ছিন্ন পায়েল
সোনালী গুহ
জন্মের পর একবারই মাতৃ দুগ্ধ পান করার সুযোগ পেয়েছিল সদ্যজাত ছেলেটি। চিনলোই না মাকে সে। জানলোই না মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ কেমন।বুঝতেই পারলনা মাকে। হায় রে হতভাগ্য সন্তান !!! জন্মের ঠিক সাতদিনের মাথায় মা চলে গেল চিরতরে।
বিলাপ করছিলেন,এইধরনের নানান কথা বলে বলে বছর সত্তরের মহিলাটি।সামনের ইজিচেয়ারে তার স্বামী ,নিশ্চুপ বসে।চোখের জল ও বুঝি শুকিয়ে গেছে এই প্রৌঢ় দম্পতির।সদ্য তারা একমাত্র কন্যাকে হারিয়ে দিশেহারা।
নন্দী দম্পতির একটিই সন্তান।ছোট থেকেই বড় আদরে যত্নে মানুষ করেছেন।ইংলিশে এম এ পাশ করেই একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চাকরিও পেয়ে গিয়েছিল পায়েল।ছোট বেলা থেকেই নাচের প্রতি একাগ্রতা দেখে বাবা তাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দেন।পাশের বাড়ির রণর সঙ্গে ছিল বাল্যপ্রেম। দুই বাড়ির সম্মতিতেই দুজনের বিয়েও হয় বছর চারেক আগে।সেইসময় করোনা সকলকে গৃহ বন্দী করেছে।তারই মধ্যে একটু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতেই বেজে ওঠে সানাই।যেহেতু মেয়েকে দূরে পাঠাতে হয়নি,তাই নন্দী দম্পতির মনে বেশ স্বস্তি ছিল।কিন্তু আজন্ম চেনা জেঠিমা শাশুড়ি হতেই গিয়েছিলেন বদলে।একমাত্র ছেলে বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল,এই ভয় ঢুকলো মনে।ব্যস ! শুরু হল,খুব কায়দা করে পায়েলের উপরে নির্যাতন।যদিও কেউ বুঝতেই পারতেননা যে,সেটা আসলে শাশুড়ির অত্যাচার।আরে,পায়েল নিজেই তো বোঝেনি প্রথমদিকে।তবুও সুখ ছিল মনে।দুটিতে সেই ছোটবেলার মতই বকবকুম করে করেই কাটাতো দিন।ততদিনে স্কুলের চাকরির পাশাপাশি নিজের একটা নাচের স্কুলও হয়েছে পায়েলের।সাধ করে একটা খুব সুন্দর পায়েল কিনে নিয়ে এসেছিল, রণ অফিস ফেরত বউয়ের জন্য।আসলে সেদিনটা ছিল ওদের দুজনের জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।ওইদিনই তারা বাল্য বন্ধুর থেকে নিজেরা যে প্রেমিক প্রেমিকা হতে চলেছে ,সেটা উপলব্ধি করেছিল ওরা। তাই সামান্য হলেও নিজেদের মতো করে উদযাপন করতো তারা দিনটি।সেদিন অফিস ফেরত বউয়ের জন্য ঘরেই বসে ছিল রণ।ওদিকে ছেলে ফিরে মায়ের খোঁজ না নেওয়ায় মাতৃদেবীও বেশ রেগে ছিলেন।পায়েল ঘরে ঢুকতেই রণ ওকে জড়িয়ে ধরে।বিছানায় বসিয়ে কোলের উপর তুলে নেয় ওর পা দুটি।নিজের হাতে পরিয়ে দেয় পায়েল জোডা।সেদিনই রাতে সেটা লক্ষ্য করে শাশুড়ি মা বিরক্ত হন।তারপর থেকেই পায়েলের প্রতি তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হয়।কিন্তু দুজনে বেশ সুখী ছিল।কর্ম ক্ষেত্রেও পায়েল সকলের স্নেহভাজন ছিল।দিন কাটছিল বেশ ।
কিন্তু বিধাতা পুরুষের অভিলাষ তো অন্য।তিনি অলক্ষ্যে বসে হেসেছিলেন,এই দুই প্রেমিক যুগলের সুখে।তাই বড্ডো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল সব।
স্কুলের ডিসেম্বরের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই একদিন হঠাৎ নাচের স্কুলে পায়েলের শরীরটা বেশ খারাপ লাগে।তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।সন্ধ্যায় রণ অফিস ফেরত বউয়ের শরীর খারাপের কথা শুনে জোর করে টেনে নিয়ে যায় পাড়ার ডাক্তার ব্যানার্জির চেম্বারে।তিনি দেখেই কয়েকটা টেস্ট করতে দেন।সুখবর দেন যে,ওরা এবারে তিনজন হতে চলেছে।আসছে সে,বহু আকাঙ্খিত সন্তান।খুশিতে আত্মহারা দুজনে বাড়ি ফিরে আসে।দীর্ঘ প্রতীক্ষা চলতে থাকে।পাশেই বাপের বাড়ি হওয়ায় সেখানে গিয়ে পায়েলের থাকা হয়না বিশেষ।এইবারে মা নিয়ে যেতে চাইলে শাশুড়ি আপত্তি জানান।তাই শ্বশুর বাড়িতে থেকে যায় অন্তঃসত্ত্বা পায়েল।দুর্ভাগ্য মেয়েটার এইসময়েও শাশুড়ি বিশেষ যত্ন করেননা। তবু স্বামীর পরিচর্যায় হাসিখুশী মেয়েটা বেশ উচ্ছ্বলই ছিল।
অবশেষে এলো সেই অভিশপ্ত দিন।সেপ্টেম্বরের একুশে মাতৃভবনে সিজার করে ছেলে হয় পায়েলের।প্রকৃত প্রস্তাবে,এইবারে দুই বাড়িতেই উৎসবের আমেজ।খুশি হন শাশুড়ি নাতি পেয়ে।কিন্তু পরেরদিন থেকেই তুমুল জ্বর আসে পায়েলের।শিশুটিকে সরিয়ে নার্সারিতে রাখা হয়।ধরা পড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত সে।পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।“আমি ভালো হয়ে যাবো রণ”….. এই ছিল তার শেষ কথা।প্লেটলেট কমে আশি হাজারে নামে ।উদভ্রান্তের মত ওর স্বামী দৌড়াদৌড়ি করতে থেকে।শেষে অনেক কষ্টে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ওকে।কিন্তু নাহ্!!! সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে পায়েল ,সন্তান জন্মের সাতদিনের মাথায় চলে যায় সব ছেড়ে।
উন্মত্তের মতো রণ,দিশেহারা হয়ে ভেঙে পড়ে কান্নায়। পুত্রের প্রতি গভীর অভিমানে নেয় মুখ ফিরিয়ে।হতভাগ্য শিশুটি বুঝতেই পারে না,বিনা অপরাধে সে সাজা পেতে থাকলো। এই সাজা তার আজীবনের।
সন্তানহারা জননী বিলাপ করতে থাকে নাতিকে বোতলের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে ৷।
***************************************
সোনালী গুহ পরিচিতি
পেশায় শিক্ষিকা। মাতৃভাষায় কিছুটা মনের আনন্দে লেখালিখি করেন। অত্যন্ত অমায়িক, সবার সাথে মিলেমিশে,সবাইকে নিয়ে চলতে স্বস্তি অনুভব করেন।
সুন্দর