গোপালচরিত
অনির্বাণ সাহা
গুপ্তিপাড়া হল ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার অন্তর্গত অতি প্রাচীন একটি জনপদ। অতি প্রাচীন কাল থেকেই গুপ্তিপাড়া রথের জন্য ভারতবর্ষের মধ্যে একটি বিশেষ নাম। এই অঞ্চলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু,মুসলিম এবং বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস দেখতে পাওয়া যেত। আবার শাক্ত ধর্মাবলম্বী মানুষদেরও এখানে দেখতে পাওয়া যেত। এহেন গুপ্তিপাড়ার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় বেশকয়েকটি প্রাচীন গ্রন্থে এবং সত্যনারায়ণ কথনে। সেগুলি হল নিম্নরূপঃ
১৬০০ সালে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম লেখেন:
‘বাহ বাহ বল্যা ঘন পড়ে গেল সাড়া
বামভাগে শান্তিপুর,ডাইনে গুপ্তিপাড়া’।
১৭০০ শতকে বিজয়রাম সেন কর্তৃক লিখিত “তীর্থমঙ্গল” কাব্যগ্রন্থে তৎকালীন গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ।
আবার দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে :
‘অম্বিকা পশ্চিম পাড়ে,শান্তিপুর পূর্ব ধারে
রাখিল দক্ষিণ গুপ্তিপাড়া;
উল্লাসে উলার গতি,বটমূলে ভগবতী
চন্ডিকা নহেন যথা ছাড়া।’
এছাড়াও সত্যনারায়ণ কথাতেও এই স্থানের উল্লেখ রয়েছে :
“ত্যজিয়া কুবজপুর সাধু গুণনিধি।
নবদ্বীপ রহে পাছে আর খড়ে নদী।।
গুপ্তিপাড়া ডাহিনে রইল বহুদূর।
বামেতে রহিল গ্রাম নাম শান্তিপুর।।”
সুতরাং এই স্থানটির প্রাচীনত্ব,বর্ধিষ্ণুতা এবং গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। আর এই গুপ্তিপাড়া শহরের সাথে জড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নাম। তাদের মধ্যেই অন্যতম একজন হলেন গোপাল ভাঁড়।
গোপাল ভাঁড় ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও চরিত্রবান এক ব্যক্তি। সর্বোপরি গোপাল ভাঁড়ের বাকচাতুর্য শক্তি,সমাজনীতি,রাজনীতি ও রসালাপ তাকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করায়। গোপাল ভাঁড়ের প্রকৃত বা পারিবারিক নাম ছিল গোপালচন্দ্র নাই। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের তৎকালীন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজদরবারে উপস্থিত পঞ্চরত্ন সভার এক মুখ্য ও অন্যতম সদস্য। অথচ রাজ পরিবারের তথ্য থেকে গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে সেরকমভাবে কোনো তথ্য বা নথি খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এই কারণেই প্রশ্ন ওঠে গোপাল ভাঁড় কি রক্ত-মাংসের কোন মানুষ নাকি শুধুই মিথ?? গোপাল ভাঁড় ও গুপ্তিপাড়া সম্পর্কে কিছু বলার আগে গোপাল ভাঁড়ের পারিবারিক পরিচিতিটা আমাদের একটু জানা দরকার ।
গোপাল ভাঁড়ের দাদা কল্যানচন্দ্র নাই মহাশয়ের পরিবারের নবম উত্তর পুরুষ শ্রী নগেন্দ্রনাথ দাস প্রণীত “নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়” নামাঙ্কিত বইটি থেকে জানা যায় যে,গোপাল ভাঁড়ের আদি বা পৈত্রিক বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদে। এই পরিবারের আনুমানিক প্রথম পুরুষ হিসেবে “আনন্দরাম নাই” নামক এক ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। তিনি সম্পর্কে গোপাল ভাঁড়ের ঠাকুরদা ছিলেন। জাতিতে ছিলেন নাপিত। আনন্দরাম নাই তৎকালীন সময়ে এক পরম তান্ত্রিক সাধক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এমনকি তৎকালীন সময়ে তার নিজ বাড়িতে তিনটি চন্ডালের মস্তকের ওপর ত্রিকোণবিশিষ্ট গৃহে আনন্দময়ী কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিনের বেশিরভাগ সময়ই এই দেবী আরাধনায় তিনি মগ্ন থাকতেন। আবার ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন তৎকালীন বাংলা,বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খাঁ বাহাদুরের এক সুনিষ্ঠ জায়গীরদার। আনন্দরাম নাই মহাশয়ের সুযোগ্য পুত্র ছিলেন দুলালচাঁদ নাই। তিনি ছিলেন আলিবর্দী খাঁ বাহাদুরের রাজসভার একজন বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক এবং বৈদ্য। আবার পিতা আনন্দরামের মতো তন্ত্রসাধনাতেও বেশ মনোযোগ ছিল তার। তিনি শল্য চিকিৎসা ও তন্ত্রসাধনার মধ্যে অদ্ভুত এক মেলবন্ধন করেন। চিকিৎসাবিদ্যায় তিনি তন্ত্র সাধনার প্রয়োগ করতেন তৎকালীন সময়ে। জানা যায় যে,আলিবর্দী খাঁয়ের নাতি সিরাজউদ্দৌলা কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে দুলালচাঁদ মহাশয় তার তন্ত্র ও শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলেন। এই কারণে তিনি আলিবর্দী খাঁয়ের কাছে তার সভাসদদের মধ্যে বিশেষ প্রিয় পাত্রও ছিলেন।
দুলালচাঁদ নাই মহাশয়ের দুই পুত্র ছিল। জেষ্ঠ পুত্রের নাম কল্যানচন্দ্র নাই এবং কনিষ্ঠ পুত্রের নাম গোপালচন্দ্র নাই। পারিবারিক সূত্রে গোপাল ভাঁড় ছিলেন জাতিতে ‘নাপিত’। আবার কোনো কোনো গবেষক গোপালকে চিহ্নিত করেছেন কায়স্থ হিসেবে। প্রাথমিকভাবে তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অন্তঃপুরের ভান্ডারের তত্ত্বাবধায়ক। তৎকালীন সময়ে ভান্ডার তত্ত্বাবধায়কদের বলা হত “ভান্ডারি”। তাই গোপাল চন্দ্র নাই থেকে তাঁর পদবি হয়ে গেল “ভান্ডারি”। “ভান্ডারি” থেকে আরও পরে তার বাকচাতুর্য শক্তি ও রসালাপের নিপুনতার জন্য তাকে “ভাঁড়” বলে সম্মোধন করা হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে,তিনি বাস করতেন কৃষ্ণনগরে। “বাঙ্গালা ক্ষিতীশ বংশালী” গ্রন্থ থেকে জানা যায় গোপাল ছিলেন শান্তিপুরের বাসিন্দা। লোকমুখে কথিত আছে,তাঁর বাড়ি ছিল ঘূর্ণী শহরে। আবার নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত “বিশ্বকোষ” গ্রন্থে পাওয়া যায় যে,গোপাল ভাঁড়ের বাড়ি ছিল গুপ্তিপাড়া এলাকায়। আবার “এই সময় GOLD”-এ প্রকাশিত সুমনা চক্রবর্তী কর্তৃক লিখিত “গুপ্তিপাড়ার গুপ্তকথা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী ও হাস্যরসিক বিদূষক গোপাল ভাঁড়ের শ্বশুরবাড়ি ছিল এই গুপ্তিপাড়াতে। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন নথি এবং কোন বইতেই গোপাল ভাঁড়ের স্ত্রীর নামের কোন উল্লেখ অদ্ভুতভাবে পাওয়া যায় না। তবে নগেন্দ্রনাথ দাসের বইটি থেকে জানা যায় গোপালের একটি পুত্র এবং একটি কন্যা ছিল। গোপালের পুত্রের নামও পাওয়া যায় না। খুব অল্প বয়সেই গোপালের পুত্র পরলোক গমন করে। গোপালের কন্যার নাম ছিল রাধারানী। রাধারানীর দুই পুত্র ছিল রমেশ এবং উমেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এরপরেই গোপাল ভাঁড়ের পরিবারের প্রত্যক্ষ আর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
তবে এ ব্যাপারে বলে রাখা ভালো নগেন্দ্রনাথ দাস নিজেকে বংশপরিচয় এবং প্রমাণাদি সহ গোপাল ভাঁড়ের দাদা কল্যানচন্দ্র নাইয়ের নবম উত্তরপুরুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি গোপাল ভাঁড় তথা নিজেদের বংশের একটি বংশতালিকাও প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও যুক্তিবাদীদের মতে,গোপাল ভাঁড়ের পারিবারিক পদবী যদি “নাই” হয় তাহলে নগেন্দ্রনাথের পদবী “দাস” কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত “প্রথম আলো” ওয়েবপেজ থেকে। উক্ত ওয়েবপেজে ১৩ই এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত আলতাফ শাহনেওয়াজ কর্তৃক লিখিত “গোপাল ভাঁড় কে ছিলেন?” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,নগেন্দ্রনাথের বর্তমান প্রজন্ম বর্তমানে কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাধাপ্রসাদ লেনের বাসিন্দা। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী “নগেন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর পারিবারিক পদবি পরিবর্তন করেছিলেন”।
তথ্যসূত্র :
— নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত “বিশ্বকোষ” গ্রন্থ।
— শ্রী নগেন্দ্রনাথ দাস প্রণীত “নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়” পুস্তক।
— “হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ” (দ্বিতীয় খন্ড)-সুধীর কুমার মিত্র।
— “এই সময়GOLD”-এ প্রকাশিত সুমনা চক্রবর্তী কর্তৃক লিখিত “গুপ্তিপাড়ার গুপ্তকথা” শীর্ষক প্রতিবেদন।
— “অবেক্ষণ” ওয়েবপেজে ৯ই অক্টোবর,২০১৮ তারিখে প্রকাশিত প্রকাশিত পলাশ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত “গুপ্তিপাড়ার গুপ্ত কথা” শীর্ষক প্রতিবেদন।
— “প্রথম আলো” ওয়েবপেজে ১৩ই এপ্রিল,২০১৮ তারিখে প্রকাশিত আলতাফ শাহনেওয়াজ কর্তৃক লিখিত “গোপাল ভাঁড় কে ছিলেন ?” শীর্ষক প্রতিবেদন।
— উইকিপিডিয়া ওয়েবপেজ।
**************************************
অনির্বাণ সাহা (ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক)