ভিটে
শ্রুতি দত্ত রায়
(১)
কলা আর কাঁচা দুধ ভরা মাটির মালসাটা সন্তর্পণে পুকুরপাড়ে নামিয়ে হাতজোড় করলেন সৌদামিনী। মনে মনে মা মনসাকে কল্পনা করে আকুলভাবে প্রার্থনা করলেন,”হে ঠাকুর, ছেলেটার অপরাধ নিও না। তোমার সন্তানের গায়ে হাত তুলেছে ঠিকই, কিন্তু তুমি তো জান এটা ছাড়া সেই মুহূর্তে ওর আর কিছু করার ছিল না। ক্ষমা করে দাও মা, রক্ষা কর আমার পরিবারটা।”
নাহ্ , এবার ফেরা যাক।পুকুরপাড়ের এই ঝোপ জঙ্গলে আর দাঁড়িয়ে থাকাটা উচিত হবে না। তাছাড়া তেনাদের তো এ তল্লাটে মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালালেন তিনি। গতকালের ঘটনাটা আবারও মনে পড়ল তাঁর। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
প্রতিদিনের মত ঠিকে ঝি শেফালী এসে সকালে বাসি ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। বাইরের ঘরে সৌদামিনীর ছয় বছরের নাতিবাবু তখন বেতের বড় সোফাটায় শুয়ে টিভিতে কার্টুন দেখছিল। শেফালী ঘরের বুককেসের তলায় ঝাড়ু ঢুকিয়েই ভয়ে চীৎকার করে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েছিল। ঝাঁটা ফেলে এক ঝটকায় নাতিবাবুকে কোলে তুলে বেড়িয়ে এসেছিল পাশের ঘরে। হাঁকডাকে ছেলে বৌমা সবাই ছুটে গিয়ে দেখে প্রাণীটা তখন সোফার পায়াটা পেঁচিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল ওকে কোনরকম আঘাত ছাড়া দরজা দিয়ে বের করে দেওয়ার। কিন্তু কোনভাবেই না পেরে শেষটায় নিজেদের সুরক্ষিত করতে নিরীহ প্রাণীটার প্রাণ কেড়ে নিতে হয়েছিল বাবানের। সেই থেকে সৌদামিনী ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন। সর্পহত্যা যে মহাপাপ।না জানি কি অমঙ্গল হয়। তাই তো তড়িঘড়ি বাড়িতে ছোট করে মনসা পূজার আয়োজন করলেন। আর যাই হোক, এই ভিটের কোন ক্ষতি তিনি চান না।
যদিও ভিটে বলতে ঝোপঝাড়, ইঁটের পাঁজা, উঠোন, কুয়ো পাড়, ছোট একখানা ডোবা সাইজের পুকুর সমেত সত্তর-পঁচাত্তর বছরের পুরানো এক বসতবাড়ি। মাথার উপরে টিনের ছাদ। রেলগাড়ির মত পর পর কামরাওয়ালা সাতখানা ঘর। সেই কবে দেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিক্রমপুরের পাট চুকিয়ে শ্বশুরমশাই ছোট শহরতলীটাতে এসে ছেলেপুলে নিয়ে এই জমিতেই ঘাঁটি গেঁড়েছিলেন। কোনরকমে দুখানা ঘর তুলে পেতেছিলেন গেরস্থালি। ধীরে ধীরে বছর গড়িয়েছে। সংসারের প্রয়োজন অনুযায়ী একটা একটা করে ঘরের সংখ্যা বেড়েছে। একটা সময় ছিল, যখন এই বাড়ি আত্মীয় কুটুম্বে গম গম করত। কিন্তু এখন পড়ে রয়েছেন এ বাড়ির বড় ছেলের বউ সৌদামিনী আর তার একমাত্র ছেলে বাবান, ছেলের বৌ তিথি ও নাতি। বাকি ছেলেরা সেই কবেই ছোট শহরের মায়া কাটিয়ে কলকাতায় গিয়ে থিতু হয়েছে। কেবল সৌদামিনী এখনও যখের ধন আগলে বসে আছেন। মৃত্যুকালে শ্বশুরমশাইকে দেওয়া কথা ফেলতে পারেননি। আজীবন এই ভিটে রক্ষা করার শপথ করেছিলেন যে।
(২)
“না,না, এভাবে আর এখানে থাকা যায় না। রেনোভেট করতে গিয়ে এই বারো ভুতের বাড়িতে আর একটা টাকাও আমি অপচয় করব না। অন্য কোন ব্যবস্থা এবার করতেই হবে।” রবিবার দুপুরে খাবার টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। বাবানের বক্তব্যে সায় দিয়ে উঠল তিথি,
“সত্যি, এভাবে আর কতদিন এই নোনাধরা, স্যাঁতসেতে এজমালী সম্পত্তি পাহারা দেব? শেফালী যদি না থাকত কি সাংঘাতিক বিপদ সেদিন ঘটতে পারত বল তো?”
“ঠিকই বলেছ। বড়কাকা,ছোটকাকারা কবে থেকে বলে চলেছে বাড়িটার একটা ফয়সালা করতে। প্রস্তাবটা তো খারাপ না। প্রোমোটারকে দিলে সব শরিকই ভাগ পাবে। জমি তো আর কম নয়। শুধু তুমিই রাজি হচ্ছো না মা।”
বাবানের গলার উষ্মা টের পেলেন সৌদামিনী।
“যতদিন যাচ্ছে,আশেপাশে কেবল ফ্ল্যাট উঠছে।আর ধীরে ধীরে নীচু হয়ে যাচ্ছে এ বাড়ির ভিত।একটু বৃষ্টিতে গামলার মত ভরে যাচ্ছে উঠোন। সর্বক্ষণ টেনশন, এই বুঝি ঘরে জল ঢুকল। শুধু কি বর্ষা? তীব্র গরমে এই কাঠের সিলিং দেওয়া ঘরে এসি লাগানোরও কোন উপায় নেই। আর শীতে রাতভর মাথার উপরে ভামেদের দল নেত্ত করে বেড়ায়। এভাবে আজকালকার দিনে টেকা যায়? কি আছে আপনার এই পলেস্তারা খসা,সাপ-ব্যাঙ-ছুঁচোর আতুরঘরে, আপনিই বলুন মা?”
সৌদামিনী এদের কথা চুপ করে শুনছিলেন। বৌমার প্রশ্নের জবাবে নিজের মনেই নীরবে উত্তর দিলেন, “কি যে আছে, তা তোমাদের বললেও তোমরা বুঝবে না। এই বাড়ির প্রত্যেকটা ইঁটে আছে শ্বশুরমশাই-এর পরিশ্রম ও ঘামের গন্ধ। দেয়ালের গায়ে লেগে আছে শ্বাশুড়িমায়ের যত্নের পরশ। বাড়ির প্রতিটি কোণে বাবানের বাবার স্মৃতি। আজও যেন তিনি ঘরগুলোর আনাচে কানাচে কান পাতলে শুনতে পান ফেলে আসা যৌথ পরিবারের হাসি-কান্না, মান-অভিমান, বিষাদ-আনন্দের প্রতিধ্বনি। ঐ শ্যাওলা ভরা পিছল উঠোনে আজও খুঁজে পান বাবানের ছেলেবেলা।পুকুরপাড়ের নারকেল, সুপুরি কিংবা দক্ষিণদিকের বাতাবীলেবু, কামরাঙা গাছগুলোতে যে আজও সেই সময়ের টুকরোগুলো অদৃশ্যভাবে লেগে আছে। উঠোনের একপাশের লঙ্কাগাছে, বিলিতি ধনেপাতার কাঁটায়ও যে বড্ড মায়া জড়িয়ে আছে।”
সৌদামিনীকে চুপ থাকতে দেখে ছেলে বলে উঠল,”এবার আর তুমি বাগড়া দিও না। কি হবে তোমার ওই সব বার্মা কাঠের সিন্দুক,পালঙ্ক, খাটের তল ভর্তি ব্রিটিশ আমলের ট্রাঙ্ক-বাক্স সামলে? আরশোলা, ইঁদুর,মাকড়সার বাসা এক একেকটা। সব এবার একে একে বেচে দেব, বুঝলে? আজই ফোনে কাকাদের সঙ্গে কথা বলব। এবার আর তোমার আপত্তি শুনছি না।”
(৩)
আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। সকালবেলা বাড়ির চৌহদ্দি ঘুরে ঘুরে ঝুড়িতে পূজার ফুল তুলছিলেন সৌদামিনী। স্থলপদ্ম গাছগুলিতে এবার অনেক ফুল ফুটেছে। শিউলি তলাটা অজস্র ঝরে পরা ফুলে পুরো সাদা হয়ে আছে। যেন খসে পড়া অসংখ্য তারা। আলো করে রেখেছে উঠোনের এক কোণ। আজকাল আর নীচু হয়ে ফুল কুড়োতে পারেন না সৌদামিনী। হাঁটুতে বাত। তাই পাতার উপর পরে থাকা কিছু ফুল হাত দিয়ে তুলে নিলেন শুধু। অপরাজিতার বাঁশের মাচাটা এই বর্ষার জলে বেশ খানিকটা পচে গেছে। এদিক ওদিক এলোমেলোভাবে বাড়তে থাকা লতাগুলোকে যত্ন করে টেনে এনে একটা বাঁশের কঞ্চিতে জড়িয়ে দিলেন। এবার ওরা অবলম্বন পেয়ে লকলকিয়ে বাড়বে।
“মাসীমা, ও মাসীমা,,,,,”
ডাক শুনে মুখ তুলে তাকালেন সৌদামিনী। বাড়ির লাগোয়া জমিটায় কিছুদিন আগে যে নতুন ফ্ল্যাটটা গজিয়ে উঠেছে, তারই দোতলার ব্যালকনি থেকে ডাকছে গার্গী। খুব মিশুকে মেয়ে। পাড়ায় নতুন এসে ইতিমধ্যেই বেশ আলাপ করে নিয়েছে। বিশেষ করে সৌদামিনীর পরিবারের সঙ্গে তো ভালোই মিশে গেছে।
“মাসীমা, কটা ফুল হবে? আজ বাজার থেকে পূজার ফুল আনতে ভুলে গেছে।”
সৌদামিনী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন, “একটু পরে এসে নিয়ে যেও। আমি তুলে রাখছি।”
“ইস্ ,কত ফুল ফুটেছে আজ, তাই না!!!! আপনার উঠোন তো পুরো ঝলমল করছে। সত্যি, আপনাদের বাড়িটা দেখলে আমার ভারি হিংসে হয়। আজকালকার দিনে শহরের মধ্যে এত্ত খোলামেলা গাছগাছালি ঘেরা বাড়ি তো দেখাই যায় না। আমার তো এই দু কামরার ফ্ল্যাটে এখনই দমবন্ধ হয়ে আসে। কিভাবে যে বাকি জীবনটা কাটাব। আপনারা সত্যি খুব লাকি।”
সৌদামিনী মুখে এক চিলতে হাসি ফোটালেন। মনে মনে ভাবলেন, “কিছুদিনের মধ্যেই আমার আর এমন সৌভাগ্য থাকবে না গো। আগামীকাল আসছে সব দেওররা কলকাতা থেকে। ছেলেই যোগাযোগ করেছে। প্রোমোটারের সঙ্গে প্রাথমিক কথা শেষ। আগামীকাল বিকেলেই সব শরিকের সঙ্গে আমাকেও সই সাবুদ করে পাকাপাকিভাবে এই ভিটেমাটি অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে।” বুকের ভেতর থেকে একটা ভারী নিঃশ্বাস ঠেলে বেরিয়ে এল সৌদামিনীর। মৃত্যুশয্যায় শ্বশুরমশাই বাড়ির বড়ছেলের বৌটির হাত ধরে বলে গিয়েছিলেন, সৌদামিনী যেন এই পরিবারটাকে একটা সুতোয় বেঁধে রাখেন। রক্ষা করেন সব জমি জায়গা। দেশভাগের সময়কার ভিটে মাটি হারানোর শোক তিনি আমৃত্যু ভুলতে পারেন নি। তাই হয়তো তাঁর নিজের রক্তজল করা পরিশ্রমের ফসল এই স্থাবর সম্পত্তিটুকু রক্ষার গুরু দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন সৌদামিনীকে। বাড়ির দলিলের দানপত্রে তাই বাকি তিন ছেলের সঙ্গে অকালমৃত বড়ছেলের বৌ এর নামটিও পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই থেকে আজ অবধি হাজার অসুবিধা সয়েও এই বাড়িকে আগলে রেখেছেন তিনি। এবার আর সম্ভব নয়। বাড়ি এবার হাতছাড়া করতেই হবে।
(৪)
সেদিন ভোররাতে ভারি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলেন সৌদামিনী। বৌ হয়ে আসার পর প্রথম প্রথম যেভাবে দিন কাটত তাঁর, তারই একটুকরো ছবি যেন। দেখলেন, বাড়ির উঠোনের একদিকে যে রান্নাঘর ,সেখানে বাড়ির সব পুরুষেরা একসাথে কাঠের পিঁড়িতে খেতে বসেছে। বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ। ঘরে জ্বলছে হ্যারিকেন আর কুপির আলো। শ্বাশুড়িমা নিজে পেতলের হাঁড়ি থেকে খিচুড়ি . দিচ্ছেন সবার পাতে। কয়লার উনোনের ধারে বসে বড় কড়াই-এর থেকে গরম গরম বেগুনভাজা তুলে দিচ্ছেন সৌদামিনী। খেতে খেতে জোর আড্ডা চলছে সবাই মিলে। এটোঁ হাত শুকিয়ে গেলেও কেউ পাত ছেড়ে উঠছে না। সবার মুখেই পরিতৃপ্তির ভাব। ঘোমটার আড়াল থেকে আবছায়া আলোতেই উজ্জ্বল মুখগুলি দেখছেন সৌদামিনী। মনটা কেমন আনন্দে ভরে উঠছে। টিনের চাল থেকে ভেসে আসছে জল তরঙ্গের টুংটাং ধ্বনি, একটানা,,,,,নিরন্তর। পুকুরের উপচে পড়া জল থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙেদের কলতান। এক অদ্ভূত মায়ানগরীর দৃশ্যবলয়ে যেন নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়েছেন তিনি। ভারি ভাল লাগছে তাঁর। হাল্কা লাগছে শরীর।
(৫)
রজনীগন্ধার স্টিকের পাশে বাড়ির শিউলি ফুল দিয়ে সৌদামিনীর পা দুখানা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। উঠোনের তুলসীতলায় শায়িত রয়েছেন তিনি। ছেলে,বৌমা,নাতি সহ, যারা দীর্ঘ কয়েক বছর এই ভিটেতে পা রাখেনি,সেই দেওররা তাদের পরিবার নিয়ে ঘিরে রেখেছে আজ সৌদামিনীকে। সকালের সোনাঝরা আলোয় এক অনির্বচনীয় স্নিগ্ধতায় ভরে আছে ওঁর মুখমন্ডল। পরম নিশ্চিন্তে শেষ শয্যায় চিরশান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সকলকে এক উঠোনে বেঁধে রাখতে পেরেছেন।এখনও হাতছাড়া হয়নি ভিটে মাটি।।
*********************************
শ্রুতি দত্ত রায় পরিচিতি:
সুন্দরী ডুয়ার্সের মফস্বল শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পেশায় সরকারি বিদ্যালয়ের ভাষা সাহিত্যের শিক্ষিকা। ভালবাসেন গান শুনতে,বই পড়তে,ডুয়ার্সের প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে। আর গান গাইবার মধ্যে খুঁজে পান মুক্তির স্বাদ।