লাউয়ের ডাঁটা
ব্রতী ঘোষ
রবিবারের বাজারটা জমিয়ে করতে না পারলে রজতবাবুর মন ভরে না ৷ বিশেষ করে নিজের হাতে দেখে মাছটা কিনতে না পারলে ওর শান্তি হয় না ৷ বাজার করে ফেরার পথে মদনের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে তবে রিক্সা ধরে বাড়ি ফেরেন ৷ তবে আজ মদনের দোকানটা বন্ধ ৷ এরকম তো হয় না–নিশ্চয়ই ওর ছেলের শরীরটা খারাপ হয়েছে ৷ গত সপ্তাহে বলছিল বটে ৷ যাক্ গে ! বাড়ি ফিরে সাহস করে বউ কাকলিকেই বলতে হবে এক কাপ চায়ের কথা ৷ এই সব চিন্তা করতে করতে রিক্সাটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ৷ কিন্তু এ কি !! এতো ঝন্ঝন্ বাসনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কেন ?
আসলে হয়েছে কি !! ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি ৷ এর আগে বিনতা রজত বাবুদের বাড়ি কাজ করতো,তার ওই খিনখিনে গলার আওয়াজ আর খুক খুক কাশি ইদানিং রজত বাবুর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তাই কাকলি দেবীর কথা এক প্রকার অগ্রাহ্য করেই রজত বাবু বিনতাকে ছাড়িয়ে দেন। এদিকে বাড়িতে কাজের লোক না থাকলে যে গিন্নিরা ৪৪০ ভোল্টের আওতায় থাকেন সেটা তিনি সেই মুহূর্তে ভুলে গিয়েছিলেন,এখন কিন্তু ভারি পস্তাচ্ছেন ৷ আজ এক সপ্তাহ হল বাড়িতে কাজের লোক নেই,বুঝতেই পারছেন তো অবস্থাটা !! বাড়িতে ঢুকেই রজতবাবু দেখলেন বউ বাসন মাজছে ৷ তবে কাজের লোক না থাকার রাগটা বাসনের উপর গিয়ে পড়াতে তার আওয়াজটা ঝন্ঝন্ শব্দে বাড়ির চৌহদ্দির সীমা অতিক্রম করে রাস্তা অব্দি পৌঁছে যাচ্ছে।
এবার সবে রজত বাবু বাজারের ব্যাগটা রেখে পিছন দিকে ঘুরেছেন-‘শোনো ! বাজারগুলো বার করে একটু ধুয়ে ফেলো দেখি !’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ দিচ্ছি – ‘
মনের বিরক্তিটা আপ্রাণ চেষ্টা করে চাপা দিলেন তিনি ৷
‘ তবে একটু যদি চা— ‘
‘ কি? কি বললে ? ‘
‘ না না ! তোমাকে করতে হবে না আমি করে নিচ্ছি ৷ ‘
‘ সকাল থেকে এরই মধ্যে দুবার চা হয়ে গেছে ৷ আবার ? বলি ! চায়ের বাসন গুলো কে ধোবে শুনি ? ‘
‘ কেন ? আমি তো আমার চায়ের কাপটা ধুয়েই রাখি ৷‘
‘ বাহ ! বাহ ! কাপটা ধুলেই হয়ে গেল? আর চায়ের বাটিটা,ছাকনি টা,সেটা কে ধোবে শুনি?’ –ঝন্ঝন্ শব্দে কাকলি দেবীর বাকি কথাটা চাপা পড়ে গেল ৷
রজত বাবু বুঝলেন এ ভারি বেগতিক অবস্থা এখন ! কাজের লোক না হলেই নয় ! নয়তো রোজের এই টেনশন আর নেওয়া যাচ্ছে না ৷ অবশ্য কাকলিকে সব কাজ সেরে স্কুলে যেতে হয় ৷ ওর কষ্ট হচ্ছে ৷ এ কথা সত্যি !! রজতবাবুর অফিস একটু দেরিতে গেলেও চলে। তবে দুজনের কাজের জায়গা একই দিকে হওয়াতে দুজনেই একসঙ্গে বাড়ির গাড়িতে চলে যান। দীপক গাড়ি চালায় ভালো তবে বড্ড বৌদি বৌদি করে যেটা আবার রজত বাবুর মাঝেমধ্যে অসহ্য ঠেকে ৷ তবে কি আর করা !! রজতবাবু গিন্নির হাতে চা খাবার আশা ত্যাগ করে ভোম্বলের চায়ের দোকানে যাবেন বলে সবে পা বাড়িয়েছেন,দেখেন লক্ষ্মী ওর মেয়েকে নিয়ে চলেছে রাস্তা দিয়ে।
‘ লক্ষ্মী ! এই লক্ষ্মী ! কোথায় চললি রে? একটা কাজের লোক দেখে দে না রে।‘
‘ ও মামা–আমাকেই রাখো না,আমিও তো একটা কাজ খুঁজছি ।
‘ ও মা ! তাই নাকি ? বেশ তো চল্! তোর মামিমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি ৷‘ লক্ষ্মীকে কাকলি দেবীর কোনদিনই পছন্দ ছিল না। ওর মা বহু বছর ওদের বাড়ি কাজ করেছেন কিন্তু লক্ষ্মী কাজ যেমন তেমন করুক ওর রঙ ঢং,বিশেষ করে এই মামা মামা করা আর মামা বললেই চা করে খাওয়ানো–এ এক প্রকার ওর অসহ্য ৷ তবে এখন এই কাজের লোকের মাগ্গি গন্ডার বাজারে বাধ্য হয়েই ওকে ছুঁচোটা গিলতে হলো ৷
‘ যা বলব সেটুকুই করবি ৷ বেশি বেশি কাজ দেখানো আমার একদম পছন্দ না ৷ মনে থাকবে ? ‘
‘ ঠিক আছে মাইমা ৷‘
পরদিন থেকে লক্ষ্মী কাজে আসতে শুরু করল ৷ রজতবাবুর বাড়িতেও অপার শান্তি বিরাজ করতে শুরু করলো ৷ কিন্তু বেশিদিন বোধহয় শান্তি সহ্য হলো না বিধাতা পুরুষের ৷ এক মাসের মধ্যেই আবার যে কে সেই ৷ ভাবছেন আবার কি হলো ? তাহলে ঘটনাটা খুলেই বলি ৷ বাড়ির ফুল ঝাড়ুটা বেশ কিছুদিন ধরেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ কাকলীদেবী রোজই রজত বাবুকে স্মরণ করিয়ে দেন একটা ফুল ঝাড়ু কিনে আনার জন্য ৷ আর রজতবাবু রোজই তা ভুলে যান ৷ এবার হয়েছে কি ! সেদিন লক্ষ্মী কাজ করে বেরিয়ে যাওয়ার পথে রজত বাবুকে বলল,’মামা একটা ফুল ঝাড়ু এনো তো ! এটা দিয়ে আর ঝাড় দেওয়া যাচ্ছে না ৷ ‘ –
শুনে কাকলি দেবী একবার শুধু মুচকি হাসলেন। কিন্তু রজত বাবু ওর স্ত্রীকে অবাক করে দিয়ে সেই দিনই কিনে আনলেন ফুল ঝাড়ু আর আরো একটা মোক্ষম ভুল করে লক্ষ্মীর হাতেই সেটি তুলে দিলেন ৷ ব্যস্ ! আর যায় কোথায় ? রজত বাবুর ঘাড়ে কি করে যে দুটো মাথা গজিয়েছিল তা উনিই জানেন ! তবে মা লক্ষ্মীর কোপটা গিয়ে পড়ল অন্যদিকে৷ এই কদিনের কাজের হিসাব করে লক্ষ্মীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাকলি দেবী ওকে আর আসতে মানা করে দিলেন ৷ আবার বাড়িতে সেই অশান্তির বাতাবরণ ফিরে এলো ৷ তবে লক্ষ্মীর মত একটা ভালো কাজের মেয়েকে এরকম বিনা দোষে ছাড়িয়ে দেওয়াতে রজত বাবু খুবই বিরক্ত হলেন স্ত্রীর উপর–এ অন্যায় কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না ৷ এর শেষ না দেখে তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না ৷
তবে এবারে কিন্তু কাকলি দেবীর মুখে টুঁ শব্দটি নেই ৷ আজ দিন দশেক হল কাজের লোক নেই,কিন্তু কোন সাড়া নেই গিন্নির মুখে ৷ রজতবাবুর বেশ একটু বেসুরোই লাগছে ব্যাপার–স্যাপারটা ৷ আসলে এবারে যে চেঁচামেচি করার মুখ ই তো নেই আর–মনে মনে ভাবলেন উনি ৷
পরদিন সকালে –
‘ বৌদি লাউয়ের ডাঁটা খাবেন ? আমাদের বাড়িতে হয়েছে ৷ ‘
‘ ও মা দীপক ! তুমি কি করে জানলে যে আমি লাউয়ের ডাঁটা ভালোবাসি !! ‘ ‘ ‘আপনি সেদিন দাদাকে বলছিলেন না গাড়িতে বসে,আমি শুনলাম তো ! ‘
‘ বাহ ! কি টাটকা ডাঁটাগুলো !
গাড়িতে করে অফিস যেতে যেতে বৌদি আর দেওরের এহেন কথাবার্তায় যথেষ্ট বিরক্ত রজতবাবু সারাটা পথ জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন,আর ভাবতে লাগলেন কি করে এর থেকে উনি মুক্তি লাভ করবেন ৷
অফিসে এসেও ঠিক মন বসাতে পারলেন না কাজে ৷ ঘুরেফিরে একই কথা অর্থাৎ লাউয়ের ডাঁটা আর মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন না ৷ রজত বাবুর পাশে বসা বিমল বাবু অনেকক্ষণ থেকে এই শুকনো মুখের রজত বাবুকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ৷ শেষ মেশ আর থাকতে না পেরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আসল ব্যাপারটা জানতে পারলেন ৷
‘ আরে রজত দা, এটা একটা কোন চিন্তার ব্যাপার হলো? এক কাজ করুন – ‘ বলে কি যে ফুসমন্তর দিলেন রজত বাবুর কানে–ওর মুখটা এক্কেবারে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
এরপর দুই বন্ধু মিলে বেরিয়ে গেলেন অফিস থেকে ৷
পরের দিন –
‘ আচ্ছা দীপক এলো না তো এখনো ?’ রজত বাবু নির্বিকার ৷
‘ কি ব্যাপার ? আজকে আমরা বেরোবো না ? আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে ৷ দীপক এলো না এখনো ? ‘
স্ত্রীর কথা পাত্তা না দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন রজতবাবু ৷
কাকলি দেবীর ধৈর্য্যের বাঁধ এবার ভাঙছে ৷ উনিও বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে ঘড়ি দেখতে দেখতে ৷ দেখলেন গ্যারাজ থেকে গাড়ি বেরোচ্ছে । অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে দীপককে বকা দেবেন বলে গাড়িতে পা দিতেই দেখলেন,দীপক কোথায়? এতো সেই সদাশিব! যে প্রায় বছর দশেক আগে ওদের গাড়ি চালাত ৷ এক্কেবারে খিটকেল বজ্জাত ৷ বকর বকর করে মাথা খারাপ করে দিত ৷ কাকলি দেবীই ওকে ছাড়িয়ে ছিলেন ৷ ‘কিন্তু এটা কি হলো ?’ –কাকলীদেবী শ্যেন দৃষ্টিতে তাকালেন রজত বাবুর দিকে ৷
‘এবার থেকে সদাশিবদাই আসবেন‘-গম্ভীর গলায় বললেন রজতবাবু ৷
কাকলি দেবী যা বোঝার বুঝলেন ৷ তিরিশ বছর ধরে সংসার করেও যদি এটুকু বুঝতে না পারেন তবে আর করলেন কি !! এই সক্কালবেলা স্কুল যাবার সময় আর ঝগড়া করতে ইচ্ছে করল না ।
পরের দিন রজত বাবু অফিস থেকে বাড়ি ঢুকে হাতপা ধুয়ে সবে বসেছেন চেয়ারে-‘মামা তোমার চা ৷‘
রজত বাবু তাকিয়ে দেখেন লক্ষ্মী ৷ নাহ! বিমলটা কে দেখছি এবার খাওয়াতেই হবে ৷ ব্যাটার বুদ্ধির প্যাঁচ আছে। তবে আবার বোধহয় লাউয়ের ডাঁটা চিবোতে হবে,না হলে আর উপায় কই ?
সংসার সুখের হয় পতী পত্নীর গুণে ৷
********************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷