দোলা লাগিল রে
ব্রতী ঘোষ
দু দিন ধরে বাবার সঙ্গে নীলের ভারী মনকষাকষি চলছে ৷ সামনেই ওর বড় মাসির মেয়ের বিয়ে ৷ আর তাই নীল ওর জমানো টাকা দিয়ে একটা নতুন ঘড়ি কিনবে ঠিক করেছে,বিয়েতে পরবে বলে ৷ কিন্তু বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে ও ঠিক কেন নতুন একটা ঘড়ি কিনতে চাইছে। বাবার যুক্তি হল,তোমার একটা ঘড়ি আছে সেটার স্ট্র্যাপটা বদলালেই নতুন হয়ে যাবে ৷ ক্লাস নাইনের ছেলের দুটো ঘড়ি থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই। এটা বাড়াবাড়ি ৷ তাহলে নতুন ঘড়ি কেনার যুক্তিটা খাটছে না ৷ কিন্তু নীল কি করে বাবাকে বোঝাবে যে বিয়ে বাড়িতে সায়ন্তনী আসবে ৷ এর আগেরবার মামার বাড়িতে সায়ন্তনী ওর ঘড়িটা দেখে বলেছিল সেকেলে,এখনকার স্মার্ট ওয়াচ গুলো বেশ ভালো লাগে। তাই এবারে বুকুদির বিয়েতে ও কিছুতেই ওই পুরনো ঘড়ি পরে যেতে পারবে না ৷ তাতে যদি বাবার সঙ্গে আড়ি করতে হয়-তবুও না ৷ বাবাই তো ওর বেস্ট ফ্ৰেন্ড,তাহলে বাবা কেন যে এই লজ্জার ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনা !! ও তো বাবাকে তখনই বলেছিল ব্যাপারটা ৷ শুনে বাবার কি হাসি !! আচ্ছা হাসির কি হল ??
নীলের বড় মাসির বাড়ি রিষড়াতে ৷ মামাবাড়ি ও ওখানেই | বড় মাসির কিরকম যেন লতায়পাতায় আত্মীয় হয় সায়ন্তনী ৷ বড় মাসির বাড়ি কোন নেমন্তন্ন হলেই ও আসবে ৷ সেই ছোট্ট থেকেই নীলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ওর ৷ সায়ন্তনী আর নীল একই ক্লাসে পড়ে ৷ গতবার মামার ছেলে গোগলের অন্নপ্রাশনে শেষ দেখা হয়েছিল সায়ন্তনীর সঙ্গে। পিঙ্ক রঙের লম্বা ড্রেস পরে ওকে যে কি সুন্দর লাগছিল !! তারপর তো করোনা,লকডাউন ইত্যাদি প্রভৃতি কত কি যে হয়ে গেল !! বেশ কিছুদিন পর এবার আবার মামাবাড়ির কোন অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে দেখা হবে। সেজন্য নীল মনে মনে বেশ উত্তেজিত ৷ তবে সবচেয়ে বেশি বোধহয় মনটা উচাটন সায়ন্তনীর জন্য ৷ নীল জানে সায়ন্তনী এখন আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে দেখতে ৷ ও যে চোখ বুজলেই দেখতে পায় ওকে ৷ ওর হাসি,গভীর চোখের দৃষ্টি সেটা যে কিছুতেই ভুলতে পারে না ।
যাক শেষমেষ অনেক কষ্ট করে বাবাকে রাজি করিয়ে নীল ঘড়িটা কিনে ফেলেছে। বাবা বলেছিল আমি কিন্তু তোমাকে নিয়ে কিনতে যেতে পারবো না ৷ কিন্তু এখন আবার ঘড়ির দোকানে গিয়ে ঘড়ি কজনে কেনে ? তাই অনলাইনে ঘড়িটা পছন্দ করে ও কিনে ফেলল। অবশ্য বাবা মাকে দেখিয়েই ৷ একটা কালো রঙের স্মার্টওয়াচ। কত কি যে হয় সেটাতে ! ফোন কল ধরা যায়,প্রেসার মাপা যায়,টেম্পারেচার দেখা যায়,আরো কত কি !! যেদিন অর্ডারটা দিল তার পর দিনই দিয়ে দিল ৷ আর ঘড়িটা পরে ও রাতে ঘুমিয়েই পড়ল,আর একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সারাটা রাত ধরে ৷ ঘড়িটা যেইমাত্র সায়ন্তনীকে দেখিয়েছে সায়ন্তনী ওর হাতটা ধরে একটা হামি খেয়ে ছুট্টে চলে গেছে একেবারে মামার বাড়ির ছাদে আর নীলও চলে এসেছে সেখানে ৷ সেই পিঙ্ক রঙের লং ড্রেসটা পরে আছে ও ৷ ওর লম্বা চুলের ক্লিপে একটা কাঠগোলাপ গুঁজে দিতে যাবে এমন সময় মায়ের ডাকে ঘুমটা গেল ভেঙে ৷ উফ্ ! মা যে কি করে !! আর দুটো মিনিট অপেক্ষা করলে কি হতো ?
নীল ঠিক করে ফেলেছে এবারে বুকুদির বিয়েতে সায়ন্তনীকে একটা ফুল দেবেই দেবে। দেখতে দেখতে বুকুদির বিয়েটা এসে গেল ৷ বাবা মার সাথে বিয়ের আগের দিনই নীল পৌঁছে গেল বড় মাসির বাড়িতে। সুযোগ বুঝে বুকুদির থেকে ও ঠিক জেনে নিল যে সায়ন্তনীরা কখন আসবে !! কিন্তু বুকুদি যা বললো তাতে নীলের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল ৷ বুকুদি বললো সায়ন্তনী নাও আসতে পারে কারণ ওর বাবার খুব শরীর খারাপ। আবার এলেও সকালে এসে বিকেলে বিয়েটা শেষ হলেই চলে যাবে ৷ নীল ওর অভীষ্ট দেবতা জগন্নাথ দাদার কাছে প্রাণপণে একটাই মিনতি করলো,ঠাকুর ! সায়ন্তনী যেন আসে ! ও না এলে নীলের সব স্বপ্ন,ঘড়ি কেনা যে মিথ্যে হয়ে যাবে ৷ বিয়ের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে একটা সুন্দর হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছে ও ৷ ওর ফর্সা রঙে ভারী সুন্দর মানিয়েছে ৷ আর মা ও তেমনি সবার সামনে সেই ছোট্টবেলার মতো কড়ে আঙুলটা কামড়ে দিল। কি লজ্জা ! কি লজ্জা! সত্যি মাকে নিয়ে আর পারা যায় না ৷
সারাটা সকাল পেরিয়ে গেল,বিকেল হতে চলল ৷ কিন্তু না,কোথায় সায়ন্তনী? হে ভগবান ! তাহলে কি ও আসবে না? ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে নীল ৷ সন্ধেবেলা মা’র তাড়াতে বাধ্য হয়ে জামা কাপড় পরে সে ৷ বড় মামার সঙ্গে বর আনতে যাওয়ার কথা ছিল ওর,কিন্তু অনেক ডাকাডাকি সত্ত্বেও কিছুতেই গেল না ৷ ও যাবে বর আনতে আর এর মধ্যে সায়ন্তনী এসে যদি চলে যায়, তাহলে কি করবে ও ? এত ব্যস্ততার মধ্যে ও বাবা এসে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল,’নীল তোর মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন রে?’
‘কই না তো ?’
‘মুখটা একটু ভালো করে ধুয়ে নিস,কেমন যেন কালো লাগছে ৷’
বিয়ে বাড়িতে এসে নীল দেখলো বুকুদির পাশটিতে চেয়ার আলো করে বসে আছে সায়ন্তনী। একটা লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে আজও ৷ ওর সুন্দর চুলগুলো কোমর পর্যন্ত এসে পড়েছে,হালকা লাল লিপস্টিকে ঠোঁট দুটো যেন গোলাপের পাপড়ির মতো লাগছে, ঠিক ওর স্বপ্নের মত। ও যে জানতো সায়ন্তনী এমনটাই সুন্দর দেখতে হয়েছে এই দু বছরে। ও তাকিয়ে আছে বাঁদিক করে ৷ ইস ! কি মিষ্টি যে লাগছে ! নীল ওর বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস হাতুড়ির শব্দটা শুনতে পায়। খুব আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বুকুদির সামনে দাঁড়ায়।
‘বুকুদি ! মাকে দেখেছিস রে ?’
‘এই তো ! একটু আগেই এদিকে ছিল ৷ মনে হয় ভেতরে গেছে !
‘নীল !! সায়ন্তনীকে দেখেছিস ?’
ভাগ্যিস ! বুকুদি ডাকলো নাহলে তো নীল চলেই যাচ্ছিল ৷
‘সায়ন্তনী ! তোর বন্ধু নীল |’
‘কি রে নীল ? তুই কত লম্বা হয়ে গেছিস !’
সায়ন্তনীর কথায় নীলের কান তখন লাল ৷
‘তুইও তো কত বড় হয়ে গেছিস !!
‘পড়াশোনা কেমন চলছে ? সায়েন্স নিলি ?’
এই সব কথাবার্তার মধ্যে রিঙ্কু মাসি এসে সায়ন্তনীকে ডাকলো,’রিম্পি চল সোনা ! তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাদের ফিরতে হবে। ”সে কি মাসি? তোমরা চলে যাবে?’ ‘হ্যাঁরে নীল ! তোর মেসোর শরীরটা একদম ভালো নেই।’
সায়ন্তনীর সঙ্গে সঙ্গে নীল ও খাবারের জায়গায় এলো। যতক্ষণ সায়ন্তনী আর রিঙ্কু মাসি খাবার খেলো নীল ওই জায়গা ছেড়ে কোথাও গেল না। সায়ন্তনীকে দেখিয়ে কতবার যে ঘড়িটা দেখল কিন্তু কই ও তো একবারও নীলের ঘড়িটা দেখল না ৷ ও যে বাবার সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে স্মার্টওয়াচটা কিনলো শুধুমাত্র সায়ন্তনীকে দেখাবে বলে !
কখন যে সময়টা পেরিয়ে যায় হুশ করে! এর মধ্যে আবার বুকুদির বর এসে গেল ৷ বাড়ির যত অতিথি সবাই যেন একেবারে বর দেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো ৷ কে যেন এসে নীলকেও টানতে টানতে নিয়ে গেল ! আরে বাবা ! বর তো আসবেই,বসবে,থাকবে, তাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে ?
বুকুদির বর সোম দাদাকে বেশ সুন্দর স্মার্ট দেখতে ৷ বড়মামা এসে বলে গেল-‘তুই সোমের কাছে কাছে থাকবি-ওর কি দরকার না দরকার সব খেয়াল রাখার দায়িত্ব তোর !!’
ব্যস ! হয়ে গেল ! যাও বা দুটো ঘন্টা একটু সায়ন্তনীর সঙ্গে থাকবে ভেবেছিল তাও গেল ৷ ওর তো খাওয়াও হয়ে গেছে ৷ এক্ষুণি হয়তো বা চলে যাবে ৷ আবার কবে দেখা হবে ! এতো শখ করে ম্মার্ট ওয়াচটা কিনেছিল সেটা একবারও দেখাতে পারলো না ৷ ওকে দেবে বলে একটা গোলাপ ফুল বুক পকেটে রেখেছিল সেটাও দেওয়া হলো না ৷ বিয়ে বাড়িতে এতো লোক,এত আত্মীয়-স্বজন সবাই কত আনন্দ করছে,শুধু নীলের কোন আনন্দ নেই। ওর বুকটা হু হু করছে ৷
বুকুদিকে বিয়ের জন্য মন্ডপে নিয়ে আসছে ৷ নীল ও সোম দাদাকে নিয়ে এসেছে বিয়ের মন্ডপে ৷ চারিদিকে হই হট্টগোল,মালা বদল হচ্ছে,সবার চিৎকারে আর ক্যামেরাম্যানের ঠেলাঠেলিতে সে এক অসম্ভব অবস্থা । বুকুদিদি আর সোমদাদার শুভদৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন নীলের কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছে। নীল পিছন ফিরতেই একরাশ মুক্তোর মত হাসি ঝরে পড়ল গোলাপ ফুলের পাপড়ি হয়ে।
‘আমরা চলে যাচ্ছি ৷ তোর ঘড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে,আমি দেখেছি ৷’
নীল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ৷ সানাইয়ের সুরটা কি ওর বুকের হৃদপিন্ডটাকে ভিজিয়ে দিতে চাইছে ?
‘আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হবি? রিকোয়েস্ট পাঠাবো ৷’
শার্টের পকেট থেকে গোলাপটা বের করে সায়ন্তনীর হাতে দিয়ে নীল বলে-‘আচ্ছা ৷’
*****************************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷
শারদ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিও,গল্পঃ ভালো লাগলো,ভবিষ্যত্ তে আরও আশা করছি।
মিষ্টি প্রেমের গল্পটা অনেককিছু মনে পরিয়ে দিল।খুব সুন্দর হয়েছে।
আহা 🥰 এমনি মিষ্টি প্রেমের কথা কেন গত জন্মের কাহিনী হয়ে এল❤️🥰❤️
ধন্যবাদ ! সুরজিৎদা !