Shadow

আহোম রাজবাড়ী তলাতল ঘর – অজন্তা প্রবাহিতা

তলাতল-ঘর-আসাম

আহোম রাজবাড়ী তলাতল ঘর

অজন্তা প্রবাহিতা

ভারতের উত্তর পূর্ব সীমান্তে  অসম রাজ্যর  সমৃদ্ধশালী  ইতিহাস ও রহস্যময়ী প্রকৃতি সকলকেই আকর্ষিত করে। প্রাচীন তথ্য অনুযায়ী অসমের অংশ ছিল কামরূপ এবং রাজধানী ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর (বর্তমান গুয়াহাটি শহর)। অসম কন্যা হবার কারণে  চোখের সামনে বহু  ইতিহাসকে  চাক্ষুষ দেখেছি এবং তার রোমাঞ্চ অনুভব করেছি।
পাল,কোচ,কছারি এবং চুটিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল অসম। ১৩শ শতাব্দীতে আহোমরা মিয়ানমার থেকে পাটকাই রেঞ্জ অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রবেশ করে।
কোনো রকম প্রতিষ্ঠিত রাজার সঙ্গে যুদ্ধ না করেই নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আহোমরা।
১২২৮ থেকে ১৮২৮ পর্যন্ত আহোম রাজারা প্রায় ৬০০ বৎসর নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেছিল এবং অসমে মোগল সাম্রাজ্য স্থাপনে বাধা দিয়েছিল। রাজকুমার সাউলং সুকাফা ছিলেন আহোম রাজ্যের প্রথম রাজা। সুকাফা ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে শিবসাগর জেলার চরাইদেউতে রাজধানী স্থাপন করেন।
অসমের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে আহোমদের অবদান অনস্বীকার্য। আহোম রাজত্ব কালে যুদ্ধ,কলা,আধুনিক প্রযুক্তি এবং স্থাপত্যের বিশেষ উন্নতি দেখতে পাওয়া যায়। আহোম রাজাকে ‘স্বর্গদেউ’ বলা হত।
শিবসাগর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে গড়গাঁওতে  স্বর্গদেউ  নির্মিত  পিরামিড আকৃতির রাজমহল  ‘কারেংঘর’ আজও আহোম ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। অসমীয়া ভাষাতে ‘কারেং’ শব্দটি যেকোনো রাজপ্রাসাদকে বোঝায়।
১৭০২-০৩ সালে  আহোম রাজা রুদ্রসিংহ আহোম রাজ্যের রাজধানী গড়গাঁও থেকে রংপুরে স্থানান্তর করেন। প্রায় একশ বছর অবধি রংপুর অসমের  রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। অঞ্চলটি শিবসাগরের পশ্চিমে অবস্থিত। তলাতল ঘর সর্বপ্রথম রুদ্রসিংহ ১৬৯৮ সালে  নির্মাণ করেন।
আহোম রাজা রুদ্রসিংহের মৃত্যুর পর তলাতল ঘরের রুপসজ্জা পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানের তলাতল ঘরটি স্বর্গদেও রাজেশ্বর সিংহের শাসনকালে ১৭৫১-১৭৫৯ সালে পুনরায় সজ্জিত করা হয়।
আহোম সৌধের মধ্যে বৃহত্তম তলাতল ঘর সাততলা মহল। তার মধ্যে তিনটি তলা মাটির নিচে ও চারটি তলা মাটির উপরে অবস্থিত। উপরের তলা “কারেং ঘর” নামে পরিচিত। কারেং ঘর আহোম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। কারেং ঘরটি মূলত কাঠের তৈরি। এই প্রাসাদের স্থাপত্যে সমসাময়িক মোগল স্থাপত্যের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এছাড়াও প্রাসাদের উপরের স্তরগুলিতে সাধারণ অসমীয়া স্থাপত্যের মতোই কাঠের কাজ ছিল।
সুরকি,মেথি দানা,মাষকলাই ডাল,গুড়,হাঁসের ডিম,বোয়াল মাছের গায়ের আঠা,বেলের আঠা,বোরা চাউল,শামুকের খোল ইত্যাদি নানারকম উপকরণ ব্যবহার করে নির্মিত এই রাজবাড়ীর দেয়াল আজও পর্যটক এবং ইতিহাসবিদের কৌতূহলের বিষয়।প্রাথমিকভাবে,তলাতল ঘর একটি সেনা ঘাঁটি হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। ইঁটের গুড়ো এবং এক প্রকার দেশজ সিমেন্ট দিয়ে তৈরি তলাতল ঘরের সাথে দুইটি গোপন সুড়ঙ্গ সংযুক্ত ছিল। তারমধ্যে একটি ৩ কি:মি: দীর্ঘ ছিল যা দিখৌ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। অন্যটি ১৬ কি:মি: দীর্ঘ,যা গড়গাঁও প্রাসাদ অর্থাৎ কারেং ঘরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মগোপন করার জন্য এবং পালানোর পথ হিসেবে  তলাতল ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
কারেং ঘরটিতে প্রবেশ করবার জন্য চারটি দরজা আছে। দরজাগুলিকে ‘সিংহ দরজা’ বলা হয়। প্রবেশ পথে প্রথম তিনটে ঘরের মধ্যে একটিতে দেখতে পাওয়া যায় অপ্টিকাল ভিউ। অর্থাৎ,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে উল্টোদিকের দরজা বড়ো মনে হলেও কাছে গেলে দেখা যায় সেই দরজায়  মাত্র আট  আঙ্গুল ফাঁক। জ্যামিতিক ডিজাইনে তৈরি তলাতল ঘরে এমন বহু স্থাপত্য রহস্য আছে যা জানবার জন্য আজও গবেষণা হয়ে চলেছে।
এই রাজপ্রসাদটির  কক্ষগুলো সমান্তরাল। পূর্ব থেকে পশ্চিম,বেশ কয়েকটি কক্ষ একটি দীর্ঘ করিডোর বরাবর নির্মাণ করা হয়েছিল এবং তার উত্তর থেকে দক্ষিণে অসংখ্য ছোট ছোট ঘরও রয়েছে। প্রাসাদের গলিগুলো গোলকধাঁধাঁর মতো তৈরি করা হয়েছে,যাতে শত্রু প্রবেশ করলেও সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে।
নিচতলায় পশুর আস্তাবল,স্টোর রুম এবং অধস্তন কর্মচারীদের কোয়ার্টার হিসাবে ব্যবহৃত হত। দক্ষিণপ্রান্তে নির্জন মহলটি রানীমহল ছিল বলে অনুমান করা হয়। ওপর তলায় একটি প্রসুতি ঘরও আছে।
রাজকীয় (রয়্যাল) অ্যাপার্টমেন্টগুলি উপরের তলায় ছিল,যার মধ্যে এখন মাত্র কয়েকটি কক্ষ অবশিষ্ট রয়েছে,উত্তর দিকের একটি অষ্টভুজাকার কক্ষ আছে,যা একসময় পূজা ঘর (প্রার্থনা ঘর) হিসাবে ব্যবহার করা হতো। দক্ষিণে একটি বিচ্ছিন্ন কক্ষ দাঁড়িয়ে আছে যেটি রানী তার একাকীত্বের  সময় ব্যবহার করতেন  বলে মনে করা হয়।
তলাতল ঘর আহোম সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন সমূহের মধ্যে আকারে সর্ববৃহৎ এবং আহোম রাজাদের নির্মিত এক ঐতিহাসিক রাজমহল।
মীরজুমলা  যখন অসম আক্রমণ করেন,সঙ্গে ছিলেন আসা বাকনবিশ (বরকাকতী)। তিনি লিখেছিলেন,”গড়গাঁওয়ের রাজকারেং-এর নিচের অংশ কটকটীয়া,ধুনীয়া (সুন্দর) এবং নানান কারুকার্যে সুশোভিত ঘর সমগ্র পৃথিবীতে বিরল”।  
যদিও কাঠের তৈরি এইপ্রাসাদের উপরের স্তরগুলো সময়ের সাথে সাথে আজ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। একইভাবে ভূগর্ভস্থ স্তরগুলি বর্তমানে পর্যটকদের জন্য বন্ধ রয়েছে।

রংঘর

তৎকালীন আহোম রাজ্যের গর্বের প্রতীক হিসেবে তলাতল ঘরের উত্তরে রয়েছে রং ঘর। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র।  রং-ঘর আহোম রাজাদের দ্বারা নির্মিত একটি অনন্য অ্যাম্ফিথিয়েটার। আহোম রাজাদের আমোদের জন্য তৈরি ঐতিহাসিক একটি দোতলা মহল।  আহোম শাসনকালে রঙালি বিহুর সময় মহিষের যুদ্ধ ও অন্যান্য উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার জন্য রংঘর ব্যবহার করা হত। রংঘর এশিয়ার প্রথম ‘প্যাভিলিয়ন’ হিসেবে প্রখ্যাত। এই মহলটি আহোম সাম্রাজ্যের অন্যতম রাজধানী রংপুরের রুপহি পথারে ১৭৪৬ সনে স্বর্গদেউ প্রমত্ত সিংহের রাজত্বকালে তৈরি  করা হয়।
রংঘরের আকৃতি চতুর্ভুজের ন্যায়। চূড়ায় নির্মিত মগরমুখি নৌকার আকৃতি বাইরের সৌন্দর্যকে চিহ্নিত করে এবং কাঠামোর শীর্ষে একটি ‘ট্রেফয়েল আর্চ ক্যানোপি’ রয়েছে। এটি রোমান কলোসিয়ামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ।  
পোড়া ইঁট নির্মিত  এই মহলে কোন ধরনের ধাতুর ব্যবহার করা হয় নি। ইঁট জোড়া লাগানোর জন্য এখানেও মাষকলাই ডাল, হাঁসের ডিম,বোয়াল মাছের গায়ের আঠা  ও বোরা  চাউল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৮২৬ ইয়াণ্ডাবুর সন্ধির সময় থেকে অসমে আহোম সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হতে শুরু করে।
শিবসাগরের তলাতাল ঘর দেখার সেরা সময় মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে।

তলাতল-ঘর-প্রাঙ্গণ
রাজার-ব্যাবহার-করা-তোপ

**************************************

অজন্তা প্রবাহিতা
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!