Shadow

পরম্পরা – শম্পা চক্রবর্তী

p.c. People’s Archive of Ru…

পরম্পরা

শম্পা চক্রবর্তী

   মাস ছয়েক আগে দুয়ারসিনির ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে পোস্টিং পেয়ে সরকারী কোয়ার্টারে ঠাঁই নিয়েছি। জঙ্গল ও পাহাড়ঘেরা সবুজের দেশ যেন। অজগর সাপের মতো আঁকাবাঁকা মসৃণ পথের দুধারে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কি!! বহুদিনের শখ ছিল চাকরি জীবনে অন্তত একবার এখানে বদলি হব আমার চেনা ছকের বাঁধন ছুঁড়ে গল্পে শোনা,স্বপ্নে দেখা দুয়ারসিনির সঙ্গে একাত্ম হতে। মাঝে মাঝে নিজেকে নির্জনতায় ডুবিয়ে দিতে সবারই বোধহয় ইচ্ছে হয়।
         এখানে সরকারী কোয়ার্টার্স পেয়েছি। অফিসের জিপ এসে প্রতিদিন নিয়ে যায় আবার দিয়েও যায়। প্রায়ই খাবার কিনে আনি। মল্লু নামে একটা ছোকরা দোকানবাজার করে দেয় বটে কিন্তু পরিচারিকার অভাবে থাকা-খাওয়া মুশকিল হয়ে উঠছে। আমি ভালো রাঁধতে পারি না। অনেক খোঁজার পর অবশেষে সহকর্মীর চেষ্টায় একজন মধ্যবয়সী মহিলা পাওয়া গেল। নাম ফুলমতী। আমাকে স্নেহ করে খুব। কাজের অবসরে কত গল্প বলে। বাঁচার গল্প—ভালোবাসার গল্প—মাওবাদীদের গল্প।
     এক ছুটির দিনে সকাল থেকেই আকাশ জুড়ে মেঘ আর নিম্নচাপের ঝিরঝিরে বৃষ্টি। দূরের টিলাগুলো মাথায় গাছপালা নিয়ে বৃষ্টিতে দোল খাচ্ছিল। চারিদিকে চোখজুড়ানো সবুজ আর সবুজ। ইচ্ছে হোল খিচুড়ি খাবার। ফুলমতী কিন্তু এই দুর্যোগেও ছাতা মাথায় দিয়ে আধভেজা হয়ে কাজে এসেছিলো। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওকে বসতে দিলাম। তারপর গরম চা খাওয়ালাম। নিজেও নিলাম। তারপর খিচুড়ির কথা বললাম। খুশি হয়ে সে বলল—”মু আগে বাঙালিবাবুর কাজ কইরতম। সি বহুত দিন বিতে গেল বাবু।”
—”তাই বুঝি? তা বেশ। বাঙালির খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে তুমি নিশ্চয়ই অনেক জানো। (হেসে)তবে অন্য জাতির থেকে বাঙালীরা ভালো। তাই না?”
—” কুনঅ বাঙালি ভালঅ না। ডর লাগে। মু একা না,ঝুপড়ির সকঅল বিটিছেইল্যা উয়াদের ডরায়।”
 হেসে বললাম—”কেন?”
— “সি অনেক কুথা। বাদে বুলবঅ।”
সময়ের অভাবে ফুলমতীর বাকি কথা আর শোনা হয় নি।
    প্রতিমাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শনিবার ছুটি থাকে। ছুটির দিনগুলোতে পরিবারের কাছে চলে আসি। কখনো ছোট ট্যুরে।মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য দুয়ারসিনি থেকে যাই।এরকম এক শনিবার অফিসের এক সহকর্মীর অনুরোধে আমার নিমন্ত্রণে যাবার কথা। ফুলমতীকে বিষয়টা জানিয়ে বললাম যে বিকেলে কাজে আসার দরকার নেই। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল—“কুন ঠিনে যাবেন বাবু।”
—”অযোধ্যা পাহাড়ে মাদলনাচ দেখার নিমন্ত্রণ। ওখানে আমার এক সহকর্মী থাকে। অফিসের অন্য বন্ধুরাও আসবে। রাতে খাওয়াদাওয়া হবে। শ্রাবণী পূর্ণিমায় নাচ দেখার জন্য আদিবাসী দলকে বুক্ করা হয়েছে।”
কয়েকমিনিট চুপ থেকে উদাসী গলায় বললো—”সিদিনো খাদান পারে চাঁদ উইঠলো—হাতিডহর পেইরাঁই একঠো তারা জ্বইলল—মোর মরদ গিল ছাতাটাঁড়ের মেলাতে……আমি নাচলম্…..ঝুপড়িতে বোল উইঠল—ঘিজিং ঘিনা….ঘিজিং ঘিনা….”
      বুঝলাম স্মৃতির জালে ও ক্রমশঃ জড়িয়ে যাচ্ছে।। ওর কথা—ওদের কথা ভাবতে ভাবতে ড্রাইভারের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ফিরতে রাত হোল।
         পরদিন ফুলমতী কাজে এলো না। তার পরেরদিনও এলো না। মালীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম জ্বর হয়েছে। নিজের তাগিদেই বিকেলে ওষুধ ও খাবার নিয়ে ওকে দেখতে গেলাম। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আমাকে দেখে খুশি হোল এবং ইশারায় মেয়ে ভানুমতীকে দেখিয়ে দিল কাজের জন্য।
       পরেরদিন কালোকোলো চেহারার সদ্যযুবতী ভানুমতী হাসিমুখে কাজে এলো। সপ্তাহখানেক পর একদিন কুন্ঠিত হয়ে বলল—”বাবু মোর নুনাক চারটি ভাত দিবেন? ফাটাফুটা একঠো জামা দিবেন বাবু উয়ার বাপক?”
 —” বিকেলে আয়। দেখছি।”
—”কথাঠো মনে রাইখবেন। মোর নুনা টুকচেক পান্তা খাঁইয়ে কাল তক্ক প্যাটচিটা দিয়া আছে বাবু।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওকে আশ্বস্ত করে অফিসে বেরোলাম। সারাদিন বিভিন্ন ফিল্ডে যেতে হয়েছে। কাজের চাপে ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় ভানুমতী এলো।দুশো টাকার নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—”একা যাবি?”
  —”উয়ার বাপ আইসছে। উ মহুলের লিচে দাঁড়াই আছেন। লিসা কইরছে বড়। শরমে ইঠিনে আইসেলাই।”
 হাসলাম। ও চলে গেল।
           পরের সপ্তাহে দিনচারেকের জন্য বাড়িতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে খবর দিলাম ফুলমতীকে। ভানুমতী বিকেলে এসে জানাল যে ওর মা ওকে আমার ঘরে কাজ করতে বারণ করেছে। অবাক হলাম। পারিশ্রমিক দেবার জন্য ওকে ঘরে ডাকলাম। কিছুতেই আসতে চাইছিল না। আমার মাথাতেও ক্রমশ রাগ চড়ছিল। এত বেইমান এরা!যখন যা চাইছে তাই দিচ্ছি অথচ……
        কিছুক্ষণ পর ভানুমতী এলো তবে একরকম ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তা-র-প-র—–দরজা বন্ধ করে দিলাম। ও ভয়ে গুটিসটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। ভানুমতী কাল থেকে আর আসবে না—এই চিন্তাটা আমাকে উত্যক্ত করে তুলল। আর সেইমুহুর্তে কেমন করে যেন প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষের পশুবৃত্তি জেগে উঠল আমার মধ্যে। আমার পাশবিক তাড়নায় আমি দলিত-মথিত করলাম তার কুড়ি বছরের যৌবনকে,নিষ্পেষিত করলাম তার লালিত স্বপ্নকে।
        সম্বিত ফিরল বারান্দায় ফুলমতীর চিৎকারে—”এ মুখ্যার বিটি,বাবুর কলজাটা খোঁপাইতে লাইরবি না?”
     ভানুমতী চমকে উঠল। আমিও। কাঁদতে কাঁদতে বলল—”বুঝ করি তুমি কি কইরলে বাবু!”
দরজা খুলে দেখি ভয়ংকর মূর্তিতে ফুলমতী দাঁড়িয়ে,হাতে টাঙ্গি। রক্ত হিম হয়ে গেল। ভানুমতী ছুটে এসে আমাকে আড়াল করল এবং মাকে শান্ত করে ঘরে এনে বসাল। হাঁপাতে হাঁপাতে ফুলমতী বলতে লাগল—”বিশসন বিতে গিল…..কলকেতা সহর থাইকতে আইল কেনে এক বাঙালিবাবু। উ বান্দোয়ানঠো পুলিশ আপিসার বটে। ত ভাতারখাকীর পুত আমাকে প্যাট করি চলি গেইল। আমার মরদ ফুঁসাইল….ত পুলিশবাবু রসি বাঁইধে উয়াকে সদর থানা…….তার বাদে জেলে চালান দিলেক। ভানমতী উয়ারই বিটি।
আজ দুপহরে তুকে দেখ্যা তরাস লাইগল বড়। তাথেই ছুটে আইলম।”
      প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ওদের বিদায় দিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কেন এমন দুর্বুদ্ধি মাথায় এলো জানিনা। জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। কিশোরী রাত্রি সবে জঙ্গলের কপালে তার নরমহাত বুলিয়েছে। ঝিঁঝিঁর ডাকে মুখরিত ঝোপঝাড়ের আনাচেকানাচে জমে আছে থোকা থোকা অন্ধকার। আকাশে নক্ষত্রদের মৌন সমাবেশ।ফুরফুরে হাওয়ার সাথে দূরান্তের স্মৃতি এসে জড়ো হতে লাগল মনের কোণে।
         চোখ বুঁজে আমি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম—আমার চতুর্থশ্রেণী—IPS অফিসার হিসাবে বাবার বান্দোয়ানে বদলি—ছুটিতে বাড়ি এলে বাবার মুখে সাঁওতাল,শবর,মুন্ডা ও খেড়িয়াদের গল্পশোনা—জ্যোৎস্নারাতে ফুলমতীদের মাদলনাচের গল্পশোনা—আমার বড় হয়ে ওঠা—মনের মধ্যে অরণ্যস্বপ্নের বীজবপন—WBCS অফিসার হয়ে বনদপ্তরে চাকরী— বাবার রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার হাত ধরে DFO পদে দুয়ারসিনিতে নিয়োগ……..
**************************************
             

পরিচিতি— শম্পা চক্রবর্তী।
ঠিকানা—চুঁচুড়া, হুগলী।
শিক্ষাগত যোগ্যতা—বাংলা সাহিত্যে এম্.এ.
পেশা—শিক্ষকতা।
নেশা—সাহিত্যচর্চা ( মূলতঃ লেখালেখি),সিনেমা দেখা,বই পড়া,গান শোনা,অনাবিল হাসিতে ফেটে পড়া,মানুষের মনের গভীরে ডুব দেওয়া এবং কাছে-দূরে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!