Shadow

দা’ভিঞ্চির হারানো পেইন্টিং – মোতাজিদ খুররম

Leonardo da Vinci PC : iStock

দা’ভিঞ্চির হারানো পেইন্টিং

মোতাজিদ খুররম

তখন রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ শহরে থাকি-দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। একদিন ক্লাসমেট নাতাশা বললো,’তোমাকে একটা মজার পেইন্টিং দেখাতে নিয়ে যাবো-লিওনার্দো দা’ভিঞ্চির আঁকা | ‘কী পেইন্টিং সেটা আর বলতে চায় না। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়,’ ওখানে গেলেই দেখতে পাবে। বলে দিলে আর মজা কীসের?’
কিছুদিন আগে নাতাশা আমাকে দস্তয়েভস্কির মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল,সেই থেকে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব। দা’ভিঞ্চির মোনালিসা,লাস্ট সাপার,ভিট্রুভিয়ান ম্যান- এইসব ছবি আমার দেখা,নতুন কী দেখাবে ভেবে পাই না। কিন্তু নাতাশার চোখেমুখে কেমন একটা রহস্য রহস্য ভাব-মেয়েদের সিন্দুকে অনেক রহস্য।
প্যারিসের যেমন লুভর মিউজিয়াম,লেনিনগ্রাদের তেমনি হেরমিতাজ। একদিন গেলাম আমরা সেখানে বাসে চড়ে। ভিতরে ঢুকে আমার তো মাথা ঘুরে গেল। কত কী যে দেখার আছে! একদিন কেন,এক মাসেও পুরোটা দেখে শেষ করা যাবে না,এতগুলো ঘর। ঘুরতে ঘুরতে আমরা দা’ভিঞ্চির ছবির সামনে হাজির হলাম।
ছবির নাম ‘ফুল হাতে ম্যাডোনা’-মাতা মেরীর ছবি। তাঁর কোলে শিশু যীশু। ধর্মীয় আবহের ছবি। কিন্তু দা’ভিঞ্চির বিশেষত্বই এখানে- তিনি এমনভাবে ছবিটা এঁকেছেন যে একে ধর্মীয় আবহের ছবি বলে মনেই হয় না। ছবিতে মেরীর চোখে যে মাতৃস্নেহ,মুখে যে হাসি- তা হতে পারে সন্তান কোলে যে কোনো মায়ের হাসি। বাঙালি মায়ের হাসি বললেও কেউ আপত্তি করবে না। হাসিমুখে কোলের শিশুকে একটা ফুল দিচ্ছেন একজন মা।
দু’জনের মাথার উপরে দুটো সাদা চক্র এঁকে দিয়েছেন দা’ভিঞ্চি। সেই সময়ের প্রথা অনুযায়ী এই চক্র দিয়ে ধর্মীয় আবহ বোঝানো হতো। এটুকু বাদ দিলে পুরো ছবিটাই মা আর সন্তানের আনন্দঘন মুহূর্তের অপরূপ এক পেইন্টিং। ছবিটা চমৎকার,এর পিছনের গল্পটা আরও চমৎকার-ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সেই গল্পটা বললো নাতাশা আমাকে…
‘যুবক লিওনার্দোর সঙ্গে সবসময় থাকতো একটা নোটবই।’ শুরু করলো নাতাশা। ‘নোটবইয়ের এক কোনায় তিনি লিখে রেখেছিলেন এই কথাগুলো-‘দু’টো ম্যাডোনা আঁকতে শুরু করেছি।’ এর বছর চারেক পর আমরা দেখি মিলানের রাজ দরবারে যাচ্ছেন লিওনার্দো। কোন্ কোন্ ছবি সঙ্গে নিচ্ছেন তার একটা লিস্ট করেছেন তিনি। এই লিস্টের এক কোনায় আবার দেখা যায় তাঁর মন্তব্য-‘একটা ম্যাডোনা আঁকা শেষ।’
ম্যাডোনা তো এঁকে শেষ করলেন লিওনার্দো। কিন্তু কোথায় গেল ছবিটা,কার কাছে বিক্রি করলেন তিনি,কিছুই আর এরপরে জানা যায় না। হঠাৎ করেই যেন গায়েব হয়ে গেল দা’ভিঞ্চির ম্যাডোনা।’,একটু দম নিলো নাতাশা।
‘…প্রায় তিনশো বছর পরের কথা-‘,আবার বলতে শুরু করলো সে। ‘জারের রাশিয়া। ভোলগা নদীর তীরে ছোট্ট শহর আস্ত্রাখান। শহরের প্রান্তে তাঁবু ফেলেছে সার্কাস পার্টি। ইতালি থেকে এসেছে তারা,সার্কাস দেখাচ্ছে। 
বড় তাঁবুটার সামনে এসে দাঁড়ালো তিন ঘোড়ায় টানা একটা ত্রইকা। ত্রইকা থেকে নামলো দীর্ঘকায় এক লোক। তার পায়ে বুটজুতো, গায়ে ওভারকোট,ঘন ভুরুর নিচে চোখ জোড়ায় কঠোর চাহনি। সার্কাস দেখতে এসেছে আস্ত্রাখানের কোটিপতি সাপোজনিকোভ। অনেক উঁচুতে দড়ির উপর টাট্টু ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে একটা মেয়ে। মেয়েটার পরণে ঝলমলে গোলাপি পোশাক। মাথায় রঙিন পালক। মুখে জোর করে ধরে রাখা হাসি। চোখে ভয়ের ছায়া। দড়ির উপর দিয়ে নেচে নেচে দুলকি চালে চলেছে টাট্টু ঘোড়া। অত উঁচু থেকে পড়লে ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ার দুজনেরই দফারফা শেষ।
রুদ্ধশ্বাসে খেলা দেখছে দর্শকরা। একসময় দড়ির শেষ মাথায় পৌঁছালো বেচারা মেয়েটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। শুরু হলো ট্রাপিজের খেলা। সুঠামদেহী ছেলেমেয়েরা শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে। লাফিয়ে চলে যাচ্ছে এক ট্রাপিজ থেকে অন্য ট্রাপিজে। এরপরে এলো জাগলার। তিনটি জ্বলন্ত মশালের জাগলিং দেখালো সে। সবশেষে এলো জোকার। জোকারের জোকারি শেষ হওয়ার আগেই সার্কাস থেকে বেরিয়ে এলো সাপোজনিকোভ। এগিয়ে গেল খেলোয়াড়দের তাঁবুর দিকে-ওদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
প্রথম তাঁবুটায় ঢুকলো সে। ধোঁয়া ওঠা বাটি থেকে গরম স্যুপ খাচ্ছে জাগলার আর গোলাপি পোশাকের মেয়েটা। তাঁবুর একপাশে বিছানা। পরিপাটি করে গোছানো। দেয়ালে একটা বেহালা ঝুলছে। এক কোনায় বড় কাঠের বাক্স। এছাড়াও তাঁবুর ভিতরে যাযাবর জীবনের টুকিটাকি। বাক্সের উপরে একটা ছবি-ছবিটায় চোখ আটকে গেল সাপোজনিকোভের।
‘অভিবাদন’-বললো সাপোজনিকোভ।
‘অভিবাদন’-জবাব দিলো জাগলার। চোখে তার জিজ্ঞাসা-কী চায় এই রুশ বণিক?
সরাসরি আসল কথায় চলে এলো সাপোজনিকোভ,‘কত দাম নেবে ঐ ছবিটার?’
ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়লো জাগলার। ভাঙা ভাঙা রুশ ভাষায় জানিয়ে দিল বেচবে না। এটা তার দাদার  কাছ থেকে পাওয়া বংশের উপহার। বেচার জন্য নয়। নিঃশব্দে চলে এলো সাপোজনিকোভ।
পরদিন আবার গেল সে সার্কাস দেখতে। আবার চেষ্টা করলো ছবিটা কিনতে। এবার আরও বেশি দামে। এবারও ব্যর্থ হলো। জাগলারের এক কথা-‘বেচবো না,রাস্তা মাপো।’ এভাবে চললো দিনের পর দিন। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় কোটিপতি সাপোজনিকোভ। ছবিটা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে-ছবিটা তার চাইই চাই।
সার্কাস শেষ। তাঁবু গুটিয়ে চলে যাচ্ছে সার্কাস পার্টি। সেদিন শেষ চেষ্টা করতে এসেছে সাপোজনিকোভ। তাঁবুতে বসে ভদকা খাচ্ছে জাগলার। ফুর্তিতে আছে সে। পাশে গোলাপি পোশাকের মেয়ে। খানাপিনার এলাহি আয়োজন। আস্ত চিকেন রোস্ট,আস্ত্রাখানের বিখ্যাত স্যামন,লাল-কালো ক্যাভিয়ার…
‘অভিবাদন কোটিপতি!’ সাদর সম্ভাষণ জানালো জাগলার। আজ সে দিলদরিয়া। ‘আসুন,ভেতরে আসুন। কী খাবেন বলুন?’ সাপোজনিকোভের জন্য ভদকা ঢাললো সে।
‘অভিবাদন জাগলার’,সাবধানে জবাব দিলো সাপোজনিকোভ। বাক্সের উপরে ছবিটা এখানো আছে,লক্ষ্য করলো সে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বিছানার একপাশে বসলো। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,‘চলে যাচ্ছো তাহলে? ট্রেন কখন?’
‘আমরা যাচ্ছি না’,মেয়েটা বললো।
‘যাচ্ছো না! কেন?’
‘ট্রেন ভাড়া নেই।’
‘তাই নাকি?’ হাসলো সাপোজনিকোভ। ছবির দিকে ইঙ্গিত করলো সে-‘ভাড়া জোগাড় হতে কতক্ষণ?’ ইঙ্গিতটা কাজে লেগে গেল। আপত্তির সুর তুলেছিল জাগলার,মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিল না। হাতবদল হলো একতাড়া নোট। দ্রুত তাঁবু থেকে বেরিয়ে ত্রইকা ছোটালো সাপোজনিকোভ। তার ওভারকোটের পকেটে ছবিটা। মৃত্যুর সময় প্রিয় নাতনি মারিয়াকে ছবিটা উপহার দিয়ে গেল আস্ত্রাখানের কোটিপতি সাপোজনিকোভ।’ থামলো নাতাশা। একটু গর্বের সঙ্গে বললো-এভাবে ছবিটা চলে এলো মারিয়া নামে এক রাশিয়ান মেয়ের হাতে।
‘১৯০৮ সাল-রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহর।’ গল্পের শেষটায় চলে এসেছে নাতাশা। ‘দেশ-বিদেশের ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেইসব ছবির মধ্যে মা আর সন্তানের একটি ছবিও আছে। ছবির মালিক মারিয়া বেনোয়া। তিনি শিল্পকলা একাডেমীর অধ্যাপক লিওন্তি বেনোয়ার স্ত্রী।
সেদিন প্রদশনী দেখতে এসেছেন বিখ্যাত মিউজিয়াম হেরমিতাজের কিউরেটর মিস্টার লিপগার্ড। তিনি একজন নাম করা ছবি-বিশারদ। দা’ভিঞ্চির ছবির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ বলা চলে তাঁকে। ঘুরতে ঘুরতে ছবিটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন লিপগার্ড। কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন। তারপর সবিস্ময়ে বলে উঠলেন,‘আরে! এই তো দা’ভিঞ্চির হারিয়ে যাওয়া ম্যাডোনা!’ শিল্পমহলে খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো।
১৯১২- লন্ডনের ছবি ব্যবসায়ী মিস্টার ডুভিন মারিয়াকে প্রস্তাব দিল পাঁচ লক্ষ ফ্রাঙ্ক। রাজি হলো না মারিয়া। দেশপ্রেমিক মেয়ে সে- বিদেশের ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করবে না ম্যাডোনাকে। লিপগার্ডের কাছে চিঠি লিখলো মারিয়া। ছবিটা সে পিটার্সবুর্গের যাদুঘরে দিতে চায়।
১৯১৩- যাদুঘর কিনে নিল ছবিটা।
১৯১৪- হেরমিতাজ যাদুঘরের দেয়ালে জনতার জন্য টাঙিয়ে দেয়া হলো ফুল হাতে ম্যাডোনার ছবি। সেই থেকে নেভা নদীর তীরে পিটার্সবুর্গের যাদুঘরে শোভা পাচ্ছে দা’ভিঞ্চির হারানো ম্যাডোনা। হাতে তার ফুল,কোলে শিশু,মুখে মাতৃত্বের স্বর্গীয় হাসি।’
… গল্প শেষ করে হাসলো নাতাশা। আমি তখনো হা করে তাকিয়ে আছি ছবিটার দিকে। এত কাহিনী শুনে আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,‘এত কথা তুমি জানলে কী করে?’
আমার দিকে তাকালো নাতাশা। ওর সবুজ চোখে কৌতূকের হাসি,‘আন্দাজ করো…ধাঁধাঁ।’
আন্দাজে আমি এমনিতেই কাঁচা। এখন গোলকধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। এরপর আরও অনেক ছবিটবি দেখলাম আমরা। নাতাশাও আর কিছু বললো না। আমি দু’একবার জিজ্ঞেস করলাম। সে শুধু ঠোঁট টিপে হাসলো আর আমি মনে মনে ভাবলাম-মেয়েদের পেটে কয়টা সিন্দুক থাকে! এত সিক্রেট রাখে কোথায় ওরা?
ট্রামে ফিরছি। মনে পড়লো দুটো ম্যাডোনার কথা নোটবুকে লিখেছিলেন দা’ভিঞ্চি। একটা তো পাওয়া গেল সাড়ে তিনশো বছর পর রাশিয়ায়। আরেকটার কী হলো? সেটা গেল কোথায়? নাতাশাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘কী জানি…কেউ বলতে পারে না।’ ঠোঁট উল্টে জবাব দিল নাতাশা।
‘এমন তো হতে পারে ওটা চলে গেছে বাংলাদেশের দিকে?’ এবার আমি একটু মজা করলাম।
‘হতেই পারে।’ হাসতে হাসতে বললো নাতাশা। ‘খুঁজে পেলে কী করবে?’
‘নিলামে বিক্রি করবো।’,আমি বললাম। ‘টাকা নিয়ে চলে যাবো টেনেরিফ দ্বীপে। সেখানে একটা বাড়ি কিনবো সমুদ্রের ধারে। আমাদের কবি বলেছেন-উজ্জয়িনীর বিজন প্রান্তে কানন ঘেরা ঘর-বাড়িটা হবে সেইরকম,তারপর…’
হাসছিল নাতাশা। আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,‘এসব কিছুই করবে না তুমি,আমি জানি। মারিয়ার মতোই তোমার দেশের যাদুঘরে দিয়ে দেবে।’
কথা বলতে বলতে নাতাশার স্টপেজ চলে এলো। আমাকে বিদায় জানিয়ে ও নেমে গেল। বরফ পড়তে শুরু করেছে। হাত দিয়ে কাঁচ মুছে আমি বাইরে তাকালাম। দেখি ঝিরিঝিরি বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নাতাশা,হাত নাড়ছে।
আমিও হাত নাড়লাম। আর তখনই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনে পড়ে গেল ওর পুরো নামটা-নাতাশা বেনোয়া। মনে হলো ধাঁধাঁর উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি-মারিয়া বেনোয়া থেকে নাতাশা বেনোয়া। সেই মারিয়া বেনোয়া ‍যিনি ছবিটা বিদেশির কাছে বিক্রি করতে চাননি-নাতাশা কী তারই উত্তরপ্রজন্ম? আন্দাজ করলাম হয়তো দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির কাছ থেকে বংশের গৌরবের গল্পটা সে শুনেছে। সেইজন্যই কি মিটিমিটি হাসছিল?
রহস্য সমাধানের আনন্দে ফাঁকা ট্রামের মধ্যে বসে হাসতে থাকলাম আমি। ট্রামটা তখন লেনিনগ্রাদ শহরের নির্জন রাস্তায় ঘটাংঘট শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে-শেষ স্টপেজের দিকে।
সেখানে আমার হোস্টেল-সেখানেই নামবো আমি। 
****************************************


মোতাজিদ খুররম – জিও ফিজিসিস্ট,বাংলাদেশ

1 Comment

  • Madhumita Mitra

    ঐতিহাসিক গল্পের রেশ এসে মিললো বর্তমানের সাগরে, এখানেই গল্পের মুন্সিয়ানা 👍❤️👍

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!