মুখ, শুধু মুখ
দেব মুখার্জী
সচ্চা কোই সপনা হোতা
মুঝকো কোই আপনা হোতা
আনজানা সা, মগর কুছ পহেচানা সা…
ধীর লয়ে গানটা বাজছে…রেশমী সোমুকে চিনতে না পেরে চলে গেল…টয় ট্রেনে চড়ে…কালো স্টীম ইঞ্জিনটা সাদা সাদা ধোঁয়া ছেড়ে হুশহাশ শব্দ তুলে মিলিয়ে গেল সামনের পাহাড়ের ঢালে…সবুজ গাছগাছালির ভেতরে…মেঘের আড়ালে…একরাশ মনখারাপ ছড়িয়ে দিয়ে।
সালটা বোধহয় ১৯৮৩…কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে আমি তখন…বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি রেলস্টেশনটা…বোধহয় রামনগর লেখা ছিল বোর্ডটায়…আজ লিখতে বসে মনে পড়ছিল…বড় মনে ধরেছিল সেই পাহাড়ী শহরটা, ছোটো স্টেশনটা…ছোটো ট্রেনটা…ভেবেছি একবার যদি সেখানে যাওয়া যায়।
অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে সেইদিনটা থেকে… ভুলেই গেছি রামনগর স্টেশনটার কথা, সেই টয় ট্রেনটার কথা। কিন্তু আজ… কুন্নুরের ছোট্ট স্টেশনে পৌঁছে চারিদিক তাকিয়ে দেখি … পুরোনো স্টেশন বিল্ডিংটা… পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন… বড়ই সুন্দর… … অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে হয়তো স্টেশন ঘিরে। ঢোকার মুখে দেওয়াল জুড়ে লেখা…” নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে”… জেনেছি ২০০৫ সাল থেকে ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট… এই রেলওয়ে।
প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে… দেখি সামনে লেখা… কুন্নুর – উদাগামন্ডলম … ঘড়ির দিকে তাকাই…ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে এখন, প্ল্যাটফর্ম ধরে পাশে পাশে হাঁটি… মেলাতে চেষ্টা করি সেইদিনের দেখা ছবিটার সঙ্গে… দেখি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছুই… কোচ… ইঞ্জিন… প্ল্যাটফর্ম। একটু দূরে সাজিয়ে রাখা পুরোনো ইঞ্জিনটা… সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
প্ল্যাটফর্ম জুড়ে নানান মানুষ… অধিকাংশই পর্যটক…মাইকে ঘোষণা হয়… তামিল, হিন্দি আর ইংরেজিতে… দরজা খুলে দেয় রেল কর্মচারীদের কেউ… উঠে বসি… প্রতি কোচেই একজন গার্ড সাহেব সামনে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে… উনি এসে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
একঘন্টার কিছু বেশি যাত্রাপথের সময়সীমা… পাহাড়ি রেলপথে চড়াই উৎরাই বেয়ে ট্রেনের যাত্রা শুরু… বেশ ঠান্ডা… জানলা দিয়ে কনকনে হাওয়ার দাপটে অনেকে বন্ধ করছেন জানলা… সবুজ গাছপালা, কখনও হাল্কা বৃষ্টি কখনও রোদ…কখনও মেঘের দল চোখের সামনে ভাসছে।
একটা ছোট্ট ষ্টেশনে এসে ট্রেনটা দাঁড়ায়…ওয়েলিংটন…জানলা দিয়ে এতোক্ষণ বাইরে দেখছিলাম এবার কামরার ভেতরে তাকাই… প্রায় সকলের হাতে মোবাইল। ছবি তুলতে ব্যস্ত অনেকে, কেউ কেউ কানে লাগিয়ে…কথা বলছেন…কেউ ব্যবসা সামলাচ্ছেন ফোনে… উচ্চস্বরে… পেটিএম করতে বলছেন কাউকে… বাচ্ছাগুলো গেমস খেলছে, কেউ কেউ চিপস খাচ্ছে…সামনে নবদম্পতি মোবাইলে সেলফি স্টিক লাগিয়ে দুলফি তুলছে…সামনের দিকে কলেজ পড়ুয়া কয়েকটা মেয়ে নেচে চলেছে…আবার থামছে আবার নাচছে…এখন আমি এসব দেখে অভ্যস্ত, শিখে গেছি…রীল বানাচ্ছে এরা। না প্রকৃতি পাঠে বিশেষ নজর নেই কারোর।
আবার জানলার বাইরে তাকাই বড় বড় গাছ ইউক্যালিপটাস… এরই অপর নাম নীলগিরি…পাহাড়ের গা বেয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে একেবারে ঋজু…সটান…আকাশ ছুঁয়েছে…এলোমেলো হাওয়ায় পাতাগুলো শব্দ করে নেচে বেড়াচ্ছে, পাইন গাছ চোখে পড়ছে আরও কতো গাছ…নাম না জানা…শব্দ করে ট্রেন চলছে দুলতে দুলতে…পাহাড়ের ঢালে সবুজ চা বাগান। নানান রঙে রঙিন বাড়িগুলো…খেলনার মতো মনে হচ্ছে দূর থেকে… একটা স্টেশন আসছে আবার দেখতে পাচ্ছি…আরাভানকাডু… ঠিকঠাক লিখলাম তো…কে জানে…অপর দিক থেকে একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায়…পাশাপাশি…সামনের কোচ থেকে বাচ্চাগুলো হাত নাড়ছে… এমন সময় টিটি সাহেব আসেন টিকিট চেক করতে…পকেট থেকে মোবাইল বার করে সেভ করা টিকিটটা দেখাই…আর তারপর জানলা দিয়ে হাত বার করে বাচ্চাগুলোর সঙ্গে মেতে উঠি। কয়েকদিন আগে ওয়াটস অ্যাপে পাওয়া চারটে লাইন মনে পড়ে…গুলজার সাহেবের লেখা…
উমরোনে তলাশি লি
তো জেব সে লমহে বরামদ হুয়ে
কুছ গম কে থে , কুম নম থে, কুছ টুটে
বস্ কুছ হি সহি সলামত মিলে
যো বচপন কে থে ৷
************************************
খুঁজে ফেরে বয়স – জীবন যখন
পেল সঞ্চয় – কটা মুহূর্ত তখন
কিছুটা দুঃখ, কিছু জলে ভেজা,
কিছু ভঙ্গুর – যেন কাঁচের কাঁকন।
সামান্য কিছু – আগেরই মতন
সে তো ছেলেবেলা – দামী সে রতন।
অনুবাদ- কল্যাণশঙ্কর দা।
*************************************
ট্রেন আবার চলতে শুরু করে … আমি আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে। সম্বিত ভাঙে
টিটি সাহেবের প্রশ্নে…”কোথায় যাবেন? ”
বলি…”উটি”…বলেন “টিকিটটা তো কেটটি অবধি”…ভুল হয়েছে স্বীকার করতে উনি মৃদু হেসে টিকিট এক্সটেন্ড করে দেন। আমি জানলা দিয়ে দেখি ছোট্ট হিল টাউন…কেটটির প্ল্যাটফর্মে…ট্রেনটা ঢুকছে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এল… পুরোনো স্টেশন বিল্ডিংটা…সদ্য রঙ হয়েছে বোধহয়…স্টেশনে লোকজন কেউ বিশেষ নেই, তাই নামা ওঠার কোনো প্রশ্ন নেই…ট্রেন ছাড়তেই টিটি সাহেবকে জিজ্ঞেস করি এরপর কি স্টেশন…বললেন…লাভডেল আর তারপর শেষ স্টেশন উটি।
তাহলে রামনগর…প্রথমে ভাবি হয়তো নাম বদলের হিড়িকে হয়তো বদলে গেছে তারপর ভাবি ঠিক দেখেছিলাম তো সেদিন…এতোদিন পর…আজকাল সব ঠিকঠাক মনে রাখা মুশকিল….ট্রেন চলছে…মাঝে মাঝে টানেল… ভেতরে ঢুকছে ট্রেনটা আর অন্ধকার হয়ে পড়লেই সমবেত ধ্বনি… হোওওওওওও… এই ভাবে বেশ কয়েকটা টানেল পার হয়। আর তারপর ট্রেন এসে দাঁড়ায় লাভডেল স্টেশনে।
এখন আমি অনেকটাই ডিজিটালি লিটারেট…গুগল ঘেঁটে জেনে ফেলেছি…সিনেমার সেই দৃশ্যটার শুটিং হয়েছিল কেটটিতে…ভুল করে কেটটির টিকিটটাই তো কেটেছিলাম…কি আশ্চর্য…আর ঠিক তখনই কেটটিতে বৃষ্টি পড়ছিল।
বৃষ্টিতে ভিজে চেষ্টা করছিল সোমু … মনে পড়াতে, জলকাদা মাখা চেহারায় নানান অঙ্গভঙ্গী করে চেষ্টা করছিল … রেশমীকে ফিরে পেতে … আমি আবার সেই ফ্ল্যাশব্যাকে।কারোর মোবাইল বেজে ওঠে … বাস্তবে ফিরি আমি… নতুন ধরণের রিংটোন…আগে শুনিনিতো এটা …
…হল্কী হল্কী সী বরসাত আ গয়ী
হল্কী হল্কী সী বরসাত আ গয়ী
ও মাহী তেরী ঈয়াদ বেহিসাব আ গয়ী
হল্কী হল্কী সী বরসাত আ গয়ী…
(মুনাওয়র ফারুকী)
সামনে বসে থাকা নবদম্পতি ছেলেটি ফোন ধরে … মেয়েটি বিরক্ত দেখে কেটেও দেয়… আর তারপর ছেলেটি আমায় অনুরোধ করে জানলার ধারের সিটটা ছেড়ে দিতে… আমি সরে বসি… সামনের খোলা জানলা দিয়ে মেয়েটি বাইরে মুখ বাড়ায়… অপর জানলা দিয়ে ছেলেটি মুখ বার করে মোবাইলে প্রেয়সীর ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মেয়েটি ফ্লাইং কিস দিচ্ছিল… আমি সামনে বসে হাঁ করে দেখছিলাম… একটু অস্বস্তি যে হচ্ছেনা তা নয়… তবে বেশ লাগছিল …ছেলেটার কানে কানে বলি ফ্লাইং কিসগুলো নষ্ট হচ্ছে… তুই যদি …না ধরিস … না দিস … তাহলে জানলা দিয়ে উড়ে আসা দু একটা কিস আমি ধরে…
আধুনিক প্রজন্ম বড়ই স্মার্ট… তাড়াতাড়ি মেয়েটির পাশে গিয়ে বসে সে… আমার হাতকে ঠোঁটের সংযোগ থেকে বিরত করতে মোবাইলটার ক্যামেরা অন করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়… আমি মৃদু হেসে যুগলের ছবি তুলে দি বেশ কয়েকটা।
“থ্যাঙ্কস আঙ্কেল”… শুনে বুঝি মাথার বেঁচে থাকা চুলগুলো রোদ্দুর লেগে সাদা হয়নি… মেয়েটি হাসে |
আমি হাসি… তারপর জানলা দিয়ে বাইরে মুখ বের করে আমার মোবাইলটা এগিয়ে দি…এবার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার একটা ছবি তুলে দেয়।
এতোদিন বাইরে বাইরে ঘুরছি… আমায় আবার ভুলে গেলনাতো… মাথায় তখনও… রেশমী আর সমু … তক্ষুণি ছবিটা ওকে ফরোয়ার্ড করি… পরক্ষণেই উত্তর আসে চলন্ত ট্রেনে জানলার বাইরে মুখ বার করেছো কেন… বোঝো… পরক্ষণে মাথা ভেতরে করে আরেকটা ছবি পাঠাই। তবে এর উত্তর আর আসেনা।
ইতিমধ্যে ট্রেন উটিতে এসে থেমেছে…স্বল্প পথের সহযাত্রীরা কেউ কেউ মৃদু হেসে হাত নাড়ে বা হাত মিলিয়ে বিদায় নেয়… আমিও প্রত্যুত্তর দিই।
উটি থেকে এই ট্রেনটা আবার কুন্নুরের দিকে ছাড়বে… আবার এক ঝাঁক মানুষজন… প্ল্যাটফর্মে ভিড় করেছে… ছবি তুলছে প্রায় সকলেই… সুখস্মৃতি… সামনে তাকিয়ে দেখি ট্রেনের দরজা থেকে হাত বাড়িয়ে একটি ছেলে… প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির হাত ধরেছে… একেবারে সিনেমার ঢংয়ে রাহুল আর সিমরণ। লোকজন তাকিয়ে দেখছে তাদের সেদিকে নজর নেই।
আমি একটা বেঞ্চে বসে ওদের দিকে দেখি আর তারপর উটি স্টেশনটার চারদিকে চোখ ঘোরাই। মনের ভেতর কে যেন বলে উঠে … কেমন লাগল জার্নিটা… ১৯৮৩ থেকে মনে মনে ভেবে এই ২০২২ এ গন্তব্যে পৌঁছে… রেশমী আর সমু থেকে রাহুল আর সিমরণ…
আমি একটু থমকাই… ভাবি এই দীর্ঘ পথের সফরে গন্তব্য তো শেষকথা নয় … এতোশত মানুষের সাহচর্য… সেটাতো কম কিছু নয়।
ওয়াটসয়্যাপে পাওয়া দুটো লাইন মনে পড়ে… বিড়বিড় করি
Which is more important asked the pupil …The journey or the destination
“The Company”… said the Teacher.
তোমরা দেখ অরণ্য পাহাড়
নীল সে সাগর, নদী ক্ষুরধার।
যেখানেই যাই, সেখানেই পাই –
মুখ মুখ শুধু মুখ
সেটাই আমার সুখ।
চেনা অচেনা মুখের ভীড়
তাই আনন্দ, শান্তির নীড়।
(কল্যাণশঙ্কর দা)
ট্রেনটা উটি ছেড়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেল … আমি এবার বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াই দেখি সামনে লেখা… I OOTY … গুনগুন করে উঠি…
তেরা সাহারা মিল গয়া হ্যায় জিন্দেগী
তেরা সাহারা মিল গয়া হ্যায় জিন্দেগী
ইয়ে জিন্দেগী গলে লাগা লে
ইয়ে জিন্দেগী গলে লাগা লে …….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-
আজকে যুগলবন্দী… লেখাটার নামকরণ, বাংলা কবিতাটা আর হিন্দি কবিতার অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন কল্যাণশঙ্কর দা। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা ওঁকে।
কাহিনীর শুরু আর শেষের গানের কথাগুলো সদমা সিনেমার … লেখাটার শুরু এখান থেকেই ।
******************************************
লেখক পরিচিতি
চন্দননগরের দেব মুখার্জি,কর্মসূত্রে প্রবাসী বহুদিন ধরে। ভ্রমণ ছিল তাঁর পেশার অঙ্গ। এখন নেশায় দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজে অকাজে ঘুরে বেড়িয়ে,সেই পথ চলার কিছু কথা,পথচলতি মানুষের কথা–অল্প কয়েক বছর আগে শখ করেই লিখেছিলেন ফেসবুকে। সেই লেখা পছন্দ করেন অনেকেই। লেখা চালিয়ে যেতে বলেন। উনি আর থামেন নি। মাঝে মধ্যে কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন,ই–বুক বা সংকলনগুলোতে কিছু লেখা ছাপাও হয়। সবাই প্রশংসা করে। ফেসবুকে পরিচিতি পেয়েছেন,ধারাবাহিক ভাবে লিখে গেছেন কয়েকটি ফেসবুক গ্ৰুপে দীর্ঘদিন। আজও তিনি নিয়মিত লেখেন ফেসবুকে তাঁর টাইমলাইনে। এবার বই হোক,মলাটবন্দী হোক সৃষ্টিগুলো–বন্ধু বান্ধব,পাঠক পাঠিকা আর শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধ,আবদার ছিল দীর্ঘদিনের। জনপ্রিয় কয়েকটি লেখা বেছে দিয়েছিলেন তাঁরাই। ছাপা অক্ষরে দেব মুখার্জীর প্রথম প্রচেষ্টা ‘পাড়ি‘। আশা রাখি ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক অপরিচিতই কাছের মানুষ হয়ে উঠবেন ওনার জীবনমুখী অরণ্য প্রেমের ছোঁয়ায়।