Shadow

শতবর্ষে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় – মধুমিতা মিত্র 

ছবি – এখনখবর

শতবর্ষে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়

মধুমিতা মিত্র 

“এলো বরষা  যে  সহসা”কিংবা”আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা” গানের এই কলি গুলি এখনও মনের মধ্যে দিয়ে বাজিয়ে যায় সুরের জল-তরঙ্গ,ছবি ভাসে চোখে সেই রেডিওর নব ঘোরানোর দৃশ্যের।মনের মতো গান কিংবা অনুরোধের আসরে বাজতে থাকা সুরেলা মিষ্টি গান-তখন গায়কের মহিমা বোঝার বয়স ছিল না,ধীরে ধীরে যখন সেই জায়গায় এলাম তখনই বুঝতে পারলাম গানের প্রাণ প্রতিষ্ঠা দাতা গায়কের ভূমিকা।আজ তাই বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র শ্রী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এই আলোচনার অবতারণা। এঁর শাস্ত্রীয় জ্ঞান সমৃদ্ধ গায়ন রীতি মিশেছিল দরদী কণ্ঠের সুর মূর্ছনায়।১৯২৩ সালের ৭ই জুন সতীনাথ বাবুর জন্ম হয় উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌ শহরে–ওঁর বড়ো হয়ে ওঠা পশ্চিমবাংলার হুগলী জেলার ঐতিহ্যময় শহর চুঁচুড়াতে এক সঙ্গীতময় পরিবারে।আজ বাংলা সংস্কৃতির এই দোলাচলের কালে এমন মরমী সুরসমৃদ্ধ মানুষটির সম্বন্ধে জানা এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার আসর বসানো, সময়ের দাবী হয়ে উঠছে। আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের এখনও যাঁরা আছেন তাঁদের স্মৃতি চারণের উদ্দেশ্যে,আর এখনকার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও আমাদের ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য‌ই শতবর্ষে সতীনাথ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। তাই কুলায় ফেরার পক্ষ থেকে এই মহান সুর শিল্পীকে শতবর্ষে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি
আগেই বলেছি ১৯২৩ সালের ৭ই জুন, হুগলী জেলার ঐতিহ্য মন্ডিত চুঁচুড়া শহরে এই শিল্পীর বড়ো হয়ে ওঠা।তাঁর পিতা,পিতামহ এবং মা সবাই ছিলেন সুরের মদিরায় ভরপুর।তাই একেবারে ছোট বেলা থেকেই সংগীতে প্রবেশ করেছিল এঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে,শিরা-উপশিরায়,প্রতিটি ধমনীতে।উপরি পাওনা ছিল লক্ষ্ণৌ শহরের খানদানী গজল,ঠুংরির প্রভাব।লক্ষ্ণৌতে ছিল তাঁর বাবার মামার বাড়ি।কাজেই সেখানে আনাগোনা লেগেই থাকতো এবং সেখানকার গজল,ঠুংরি তাঁকে বিশেষ ভাবে উদ্দীপ্ত করতো।
একেবারে শৈশব থেকেই সতীনাথের সঙ্গীত শিক্ষার শুরু,তখন তিনি সবেমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে।তাঁর প্রথম সঙ্গীত গুরু-শ্রী প্রবোধ ঘোষাল।প্রবোধ ঘোষাল প্রয়াত হলে সতীনাথ তালিম নেওয়া শুরু করেন শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কাছে।এরপর তিনি তাঁর সঙ্গীতশিক্ষার পাঠ নিতে শুরু করেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিখ্যাত সংগীত গুরু এবং শিল্পী পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। আমৃত্যু পন্ডিতজী তাঁর এই প্রিয় ছাত্রটিকে দিয়ে গেছেন তাঁর সংগীতের পাঠ।অত‌এব উচ্চাঙ্গ- সঙ্গীতের দ্বারা নির্মিত কাঠামোটি ছিল সতীনাথের সঙ্গীত-ইমারতের মূল উপাদান,এতে তিনি মিশিয়েছিলেন তাঁর মনের ভাব-দরদ রূপ চুণ সুড়কী;এতেই তাঁর সঙ্গীত সৌধ হয়ে উঠেছিল অনুপম,ব্যতিক্রমী এক ভিন্ন ধারার।
সংগীত জীবনের শুরুটা কিন্তু সতীনাথের আর পাঁচ জন নবীন শিল্পীর মতোই সংঘর্ষ পূর্ণ। একেবারে চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে নিজেই গ্ৰামোফোন কোম্পানীতে চিঠি লিখে রেকর্ড করার আবেদন জানান।এরপর অনেক প্রচেষ্টায় দুটি গানের রেকর্ডিং হল।গান দুটি ছিল’ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি’এবং’এইটুকু শুধু জানি ‘।গান দুটি গোপেন মল্লিকের সুরে এবং রচয়িতা যথাক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুবোধ পুরকায়স্থ। বেতারে তিনি অডিশন দেন কিন্তু বার বার দশবারের পরেও যখন ব্যর্থ মনোরথ হন, তখন তিনি সরাসরি স্টেশন ডিরেক্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।সেবার স্টেশন ডিরেক্টারের উপস্হিতিতে অডিশন নেওয়া হলে তিনি কৃতকার্য হন-তারপর,সেই ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি নিয়মিত বেতার শিল্পী হিসেবে রেডিও তে সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন।এর পর চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করার থেকেও তিনি বিরত থাকেন নি।১৯৫০ এবং ৫১ সালে’যুগদেবতা’এবং’পথহারার কাহিনী’ছবিতে রামচন্দ্র পালের সুরে প্লে ব্যাক করেন এবং১৯৫০ সালে রামচন্দ্র পালের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে মর্যাদা ছবিতে এবং ১৯৫১ সালে অনুরাগ ছবিতে একক ভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। গ্ৰামোফোন কোম্পানীর রেকর্ড‌ই হোক না কেন বা বেতারে নিয়মিত সঙ্গীত সম্প্রচার কিংবা এই প্লেব্যাক অথবা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা কোনটাই কিন্তু সতীনাথকে সে রকম কোনো পরিচিতিই দেয় নি।মোড় ঘুরে গেল ১৯৫২ সালে গ্ৰামোফোন কোম্পানী প্রকাশিত “আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম”এবং”এ জীবনে যেন আর”এ দুটি গানে-সতীনাথ গীত এই গান দুটি  শ্রোতাদের মনে দোলা লাগিয়ে ঝড় তুললো।শ্যামল গুপ্তের কথায় এবং সতীনাথের নিজের সুরে ও বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক দূর্গা সেনের পরিচালনায় এই গান দুটিই সতীনাথকে শ্রোতাদের মনে এক পাকাপাকি আসন পেতে দিল।এর পর থেকে আর পিছন পানে তাকানো নয়। সতীনাথের সুরের ধারায় সিঞ্চিত হতে থাকল আপামর বাঙালির মন। সংগীত নদীতে ভাসলো সতীনাথের সুরের তরণী।একের পর এক সুরেলা ফসলে ভরতে থাকলো তাঁর সুর তরী।নিজের সুরে”আজ মনে হয় এই নিরালায়”,’বালুকা বেলায় কুড়াই ঝিনুক”, “তোমাদের‌ই একার আছে “, ” জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো”–আরো বেশ কিছু গান জনচিত্ত হরণ করলো। বিভিন্ন প্রথিত যশা সুরকারদের সুরেও গান গেয়ে বাংলা সংগীত জগতের উচ্চ স্হানে নিজের আসন পাকা করলেন। সহধর্মিনী এবং গায়িকা উৎপলা সেনের সুরে গাইলেন ‘এলে তুমি সেই তো এলে’-‘শুধু তোমার জন্যে এই অরণ্যে ‘,সুধীন দাশগুপ্তের সুরে’সোনার হাতে সোনার কাঁকন ‘ ‘এলো  বরষা যে  সহসা ‘ ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা ‘ শ্যামল মিত্রের সুরে-‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ঘিরে ‘ – নচিকেতা ঘোষের সুরে- ‘ঐ দূর আলেয়ার একটু আলো,’সূর্য মুখী আর সূর্য দেখবে না ‘। তাঁর গীত গান গুলিতে সুরের মোহ ছাড়াও থাকত অপূর্ব এক মেলানকলি ময় বিষণ্নতা।সুরের মূর্ছনায়,মীড়ের মোচড়ে তাঁর গায়কী শ্রোতার মনে আঁকতো বেদনার ছবি-তুলতো ব্যথার ঢেউ।তাই তিনি সংগীত বোদ্ধা অবোদ্ধা সব শ্রোতাদের‌ই মন হরণ করে নিয়েছিলেন।এভাবেই বাংলা গানের স্বর্ণ যুগে তাঁর আসন হয়েছিল পাতা।
              শাস্ত্রীয় সংগীতে দক্ষতা থাকার জন্য‌ই খুব কম বয়স থেকেই সতীনাথের গানে সুর করার প্রবণতা ছিল। ১৯৫৮ সালে লতা মঙ্গেশকর তাঁরই সুর করা”আকাশ প্রদীপ জ্বলে”এবং “কত নিশি গেছে নিদহারা”–এ দুটি গান গেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। পবিত্র মিত্র’র লেখা ঐ গান দুটিতে দুরকমের সুর চলনের দ্বারা দুই আবেদন সৃষ্টিকারী সুরকার সতীনাথ বাংলা আধুনিক সংগীত জগতকে দুটি অমর গান উপহার দিলেন। এ ছাড়াও তাঁর সুরারোপিত,হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গীত-‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নাই,” শ্যামল মিত্রের কন্ঠে-“তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলা ঘর,”উৎপলা সেনের কন্ঠে- ” কিংশুক ফুল হিংসুক ভারী,” ঝিকিমিকি জোনাকির দীপ জ্বলে,” মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মুখে-” তুমি ফিরায়ে দিয়েছো” ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে-“আমি চেয়েছি তোমায়,সুপ্রীতি ঘোষের গলায়-“যেথায় গেলে হারায় সবাই,” শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের -এত যে শোনাই গান, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে-তুমি ফিরায়ে দিয়েছো,এমন সব গান বাংলা সংগীত সম্ভারের অমূল্য সম্পদ।
           উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে বুৎপত্তি সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে কেবল একজন সার্থক সুরকার‌ই করে নি,এই পান্ডিত্যের সুবাদেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ছিলেন একজন  সুযোগ্য, সার্থক এবং সফল সংগীত গুরুও।
তাঁর সফল শিষ্য তালিকায় রয়েছেন সর্বশ্রী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়,রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়,অরুণ দত্ত,দীপক মৈত্রর মতো গুণী শিল্পীরা।’এ তো নয় শুধু গান’-‘কত কথা হল বলা ‘সতীনাথ সুরারোপিত দীপক মৈত্র গীত এ গান দুটি দীপক মৈত্রকে সর্বার্থেই অমর করে রেখেছে। আকস্মিক প্রয়াণে স্তব্ধ হয়েছিল দীপক মৈত্রের সুরসাধনা।তাঁর শহর চুঁচুড়াতেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পরবর্তী কালের আরও এক বিখ্যাত শিল্পী শ্রী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় কে এবং তাঁকে উপযুক্ত তালিমের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি নিজেও তাঁর এই সুযোগ্য শিষ্যের লেখা বেশ কয়েকটি গান রাগপ্রধান গান হিসেবে সুরারোপ করে নিজেই গেয়েছেন।
           সংগীতের পেশার শুরুতে যেমন তিনি ছায়াছবিতে প্লে ব্যাক করেছিলেন,তেমনি খ্যাতির তুঙ্গে এসেও বিভিন্ন ছবিতে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে যেমন গান করেন তেমন‌ই সুরকার হিসেবে অনেক ছায়াছবিতে ও তিনি কাজ করেছেন।তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমার পরিচালিত “বনপলাশীর পদাবলী ” ছবিতে সুর প্রদান।
           রাগপ্রধান গানেও সতীনাথ তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রজ্ঞার সঙ্গে সংগীত পরিবেশনের আপন মাধুরী  মিশিয়ে তৈরী করেছেন নিজস্ব সুষমা মন্ডিত এক সংগীত ধারা।তাঁর সেই কোমল মধুর ভঙ্গিমায় রাগপ্রধানের খটমট ভাব হয়েছে মিষ্টি, সুললিত। নজরুল গীতির গায়নেও মিষ্টি মধুর ভঙ্গিমায় সতীনাথ এক অন্য আঙ্গিকে নজরুল গীতি কে পেশ করেছেন। এছাড়া ও হিন্দিতে সতীনাথের বহু ফিল্মি ও নন ফিল্মি গানের রেকর্ড রয়েছে।
           পরিশেষে শুধু এ কথাই বলা যায় আজ বাংলা সংস্কৃতির এমন দৈন্যের সময় যখন বাংলা আধুনিক গানের কথা তার দার্শনিক-সাহিত্যিক মান হারিয়ে এবং সুর তার মাধুর্য্য লুটিয়ে ও গায়কী তার মৌলিকতা বিসর্জন দিয়ে রিক্ত,নিঃস্ব – সেই সময়ে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান মরুভূমিতে মরুদ্যানের মতো এক সজীব,শ্যামল,কোমল আশ্রয়-মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ঐতিহ্য,কৃষ্টি, সংস্কৃতির বিশালত্ব।আজ শতবর্ষে এই মহান সঙ্গীতকারকে জানাই আভূমি প্রণতি।।
*******************************

মধুমিতা মিত্র: পেশা–স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ..

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!