Shadow

জয় মা,মাগো – রাজু সেনগুপ্ত

Pc..istock

জয় মা, মাগো

রাজু সেনগুপ্ত

চন্দ্রযান৩,জি সামিট ২০২৩,শাহরুক খানের জওয়ান প্রথম সপ্তাহতেই ৫০০ কোটি টাকা,এই সব গরমা গরম খবরের মাঝে আমারবৌ এর সেকি বুক ফাটা কান্না! 
পুজো এসে গেলো অথচ ডিজাইনারের শাড়ী এলোনা।এমিনতে অসুর কে কেলিয়ে মা দুর্গার যেমন একটা পরিতৃপ্ত মুখ,আমাকে কেলিয়ে আমার বৌয়ের মুখটাও সর্বদাই তেমনি পরিতৃপ্ত। সেই মুখে নয়ন বারি দেখে মনে বড়ো দুঃখ হয়েছিল।
অমন বুক ফাটা কান্নায় আমি বড্ড বিচলিত হয়ে উঠি। এমন চূড়ান্ত সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে সোহাগের সাথে স্বান্তনা মেরে বলি, “আরে এই বছর কলকাতায় গিয়ে যে এতো গুলো শাড়ী কিনলে,সেগুলো তো শুধু কলকাতার লোকেরাই দেখেছে,এ দেশে তো  কেউ দেখেনি,সবাই ভাববে নতুন শাড়ী!”
কান্নার ডেসিবেল আরো বেড়ে গেলো তাতে,”ফেস বুকে ঐ সব শাড়ী পরার ছবি সবাই দেখেছে,আমার কি হবে!”
মনীষীদের স্মরণ করি। হঠাৎ মা সারদার ছবি স্মরণে এলো। বউ কে বলি তুমি মা সারদা হয়ে যাও।মা সারদা কে তো সবাই ঐ এক শাড়ীতেই দেখেছে সারা জীবন!
ডাক্তার বলে,”চোয়ালের অবস্থা একদম ভালো নয়,কিছুদিন এক্দম লিকুইডের ওপর থাকুন।কথা কম বলুন আর পারলে বাড়ীতে হেলমেট পরে থাকা অভ্যেস করুন।থাক আপনাদের আর আমার পারিবারিক কেচ্ছা পড়তে হবেনা। আব ম্যায় লেতা হুঁ এক ছোটাসা ব্রেক।লাউড স্পীকারে ঝঁলক দিঁখ লাঁ যা`-র সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে কলকাতার পথে ঘাটে।পার্কস্ট্রীট,চৌরঙ্গী,ধর্মতলায় চীনে,মোগলাই রেস্টুরেন্টে মার কাটারী ভিড়। রাস্তায় ফুচকা আর ফিসফ্রাই বিকোচ্ছে সমান তালে।আর এই এক আমাদের মার্কিনি দুর্গাপুজো! দিনের বেলায় আদ্যপ্রান্ত নিরামিশ,”খিচুড়ি আর লাবড়া”। গা জ্বলে যায়।আচ্ছা ফুড কমিটির লোক্গুলোকে গণধোলাই দেওয়া যায় না? রাজি থাকলে যোগাযোগ করুন ১-৮০০ গণ-ধোলাই।লাঞ্চে ঐ একপেট খিচুড়ি খেয়ে বড্ডো বিপদে পড়ে গেছি।খিচুড়ির চাল আর ডাল গুলো মহাজোট ভেঙে রাজনৈতিক দলের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে কি যাচ্ছেতাই কিচায়েন শুরু করেছে।কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছেনা। সারা ইন্টেস্টাইন জড়িয়ে তেইশ ফুটের কয়েকটা ঢেঁকুর তুলে কিছুটা আশ্বস্ত হই।দুপুরে ওয়াজেদ আলির স্মরণে ‘সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে’ মার্কা কালচারাল পোগ্গাম। ভরা পেটে বিশ্রাম নেবার আদর্শ জায়গা।কিন্তু আমার পাশের ভদ্রলোক এতো জোরে নাক ডেকে ঘুনু করছে যে আমার আর ঘুনু এলোনা।এই বাজারে কে এক পিস জানিয়ে গেলো স্ন্যাক্সে নাকি সিঙাড়া ছেড়েছে।সিঙাড়ার লোভে অন্ধকারে তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে চেয়ারে ধাক্কা। কিছুটা নুনছাল উঠে গেলো।লেঙচে লেঙচে যথাস্থানে পৌঁছে দেখি কয়েকশো লোক ইতিমধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কি পেটুক রে বাবা!!ভাগে দুটি করে সিঙাড়া,একটা ফ্যামিলি সাইজ কামড় মারলাম,উয়ে বাবা কি গয়ম’।পুর্ বলতে একতাল চটকানো আলু,আর তার সাথে মানানসই ধনেপাতা।সেই চটকানো আলুর কি তেজ রে মাইরী! দ্বিতীয় সিঙাড়াটার আলু আগেই লিক করে ছিলো,বাকি আলুটুকু বাদ দিয়ে নিমকি  বানিয়ে সাঁটালাম। এখন একটু চা বা কফি পেলে মন্দ হতোনা,কিন্তু পোড়া জিভে আর রিস্ক নিলাম না।সন্ধ্যে নাগাদ সন্ধ্যারতির নামে এক ভয়ঙ্কর নৃত্য। কিছু ধুনুচি নাচিয়ে আবার দু-চার জনের পা না মাড়িয়ে নাচ থামায় না।এদিকে আবার ডিনারের সময় হয়ে গেলো। সেই সকাল থেকে অঞ্জলি,লাঞ্চ,স্ন্যাক্স-এ লাইন দিতে দিতে ঘেন্না ধরে গেলো।বউ আমাকে ডিনারের লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে,নিজে এখন ভিড়েছে সিঁদুর খেলায়।এই সিঁদুর খেলা দেখলে একটা অদ্ভুত জাতীয়তাবোধে দেহটা সির সির করে ওঠে।ব্যাটা বেন্টিঙ্ক সাহেব সতীদাহ বন্ধ করে ভেবেছিলো সতীর প্রডাক্সন বন্ধ করে দেবে। অতই সোজা!!এদিকে আমার সিঁদুরে বৌ মাঝে মাঝেই আড় চোখে ঝাড়ি মারছে আমাকে। লাইন দিচ্ছি নাকি লাইন মারছি তা দেখতে।ইত্যবসরে এক পিস স্নান সেরে বেশ রঙিন মেজাজে এসেছেন। ভদ্রলোক পরশ্রী কাতর না হলেও বেশ পরস্ত্রী কাতর।নানান রঙের আর ঢঙের সতী দেখে উনি বেশ উত্তেজিত।আমিও ঠিক তাই,কিন্তু পাশে বৌ থাকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় যে দৃষ্টি নিয়ে সমগ্র নারী জাতিকে দেখতেন বাধ্য হয়ে আমিও সেই  দৃষ্টিতে সব নারীদের দেখছি।
ভদ্রলোক বেশ বক বক করছেন,বুঝতে পারছি উনি আস্তে আস্তে বেশ ঘেঁটে যাচ্ছেন।এখন ফ্লাইওভার,স্কাইস্ক্যাপা,ম্যাকডোনাল্ড,বিকিনির মাঝে কাশ ফুল খুঁজে না পেয়ে হতাশ।বাঙলার আকাশ,বাতাস,মাটির গন্ধের জন্য বেশ বিচলিত। স্বরচিত,বা দু এক কলি উপযুক্ত কবিতার লাইন খুঁজছিলেন।তখন আমার ইচ্ছে করছিলো ভদ্রলোককে বৌয়ের দুর সম্পর্কের ভাই হিসেবে সম্বোধন করে এক ধাক্কা মেরে ট্রামের তলায় ফেলি, হয় জীবনানন্দ দাশ হবি আর না হয় মায়ের ভোগে যাবি।ডিনারে নাকি গ্রীনল্যান্ডের বাসমতি চালের পোলাও আর হল্যান্ডের গোট মীট! সাথে অন্যান্য অনেক কিছু।দু হাতা ঝোল সমেত মাংস পেলাম। ঐ ছোট্ট ফোমের থালায় সব কিছু মিশে এক অদ্ভুত স্বাদ। বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না।আলাদা বাটিতে দুটি মিষ্টি। এ দিক ও দিক তাকিয়ে দুটো মিষ্টি মেরে দিলাম। সাথে এক গ্লাস জল খেয়ে পাপ বোধটা ধুয়ে ফেল্লুম।মাইকে এখন ঝম্পড় ঝম্পড় বাজনা বাজছে। লাইভ অর্কেস্ট্রা। কলকাতা থেকে দুজন গায়ক এসেছেন।প্রথম জন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। দিনের বেলায় উনি গান গেয়েছেন।কখন এলেন,কি গাইলেন,মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া আর কেউ জানেনা। অনেকটা আমাদের ভারতীয় হকি দলের মতো।গুটি কয়েক লোক ছাড়া,আপামর জনতা কোনো খবর রাখেনা হকি দলের কার সাথে খেলা,হারলো কি জিতলো।কারোর কিচ্ছু এসে যায় না তাতে।
দ্বিতীয় শিল্পী রিয়েলিটি শো থেকে গ্রুমিং হওয়া গায়ক। শ্রোতার মুড বুঝে গান।প্রথম গান বাংলায় দেশাত্মবোধোক,দ্বিতীয় বাংলা আধুনিক,তৃতীয় “বিড়ি জ্বালাইদে ….
গায়ক প্রথম দু লাইন গেয়ে মাইক উল্টো দিকে করে শ্রোতাদের,এখন শ্রোতারা সমবেত গায়ক।হেব্বি জমে গেছে! চটুল হিন্দি গান আছড়ে পড়ছে একের পর এক।কিছু  নাচিয়ে ততক্ষণে আসন ছেড়ে ড্যান্সিং ফ্লোরে,আর কিছু শরীর সচেতনা তন্বী গুরু পাকের পর ক্যালরী ঝরানোর আদর্শ সময়হিসেবে বেছে নিয়েছে এই সময়টাকে।
আমিও খুব উত্তেজিত।শরীর দুলিয়ে ড্যান্সিং ফ্লোরে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি,বউ কি বুঝলো কে জানে,আমায় বলে,”বয়েসের সাথে সাথে হ্যাংলামিটাও  তোমার অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে!”
আর কিছুক্ষণ পরেই মায়ের বাক্স বন্দী হয়ে স্টোরেজ বা গ্যারেজ যাত্রা।মা এখন বন্দী হয়ে পড়ে থাকবেন কারুর গ্যারেজে বা স্টোরেজে আর আমরা বন্দী থাকবো অফিসের ছোট্টো কিউবিকলে।কিবোর্ডে এন্টার মারতে মারতে কেড়ে আঙুলে কড়া,বস,ক্লায়েন্ট,পরিবার সামলাতে সামলাতে বছর ঘুরে আবার পুজো।পুরনো বউ সামনের পুজোতে দেখি আবার কি নতুন বায়না ধরে। এই বিদেশ বিভুঁয়ে মা তুমি একমাত্র ভরসা।
জয় মা,মাগো…
******************************************
লেখক পরিচিতিঃ সুনীল গাঙ্গুলী শক্তি চট্টোপাধ্যায়,সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়া,কিশোর,মান্না,সন্ধ্যা,হেমন্তর লংপ্লে রেকর্ডে গান শুনে ও টুকে পাস করে দিব্য আছি। কলির কেষ্ট হবার ইচ্ছে ছিলো,সময়ান্তরে কলির ভীষ্ম হয়ে বাঁচবো……।।

রাজু সেনগুপ্ত ছবি
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!