Shadow

“রবীন্দ্রনাথের মর্ত্য-চেতনা” – মেরী খাতুন

PC: Facebook

“রবীন্দ্রনাথের মর্ত্য-চেতনা”

মেরী খাতুন

 সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্–এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সত্য,শিব,সুন্দরের সাধক—কবি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ মর্ত্য-প্রীতি। তাঁর এই  প্রীতি তথা সৌন্দর্যবোধই সাধারণের মধ্যে অসাধারনকে আর সীমার মধ্যে অসীমের স্থাপনায় ব্রতী হয়েছে। তাইতো,’সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি’,’পল্লীবধূর আঁকা-বাঁকা সর্পিল পথে জল আনার দৃশ্য’,’বিকশিত সর্ষে ফুলের গন্ধ ‘তাঁর মনে নির্বিকল্প অনুভূতির সঞ্চার করে হৃদয়ে স্থান রচনা করেছে।তাঁর সাধনার দীর্ঘপথে বার বার একই সুর ধ্বনিত হয়েছে—‘আমি ভালোবাসি,আমি ভালোবাসি এই জীব,এই জীবন,এই জীবলোক। রবীন্দ্রনাথ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও তাঁর সত্যকার পরিচয় নিহিত রয়েছে তাঁর সুগভীর মর্ত্য-প্রীতি তথা জীবনপ্রীতিতে। মানুষের কবি,ধুলার-ধরনীর কবি রবীন্দ্রনাথ তাই  অকপটে বলতে পেরেছিলেন—

                    “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে

                      মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”

মর্ত্যের প্রতি কবির ছিল সুগভীর আকর্ষণ ও অকৃত্রিম প্রেম-প্রীতির বন্ধনের প্রধান কারণ হল কবি ছিলেন আদ্যন্ত্য মানবপ্রেমিক।। তাই মানবমুখীনতাই তাঁর সাহিত্যের প্রধান সুর। আর পৃথিবী ও মানব–এই দুয়ের সমন্বয়ই কবির জগৎ।পৃথিবীর বন্ধন ও মর্ত্যের আকর্ষণ তাঁর অন্তর রজ্জুকে নিরন্তর টানছে;আর তারই ফলে তিনি মর্ত্যের সুখ-দুঃখ-বিরহ ও অশ্রুকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অমৃত রসে সিক্ত করে এক অপরূপ মাধুর্যে মন্ডিত করেছেন।
মাতৃভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী, আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীর অপরূপ রূপ মহিমায় কবির হৃদয় নৃত্যরতা,অন্তহীন সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র।এই মর্ত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আত্মিক যোগাযোগ যে কত গভীর ও নিবিড়,তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘ছিন্নপত্রে’র একটি চিঠিতে–“ঐ যে মস্ত বড় পৃথিবীটা চুপ ক’রে পড়ে রয়েছে,ওটাকে আমি ভালোবাসি!ওর এই গাছপালা,নদী-মাঠ কোলাহল-নিস্তব্ধতা প্রভাত-সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয়,পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যেসব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোন স্বর্গ থেকে পেতুম।” তাই সংসারের ভিতর দিয়ে ভোগত্যাগ কিছু অস্বীকার করে নয়,সমস্ত কিছুর স্পর্শ নিয়ে তিনি পৌঁছেছেন, যেখানে—-
“কি জানি কি হলো আজি,জাগিয়া উঠিল প্রাণ
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান….”
এরপর ‘ছবি ও গান’ এর যুগ। “নানা জিনিষকে দেখিবার যে দৃষ্টি সেই দৃষ্টি যেন আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল।……. তুলি দিয়া ছবি আঁকিতে যদি পারিতাম,তবে পটের উপর রেখা ও রঙ দিয়া উতলা মনের দৃষ্টি ও সৃষ্টিকে বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতাম,কিন্তু সে উপায় আমার হাতে ছিল না,ছিল কেবল কথা ও ছন্দ।” (‘জীবনস্মৃতি: ‘ছবি ও গান ‘)।
ছোটছেলে রঙের বাক্স উপহার পেলে যেমন প্রচুর পরিমাণে রঙ ছড়িয়ে ছবি আঁকতে চেষ্টা করে—‘সেদিন নবযৌবনের নানান রঙের বাক্সটা নূতন পাইয়া’ কবির ও সেই দশা হয়েছিল, তাই যৌবনের রঙে কল্পনার তুলি রাঙিয়ে কবি রূপের ছবি আঁকলেন,প্রাণের গান গাইলেন—
—-বিশ্বজীবনের কাছে ক্ষুদ্রজীবনের এই আত্মনিবেদনের মাধ্যমে কবি ‘কড়ি ও কোমল’এর স্বর্গরাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ‘প্রভাতসঙ্গীত’-কে কবি বলেছেন নিষ্ক্রমণের কাল,কিন্তু ‘কড়ি ও কোমল’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:–“আমার কবিতা এখন মানুষের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে,”কিংবা “যৌবনের আরম্ভে মানুষের জীবলোক আমাকে তেমনি করিয়াই টানিয়াছে।” ‘কড়ি ও কোমল’ হলো মানুষের জীবন কুঞ্জের সেই সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান;এখানে কবি মর্ত্য জীবনকে এক অভিনব,অনিন্দ্য সুন্দর ভাবেপ্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিক এই সময়ে রচিত ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকটিতে কবির মর্ত্য-প্রীতির উষালগ্ন বলা চলে।’মানসী’তে কবি  স্রষ্টা রূপে আবির্ভূত হলেন।সাধারণ প্রকৃতি প্রীতি হতে বসুন্ধরার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বাসনা,অকারণ বিরহ বেদনা হতে স্থির সৌন্দর্যবিরহে কবি মানসের বিবর্তনটি পরিস্ফুট হল,’প্রকৃতির প্রতি’,’কুহুধ্বনি’,’বধু’,’অহল্যার প্রতি’,’সিন্ধুতরঙ্গ’ ইত্যাদি কবিতাগুলিতে নিসর্গ সৌন্দর্যের মর্ত্য-মমতার পরিচয় লাভ করলাম।অহল্যার মাধ্যমে জননী বসুন্ধরার সঙ্গে নিজের অচ্ছেদ্য আত্মীয়তার রহস্য,তার এই জন্মান্তরের সৌহার্দ্য ব্যক্ত করেছেন। এই তন্ময়তা বা Complete identification ‘সোনার তরী’ কাব্যের নিরুদ্দেশ যাত্রার মধ্য দিয়ে ‘চিত্রা’য় এসে সৌন্দর্য সাধনার রূপ পরিগ্রহ করেছে। আবার ‘মানসী’ কাব্যে ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতায় পৃথিবী সম্পর্কে যে ব্যাকুলতা ও নিগূঢ় প্রীতির উদ্ভব হয়েছিল,’সোনার তরী’ ‘সমুদ্রের প্রতি’,’বসুন্ধরা’ কবিতায় সেই ব্যাকুলতা,সেই জন্মান্তরীণ-হৃদ্যতা তীব্রতা লাভ করে ‘চিত্রা’ও ‘চৈতালী’-তে স্থির মর্ত্যানুরাগে পরিণত হয়েছে।
‘এবার ফিরাও মোরে’,স্বর্গ হইতে বিদায়’ সেই অপূর্ব-অভূতপূর্ব অপরিমেয় মর্ত্য চেতনার সাক্ষী। তবু ‘চিত্রা’-য় যে অপ্রতিরোধ্য উচ্ছ্বাস ছিল,’চৈতালী’-তে তা স্থাপত্যের দীপ্তিতে দৃপ্ত হল।’চৈতালী’র প্রথম কবিতা–“আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে /গুচ্ছ গুচ্ছ ধরিয়াছে ফল” যদিও হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বীর জন্য কবির দুঃখ হৃদয় চিরে প্রকাশিত হয়েছে–“আজ,পারের দিকে যাত্রা করেছি–পিছনের ঘাটে কি দেখে এলাম,কি রেখে এলোমেলো,ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্ন স্তুপ,কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ,সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব,আশা করব….আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে”,তবুও আশাবাদী কবি আমাদের মহামানবের আগমন বার্তার আভাস দিয়ে এক অত্যাশ্চর্য মর্ত্য-চেতনার পরিচয় দিলেন তাঁর জীবন সায়াহ্নের কাব্য ‘পূরবী’,’মাটির ডাক’ ‘বকুলবনের পাখী’ ইত্যাদি কবিতায় তাঁর মর্ত্য-প্রীতির পরিচয় পরিস্ফুিটিত।
***************************************

মেরী খাতুন

 

             

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!