মধ্যরাতের রূপকথা
দেবযানী ঘোষ
রোজ মাঝরাতে বৃষ্টি নামে নীরার আকাশে। সিঁড়ি বারান্দার লম্বা জানালার গরাদ শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে নীরা।
বাতাসে অশরীরী হাতছানি। অথচ নীরা একটা পুরোনো সোঁদা গন্ধের আড়ালে নিজেকে বেঁধে ফেলে ঐ গরাদের সাথে। এ বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে কিছু দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাসের বাষ্পে পুড়তে থাকে নীরা। পুড়তে পুড়তে ভস্মীভূত হয়ে সেই ভস্মে কপালে তিলক কেটে ঘরে ফিরে আসে শেষ রাতে। ঠিক সূর্য ওঠার আগে। এসেই এক ঘটি জল খায়। যেন এক যজ্ঞের সমাপ্তি। এরপর স্নান সেরে ছাদে এসে যখন দাঁড়ায় ওর পিঠ ছেয়ে থাকে কোঁকড়া,কালো চুলে। যা রোজ একটু একটু করে হাল্কা হচ্ছে তা বুঝতে পারে নীরা। বুক পেতে শুষে নেয় সূর্যের প্রথম রশ্মি কণা। ওর প্রতি রোমকূপে সঞ্চারিত হয় আরো একটা নতুন দিনের যাপন। বড় পিসিমণি নন্দিনী যত্ন করে নাম রেখেছিলেন “নীরা”। কারণ এক সময়ে এ বাড়ির আনাচে কানাচে আবর্তিত হতো এক মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠস্বরের অনুরণন। যার বেশীরভাগ জুড়েই ছিল সুনীল এর “নীরা”! চিলেকোঠার ঘর থেকে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় সে কণ্ঠস্বরের “নীরা” ক্রমশঃ অধিষ্ঠান করতে শুরু করেছিল নন্দিনীর সমস্ত সত্তা জুড়ে। একসময় কখন যেন বড়পিসি আর সুনীলের “নীরা”একাকার হয়ে গিয়েছিল তা জানেনা কেউ। সকলের অগোচরে “নীরার” অস্তিত্ব,গ্রাস করে ফেলেছিল নন্দিনী নামের এক সরল,স্বচ্ছ মনের তরুণীর সবটুকু মনপ্রাণ।
এক প্রবল বৃষ্টির দিনে নন্দিনীর ছোট বউদি মিতা যখন প্রসব করলো একমাথা কোঁকড়া চুল ও ঊজ্জ্বল চোখের এক শ্যামবর্ণা জাতিকা,ব্যস! নন্দিনী পেয়ে গেলেন তাঁর “নীরা” কে। ততদিনে ঐ মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বরের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। নির্মম ভাবে। যেদিন হসপিটাল থেকে নিয়ে আসা হলো সদ্য জাতিকাকে সেদিন দোতলা থেকে আলুথালু হয়ে ঐ যে দৌড়ে এসে বুকে নিলেন আর-‘নীরা’,’নীরা’,’নীরা’…..বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেললেন,তারপর থেকে যতদিন বেঁচে ছিলেন নীরা ব্যতীত নন্দিনীর অন্য কোনো জগৎ ছিল না। তিনি যদিও তার বেশ কিছু আগে থেকেই মানসিক স্থিরতা হারিয়েছিলেন। তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েই হোক বা নিজেদের অপরাধবোধ থেকেই হোক সদ্যজাতিকার নাম “নীরা” ই স্থির হলো। নীরার কাছে থাকলে নন্দিনী একেবারেই সুস্থ ও অতি স্বাভাবিক থাকতেন। বাইরে থেকে কেউই বুঝতো না যে তিনি অপ্রকৃতিস্থ।
(১)
সময়টা ছিল আশি’র দশকের এর কলকাতা শহর। চারিদিকে রাজনৈতিক উত্তাপ। নবজাগ্রত যুবসমাজ এক নতুন সমাজ গঠনের নেশায় মরিয়া। সেই সময়ে নন্দিনীদের যৌথ পরিবারে এক নতুন সদস্যের আগমন ঘটে। মেজ দাদার হাত ধরে। নীলাঞ্জন। ফরসা ছিপছিপে,খাঁড়া নাক,একটু বড়ো চুল,পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি। হাতে শুধু একটা বই ভর্তি ব্যাগ। এলোমেলো অথচ গভীর চাহনি। সব মিলিয়ে যেন এক টুকরো আলো ঝলমলে সজীব বাতাস। বছর পঁচিশ এর এক-সবুজ তরুণ। চিলেকোঠার ঘরে থাকতো সে।বই পড়া ছাড়া সে যে আর কিছু কখনও জানতো তা বোঝা ভার। নীলাঞ্জন কেন এসেছিল বা কোথা থেকে,এসব নন্দিনী কিছুই জানতো না। কেউ বলেও দেয় নি। আর নীলাঞ্জন এতোটাই লাজুক প্রকৃতির এবং একই সাথে ভীষণ আনমনা।নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতো সারাক্ষণ, আর প্রায় সময়ই নিজেকে ঘরেই বন্দী রাখতো। শুধু যখন সে কবিতা পড়তো তখন ছাদময় হেঁটে বেড়াত নীলাঞ্জন। বোধহয় আবেগ ছাড়াও ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ধ্বনিত হতো যা নন্দিনীর অন্তরাত্মাকে সমূলে নাড়িয়ে দিত। নীলাঞ্জন শুধু মেজ দাদার সাথেই কথা বলতো এ বাড়িতে। ওর সাথেই দু এক সময় বাইরে যেতো আবার এসে ঐ চিলেকোঠায়। নন্দিনী তখন কলেজে পাঠরতা বাইশ বছরের সুন্দরী। বাবা,মা বেঁচে নেই। তিন ভাই,ও এক বোন। বড়ো দু ভাই বিবাহিত ও তাদের সন্তান সন্ততিরা ছোট ছোট। ছোড়দা সদ্য পাশ করে চাকরি বা ব্যবসা কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় নন্দিনী রোজ রাতে সিঁড়ি বারান্দার অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে কবিতা শুনতো। অতো রাতে যতো নীচু কণ্ঠস্বরেই আবৃত্তি হোক না কেন,ঠিকই সমস্ত শব্দেরা যেন লুটিয়ে এসে পড়তো ওর পায়ের কাছে। সমস্ত অণু-পরমাণু ভিক্ষা করে নিত নন্দিনীর। একটু একটু করে নন্দিনীর যা কিছু নিজের,সবকিছু সে সমর্পণ করে ফেললো নীলাঞ্জন এর চরণে। বলা যায় ওর কণ্ঠে,ওর প্রাণোচ্ছল স্পন্দনে। কিন্তু এর কিছুই জানতে পারলো না নীলাঞ্জন। সে তার মতোই দিনযাপন করছিল নিজের ছন্দে।
হঠাৎ একদিন ছন্দপতন। গভীর রাতে বড় দাদা দেখে ফেললো নন্দিনীর গোপন অভিসার। সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে না পৌঁছতেই কানের লতিতে পড়লো এমন টান যে,সোনার কানের দুল গেঁথে গিয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে লাগলো। নন্দিনীর কোনো কথা কেউ শুনলো না। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো নীচে। আর ওদিকে যে কী হলো তা তখনই জানতে পারলো না নন্দিনী। শুধু ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভোররাতে টের পেল দু তিনটে পায়ের,শব্দ,গেট খোলার আওয়াজ,ব্যস।
তিন দিন ধুম জ্বর ও প্রায় অচেতন থাকার পর যখন একটু সুস্থ তখন বুঝতে পারলো চিলেকোঠা ফাঁকা। হঠাৎ পুরো পৃথিবীটা শূন্য মনে হতে লাগলো নন্দিনীর। তারও কদিন পর যখন হাজার প্রশ্ন মাথায় শূলের মতো বিঁধছে,যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে মন তখন বড়ো বৌদিকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নন্দিনী বলে,
— আমায় শুধু এটুকু বলো বৌদি,সে কোথায়? আর তোমরা জানো না–ও যে কিছুই জানতো না।
—- কী বলছো ঠাকুরঝি?
—- হ্যাঁ বৌদি,ও কিচ্ছু জানতো না।
— এটা কী করলে নন্দিনী? অমন নিষ্পাপ ছেলেটা পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল….
এটুকু বলে বড়ো বৌদি চুপ করলেন ঠিকই কিন্তু নন্দিনীর দু কানে যেন হাজার হাজার ডেসিবেল এর শব্দ।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ঠাস করে পড়ে গেল মেঝেতে গড়িয়ে। জ্ঞান ফিরলো ঘোলা চোখে। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,”এখন অসুখ নেই,এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা …!”
তার পর থেকে শুধুই “নীরা”ময় এ জগৎসংসার,নন্দিনীর কাছে। সারাক্ষণ নিজের মনে বুঁদ হয়ে এই সব শব্দদের আউড়ে যায়। যেন এদের নিয়ে ও সংসার পেতেছে। “নীরার” জন্য লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর প্রত্যেকটি শব্দকে যেন ও আদরে,যত্নে,ভালোবাসায় প্রতিপালন করতে চায় সন্তানের মতো। কারণ মন জমিতে এই বীজ পত্তন করে গেছে পঁচিশ বছরের এক দুরন্ত পুরুষ। এর বছর কয়েক পর ভাইঝি নীরার জন্ম। আর অদ্ভুত ভাবে ভরা বর্ষার সেই একই দিনে,যেদিন নীলাঞ্জন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল। ভাইঝিকে পেয়ে সব ভুলে গেল নন্দিনী। সেই থেকে ভাইঝি নীরার সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। প্রথম দিকে নীরার মা মিতা একটু ভয় পেলেও পরে যখন দেখলো একজন অসহায় নারীর পুরো বেঁচে থাকাটা তার মেয়েকে ঘিরে,তখন আর কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু কেউ জানলো না সকলের অগোচরে,নীরার খুব স্বাভাবিক জীবনযাপনের অন্তরালে একটু একটু করে নন্দিনী তার সমস্ত অসুখ সঞ্চারিত করে ফেললো নীরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নীরার নিজস্ব সত্তা কখনও তৈরীই হলো না।
অতএব নীরাও এক প্রকার অপ্রকৃতিস্থ,সামাজিক প্রেক্ষাপটে। তাই এই বাড়ি থেকে আজ একে একে সব বিদায় নিয়েছে,নানা অছিলায়। নন্দিনী যতদিন ছিল ততদিন সে সারাক্ষণ নীরাকে আগলে রাখতো। কিন্তু বর্তমানে,পঁয়ত্রিশোর্ধ,শ্যামবর্ণা,সুন্দরী,যুবতী নীরা পুরো বাড়িতে সম্পূর্ণ ভাবে একাই থাকে। একটা সরকারী গ্রন্থাগারে কাজ করে। তখন প্রায় পুরোটা সময় বই এর সাথে। আর বাকি সময়টা নিজের সাথে কাটিয়ে দেয়।
(২)
আপাতদৃষ্টিতে একা মনে হলেও নীরা একেবারেই একা নয়। নন্দিনীর মৃত্যুর পর থেকেই পুরো বাড়িতে ও একজনের অস্তিত্ব অনুভব করে। সে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে নীরা কে। আড়ালে আবডালে নীরাকে নিয়ে কতোই যে জল্পনা চলে। নীরাকে সেসব এক্কেবারে ছুঁতে পায় না। কারণ নীরার মন খারাপ হলেই যেন এক মেঘমন্দ্র,দরাজ,পুরুষ কণ্ঠস্বর ওর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলে,”নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড়ো দুঃখে থাকে।”
হেসে ওঠে নীরা। মন ভালো হয়ে যায়।
রাস্তায় চলতে চলতে বা কোনো কাজে ব্যস্ত নীরার গ্রীবা হঠাৎ যেন পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে আর খুব ঘনিষ্ঠভাবে উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলে ওঠে “নীরা,তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়ে গেল।”
নীরার শরীরের সাথে মিশে থাকে কারো একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা। যে জন তার সমস্ত ধনরত্নের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে শুধুমাত্র নীরার জন্য। যার হাটে কখনও ঘাটতি হয় না বা ফুরিয়ে যায় না কোনো অনুভূতি। সেখানে নীরা কিভাবে একা হয়! পুরো একটা গোটা সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী সে। শুধু নীরার আরাধনায় জলসা সাজায় সেই ব্যক্তির শব্দেরা। প্রতি মাঝরাতে নীরা তার ডাক শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে সিঁড়ি বারান্দায়। নীরার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে মধ্যরাত্রে এক কবিতা বোনে যে,সেই পুরুষের কাছে সমর্পিত নীরার সম্পূর্ণ সত্তা। তাই গরাদ ধরে দাঁড়ায় নীরা। নীরা ভয় পায় না কারণ সেই দীপ্তময়,উচ্ছ্বল,যুবা পুরুষ ওকে আশ্বস্ত করেছে। তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা,অসম্ভব জেগে ওঠা উষ্ণতা,চাপা আর্তরব কখনও ভয় দেখাবে না নীরাকে। শুধু তার শব্দেরা আদর করে নীরাকে,আ-নখ-কেশ। দুঃখের সাথে দুঃখ মিশিয়ে। নীরা ভিজে যায় চোখের জলে,আদরের স্রোতে। যারা নীরার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মুষ্ঠিভিক্ষা চায়। নীরা ওর চশমা খোলা মুখ বৃষ্টি জলে ধুয়ে তখন নীরা হয়ে যায়। খুব কাছাকাছি ওরা। এতোটাই যে,বাকি সব ঝাপসা। একে অপরের আত্মার সাথে সন্ধি করে। পায়ের পাতা ছুঁয়ে,উরু হয়ে যোনিপথে প্রবেশ করে শব্দেরা। কোন কোন শব্দ স্তনবৃন্ত ছুঁয়ে নাভি গহ্বরে। গলা জড়িয়ে,ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দেয় কেউ। নীরা ভিজতে থাকে। পুড়তে থাকে। গলতে থাকে। আপাদমস্তক যেন এক অগ্নিযজ্ঞ। ভোররাতে সেই পুরুষ তার শব্দযাত্রীদের নিয়ে ফিরে যেতে যেতে অগ্নিদগ্ধ,পরিশ্রান্ত নীরাকে বলে,”নীরা তুমি শান্ত হও।”
গভীর রমণ নিজের মধ্যে নিজের ও ভালোলাগার যন্ত্রণা মিলেমিশে যে আবেশ তৈরী করে তার মধ্যেই ভাসতে থাকে নীরার অস্থিভস্ম। ঘরে এসে জল খায়।
( ৩)
নীরা জানে সে প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে সে। চুলের ঘনত্ব কমে যাচ্ছে রোজ,দেহ ফ্যাকাশে হচ্ছে,চামড়ার নীচে তরলের অংশ ক্রমশ নামছে। কিন্তু ওর কোনো কষ্ট নেই,আফসোস নেই কারণ নীরা প্রথমেই পেয়ে গেছে প্রধান কবিতা, ৯,৮,৭,৬,৫…..থেকে ক্রমশঃ শূন্য। মহাশূন্যের দিকে ধাবমান সে। যেখানে দরজা খুললেই দাঁড়িয়ে আছে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ। যার পরিচয় শুধুমাত্র,-‘নীরার প্রেমিক’। অন্য কোনো পরিচয় যার কখনও ছিল না বা থাকতে পারে না। নীলাঞ্জনরা বলি হয়। কিন্তু যে পুরুষ,-‘নীরা দরজা খুললে জন্তু থেকে মানুষ হয়,’তাকে নীরার প্রেম থেকে নিবৃত্ত করার অধিকার স্বয়ং বিধাতার ও নেই।
নীলাঞ্জন কে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঐ সময়ে ক্ষমতায় আসীন দলের বিপক্ষে যারা,তাদের সদস্য ছিল নীলাঞ্জন। শিক্ষা,সংস্কৃতির আলো দিয়ে তৎকালীন সমাজের সমস্ত কিছুকে পরিশোধিত করার তীব্র সংকল্প তার। সমস্ত কার্যপ্রণালীর সৃষ্টিশীল যে অধ্যায়,তার প্রধান ছিল সে। আর নন্দিনীর মেজ দাদাও সেই দলে ছিলেন তাই নীলাঞ্জন কে এ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে নীলাঞ্জন কখনও জানতেও পারেনি নন্দিনীর মতো একজন মানুষ নিজের সবকিছু সমর্পণ করে বসে আছে তার জন্য। নীলাঞ্জন নিজের কাজের গভীরতায় এতই বেশি নিমগ্ন থাকতো যে বহির্জগতের যাবতীয় আসা যাওয়া সম্পর্কে সে ছিল ভাবলেশহীন।
অথচ ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস !
সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে,আর কিচ্ছুটি না জেনে একটি তরতাজা,সম্ভাবনাময় ঊজ্জ্বল সুন্দর প্রাণকে বিনাশ করে দেওয়া হলো নির্মমভাবে। সেদিন নন্দিনী সিঁড়িতে ধরা পরার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই নীলাঞ্জন কে বাইরে ডেকে আনেন মেজ দাদা। বড় দাদা সহ আরো কয়েকজনের সহায়তায় নীলাঞ্জনকে ধরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের কাছে। অপরাধ অবশ্যই কিছু দেখানো হয়েছিল। নীলাঞ্জন এতোটাই হতবাক ছিল যে সম্বিত ফিরে যখন পালাতে যাবে সেই মুহূর্তে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ওর শরীর। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দেহ। আর মন…উঠে যায় শূন্যে। আড়ালে হাসেন পরম পিতা।
নীরাকে প্রতি মুহূর্তে সেই প্রেমিকপুরুষের রক্তাক্ত হৃদয়ের আর্তকণ্ঠ স্মরণ করিয়ে দেয় –
“রক্তমাখা হাতে তোমায় অবলীলায় নাশ করিনি।”
সে নীরাকে শুধুই ভালোবাসতে চায়।
নীরা জানে কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে। নীলাঞ্জন কে হত্যা করে তার পরিবারের লোকেরা কোন্ শূন্যে নেমেছে সে ঠিকানা যদিও অজানা,তবে এখন,এই মুহূর্তে মৃত্যুর ভয় এড়িয়ে,জীবনের সব হাতছানি থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত করে নীরা প্রস্তুত সেই শূন্যে যাত্রার জন্য যেখানে বহুযুগ ধরে অপেক্ষা করে আছে ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কাছে ভরাডুবি হলে ওর মুক্তি।
সমাপ্ত
*****************************************
দেবযানী ঘোষ ঃ
মধ্যমগ্রাম,দেবীগড়
পেশা – শিক্ষকতা (অংক,রসায়ন),সঙ্গীত শিল্পী & শিক্ষক,লেখক।
বই পড়তে (বিভিন্ন ধরনের বিষয়) এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সহ রুচিসম্মত সব ধরনের গান শুনতে ভালোবাসেন।
“এবং আমরা” পত্রিকার সদস্যা।
২০২৩ বইমেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ – রোদ জনাকির গল্প
অসম্ভব ভালো একটা গল্প পড়লাম। তারপর কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে রইলাম। আশির দশকের রাজনৈতিক উত্তাল সুনীলের বিভিন্ন রচনায় ধরা পড়েছে। তার আভাস পেলাম নীলাঞ্জন চরিত্রে। ভাষার খেলা চমৎকার। কাহিনীর বুনোট ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপায় নেই। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। দারুণ।👌🏼👌🏼👌🏼