ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
অনির্বান সাহা
ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভারতীয় হেডমাস্টার এবং প্রথম ভারতীয় ইংরেজির অধ্যাপক। এছাড়াও তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ ও বহু বিষয়ের জ্ঞানের অধিকারী,এর সংগে সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে বাংলার যথার্থ নবজাগরণ শুরু হয় রামমোহনের কলকাতায় আগমনের পর। সেই সময় সঠিক শিক্ষা এবং জীবন-রহস্য মন্থনের মন্ত্র জনসাধারণের মধ্যে প্রচার ও প্রসারের জন্য যেকয়জন দিকপাল দেশি এবং বিদেশি ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে,তাঁদের মধ্যে ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সর্বাগ্রে আসা উচিত।
এহেন প্রতিভাধর এক পন্ডিত ব্যক্তির জন্ম হয় ১৮ই সেপ্টেম্বর,১৮২০ তারিখে গুপ্তিপাড়ার গঙ্গা-বেহুলার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত আয়দা পল্লীর সম্ভ্রান্ত কুলীন ব্রাহ্মণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে। পিতার নাম ছিল বদনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন তাঁর ভাইদের মধ্যে মেজ এবং তাঁর পরবর্তী জীবিত ভাইয়ের নাম হল মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ঈশানচন্দ্র এবং মহেশচন্দ্র এই দুই ভাই ছিলেন তৎকালীন সময়ে প্রথিতযশা শিক্ষক,সুপন্ডিত এবং সুলেখক। এছাড়াও তৎকালীন সমাজে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসেও এই দুজনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। বোনেদের মধ্যে একমাত্র জ্যেষ্ঠ বোন জীবিত ছিল কিন্তু তাঁর নাম জানা যায় না। প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী ঈশানচন্দ্র ১২ বছর বয়স অবধি বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তৎকালীন সময় পারসি ভাষার শিক্ষা ছিল অত্যাবশক। তাঁর পারসি শিক্ষকের নাম ছিল তোফেল আহমেদ। ১২ বছর বয়সেই তাঁর পিতা কলকাতার চিৎপুরে রেভারেন্ট পিয়ার্স সাহেবের বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করেন এবং সেখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করেন। ঈশানচন্দ্র ছিলেন একজন কৃতি এবং অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ হতেই পারিবারিক কারণে পিতার কর্মস্থল মেসার্স জন পামার এন্ড কোম্পানিতে চাকুরীতে যোগদান করতে বাধ্য হন তিনি।
কিন্তু তাঁর অধ্যাবসায় ও শিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা দেখে জন পামার সাহেব ১৮২৯ সালে হিন্দু স্কুলে তাঁর জন্য একটি ফ্রি-সিটের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে হিন্দু স্কুলের শিক্ষা গ্রহণের পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই ১৮৩৩ সালে তিনি আলেকজান্ডার ডাফের স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। আর সেখানেই শিক্ষকতার পাশাপাশি ডক্টর আলেকজান্ডার ডাফের কাছে অধ্যাত্মতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেন। এছাড়াও ডক্টর ম্যাকের কাছে তিনি গণিত,রসায়ন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। উপরিউক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও বাংলা ভাষাসহ ইংরেজি,গ্রিক,পারসি,লাটিন প্রভৃতি ভাষায় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। বিশেষ করে ইংরাজি ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল ব্রিটিশদের কাছেও ঈর্ষণীয়। ১৮৩৪ সালে হাজারীবাগের কিষাণপুরে “উইলকিনসন্স স্কুল” নামে একটি নতুন মিশনারি স্কুল স্থাপিত হলে তিনি সেখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। আর এখানেই রচিত হলো এক যুগান্তকারী ইতিহাস। তিনি হলেন প্রথম বাঙালি ভারতীয় প্রধান শিক্ষক। ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে প্রধান শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এরপরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলি অনুযায়ী শিক্ষকতার কাজে যুক্ত থাকেন তিনি। ১৮৫৩ সালে কৃষ্ণনগর কলেজের সিনিয়র বিভাগে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। রচিত হয় আবার ইতিহাস। প্রথম বাঙালি ভারতীয় হিসেবে সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনিই। বাঙালি ভারতীয় হিসেবে শুধুমাত্র প্রথম প্রধান শিক্ষক ও প্রথম সহকারী প্রধান শিক্ষকই নয় বাঙালি ভারতীয় হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশদের টেক্কা দিয়ে প্রথম ইংরাজি অধ্যাপকও ছিলেন তিনি। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষকতা করার পর তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে অফুরন্ত জ্ঞান এবং অসামান্য শিক্ষকতার দক্ষতার জন্য তাঁর পদোন্নতি ঘটে। ১৮৬৯ সালে তৎকালীন হুগলি কলেজে প্রথম বাঙালি ভারতীয় হিসেবে স্থায়ীভাবে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন তিনি। সুদীর্ঘ আর ৩৮ বছর শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত থাকার পর ১৮৭১ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন হুগলি কলেজ ( বর্তমান হুগলী মহসীন কলেজ )থেকেই অবসর গ্রহণ করেন ঈশানচন্দ্র। শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৮৯৩ সালের ১৬ই জুন ঈশানচন্দ্র পরলোকগমন করেন।
তথ্যসূত্র :
– “দ্বিতীয় চরিতাষ্টক” – কালীময় ঘটক (১৮৭৩)।
– “সেকালের শিক্ষাগুরু” – হারাধন দত্ত।– শ্রীযুক্ত সুজিত মুখোপাধ্যায় মহাশয় (গুপ্তিপাড়ার পুরোহিতকুলের একজন বিশিষ্ট পুরোহিত,ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষ ও লেখক)।
******************************************
অনির্বাণ সাহা (ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক)