আবার বাজল সানাই
চন্দ্রকান্তি দত্ত
প্রেমে পড়লে মানুষের যে এরকম দুর্গতি হয়, ভোলাদাকে না দেখলে সেটা আমি জানতে পারতাম না।
ভোলাদা আমার থেকে বছর তিনেকের বড়। আমি যখন ক্লাস নাইনে, ভোলাদা তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের জ্ঞানদাসুন্দরী হাই স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপটেন ছিল। আর শুধু ক্যাপটেন নয়, ফুটবল টিমের অবিসংবাদী সেন্টার ফরোয়ার্ড। ভোলাদা খেললে এ অঞ্চলের কোন দলেরই ক্ষমতা ছিল না যে জ্ঞানদাসুন্দরীকে হারায়। ভোলাদা পায়ে বল নিয়ে এগোলে অন্যপক্ষ ‘ত্রাহি মধুসূদন’ ডাক ছাড়ত।
আমাদের জ্ঞানদাসুন্দরীতে আমরা ছেলেরা মেয়েরা একসাথে পড়তাম। ক্লাস নাইনে ওঠার পর যখন আমরা হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরলাম, তখন কিছু ছেলের মধ্যে শাড়ি পরা মেয়েদের দেখে একটু অতিরিক্ত পুলক জাগল। তবে সেটা শুধুই পুলক, তার বেশী কিছু নয়। কারণ, স্কুলের ছেলেমেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে রোমান্সে মেতেছে, এ খবরটা চাউর হতে সময় লাগত না। ফল হতো মারাত্মক। দোষী ছেলের পিঠে অন্ততঃ দুখানা বেত ভাঙতেন আমাদের হক স্যার। এদিকে বাড়িতে খবর পৌঁছলে, সেখানেও এক দফা ঠ্যাঙ্গানি জুটত। এ তো গেল ছেলেদের কথা। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা আরও মারাত্মক। সেবার দেখলাম, অনিলের সাথে চাঁপার একটু বেশী বেশী কথা বলার খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই অনিল তো শাস্তি পেলই, সাথে সাথে চাঁপারও স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেল। শেষে চঞ্চল স্যার চাঁপার বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ব্যাপারটা মেটালেন।
আমাদের ভোলাদা কিন্তু এসব থেকে শত যোজন দূরে থাকত। পড়াশোনার বাইরে তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল ফুটবল। স্কুল চলাকালীন টিফিনের ঘন্টা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকত। ঘন্টা পড়ার পরে স্যার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যেটুকু অপেক্ষা। তারপর আধঘন্টা আর তার দেখা পাওয়া যেত না। অনেক দিনই এরকম হতো যে ভোলাদা টিফিন পিরিয়ড শেষের ঘন্টা শুনতে পেত না। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ঢুকত তখন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। অন্য কেউ এরকম অন্যায় করলে কি হতো বলা যায় না। তবে, ভোলাদার বেলায় সেসব কিছু ঘটত না। স্যার গম্ভীর মুখে বলতেন, “বলটা ওই কোণে রেখে জায়গায় গিয়ে বোস।”
ভোলাদা তখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। সেখানেও ফুটবল নিয়ে মেতে উঠেছে। কলেজ টিমে জায়গা করে নিয়েছে। এবার মুকুন্দ পাকড়াশী স্মৃতি শিল্ডের ফাইনালে উঠেছে আমাদের জ্ঞানদাসুন্দরী আর ভোলাদার কলেজ। ফাইনাল হবে জ্ঞানদাসুন্দরীর মাঠে। ফাইনালের দিন খেলার আগে আমাদের স্পোর্টস স্যার ভোলাদাকে একা পেয়ে কানে কানে কি একটা বললেন। ভোলাদা হ্যাঁ না কিছুই বলল না। পরে খেলাতে ওরা আমাদের গুণে গুণে তিনটে গোল দিল। তার মধ্যে দুটো ভোলাদা। পরে স্যারকে বলে গেল, “কিছু মনে করবেন না ।স্যার। মিরজাফর হতে পারলাম না।”
তা যে কথা বলছিলাম। মানে প্রেম করার কথা বা প্রেমে পড়ার কথা।
ভোলাদা একদিন কথায় কথায় বলল, “বুঝলি মানু, প্রেমে পড়া একটা রোগ। এ রোগে যে পড়েছে, তার মোটামুটি হয়ে গেল। একুল ওকুল সব শেষ।”
আমি কতকটা বুঝতে পারলেও পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। ভোলাদার মুখে প্রেমে পড়ার কথা শোনা আর ভূতের মুখে রামনাম শোনা একই ব্যাপার। শুধোলাম, “কেন দাদা? সব শেষ হবে কেন?”
ভোলাদা বিজ্ঞের মতো একটা হাসি দিয়ে বলল, “তুই দেখছি একটা আকাট মুখ্যু তৈরি হচ্ছিস। আরে, শেষ হবে না তো কি হবে? লাইফ তো তখন পুরো কেরোসিন।”
– “কেরোসিন? মানে?”
– “কেরোসিন মানে কেরোসিন। ব্যাটা নিজেও জ্বলবে, অন্যকেও জ্বালাবে।”
উপমাটা ভাল লাগল না। কেউ প্রেম করছে বলে তার লাইফকে একেবারে কেরোসিন বানিয়ে দেওয়া কি ঠিক? ওই তো ইন্দ্রদা আর লতাবৌদি। ওরাও তো এক অফিসে কাজ করতে করতে প্রেম করে বিয়ে করেছে। কই, নিজেরা জ্বলছে বা কাউকে জ্বালাচ্ছে বলে তো শুনিনি। তাহলে ভোলাদা হঠাৎ এই কথাটা বলল কেন? খোঁজ নিতে হবে।
সেদিন সন্ধ্যের মুখে লাইব্রেরী থেকে ফিরছি। পথে ননীর সাথে দেখা। ননী বলল, “মানু শুনেছিস, ভোলাদাকে নাকি আজকাল ক্ষুদিরাম পার্কে খুব দেখা যাচ্ছে!”
আমি অবাক হলাম। বললাম, “সে কি রে? ভোলাদা এখন জ্ঞানদার মাঠে প্র্যাকটিস করে না? কেউ বারণ করেছে?”
ননী মুখে একটা তির্যক হাসি ফুটিয়ে বলল, “না গুরু। কেস অত সোজা নয়। ভোলাদা সকাল সকাল জ্ঞানদায় প্র্যাকটিস শেষ করে বল নিয়ে ক্ষুদিরামে যাচ্ছে। সেখানে একা একা বল পায়ে কেরামতি দেখাচ্ছে।”
– “কেরামতি দেখাচ্ছে? কাকে?”
– “সেখানেই তো রহস্য রে মানু। সেটা এখনও ঠিক ধরা যাচ্ছে না।”
– “কে হতে পারে বলতো?”
– “এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে ক্লাস টেনের সোনা, শিখা, তনু বা করবী, এদের মধ্যে কেউ হবে। এরাই রোজ একসাথে ক্ষুদিরামে যায়। এদেরই সামনে সন্ধের মুখে বল নিয়ে ভোলাদা কেরামতি দেখাচ্ছে।”
বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। ভোলাদা এরকম ছেলেমানুষী করছে, এটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আবার এই ভোলাদাই সেদিন কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ প্রেম নিয়ে কথা বলল। পালের হাওয়া কোনদিকে একটু মাপতে হবে।
দুদিন পরে আমি আবার লাইব্রেরী গেলাম। বই পালটে সোজা রাস্তায় না ফিরে ক্ষুদিরামের পাশের রাস্তা ধরলাম। বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, ননী এক বর্ণও বাড়িয়ে বলে নি। ক্লাস টেনের ওই চারজন একটা বেঞ্চে বসে আছে। আর ভোলাদা একটু তফাতে বল নিয়ে একাই কি সব কসরত করে চলেছে। কখন থেমে গিয়েছি বুঝতে পারি নি। একটু পরেই সন্ধ্যা নামল। মেয়েরা বাড়ির দিকে রওনা হল। ভোলাদা প্রথমে দেখতে পায় নি। যখন দেখল, তখন তাড়াতাড়ি বলটা তুলে নিয়ে গেটের দিকে দৌড় লাগাল।
ননীর মত একই দশা আমারও। ভোলাদা কার জন্যে এসব করছে বোঝা গেল না। তবে খেলার যে বারোটা বাজছে,এটা অতি বড় মূর্খও বলে দিতে পারবে।
এরপর মাসখানেক আর কোন খবর নেওয়া হয় নি। অ্যানুয়াল পরীক্ষা, থিয়োরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল মিলে, প্রায় একমাস চলল। এবার দশদিন ছুটি। ডিসেম্বরের চব্বিশে রেজাল্ট বেরোবে। তারপর আবার ছুটি। মনে পড়ল ভোলাদার খবর নিতে হবে। বড্ডো দেরী হয়ে গেছে। বিকেল হতেই চললাম সোজা ক্ষুদিরামের দিকে। গিয়ে দেখি, ভোলাদা আসে নি। একটু তাকাতেই দেখলাম, মেয়েরাও সবাই নেই। তিনজন আছে। আমি সোনা ছাড়া কাউকে চিনি না। তাই বুঝতে পারলাম না ঠিক কে নেই।
পাড়ায় ফিরে ননীকে পেলাম। ক্রিকেট খেলে ফিরছে। বলল, “কি গুরু? পরীক্ষা কেমন হল? এবারও ফার্স্ট তো?”
আমার মাথায় তখন ভোলাদা ছাড়া আর কিছু নেই। কোনরকমে বললাম, “পরীক্ষা ভালই হয়েছে রে। তোর কেমন হল?”
ননী সাইকেল থেকে নেমে বলল, “আমারও ঠিকই হয়েছে। খালি ইংলিশটা একটু ডুবিয়েছে।”
– “যাক গে। যা হবার হয়েছে। এখন তো আর কিছু করার নেই। এদিকে ভোলাদার খবর কি রে?”
– “ও, তুই কিছু জানিস না, তাই না?”
– “না রে। পরীক্ষা পরীক্ষা করে আর কিছু জানার উপায় ছিল না।”
– “ভোলাদার ফুটবল খেলা প্রায় লাটে উঠেছে। এখন সপ্তাহে মেরেকেটে দুদিন জ্ঞানদাসুন্দরীতে প্র্যাকটিস করে। বাকি চারদিন শিখার সাথে রূপনারাণের পাড়ে যাচ্ছে। একদিন আমার সামনে পড়ে গেছে। আমাকে দেখে বলল, ‘ননী, বাদাম খাবি?’ আমি নির্বিকার মুখে বললাম, ‘দাও’। তোকে কি বলব রে মানু, বিকেল চারটেয় কেনা চারআনার বাদাম, সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত একটাও খরচ হয় নি। চারআনা কে চারআনাই রয়ে গেছে।”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “বলিস কি রে? ভোলাদার এই অধঃপতন? লাইফ তো পুরো কেরোসিন রে!”
এবার ননীর চমকানোর পালা। আমার মতো মার্কামারা ভাল ছেলের মুখে এরকম কেরোসিন মার্কা উপমা ও আশা করে নি। বলল, “কি বললি? কেরোসিন?”
আমি ওকে শান্ত করলাম, “কথাটা আমার নয়। ভোলাদার। ভোলাদা কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিল, প্রেম করলে নাকি লাইফ কেরোসিন হয়ে যায়।”
দুজনে প্রাণখুলে হাসলাম। তারপর ননীর কথামত ঠিক হল আমরা দুজনে একদিন রূপনারান যাব। গোয়েন্দাগিরি করতে।
মাস তিনেক পরে একদিন ভোলাদার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। শুনতে পেলাম, ভোলাদার জেঠু প্রবল চেঁচাচ্ছেন। “বংশের কুলাঙ্গার একটা। পড়াশোনায় একেবারে বিদ্যেসাগর। কোনরকমে থার্ড ডিভিশন পেয়ে কলেজে পড়ছে। এবার এই উল্টোপাল্টা কাজের জন্যে সেটাও যাবে। মন দিয়ে ফুটবলটা খেলছিল। এবার প্রেম না পিরিতি, কি একটা করে সেটাও জলাঞ্জলী দিয়েছে। ছি ছি। লোক সমাজে মুখ দেখাবার জো রাখলে না।”
বাড়ি থেকে কেউ বেরোচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম।
এরপর দীর্ঘদিন ভোলাদা বা শিখাকে একসাথে দেখা যায় নি। বস্তুতঃ, শিখা আর বাইরেই বেরোয় না। শুধুমাত্র স্কুলে যায় । ভোলাদা পুরো দমে প্র্যাকটিস করছে। যদিও টিমে ফেরার সুযোগ এখনও পায় নি।
মাসখানেকের মধ্যেই শিখাদের বাড়িতে সানাই বাজল। আমরা হাত চেটে খেয়ে এলাম। শুধু ভোলাদার বাড়ির কাউকে দেখতে পেলাম না।
ভোলাদার এক মামা কলকাতায় থাকতেন। এখানে দিদির বাড়ি বেড়াতে এসে সব শুনে ভোলাদাকে নিয়ে কলকাতা চলে গেলেন।
দীর্ঘ তিন বছর ভোলাদার কোন খবর পাই নি। আমি হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে দুর্গাপুরে আর ই কলেজে পড়ি। মাঝে মাঝে বাড়ি গেলেও ভোলাদার খবর নেওয়া হয় না। ননীও ওখানে নেই। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ছে। তাই ওর সাথেও দেখা হয় না।
সেবার দুর্গাপুরে নেহেরু স্টেডিয়ামে আই-এফ-এ শিল্ডের কয়েকটা খেলার আয়োজন করা হল। আমি মফ:স্বলের ছেলে। কোনদিন কলকাতা যাই নি। স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতার কোন দলের খেলাও দেখি নি। সুতরাং টানটান উত্তেজনা। এবার দেখব। মোট ছটা খেলা হবে। ঠিক করেছি, সবকটাই দেখব।
আমরা পাঁচজনের একটা দল ঠিক সময়মতো মাঠে হাজির হলাম। থিকথিকে ভীড়। স্টেডিয়ামে মাথা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ইস্টার্ন রেলের সাথে এরিয়ানের খেলা। কমেন্ট্রি বক্স থেকে দুদলের খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। আমাকে অবাক করে ইস্টার্ন রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে ভোলানাথ মজুমদারের নাম ঘোষণা করা হল। আমার খেলা দেখা মাথায় উঠল। প্লেয়াররা মাঠে নামামাত্র আমি এদিক ওদিক করে ভোলাদাকে খুঁজতে লাগলাম। হ্যাঁ। এই ভোলানাথই আমাদের প্রিয় ভোলাদা। খেলা চলার মাঝেই বাকি বন্ধুদের ভোলাদার পরিচয় দিলাম। বললাম, “খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে বেরবো। যদি একবার দেখা করতে পারি।”
দেখা করা গেল না। দেখা করা দূরের কথা, উদ্যোক্তা ও পুলিশ কাউকে প্লেয়ারদের কাছাকাছি ঘেঁষতে পর্যন্ত দিল না। বাকি খেলাগুলোও দেখলাম। তবে প্রথম দিন যে উত্তেজনা ছিল, সেটা আর খুঁজে পেলাম না। আসলে তখন মাঠে গেলেই ভোলাদা ছাড়া কাউকে ভাবতে পারছি না।
ডিসেম্বর মাসের শেষে খ্রীসমাসের ছুটিতে বাড়ি এলাম। ননীও এসেছে। দেখা করে ভোলাদার কথাটা ওকে বললাম। ননী বলল, “আমি জানি রে মানু। ভোলাদা এখন রেলে চাকরী করে। খেলার কোটায় পেয়েছে। সেই সূত্রেই ইস্টার্ন রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড। আমি কয়েকবার দেখা করেছি। ভোলাদাও আমার ওখানে এসেছে। এখন বেশ ভাল আছে। তবে শিখার কথা মাঝে মাঝে বলে। এখনও ভুলতে পারে নি।”
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ননীর চিঠি পেলাম। লিখেছে, ‘এ মাসের উনত্রিশ থেকে দিন চারেকের জন্য বাড়ি আসার ব্যবস্থা কর। ভোলাদার বিয়ে। ভোলাদা তোকে বলতে বলেছে। বাকিটা সারপ্রাইজ।’
বিয়ে করার মধ্যে সারপ্রাইজের কি থাকতে পারে বুঝতে পারলাম না। তবে যাব। ভোলাদা নিজে না বললেও যাব।
ভোলাদার বিয়ে। সময়মতো হাজির হয়েছি। বাবা মা কাকা কাকি, এমন কি কাকার দশ বছরের মেয়ে পর্যন্ত অবাক। আমি অবশ্য গায়ে মাখছি না। এসেই ভোলাদার সাথে দেখা করলাম। বললাম, “আচ্ছা মানুষ কিন্তু তুমি ভোলাদা। ননীকে দিয়ে নেমন্তন্ন করেছ, অথচ পাত্রী কে সেটা জানাও নি। এ কেমন কথা?”
ভোলাদা পাত্তা দিল না। বলল, “একটু ভারিক্কি হয়েছিস মনে হচ্ছে। যাক গে। যা হয়েছিস হয়েছিস। এদিকে এতক্ষণ তোর কথাই ভাবছিলাম। কালকে খুব সকালে জামাই সেজে আমার এখানে চলে আসবি।”
আমার কথার জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলছে দেখে আমি খেপে গেলাম। বললাম, “জামাই সেজে মানে? বিয়ে আমার না তোমার?”
ভোলাদা হাত পায়ের নখ কাটতে কাটতে বলল, “আরে, চটছিস কেন? তোকে বিয়ে করতে হবে না। তুই শুধু গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে যাবি।”
আমি তখনও ঠান্ডা হই নি। বললাম, “কনে কে তা-ই জানি না তার আবার তত্ব নিয়ে যাওয়া।”
ভোলাদা তখনও হাসছে। হাসি থামিয়ে বলল, “তোকে ননী কোন সারপ্রাইজের কথা বলেছিল?”
আমাকে এবার শান্ত হতে হল। বললাম, “হ্যাঁ, বলেছিল।”
– “তাহলে মেলা রাগ না দেখিয়ে অপেক্ষা কর না!”
আমার বিস্ময়ের আর সীমা-পরিসীমা রইল না যখন গাড়ি আমাকে আর ননীকে নিয়ে শিখাদের বাড়ির গেটে থামল। বিয়ের সাজে সজ্জিত বাড়ি। সানাই বাজছে। আমি ননীর দিকে তাকালাম। এখানে কার সাথে বিয়ে? শিখার তো কোন বোন নেই। দুটো যমজ ভাই আছে – কাল্টু আর বিল্টু।
আমার অবস্থা দেখে ননীর বোধহয় করুণা হল। বলল, “শোন তবে। কনে আর কেউ নয়। স্বয়ং শিখা। বাকিটা ফিরে যেতে যেতে বলব।”
ভাগ্যের নির্ম্মম পরিহাস বা অন্য কোন কারনে শিখার বিয়ের মাত্র দুবছরের মাথায় ওর স্বামী কোন এক কঠিন রোগে মারা যায়। রোগটা পুরনো। ওরা গোপন করেছিলেন। শাশুড়ি ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি এবং সব জানা থাকা সত্বেও বৌমাকে দায়ী করেন। স্বাভাবিক ভাবেই শিখার পক্ষে সেখানে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। শিখাকে এক বস্ত্রে বাপের বাড়িতে ফিরতে হয়।
খবরটা আমাদের ছোট্ট শহরে যেমন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তেমনই কোন হিতৈষী মারফত ভোলাদার কাছেও পৌঁছে যায়।
ভোলাদা পরবর্তী সুযোগে দেশে এসে শিখার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু সদ্য বাপের বাড়ি ফেরা শিখা তখন স্বেচ্ছাবন্দি। যোগাযোগ হয় না। ছুটি ফুরিয়ে আসায় ভোলাদাকে কলকাতা ফিরতে হয়।
কিন্তু ভোলাদা হার মানে না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে জীবনের প্রথম ও একমাত্র ভালবাসার মানুষকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দেবে। নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে তাই চিঠি লিখে শিখাকে বিয়ে করার কথা সরাসরি তার নিজের মাকে জানিয়ে দেয়।
মা পড়েন মহা বিপদে। এ বাড়িতে ভোলাদার জেঠু আদিনাথ মজুমদারের অনুমতি ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। অতএব জেঠু রাজি না হলে ভোলার পক্ষে একজন বিধবা মেয়েকে বিয়ে করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। অনেক ভেবে ভোলাদার মা বড় জাকে কথাটা বললেন।
ঘোষবাড়িতে প্রথমবার সানাই বেজেছিল তিনবছর আগে ১৯৭৩ সালে। সেবার সানাই-এ বৈরাগী ভৈরব বাজলেও অনেকের মনের কোনে বিষাদের সুর জেগেছিল। আজ ১৯৭৬ এ আবার ঘোষবাড়ি সানাইএর সুরে মুখরিত। বাজছে বৈরাগী ভৈরব, বাজছে মধুবন্তী সারং। অল্পবয়সী দুটি প্রাণ অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ভালবাসার মানুষের সাথে মিলিত হচ্ছে। সেই হেতু শুধু মিলনের সুর।
আমি ভোলাদার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, “ভোলাদা, প্রেমে পড়লে সবার লাইফ কেরোসিন হয় না। কারো কারো বেলায় গোলাপ হয়েও ফোটে।”
—শেষ—
***************************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
Khub valo laglo.