সাথে কনকলতা বাড়ি ফিরলেন। একটা অহেতুক চিন্তার বোঝা ঘাড় থেকে নেমে গেল। হৈমন্তী চা বানিয়ে আনলেন। দুজনে নিশ্চিন্তে চায়ে চুমুক দিলেন।
                *** শেষ ***
***************************************
চন্দ্রকান্তি দত্ত
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে  লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।

 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!