প্রোফাইল ফটো
শম্পা চক্রবর্তী
শুরু থেকেই শুরু করা যাক। হেডস্যার বললেন দুবছর পর অফলাইনে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে। স্বাধীনতা ৭৫।সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয়। দক্ষিণ কলকাতার এই বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটির সি বি এস সি বোর্ড। মহামারীর সময়ের অনলাইন বিভীষিকা কাটিয়ে এবার সশরীরে উৎসব পালন করা হবে। সবাই যেন কোমর বেঁধে কাজে নামে।
কোভিডের আগেই ড্রামা ক্লাব্ তৈরী হয়েছে। সুকান্ত স্যার উত্তর বাংলার একটি মিশনারি স্কুলের ড্রামা টিচারের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর এই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। গত দুবছর সব অনুষ্ঠান অন লাইন হয়েছে। এবার এই দিনটিতে যেন পুষিয়ে নেওয়া যায়। সুকান্ত স্যারের উৎসাহ,উত্তেজনা,দায়িত্ব-সব কটি জিনিস অন্যান্যদের চেয়ে একটু বেশি। সদাহাস্যময় মানুষটির শিশু- কিশোরদের দিয়ে নাটক করানোর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার নিদর্শন পাওয়া যাবে এবার।
ইন্টারনেটের কল্যাণে বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্বকে চিনতে শিখেছে, অথচ নিজেদের চারিপাশের অনেক কিছু তাদের অজানা থেকে যাচ্ছে। হেডস্যার বললেন বিদ্যালয়ের চারপাশের রাস্তা যাঁদের নামে, সেই স্মরণীয় ব্যক্তিদের চিনুক ছাত্ররা। সেই মত চিত্রনাট্য তৈরি করা হোক। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। যে রাজপথটি ধরে সোজা হাঁটলে বিদ্যালয়ের সদর দরজায় পৌঁছনো যায়,তার নাম হরিশচন্দ্র মুখার্জী রোড।
ইতিহাসের বীণা ম্যাডাম,বাংলার দীপিকা ম্যাডাম আর সুকান্ত স্যার এক সঙ্গে বসে লিখে ফেললেন নাটকের খসড়া যার মুখ্য চরিত্রের নাম হরিশচন্দ্র মুখার্জি। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের নাটক কলেবরে বড় হয়না। স্বদেশ প্রেমের ভাবনাটাই আসল।
হরিশচন্দ্র মহাশয়ের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর হিন্দু পেট্রিয়টের নাম। আর আছে তদানীন্তন কালের নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও নীলচাষীদের দুর্দশার কাহিনি। ছোট একটা চিত্রনাট্য তৈরি করা হল। চরিত্র গুলি হল সাংবাদিক হরিশচন্দ্র,অত্যাচারী নীলকর সাহেব,দয়ালু সাহেব,নীলকর চাষী আর নাচে,গানে,ছন্দে গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একদল সূত্রধর।
বছরের শুরুতে যে প্ল্যানার তৈরী হয় তাতে উল্লেখ করা আছে যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্ররাই স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে যোগদান করবে। সি বি এস সি পাঠ্যক্রমে ওই বয়সী ছাত্রদের ইতিহাসের এই দিকটা পড়ান হয় না। ভালোই হলো। উৎসব উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে ঊনবিংশ শতকের বাংলার ইতিহাসের একটা দিক জানা হবে।
সুকান্ত স্যার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উৎফুল্লতায় যন্ত্রানুষঙ্গ ও পোষাকের ভাবনাও ভেবে রেখেছেন। বিষয় ইতিহাস হলেও উপস্থাপনায় যেন আধুনিকতার ঘাটতি না থাকে। আই টি টীমের সঙ্গে বসে ব্যাক্ ড্রপ্ বুঝিয়ে দিতে হবে।
জোর কদমে মহড়া শুরু হল। টানা দুবছরের অনলাইন- যন্ত্রণার অবসান। স্বাধীনতা দিবস সশরীরে পালন করা হবে। অভিভাবকদের মুঠোফোনে এই সুখবর ছড়িয়ে পড়ল,হোয়াটস্ এ্যাপ্ গ্রুপের মাধ্যমে। সবার সহযোগিতা আশা করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সমস্যা শুরু মহড়া শুরুর দিন তিনেকের মধ্যে। অভিভাবকদের হোয়াটস্ এ্যাপ্ গ্রুপ ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠল। যে সব ছাত্রদের অনুষ্ঠানের জন্য বাছাই করা হয়েছে তাদের যোগ্যতা কী বেশি? যারা বাদ পড়ল, এই উৎসবে তাদের ভূমিকা কী! এমনিতেই মহামারীর দুবছর কেউ কোন সুযোগ পায়নি।
মুঠোফোনের বোতামগুলো ক্রীতদাসের অধম। শুধু মৃদু স্পর্শের অপেক্ষা। মুহুর্মুহু মনের কথা গুলোকে টেনে দাঁড় করায় সভার মাঝে। মেসেজের পর মেসেজ জুড়ে অচিরেই বিরাট এক বিক্ষোভের আকার নিল। স্ক্রিন শটের মালা পৌঁছল হেডস্যারের মুঠোফোনে। চিন্তার রেখা তাঁর কপালে। নন পার্টিসিপেন্টসদের মধ্যে কেউ যদি এই ইস্যুতে টি সি চেয়ে বসে;মালিকপক্ষ কে কি জবাব দেবেন উনি! ছাত্রসংখ্যার উপরে নিয়ন্ত্রণ হারানোর চেয়ে ব্যর্থতা আর কী আছে!
সার্কুলার এল যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর সব ছাত্রদের মঞ্চে নামার সুযোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। সেইমত চিত্রনাট্য পরিবর্তনের হুকুম হলো।
এবার দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ সুকান্ত স্যারে’র কপালে। নীলচাষী কিংবা নীলকর সাহেবদের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। বেচারী হরিশচন্দ্র মহাশয় তো একজনই। বঙ্গবাসীর পরম পরিত্রাতা রবিঠাকুরেররও সেই সময় জন্ম হয়নি। দু চারটি পরিচিত গান ও নৃত্য দিয়ে পার্টিসিপেন্ট সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই।
নতুন করে চিত্রনাট্য লেখা শুরু হল ; মূল ভাবনা বজায় রেখে। ওদিকে হোয়াটস্ এ্যাপে যুদ্ধ ভেরী বেজেই চলেছে। অদৃশ্য সেই ঢেউয়ের আঘাতে টলমল হেডস্যারের অস্তিত্ব।
এই কয়দিনের মহড়ায় যে সব শিশু শিল্পীরা ধীরে ধীরে চরিত্রে প্রবেশ করছিল তাদের যাত্রায় ছেদ পরল। পরিবর্তিত চিত্রনাট্যে তাদের ভূমিকা বদলে যাবে যে!
বীণা ম্যাডামকে ধরে ওই সময়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়দের জীবনীর অংশ চিত্রনাট্যে যুক্ত করা হল। চিত্রনাট্যের আয়তন বাড়ল। চরিত্রদের ভীড় বাড়ল। এতকিছু সামলাতে গিয়ে হরিশচন্দ্র মহাশয় ও তাঁর হিন্দু পেট্রিয়টের গুরুত্ব কমতে থাকল। একদল নীলচাষীর ভূমিকায় নির্বাচিত যে সব ছাত্ররা মহড়ায় উপস্থিত হচ্ছিল, তাদের বড় বেমানান লাগতে লাগল।
প্রতিদিনের মহড়ার কয়েকটি স্থির চিত্র ও ভিডিও পাঠাতে হবে অভিভাবকদের হোয়াটস্ এ্যাপ্ গ্রুপে। হেডস্যারের নির্দেশ। দুশো চল্লিশ জন অভিভাবকের মুঠোফোনে ভেসে উঠছে মহড়ার খুঁটিনাটি। কমপক্ষে সত্তর-আশিটা মন্তব্য আসছে প্রতিদিন। নির্ভেজাল উৎসাহদাতাদের চেয়ে পরামর্শদাতারা দলে ভারী। কী হয়নি,কী হলে ভালো হত,কী হওয়া উচিত ছিল ইত্যাদি।
আদ্যন্ত শিল্পী মানুষ সুকান্ত স্যার সকলকে অনুরোধ করলেন যাবতীয় বাইরের প্রভাব অগ্রাহ্য করে কাজে মন দিতে। কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলেন প্রতিটি মন্তব্য পড়ে দেখতে। অভিভাবক সমূহ আদতে শুধু ক্লায়েন্ট নয়,ক্লায়েন্টের বাবা।
প্রায় প্রতিদিনই একটু আধটু বদল হতে থাকল চিত্রনাট্য,গান,যন্ত্রানুষঙ্গ। অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য এই যে সবাই যেন খুশী থাকে। সবাই অর্থাৎ ওদিকের সবাই। যাঁদের ইনভেস্টমেন্টে লালিত হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যালয়ের জীবিত ও নির্জীব উপাদানগুলো।
প্রথমদিকে পরিবর্তনের ঝাপটায় কাতর হত শিল্পীরা। কিছুদিনের মধ্যে তারা বুঝে গেল যে সঠিক বলে কিছু নেই। আজ যা শিখলাম তা শুধু আজকের জন্য ঠিক। কাল পাল্টে যেতেও পারে। কোন কিছুর মধ্যে তারা আর তেমন করে প্রবেশ করছে না। সুকান্ত স্যারের সহকারীরা এক একটি সিন্ তৈরি করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন,’এটা থাকছে তো!’ অন্তরে পরাধীনতা নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি চলছে। এই অস্বস্তি কিসের দান! মহামারীর নাকি বিজ্ঞানের?
বিদ্যালয়ের মাঠে,যেখানে পতাকা উত্তোলন হবে,তারই পাশে ‘কালচারাল প্রোগ্রাম’ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। অনুষ্ঠানের আয়তন বেড়ে যাওয়ায় ঠিক হল যে নাটক হবে বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে। পতাকা উত্তোলন ও সামান্য জলযোগের পর সম্মানিত অতিথিরা প্রেক্ষাগৃহে আসন গ্রহণ করবেন।
নির্দিষ্ট সময় শুরু হল অনুষ্ঠান। স্বাধীনতা ৭৫।
দর্শকরা সবাই শিল্পীদের অভিভাবক। মঞ্চে শিশু শিল্পীদের দেখার আনন্দ আর উত্তেজনায় ঝলমল করছে পরিবেশ। যদিও ‘স্টেজ রিহার্সালে’র ভিডিও দেখেছেন সবাই। যেমন চাওয়া হয়েছিল তেমনটিই হচ্ছে সব।
ক্ষুদে সূত্রধরদের হাত ধরে সময় পিছিয়ে গিয়ে মঞ্চে হাজির হল এক টুকরো ইতিহাস।
খালি চোখে দেখলেন কেউ কেউ। বেশিরভাগ দর্শকই ক্যামেরা দিয়ে দেখলেন। অনেক অনুরোধ করেও ক্যামেরা বন্ধ করানো গেল না। দর্শকদের আসনে বসিয়ে রাখার চেষ্টাও প্রায় ব্যর্থ হল বলা যায়। মঞ্চের সামনে ক্যামেরাধারীদের ভীড়- বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ফটো তোলা হচ্ছে এই ঘোষণার পরও।
নির্বিঘ্নে শেষ হল সোয়া এক ঘণ্টার সফর। দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে মুখরিত প্রেক্ষাগৃহ। সুকান্ত স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। একটি গ্রুপ ফটোর অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না। কুশীলবরা স্যারকে ঘিরে দাঁড়াল। হাসি হাসি এক ঝাঁক উজ্জ্বল মুখ। জোড়া জোড়া আঙ্গুলে বিজয়ের সংকেত। রেডি? সে চীজ। ক্লিক্। ক্লিক। ক্লিক। ক্লিক।
শেষের তোলা এই ফটোটাই এখন অভিভাবকদের হোয়াটস্ এ্যাপ্ গ্রুপের প্রোফাইল ফটো। এতগুলো হাসি মুখের মাঝখানে স্যার এত গম্ভীর কেন। ক্লান্তি,নিরুৎসাহ,নাকি প্রতিবাদ!
************************************
শম্পা চক্রবর্তী পরিচিতিঃ-
লেখিকা আপাতত গুরগাঁও বাসী। জন্ম,বেড়ে ওঠা,পড়াশোনা কলকাতায়। ৩০বছর একটানা এখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার পর স্বামীর কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রবাসী হয়ে ওঠা। শখ বলতে বারান্দা বাগান,বই পড়া,সিনেমা দেখা।