Shadow

কালিম্পং রহস্য – সুরজিত সরখেল

Kalimpong PC: Travel – Hindustan Times

কালিম্পং রহস্য

সুরজিত সরখেল

….. এই নিয়ে বারকয়েক কালিম্পং আসা হয়ে গেল। যদিও এবারেরটা পেশা সংক্রান্ত ব্যাপারে।আমি বিনায়ক সেন ঐ একটু আধটু গোয়েন্দাগিরি করি।আমার সহকারী আমার সহধর্মিণী শর্বরী ওরফে রিনি সেন। এই মাস চারেক আগে আমাদের বিয়ে হল। আমাদের পরিচয়ের যোগসূত্রটা না বললে নয়। গতবছর লালবাজারে একটা খুনের তদন্তের কাজে বটব্যালদার কাছে আলোচনার জন্য গিয়েছিলাম। পুরোনাম হচ্ছে কৃষ্ণকান্ত বটব্যাল। লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দা।ওঁর সঙ্গে বছর কয়েক আগে আমার একটা গানের অনুষ্ঠানে আলাপ হয়। একটু আধটু গান করার শখও আছে আমার। গান শুনে ভাল লাগায় উনি আমার সঙ্গে আলাপ করে ওঁর যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটে আসতে বলেছিলেন। সেই থেকে পরিচয়। উনি ভাল সেতার বাজান। বৌদির কাছে সেটা শুনেছিলাম। নিজের থেকে বলেননি। বৌদিও ভীষণই অমায়িক। যখনই যাই,যতক্ষণ বটব্যাল দার সঙ্গে কথা বলি,কিছু না কিছু খাবার তৈরি করে,সাথে চা দিয়ে পাঠাবেন। কখনও লুচি আলুর দম,কখনও ফিশফ্রাই,কখনও ঘুগনি,পকোড়া,ওমলেট……সে এলাহি ব্যাপার। অনেক অনুরোধ করার পরে একদিন সেতার বাদন শুনলাম। কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারিনি। মালগুঞ্জি রাগ বাজিয়েছিলেন। এসব রাগ কোন গুরুর কাছে দস্তুরমতন তালিম না পেলে ওভাবে বাজানো যায়না।সারাদিন চোর,ডাকাত,অপরাধী ঘেঁটে বাড়িতে এসে রাত গভীরে উনি সেতার বাজিয়ে পরের দিন আবার ডিউটি তে গেছেন; বহুদিন এরকম হয়েছে। সেইথেকে সবদিক থেকে উনি আমার গুরুদেব হয়ে গেলেন। আর বৌদি আমার লোকাল গার্জিয়ান হলেন ৷ মা গত হবার পরে আমি কসবায় একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকতাম। লালবাজারে বটব্যালদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে একদিন উনি আমাকে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে একটা রিপোর্ট আনতে পাঠালেন। ব্যস,ওখানেই শর্বরী মিত্রর সঙ্গে প্রথম দেখা,তারপরে এখানে ওখানে,রেস্টুরেন্টে,সিনেমা হলে,বছর খানেক পরে একেবারে পাকাদেখা করে,পাকাপাকিভাবে আমাদের জুটি বেঁধে দিলেন দাদা বৌদি। রিনিদের বাড়ি তালতলায়।
আমার মতন রিনিও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বৌদি একদিন হাসতে হাসতে বললেন,ওহে গোয়েন্দা বাবু,তোমার এরকম সহকারী পাবে,ভাবতে পেরেছিলে কখনও? সত্যিই অস্বীকার করা যায়না। আমি তো কোন ছার,বটব্যাল দা এবং আরও অনেকের রিনির সাহায্য নিতে হয় বিশেষ করে জটিল কেস গুলোতে। মাঝেমাঝে বৌদি আমাদের সামনে এসে কখনো কখনো মান্না দের ওই গানটা “কে প্রথম কাছে এসেছি,কে প্রথম ভালোবেসেছি”..করতে থাকেন,আর আড়চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেন।               কালিম্পং এর একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটের কাছে একটা হোটেল মালিকের একমাত্র ছেলের খুনের তদন্তে বটব্যালদার নিজের আসার কথা ছিল। কিন্তু আর একটা জটিল তদন্তের ব্যাপারে আটকে গিয়ে উনি আমাদের ওপরে দায়িত্ব দিলেন। কোনো অসুবিধা হলে উনি দেখবেন,কথা দিলেন। আর হোটেল মালিকের সঙ্গে ওঁর অনেকদিনের পরিচয়।উনিও কিছুদিনের মধ্যে আমাদেরসঙ্গে যোগ দেবেন। তাছাড়া স্থানীয় থানার অফিসার মি:রমন লাল সুব্বা ওঁর পরিচিত। সুতরাং,আমরা গোয়েন্দা দম্পতি হিসেবে কালিম্পং রওনা দেবার আগে দাদা আর বৌদির আশীর্বাদ নিতে,লাগেজ গুছিয়ে রেখে এসে,দেখা করতে যেদিন এলাম,সেদিন বৌদিকে ভীষণ চিন্তায় পড়তে দেখলাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম দেখে,আমাদের রক্তের সম্পর্ক না হলেও,কতটা খাঁটিভালোবাসা মানুষের হৃদয়ে থাকলে,ওরকম ভাবে বিপদের সম্ভাবনায় কাতর হওয়া যায়! বিশেষত,মা গত হবার পরে স্নেহের পরশ যে আবার পাবো,বৌদির সঙ্গে দেখা না হলে জানতেই পারতাম না। এয়ারপোর্টে বটব্যাল দা আর বৌদি গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে কিছু পরামর্শ দিয়ে চলে গেলেন। বাগডোগরা পৌঁছে লাগেজ নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মোবাইলে ফোন চলে এলো। কাঞ্ছা ছেত্রীকে মি: গুরুং নিজের জীপ গাড়িটা দিয়ে পাঠিয়েছেন,আমাদের নিয়ে যাবার জন্য। হাসিখুশি মুখের ছটফটে,প্রাণবন্ত কাঞ্ছা লাগেজ গুলো গাড়িতে তুলে ঝরঝরে বাংলায় বললো,’স্যার,আগে ফ্রেশ হয়ে সামনের রেস্টুরেন্টে গরম,গরম চিকেন মোমো,কফি স্যান্ডউইচ খেয়ে গাড়ি ছাড়বো। হোটেলে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।’ রিনিও মোমো খাওয়ার কথা শুনে লাফিয়ে উঠলো। কোণার দিকে একটা টেবিলে বসলাম তিনজনে। এখন বেলা ঠিক সওয়া তিনটে বাজে। আগামী পরশু লক্ষ্মী পূজো। এইসময়টায় প্রচুর ট্যুরিস্ট ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পরে। বাগডোগরাতেও প্রচুর মানুষ দেখছি,একে একে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসছে। গরম গরম মোমো আর কফি এসে গেল। খেয়ে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাতেই রিনি অনুযোগ করে উঠলো,’নিজে একটু খেয়াল রেখো। বেশি সিগারেট খেলে কি হয়,তা তুমি ভালই জানো’! বেশ ভালই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা মারছে। নরম রোদের ছোঁয়ায় বেশ একটা সুন্দর আমেজ,একটা প্রশান্তি বোধ কাজ করছে। যাচ্ছি একটা খুনের তদন্ত করতে,কিভাবে আগামী দিনগুলো কাটবে,ভাবছিলাম। কাঞ্ছা গাড়ি ছাড়ার আগে একটা গাট্টাগোট্টা মাঝবয়সী লোক,পরনে চকোলেট রঙের পাঠান ড্রেস,আর তার ওপরে একটা জিন্সের জ্যাকেট আর মাথায় নেপালি টুপি,কাছে এসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন “একটু লাইটার টা দিন না”! মনে পড়লো,এই লোকটাই আমাদের পাশের টেবিলে আরো একজন লোকের সঙ্গে নেপালি ভাষাতে কথা বলছিল। মনে একটা খটকা লাগলো। বটব্যাল দার ভাষায় “গোয়েন্দাদের ষষ্ঠেন্দ্রিয় ভীষণ প্রখর হয়। প্রতিটি মানুষকে তার চেহারা,স্বভাব,পছন্দ অপছন্দ,পোশাক,সংস্কৃতি,অভ্যাস এবং আরও অনেক কিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। একটা উপন্যাস বা গল্পের মতন করে মন দিয়ে পড়তে হয়।তুমি যতই চরিত্রের গভীরে যাবে,তোমার কাছে একটা একটা করে অজানা জগৎ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকবে। প্রতিটি মানুষের স্বভাব,চরিত্র,মানসিকতা,সমস্ত রকমের বোধগুলো ভিন্ন,ভিন্ন রকমের হয়। তুমি যতই তোমার দৃষ্টি দিয়ে,অনুভূতি দিয়ে অনুসন্ধান করতে থাকবে,ততই আকাশে মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলার মতন,তোমার মনের মধ্যেও চিন্তার অনুরণন হতে থাকবে। মানুষের মনের মধ্যে যে গভীর,রহস্যময় সাগর আছেতার হদিশ পাবে মাত্র। এইবার সেখানে ডুবুরির মতন ডুব দিয়ে দিয়ে ঝিনুকের মুক্তোর মতন তোমার অনুসন্ধিৎসু মন যা খুঁজে পাবে,সেটাই হল তোমার চূড়ান্ত লক্ষ্যভেদ”!
                         রিনির ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম,”কিছু রসদ পেলে? সিগারেট ধরিয়ে দুটো টান দিয়েই কোন জগতে চলে গেলে! হাতে ছ্যাঁকা খেয়েও হুঁশ না ফেরায় অগত্যা তোমাকে ডাকতে হল।”
 কাঞ্ছা গাড়ি ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে পাহাড়ি পথে দুপাশে মহানন্দার গভীর অরণ্যের বিশাল,বিশাল মহীরুহের,সোঁদা গন্ধ শরীরের ভেতরে রন্ধ্রে,রন্ধ্রে প্রবেশ করতে একটা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। একটা মৃদু ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা কেটে যেতেই দেখলাম তিস্তা নাচতে নাচতে সারাটা পথে কখনও ডান দিক,আবার কখনো বাঁদিকে  চলেছে। কখনও কাছে,দূরে পর্বত শ্রেণী,তাদের জঠরে শাল,সেগুন,দেবদারু, রডোড্রেনডন,ইউক্যালিপটাস,নাম না জানা অর্কিডের পসরা সাজিয়ে রেখে আমাদের গাড়ির গতির সঙ্গে তাল রেখে দ্রুত পিছনে চলে যেতে থাকল। সন্ধে নেমে আসছে দ্রুতগতিতে। পাখিদের ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। কলরব চলছে ওদের। অবশেষে প্রায় রাত আটটা বেজে গেল আমাদের হোটেলে পৌঁছতে। গাড়ি থেকে বেরোতেই ঠান্ডাটা মালুম হলো। মি: গুরুং দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের জন্য। কথা বলতে বলতে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের ভিতরে এসে পৌঁছলাম। সুন্দর কাঠের দেওয়াল,মেঝে,ওয়েল ফার্নিশড রুম,একটা সুন্দর বারান্দা আছে। এখান থেকে কাছেই ডেলো পাহাড় দেখা যায়।
                 মিঃ গুরুং ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। একমাত্র ছেলে অজয়,পাঁচবছর বয়সী নাতি,আর বৌমা নীতা এই ছিল অরুণ বাবুর সাজানো গোছানো সংসার।অজয় খুন হয়ে যাবার পরে বৌমা আর নাতি কেনীতাদের বাড়ি আলগাড়াতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই ভয় পেয়েছেন। হোটেলের তিনতলায় যে ঘরে অজয়ের দেহটা চেয়ারে বসানো অবস্থায় ছিল,পুলিশ ঘরটা সিল করে দিয়ে গেছে। সাতদিন হয়ে গেল দেহটা মর্গে রাখা আছে,পুলিশি তদন্ত হবে,আমাদেরও পরীক্ষা করতে হবে। বটব্যাল দা,ফোন করে মিঃ সুব্বাকে সবকিছু বলে রেখেছেন। কালকেই আমরা মর্গে যাব। খুনটা হয়েছিল সম্ভবত রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। ঐ সময় অজয় কফি আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল। হোটেলের ব্যবসা ছাড়া অজয়ের শখ ছিল প্রাচীন,দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য জিনিসের সংগ্রহ করা।যেমন,সম্রাট কনিষ্কের আমলের একটা স্বর্ণমুদ্রা,লর্ড বেন্টিঙ্কের একটা ছড়ি,মোগল আমলের কিছু দুষ্প্রাপ্য পেইন্টিং,মুদ্রা। ওর সংগ্রহের তালিকায় আরও দুষ্প্রাপ্য বস্তুও ছিল। খুব সম্প্রতি একটা পাথর ও সংগ্রহ করেছিল। দেখে খুবই সাধারণ নুড়ি পাথর বলে মনে হয়। ওটা ছিল একটা উল্কা পিন্ড। এই সমস্ত সংগ্রহের অধিকাংশই সরকারিভাবে নিষিদ্ধ তালিকায় ছিল। অজয়কে মৃত অবস্থায় যে ভাবে ঘরের মধ্যে পাওয়া যায়,তার ছবি অরুণ বাবু দেখালেন,যা দেখলে মনে হবে,কাজ করতে করতে অজয় ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে ছিল খাবারের থালি,আর ছিল একটা সাদা খাম,সবই এখন পুলিশের জিম্মায়। হোটেলের পিছনদিকের সি সি টিভির ফুটেজে অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়েনি। হোটেলের সামনের দিকে একটা সুদৃশ্য ঘোরানো কাঁচের সিড়ি আছে,যেখান দিয়ে অজয়ের ঘরে পৌঁছানো যায়। এখান থেকে সামনের ডেলো পাহাড়ের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। নিচে পুলিশের গাড়ি থেকে মিঃ সুব্বা নেমে এসে আমাদের খোঁজ করে,বটব্যালদার কথা বললেন। উনি না আসা পর্যন্ত অজয়ের ঘরে ঢুকতে পারছিলাম না। ঘরে ঢোকার আগের মুহূর্তে দরজার বাইরে থেকে একঝলক ঘরের মধ্যে তাকিয়েই খাটের পায়ার ঠিক পেছনেই একটা ব্রাসের বোতাম দেখতে পেয়ে পকেটে ঢোকালাম। মি: সুব্বা ফরেনসিক রিপোর্টটা আমার হাতে দিলেন। কাল আমরা মর্গে যাব দেহটা পরীক্ষা করতে। বোতামটা যেন কোথায় দেখেছি ভাবতেই মনে পড়ে গেল,সেই রেস্টুরেন্টে চকোলেট রঙের পাঠান ড্রেস পরে লোকটা লাইটার চাইছিল,তার পরনে একটা জ্যাকেট ছিল,যার মাঝখানের বোতামটা ছিলই না। তাহলে আমরা যে এখানে খুনের তদন্ত করতে আসছি,এই খবরটা কেউ ওকে জানিয়েছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে মি: সুব্বার সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলতে বলতে হোটেলের চারপাশটা ঘুরে দেখছিলাম। চাঁদের আলোয় ভীষণ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। সুব্বা চলে যাবার পরে মি : গুরুং কে বললাম,ডিনারের আগেই আমরা অজয়ের প্রাচীন জিনিসের সংগ্রহশালা দেখবো। উনি আমাদের হোটেলের তিনতলার একটা ঘরে যা লক করা ছিল,সেইঘরে নিয়ে এলেন।অজয়ের পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না। মূল্যবান বেলজিয়াম গ্লাসে মোড়া দেওয়ালের শোকেসে থরে থরে সাজানো আছে সুদৃশ্য ছোট,বড় বাক্স। তার ওপরে লেখা আছে জিনিসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। উল্কাপিণ্ডের বক্সটা খুলে দেখলাম,একটা ধূসর রঙের মামুলি নুড়ি পাথরের মত দেখতে একটা ছোট্ট পাথর,যার দাম কত হতে পারে,আমাদের কারোর আন্দাজ নেই। গুরুং বললেন “এটা পাবার পর থেকেই,অজয় যেন কিরকম গম্ভীর হয়ে যায়!!” ভীষণ ভয় পেলে মানুষ যে রকম হয়ে যায় সেরকম! বাড়ি থেকেই বের হতো না! একটা তরতাজা মানুষ কিরকম নিঃশব্দে খুন হয়ে গেলো,সত্যি ভাবা যায়!”
                 রেস্টুরেন্টে দেখা লোকটার যথাসম্ভব বিবরণ অরুণ বাবুকে জানিয়ে জানতে চাইলাম,যে উনি চেনেন কিনা; শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ওঁর মুখটা কিরকম বিবর্ণ হয়ে গেল।বলে উঠলেন,”ওকে এই পাহাড়ি এলাকায় শুধু নয়,আশে পাশের সব দেশ,নেপাল,ভুটান,পাকিস্তান,প্রভৃতি দেশগুলোতে বিশাল চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই চেনে। ডাকনাম পেড্রো। পুলিশের মধ্যেও ওর চর আছে। ভীষণ বেপরোয়া,হিংস্র প্রকৃতির। অজয়ের সঙ্গে এবাড়িতে ওকে বারকয়েক দেখেছিলাম। ওকে সতর্ক করেও দিয়েছিলাম। তারপর আর দেখি নি। বুঝতে বাকি রইলনা,আমাদের এখানে আসার কারণটা কিভাবে জানতে পারলো। সেদিন রেস্টুরেন্টে লাইটার নেবার অছিলায় কিছু জানার উদ্দেশ্য ছিল হয়তো,কাঞ্ছা গাড়িতে ওঠার জন্য তাড়া দিতেই আমরা উঠে পড়ায় বিশেষ সুযোগ ও পায়নি। তবে মন বলছে শীঘ্রই মোলাকাত হবে।
        রাতে ডিনার করে ঘরেতে ঢুকেই লাইট নিভিয়ে দিয়ে রিনিকে কানে কানে বললাম,”আমার অনুমান যদি মেলে তবে আজ রাতেই কিছু একটা ঘটনা ঘটবে,সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। তবে ভয় পেয়ো না,সঙ্গে দাদার দেওয়া এটা আছে।” পকেট থেকে ছোট্ট জার্মান মাউজার টা বার করে দেখালাম। কয়েক রাউন্ড কার্তুজও আছে। যদিও কোনদিন শুটিং প্র্যাকটিস ছাড়া ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি।
                একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ বারান্দায় বসে আছি। অনতিদূরে চার্চের ঘড়িতে বারোটা  বাজল।পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সামনের পাহাড়,জঙ্গলের অতি প্রাকৃত রূপ রহস্যের হাতছানি দিচ্ছে যেন। এমন জায়গায় দুজনে বসে আছি,চট করে কেউ দেখতে পাবেনা। সামনের গভীর জঙ্গলের মধ্যে যে পিচের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে,সেখানে প্রকাণ্ড জ্যাকারান্ডা গাছটার নীচে দুটো ছায়া মূর্তি নড়ে উঠলো যেন! গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে,আমাদের হোটেলের পিছনদিকে। রিনি আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। ভীষণ উত্তেজিত! হঠাৎ একটা গুলির শব্দ,আর সেইসঙ্গে বাঁশির তীব্র আওয়াজ। একসঙ্গে অনেকগুলো সার্চ লাইট জ্বলে উঠলো। মি: সুব্বা ঠিক সময়মতো তার বাহিনী নিয়ে না আসলে পেড্রো এত সহজে ধরা পড়তো না।
             পেড্রো স্বীকার করেছে,যে ভয় দেখানো যে চিঠিটা সাদা খামে ও পাঠিয়েছিল,তাতে চিঠিতে ও সায়নাইড লাগিয়ে রেখেছিল। তখন অজয় খাচ্ছিল। চিঠিতে কি লেখা আছে পড়তে পড়তে ও খেতে গিয়ে বিষক্রিয়া হয়ে প্রাণ হারানোর মুহূর্তে পেড্রোর জ্যাকেটটা খামচে ধরে। কিন্তু ভয়ংকর বিষক্রিয়ায় ও প্রাণ হারিয়ে ফেলে। খামের ভিতরের চিঠিতে যে পটাসিয়াম সাইনাইড ছিল,এ ব্যাপারে রিনির পূর্বাভাস অভ্রান্ত ছিল।
             মি : সুব্বা আর অরুণ বাবুর অনুরোধে আরও দু দিন কালিম্পং আর কার্শিয়াং ঘুরে নিলাম বাড়ি ফেরার আগে।।
***********************************

সুরজিৎ সরখেল পরিচিতি :
১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্ম। ২০১৮ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গীতে একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। সেজমাসী এবং মেজমামা প্রখ্যাত সুরকার স্বর্গীয় হৃদয় রঞ্জন কুশারীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। কলেজ জীবন শুরু হবার পর সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। অফিসে কর্মজীবনের ফাঁকেই শুরু হয় সাহিত্য চর্চা। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।

 

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!