গুসকরার ঐতিহ্যমন্ডিত চোংদার পরিবারের মা কালী এবং দুর্গাপূজার মহিমা
জয়িতা সরকার
কালীপুজোর দিন আমার চোংদার পরিবারের কালীর কথা মনে পড়ে। ফোনের গ্যালারি থেকে ছবি বের করে দেখি সাধারণ ক্যামেরায় তোলা মায়ের সান্ধ্য আলো-আঁধারি রূপ। কৃষ্ণবর্ণ মাতৃমূর্তি। তা হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর। তখন ওখানে গিয়ে কিছু বিষয় জানতে পারি।সেসব আমার গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে বেশ। দু-চারজন মানুষের সঙ্গে দেখা বা কথা হবার পরেও কিছু বিষয় জানতে জানতে যে লেখার সৃষ্টি,সেটিই এখানে উপস্থাপিত করছি।
বর্ধমান জেলার পূর্বে গুসকরা শহরের একদিকে দামোদর নদ, অন্যদিকে অজয়ের শাখা। প্রাণবন্ত এই ক্ষুদ্র শহর নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে টিকে আছে। এখানে রয়েছে মানুষের প্রিয় রটন্তী কালী মন্দির, নিজস্ব নানা মেলা, লোকাচার,চর্চা, পাশের গ্রামে রয়েছে ডোকরা শিল্পের চর্চা, নিকটে রয়েছে সুবিখ্যাত বোলপুর শান্তিনিকেতন এবং আরো কত কি। এই শহরের কয়েক শতাব্দী প্রাচীন পরিবার হলো ঐ জমিদার পরিবার। আমার আগ্রহের জন্য বেশ প্রাচীন আমলের একটি ছোট মন্দিরে ক্ষুদ্র কক্ষে তালা খুলে আধো অন্ধকারে আমার পরিচিতা একজন এবং ওই জমিদার বংশের মানুষ এক ভদ্রমহিলা পরিবারের কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি দর্শন করান। রহস্যভরা সংকীর্ণ স্থান,এদিক ওদিক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং রীতিমতন গা বাঁচিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়েছিল।একটু জড়োসড়ো হয়ে বসতে হয়েছিল। একটা রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম।
তাঁদের ৪৫০-৫০০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপূজা বিখ্যাত এবং বেশ ভিন্ন ধরণের। অপূর্ব মহিমান্বিত সেই পূজা কিন্তু শাক্ত মতেই হয় এবং নিজস্ব পালি লিপিতে লেখা পুঁথি অনুযায়ী হয়।ঐসময় অনেক পর্যটক আসেন বনেদী বাড়ির পুজো দেখার আশায়। এই পরিবার নাকি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের কোন একটা কাজের সহায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে গুসকরায় আসেন। তাঁরা ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন,পরে আবার বংশের কেউ রাজার প্রধান সেনাপতি হয়েছিলেন। ক্রমশ তাঁরা প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে পারেন এবং একটা সময় জমিদার রূপে পরিগণিত হন। বর্ধমানের রাজাদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভালো ছিল। বলা হয়,বাঁশের ‘চোঙে’ ক’রে রাজস্ব আসতো বলে চট্টোপাধ্যায়রা ‘চোংদার’ রূপে চিহ্নিত হন। বংশধরেরা সেই টাইটেল বহন করছেন। চতুর্ভূজ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শেরশাহের আমলে এই দুর্গাপূজার প্রচলন করেন।সাতটি গাঁয়ের মানুষ এই পূজায় অংশগ্রহণ করতো। সেই সময় বিরাট যাত্রাপালার আয়োজন হতো। বিশাল সম্পত্তির জোরে জমিদার বাড়িতে বিরাট বড় দুর্গাদালান গড়ে তোলেন তাঁরা। তার সংস্কার প্রয়োজন হলেও প্রচুর অর্থ দরকার।তবে বংশধরেরা নিজেদের নিয়ম ঐতিহ্য , পরম্পরা যথাসাধ্য বয়ে নিয়ে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। আগে মোষ ইত্যাদি পশু বলি হতো। এখন তা বন্ধ হয়েছে, চালকুমড়ো বলি হয়।
পুজোয় ব্যতিক্রমী আরো নানা বিষয় আছে ।যেমন মা দুর্গা ব্যাঘ্রবাহনা ,মা সরস্বতীর মুকুট নেই। চতুর্ভুজ বাবু এবং তাঁর স্ত্রী বিদ্যাধরী নাকি দশমীর দিন মারা যান ।সেই থেকে দশমীতে এখানে ঘট বিসর্জন হয় না, ভৈরব মন্দিরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।উল্টে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হয়! তাঁদের দেহের ওপর হোমকুণ্ড প্রতিষ্ঠিত আছে ,সেখানে তিন-চারদিন অনির্বাণ প্রাণপ্রদীপ জ্বালানো হতে থাকে, দশমীতে পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়। তো এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জমিদারির অতীত খচিত একটি অংশে সেদিন প্রবেশ করেছিলাম,মনে পড়ে। এতদিনে আবারো হয়তো কিছু সংস্কার সাধন ,পরিবর্তন হয়েছে ,কিন্তু আদি বিষয় ঠিকই একই আছে।
এই জমিদার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত একটা বড় বিষয় আছে, যা স্থানীয় মানুষেরা কেউ ভালো চোখে দেখে, কেউ দেখে না।জানা যায়, দুর্গাপূজায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এসেছেন। স্থানীয়রা বলেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি আগে বোলপুরে নয়, এখানেই বিশ্বভারতীর মতন একটা বিশেষ পাঠদানের কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন চারিপাশের দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে। কিন্তু রক্ষণশীল জমিদার মশাই অনুমতি দেননি, কারণ ভাবনাটা যথেষ্ট প্রগতিবাদী। সেই চেয়ার আজও আছে, যেটায় কবিগুরু বসেছিলেন।
টুকরো ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আজ ভাবি ,প্রতিটা মুহূর্তই তো ইতিহাস হতে থাকে, কোনটা পাতায় লেখা হয়, কোনটা হয়না। এই মহান সৃষ্টির মাঝে ইতিহাসের পাতাগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। তারই কিছু কিছু কখনো চোখে পড়লে বেশ লাগে।
চোংদার বাড়ির দুর্গাদালানের সংগৃহীত ছবিগুলো,কষ্টিপাথরের কালীমূর্তির ছবি লেখিকার ।
————————————————-
জয়িতা সরকার (বৈদ্যবাটী,হুগলী জেলা)