Shadow

পুবের হাওয়া – কল্যানী মিত্র ঘোষ

পুবের হাওয়া

কল্যানী মিত্র ঘোষ

সম্প্রতি আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একটি ম্যাগনেট উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের পোশাক পরিচ্ছদের ওপর অসংখ্য বিধি নিষেধ আরোপ করা হলো। পুবের দেশ গুলোতে ছেলেমেয়েরা সাধারণত পশ্চিমী পোশাক ও ফ্যাশনের অনুকরণ করে থাকে বলে মনে করা হয়, কিন্তু এবার যেন উল্টো এক ছবি। ভারত থেকে প্রায় মধ্য বয়সে এদেশে এসে প্রথম প্রথম পথে ঘাটে খোলামেলা পোশাকের আতিশয্যে চোখ নামিয়ে ফেলতে হতো,তারপর ধীরে ধীরে সয়ে গেল। যে যেমন খুশি পোশাক পরেই রাস্তায় হাঁটুক না কেন কেউ চোখ তুলে তাকাবে না, কেউ কোনো কুরুচিকর মন্তব্য করবে না,শরীরের কোনো উন্মুক্ত অংশকে ছুঁয়ে ফেলতে ব্যগ্র হবে না, এতটাই সম্মান করে চলে প্রত্যেকে একে অন্যকে। ড্রেস কোড ব্যাপারটা কয়েকটি জায়গায় বহাল থাকলেও সরকারি স্কুল কলেজ, দোকান বাজার, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি কোথাও এর বালাই নেই। খুব বড় কোনো হোটেল বা দফতরের কথা অবশ্য আলাদা। কিছু কিছু প্রাইভেট স্কুল এবং চার্টার্ড স্কুলে ইউনিফর্ম রয়েছে তাও সে মাধ্যমিক অবধি। উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলেই ছেলেমেয়েরা নিজেদের কেউকেটা মনে করতে শুরু করে এবং নিজেদের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরতে শুরু করে দেয়। অভিভাবকদের করণীয় খুব একটা কিছু থাকেনা,কারণ এদেশে ছেলেমেয়েদের শাসন করা হয় না। ছোট থেকেই তাদের বুঝিয়ে বলতে হয় কোনটা ভালো কোনটা মন্দ,কোন দিকটা বেছে নিলে তাদের ক্ষতি হতে পারে,যদি ভালো দিক বেছে নেয় তাহলে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এই ভাবে বলপ্রয়োগ এবং ভর্ৎসনা ছাড়াই তাদের মধ্যে সচেতনতার বীজ বপন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে। বলাই বাহুল্য সেটা সর্বদা সাফল্যের মুখ দেখতে পায় না এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রচুর ছেলেমেয়ে স্বেচ্ছাচারীও হয়ে ওঠে। উচ্চ বিদ্যালয়ে যখন তারা আসে তখন অভিভাবকেরা অসম্ভব অসহায় বোধ করেন,কিশোর কিশোরীদের রাজ্য সরকার সর্বতোভাবে সাহায্য করে যাতে তাদের স্বাধীনতায় কোনো ভাবেই হস্তক্ষেপ করা না হয়। এই স্বাধীনতা যখন স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয় তখন তা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এই তরুণ প্রজন্ম যেন পোশাক এবং অলঙ্কারের মাধ্যমেই তাদের যাবতীয় বিদ্রোহ ফুটিয়ে তুলতে চায়। অনেকেই মাধ্যমিকের সময় থেকেই ড্রাগ বা অন্যান্য নেশা করতে শুরু করে নয়তো কোনো গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই দুটোই এদেশের তরুণ প্রজন্ম কে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। অভিভাবক কিছু বললে তারা এদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন সংস্থায় (CPS) যোগাযোগ করে উল্টে মা বাবাকে ই দোষী সাব্যস্ত করে।
উচ্চ বিদ্যালয়ে যখন এই সমস্ত ছেলেমেয়েরা আসে তখন তারা তাদের বন্ধুবান্ধবদেরও প্রভাবিত করতে থাকে। গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত যারা তারা বিভিন্ন গ্যাংয়ের তারিফ করে লেখা বাক্য দিয়ে আঁকা টি- শার্ট পরে এসে,কারোর জামায় আবার অশ্রাব্য কিছু বাক্য লেখা, কিংবা কোনো নিম্নরুচির ছবি আঁকা। শিক্ষকদের খুব অসুবিধা    হয় এমন দেখলে, বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষক যখন দেখেন অপরূপা কোনো কিশোরী নাভিমূলে বিভিন্ন ছিদ্র করে তাকে বিবিধ অলঙ্কারে ভূষিত করেছে এবং তার ওপরের অনেকখানি অংশই অনাবৃত, ছাত্রদের কৌতূহলী দৃষ্টি বারবার সেদিকেই নিক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তখন তিনি ছাত্রীটিকে ঠিক কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। অনেকে তখন অ্যাডমিন অফিসে ফোন করে সিকিউরিটি থেকে কোনো মহিলাকে ক্লাসে আসতে অনুরোধ জানান এবং সেই মহিলা এলে তিনি তার হাতে একটি চিরকুটে গোটা ঘটনাটি লিখে দেন। গ্যাং এবং ড্রাগের কবলে যারা ইতিমধ্যেই পড়েছে তাদের দেখলেই চেনা যায়,তাদের জামায় কোনো মাদকের ছবি বা কোটেশন থাকে,বেল্টের বদলে কাঁটা কাঁটা চেইন পরে, তাদের প্যান্ট গুলো ও কোমর থেকে অনেক নীচে এমন ভাবে ঝুলতে থাকে যে অন্তর্বাস বেরিয়ে থাকে। শরীরের এমন জায়গায় উল্কি আঁকা হয় যে অবধারিত ভাবে চোখ সেদিকেই চলে যায়,আসলে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এসব করা। এদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে স্কুল কর্তৃপক্ষ সর্বদাই ওয়াকিবহাল। যখন সমস্ত ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক স্কুল থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ে আসে তখন তাদের সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আগের স্কুল থেকে বর্তমান স্কুলের ডেটাবেসে জমা পড়ে যায়। প্রত্যেকের ইতিহাস, পারিবারিক পরিস্থিতি,পরীক্ষার নম্বর,উপস্থিতির হার সব খুঁটিয়ে দেখা হয়। কিন্তু কোনো অপরাধেই তাদের স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে বিরত করা হয় না,সে তারা মাদক সেবী,গ্যাংয়ের সদস্য অথবা দেহ ব্যবসায়ী হলেও নয়। শিক্ষার অধিকার প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের রয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মচারী মিলে সেই সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের ডেটাবেসে চিহ্নিত করে রাখেন মন্তব্য সহ। এরপর যেদিন তারা স্কুলে তাদের স্কুলের পরিচয়ের প্রমাণপত্র এবং বই বা কম্পিউটার ইত্যাদি নিতে আসে সেদিন তাদের আলাদা ভাবে ডেকে পাঠান স্কুলের অধ্যক্ষ। তারা একটু নড়ে যায়,তাদের কোনো ভাবেই ভর্ৎসনা করা হয় না,শুধু স্কুলের নিয়ম কানুন সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হয় এবং কোনো বিষয়ে নিয়ম এবং নিয়ম বহির্ভূত আচরণের কি ব্যবস্থা নেওয়া হয় সে ব্যাপারেও আলোচনা হয়। পরোক্ষ ভাবে ছাত্র ছাত্রীদের সচেতন করে দেওয়ায় তারা অনেক টাই সতর্ক হয়ে যায়।
বর্তমান পোশাক সংক্রান্ত নিয়মাবলী :
১.পোশাক,গয়না এবং ব্যক্তিগত বস্তুগুলি সমস্ত রকম লেখা,ছবি বা অন্য কোনও চিহ্ন থেকে মুক্ত হতে হবে যা অশ্লীল বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অথবা যা অ্যালকোহল,মাদক,তামাক বা অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপের ব্যবহারকে উৎসাহিত করে৷
২. পোশাক,গয়না,এবং ব্যক্তিগত বস্তু জাতি,লিঙ্গ,যৌন অভিযোজন,জাতিগত,ধর্মীয়,রাজনৈতিক,বা ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনগুলিকে যেন অপমান বা হেয়ো না করে।
৩. নিম্নলিখিত ধরণের লেখা বা চিত্র সহ স্কিন আর্ট (উল্কি বা পেইন্টিং) অবশ্যই আবৃত করা উচিত: অশ্লীল, কুৎসিত বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ, অ্যালকোহল, ড্রাগস, তামাক বা অন্যান্য বেআইনি কার্যকলাপের ব্যবহারের বিজ্ঞাপন,  স্কুল ক্যাম্পাসে  স্কুলের পরিবেশের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি জড়িয়ে থাকা যে কোনো কিছুই এর আওতায় পড়ছে।
৪. উপযুক্ত জুতো সব সময় পরতে হবে। টুপি বা ক্যাপ এবং অন্যান্য মাথার আচ্ছাদন এবং সানগ্লাস শ্রেণীকক্ষের ভিতরে পরা যাবে না।
৫.  পোশাক এমন হতে হবে যা অন্তর্বাস ঢেকে রাখতে পারবে,   বুক, পেট এবং পশ্চাদ্ভাগ ঢেকে রাখার জন্য তা যথেষ্ট হতে হবে। বিশেষভাবে: সি-থ্রু, স্ট্র্যাপলেস, ব্যাকলেস, হল্টার টপস, টিউব টপস, প্লান্জিং নেকলাইন এবং উন্মুক্ত পেট/তলপেট একেবারে নিষিদ্ধ।
৬. উপযুক্ত/গ্রহণযোগ্য দৈর্ঘ্যের স্কার্ট এবং শর্টস পরা উচিত যাতে বসে থাকা বা দাঁড়ানো কোনো অবস্থাতেই শরীরের নিম্নভাগ প্রকট না হয়।
৭.প্যান্টগুলি অবশ্যই নিতম্বে আঁটোসাঁটো  হতে হবে করতে হবে যাতে তারা বেল্ট ছাড়াই কোমরে আটকে থাকে।
৮. কাঁটা দেওয়া বেল্ট, কোনো ধরনের চেইন ইত্যাদি যে গুলো দ্বারা শারীরিক আঘাত প্রাপ্তির সম্ভাবনা সে গুলো নিষিদ্ধ।
৯. পোশাক পরিবর্তন শুধুমাত্র বাথরুম এবং লকার রুমের ভিতরে অনুমোদিত। পার্কিং লটে বা গাড়ির ভিতরে পোশাক পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ।
১০. অশোভন পোশাক পরে ধরা পড়ে গেলে তার ওপর শুধু একটি জ্যাকেট চাপিয়ে নিলে চলবে না। স্কুলের সিকিউরিটি তাদের চিহ্নিত করে অফিসে নিয়ে এলে তাদের শোভন পোশাক দেওয়া হবে এবং সেগুলো তাদের পরিধান করতে বাধ্য করা হবে।
সর্বোপরি, অনুপযুক্ত পোশাক পরা ছাত্ররা নিম্নলিখিত পরিণতি পেতে পারে: প্রথম এবং দ্বিতীয় অপরাধ – তাদের সতর্ক করে দেওয়া, অভিভাবক কে অবহিত করা এবং অবশ্যই পোশাক পরিবর্তন করতে বাধ্য করা।
সমস্ত নিয়মাবলী খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যাবে কি কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবম্বিধ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন। লাগামছাড়া স্বাধীনতা ডেকে এনেছে অনেক অপ্রিয় ঘটনা। কিশোরী কন্যার শরীরী আবেদন ও আহ্বানে একটি কিশোর সম্পূর্ণ ভুল বার্তা পেয়ে তাকে দেহোপজীবিনী ভেবে বসে এবং তার ঠাকুমার সঞ্চিত অর্থ চুরি করে নিয়ে এসে মেয়েটিকে কুপ্রস্তাব দেয়। তেমনই পার্কিং লটে পোশাক পাল্টাতে গিয়ে অন্যের ক্যামেরায় ধরা পড়ার ঘটনা ও রয়েছে। কুমারী মাতৃত্ব বা অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের জন্য অনেকাংশে দায়ী এই অশোভন পোশাক। এদেশে ছেলেদের প্যান্ট পরা এতটাই অশোভন যে বলার নয়,তাদের কোমরে বেল্ট থাকে ঠিকই কিন্তু অসম্ভব ঢোলা জিন্স কোমর থেকে প্রায় এক বিঘৎ নীচে বেল্ট দিয়ে বাঁধা থাকে,অন্তর্বাস উন্মোচিত,পশ্চাদ্দেশের অনেকাংশই দৃষ্টি গোচর এবং প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা থাকে এই বুঝি প্যান্টটি খুলে পড়ে যাবে। সারা গায়ে কুৎসিত উল্কি এঁকে আসা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, ক্লাসের ভেতর টুপি পরে বা জ্যাকেটের হুড দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে রাখাও ভীষণ জনপ্রিয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। প্রতিটি ক্লাসেই শিক্ষক শিক্ষিকাদের মনে করিয়ে দিতে হয় এ ব্যাপারে। পুবের দেশ গুলো যখন ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্দোলনে নেমেছে ঠিক সে সময়ে প্রথম বিশ্বে এই নিয়ম ছাত্র ছাত্রীদের মনে প্রবল অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করছে এতে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। হতে পারে,কিন্তু এই স্কুলে ভর্তির প্রথম দিন অসংখ্য অভিভাবক এসে স্কুলের অধ্যক্ষ কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন,অভিভাবক হিসেবে যে শাসনের বাঁধনে নিজের সন্তানদের বাঁধতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটি করে দেখালেন। পশ্চিমে এখন “পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা”।
সমাপ্ত
************************************

কল্যানী মিত্র ঘোষ পরিচিতি :
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে বসে বাংলার জন্য মন কেমন থেকেই লেখালেখির শুরু ২০১৮ সাল থেকেই নিয়মিত। ভূগোল নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে কাজ করার পর আমেরিকা তে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু ২০০৩ থেকে। 

1 Comment

  • Indrani Chakrabarti

    খুব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ স্কুল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে বলতে হবে।এত বেশি উন্মুক্ত পরিবেশে লাগামহীন ভাবে মানুষ হলে এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাই ভুগবে।
    সুন্দর লেখা তোমার যেমন হয়।অনেক ভালবাসা রইল। 👌❤️

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!