মন-দর্পণ
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
ভবতোষবাবুর কী হয়েছে আজকাল, ছেলেদের কাউকে যেন ঠিক সহ্য করতে পারছেন না। ব্যবসায়ী বড় ছেলে মহীতোষ ওরফে মহী তাঁকে শ্রদ্ধাভক্তি ভালই করে,এমনকি তিনি অবসর নেওয়ার পরেও এখন বাড়তি বোঝা বলে মনে করে না। বউমাও যেটুকু মনে হয় আড়ালে-আবডালেও কোন কটাক্ষ করেন না। ছোট ছেলে আশুতোষ একটা ছোটখাটো চাকরি করে,বিয়ে করেনি এখনও। প্রেম-টেম করে,তিনি জেনেও তেমন পাত্তা দেন না। কিন্তু ছেলেদের বা বউমাকে অসহ্য মনে হবার কারণ কিছু বুঝতে পারছেন না তিনি। স্ত্রী-বিয়োগ হবার পরও এমন অবস্থা ছিল না, এটা যেন শুরু হয়েছে মাসখানেক কি মাস দুই থেকে।
তবে কি তাঁর স্কিজোফ্রেনিয়া হল? উনি শুনেছেন যে এ রোগে নাকি দুনিয়ার সবাইকে শত্রু বলে মনে হয়। কাউকে মনের কথা খুলে বলতে না পারলে শান্তি হচ্ছে না। হ্যাঁ,একমাত্র নন্দদুলালই ভরসা। কই,নন্দকে দেখে তো তাঁর এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না! তাহলে নিশ্চয়ই এটা স্কিজোফ্রেনিয়া নয়। চিন্তিত মনে মোবাইল থেকে নন্দদুলালকে একটা ফোন করলেন ভবতোষ।
নন্দ এল। চা-টা খেল। বউমা চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেলে ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন ভবতোষ। তারপর দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুর মধ্যে কী কথা হল তা আমি জানলেও বলব না।
পরদিন সকালে মহীতোষের অফিসে গিয়ে হাজির নন্দদুলালবাবু। মহীকে বললেন-‘কিরে মহী,তোকে তো আজকাল বাসায় পাওয়াই যায় না। শুনলাম ভবার সঙ্গেও নাকি ভালভাবে কথা বলিস না। হয়েছেটা কী? যদি তেমন কোন সমস্যা হয়ে থাকে আমাকে বল,আফটার অল আমি শুধু তোর বাবার বন্ধুই নয়,তোদের শুভাকাঙ্ক্ষীও তো!’
মহীতোষ প্রথমে বুঝতে পারে না কী বলবে। তারপর কী ভেবে নিজের সমস্যার কথা সে তার নন্দকাকাকে খুলেই বলে ফেলল। আসলে হয়েছে কী,বাচ্চাদের ভাল স্কুলে পড়ানো ছাড়াও ধার শোধ ইত্যাদিতে কিছু খরচা বেড়েছে। মহীর ব্যবসার সামান্য আয়ে আর কুলোচ্ছে না। বাবার জমানো টাকা তো ব্যাঙ্কে পচছে,কবে বুড়ো মরবে,তবে ধার শোধ হবে,খরচাপাতির কিছুটা সুরাহা হবে। এই কারণে তার স্ত্রীও খুব একটা খুশি নয় শ্বশুরের উপর। অবশ্য এ সব তাদের ভাবনাই শুধু,সত্যি সত্যি তো আর তারা বাবার মৃত্যু চায় না!
– ‘বুঝেছি’,নন্দ বলেন। ‘সত্যি বড় সমস্যা! তবে তোকে আর এ নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। ভবা ওর জমানো টাকার জন্যে একটা স্কীম নিতে চলেছে। তাতে করে সে যতদিন বাঁচবে একটা পেনসন পেয়ে যাবে প্রতি মাসে।’
– ‘আর মরে গেলে?’
– ‘মরে গেলে অবশ্য তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। তোরা দুই ভাই নমিনি, দশ লাখ করে পাবি বড়জোর।’
– ‘তবু মাসে কত আসবে হাতে?’
– ‘তা ধর ষাট-সত্তর হাজার হবে। ভবা পিএফ,গ্র্যাচুইটি আর সারাজীবনের রোজগার থেকে মোটামুটি ভালই জমিয়েছিল। তখনই একটা পেনসন স্কিম নিতে পারত।’
– ‘আপনি আমাকে বাঁচালেন নন্দকাকা।’
– ‘আরে আমি আবার কী করলাম। এ সবই তো ভবার বুদ্ধি। বলছিল,ছেলেদুটোর যত কথা ছিল মায়ের সাথে। গৌরী যাবার পর থেকে ওরা আমাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না,কিন্তু আমি তো ওদের কষ্ট বুঝি।’
– ‘না। কাকা,সে কথা বলিনি। আপনি আমাকে একটা মস্ত অপরাধবোধ থেকে রক্ষা করলেন। সত্যি,আমি এমন হতভাগা ছেলে যে নিজের বাবার মৃত্যুকামনা করেছি!’
সেদিন সন্ধেয় নন্দবাবু আশুতোষকে ডাকলেন নিজের বাসায়। আশু এলে নন্দ তাকে শুধোলেন- ‘হ্যাঁরে আশু,আমি ক’মাস ধরে লক্ষ্য করেছি তুই ভবার সাথে কথাই বলিস না। কী হয়েছে,খুলে বলবি?’
– ‘না কাকা,তেমন কিছু নয়,ও আমাদের পার্সোন্যাল ব্যাপার।’
– ‘আচ্ছা,তা হ্যাঁ গো আশুতোষবাবু,আমি কি আপনাদের এতই পর হয়ে গেলাম!’ বলে আশুর পিঠে একটা কিল মেরে বললেন,‘ওরে ব্যাটা জানিস,আমার আর ভবার বন্ধুত্ব তবে থেকে যখন আমরা জামাকাপড় অবধি পরতে শিখিনি।’
এবার একটু লজ্জা পেল আশু। বলে,’কাকাবাবু,কিভাবে বলি,আমার আর শুভার সম্পর্কটা বাবা কিছুতেই মেনে নিচ্ছেন না-জাতের সমস্যা। আচ্ছা বলুন,এখন ওসব কেউ মানে? শুভা শিক্ষিত মেয়ে,কলেজে পড়ায়……আমি তো ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে বিয়ে করতেই পারতাম,শুভাই চায় সবার সম্মতিতেই বিয়েটা হোক। তবে বাবা থাকতে সে আর হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
– ‘দেখ বাবা,অত চিন্তা করিস না। ভবা তো আমার বন্ধু,আমি জানি ওর মনের কথা। মুখপোড়াটা ভাঙবে তবু মচকাবে না। এই তো কালকেই বলছিল যে আশু ওর হবু বউয়ের বাড়ি থেকে প্রথা-মাফিক সম্বন্ধটা আনলে আমি কি না করতাম? কিন্তু একসময় সত্যিই বেঁকে বসেছিলাম, এখন আর সে কথা ছেলেকে বলি কী করে বল তো! তাই তো আমি এলাম তোর সাথে কথা কইতে।’
– ‘সত্যি বলছেন কাকা?’ আশু স্পষ্টই উল্লসিত। ‘তাহলে আজই গিয়ে কথা বলি বাবার সাথে,জেনে নিই ব্যাপারটা? সত্যি আমি বাবার সম্বন্ধে কি না কি ভাবতাম!’
– ‘না না, আজ নয়। দুটো দিন ওকে স্থির হতে সময় দে। বড় তেজিয়ান মানুষ কিনা! আমি বরং কাল জেনে আসি ও কিভাবে এই সম্বন্ধটাতে এগোতে চায়।’
পরদিন সকাল সকাল নন্দদুলাল গিয়ে ধরেছে ভবতোষকে। ছেলেদের সঙ্গে যা কথা হয়েছে খুলে না বললেও কিছুটা রেখে-ঢেকে জানায় তাকে।
– ‘তা তুই এখন কী করতে বলিস আমাকে?’ ভব শুধোয়।
– ‘কী আবার? যা যা বলে এসেছি সেগুলো করে ফেল চটপট। দ্যাখ,আমি আমার কথাগুলো তোর কথা বলে চালিয়ে এলেও কাজগুলো তো করতে হবে তোকেই। কয়েকটা কথা ভেবে দ্যাখ। টাকা ব্যাঙ্কে ডিম পাড়ছে, আর ছেলেরা কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাচ্ছে। কবে তুই ম’লে কোটি টাকা পাবে সেই ভরসায় ছেলেরা,বউমারা,নাতি-নাতনিরা,এমনকি তুই নিজেও এখন কষ্ট পাবি কেন? আর শুভাকে মেনে নে। জাত মানুষকে খাওয়ায়-পরায় না,অসবর্ণ বিয়ে নিষিদ্ধ এই কথা হিন্দুশাস্ত্রে কোথাও লেখে না-তুই নিজেও জানিস সেটা।’
– ‘আর সমাজ? সে তো শাস্ত্রেরও ঊর্ধ্বে!’
– ‘বাজে কথা। তুই যাকে সমাজ বলছিস বা যে সমাজের দোহাই দিচ্ছিস,সেটা তোর অহংবোধ। মেনে না নিলে তুই ছেলে হারাবি,সমাজ কি ফিরিয়ে দেবে ছেলে? তোর ছেলেরা বড় ভাল রে। আজ হয়ত তোকে শাপান্ত করছে মনে মনে,কিন্তু নিজের অহমের উপরে উঠে এসব মেনে নিলে এই ছেলে-বউই চিরকাল তোকে মাথায় করে রাখবে।’
– ‘কিন্তু এরকম ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান কি সত্যি আছে না তুই ভাঁওতা দিচ্ছিস?’
– ‘সেসব আমার উপর ছেড়ে দে। গোটা জীবন কি ব্যাঙ্কে বসে মাছি মেরেছি? তুই বরং আশুর সঙ্গে কথা বলে একবার মেয়েটিকে দেখে নে,ওর বাবা-মা শিগ্গিরই আসবে এখানে কথা বলতে। আমি পরের সপ্তাহে হরিদ্বার-দেরাদুন যাচ্ছি,তার আগেই সব সেরে নে।’
দু’সপ্তাহ পরের কথা,নন্দ ফিরেছে দেরাদুন থেকে,ওদের জন্যে দু’কিলো ভাল বাসমতী চাল আর ভবতোষের জন্যে একটা গাড়োয়ালি শাল নিয়ে। ‘এসব আবার আনতে গেলি কেন,শুধু শুধু বাজে খরচা’-ভব একটু গাঁইগুঁই করে। ‘আচ্ছা,আমি এতই বোকা,না? তুই শালা আমার হাত থেকে সহজে পার পাবি ভাবছিস! তোর ইনভেস্টমেন্টের দালালির একটা পার্সেন্টেজ তো পাচ্ছিই,তাছাড়া আশুর শ্বশুরবাড়ির থেকে নমস্কারিতে একটা খদ্দরের স্যুট তো বাগাতেই হবে। তা তোর কী খবর বল। সমস্যা মিটল?’
– ‘উঃ কি নিশ্চিন্তি রে! রবিবার আশুর শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছিল সম্বন্ধ নিয়ে। আশু এসে বসল,দুই ছেলে বউমা মিলে কত গল্প হল। বিশ্বাস কর একবারও ওদের দেখে মনে হয়নি যে ওরা আমাকে মারতে চায়।’
– ‘তাহলে স্কিজোফ্রিনিয়া উধাও,বিনা চিকিৎসাতেই?’
-‘বিনা চিকিৎসাতে কে বলল? ডাক্তারই তো রোগ সারাল। এই ডাক্তারটিও যে বদ্যির ব্যাটা-নন্দদুলাল গুপ্ত,এম-এ,রিটায়ার্ড ব্যাঙ্ক অফিসার’-ভবতোষের গলায় শ্রদ্ধামিশ্রিত কৌতুক।
পরদিন মহী আর আশু দু’জনেই এসেছে নন্দর বাসায়,শনিবার ওদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের নেমন্তন্ন নিয়ে।
– ‘কি রে,বুড়োগুলোর মরে যাওয়া উচিৎ না বেঁচে থাকা?’ নন্দ জনান্তিকে শুধোন দু’জনকে।
– ‘এসব কথা ভাবলেও এখন লজ্জা লাগে নন্দকাকা,সত্যি কী করে ভেবেছি তখন? ভাগ্যিস বাবা জানেনা এসব’,বলে ওঠে দুজনেই।
একেই বলে উইন-উইন সিচুয়েশন,তোমারও জিত,আমারও জিত। এমনকি ভবতোষের ইনভেস্টমেন্ট থেকে নন্দরও দু’পয়সা কমিশন আসবে। ‘তোরা মন দর্পণ কহলায়ে…’ হঠাৎ বেসুরে গেয়ে ওঠেন নন্দদুলাল। তারপরেই হো হো করে হেসে ওঠেন। দু’ভাই অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে।।
***************************************
পল্লব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের খনিজ তৈলক্ষেত্রে কাটিয়েছেন সারাজীবন,সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। বিহারের,অধুনা ঝাড়খণ্ড,যে অঞ্চলে তিনি মানুষ সেখানে ‘নানা ভাষা,নানা জাতি,নানা পরিধান’ হলেও একসময় বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চার আবহ ছিল। সেই শিক্ষা থেকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায় ও বিগত কয়েক বছরে অবসর,জয়ঢাক,ম্যাজিক-ল্যাম্প,ছুটির ঘন্টা,আদরের নৌকা,ঋতবাক ইত্যাদি নেট-পত্রিকা ও যুগ,ট্রৈনিক,বোম্বে-ডাক ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায়,ক্যাফে-টেবল প্রকাশিত শরদিন্দু স্মৃতি-সংখ্যায় লিখে আসছেন। তাঁর প্রকাশিতব্য গল্প সংগ্রহ ‘আড্ডা আনলিমিটেড’ ও ‘বরাহ-নন্দন ও অন্যান্য গল্প’- দুটিই এখন যন্ত্রস্থ।