জন্মদিনের গিফট্
ব্রতী ঘোষ
ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল পরী – ক্ষার আজই শেষ দিন ৷ আজ বাংলা পরীক্ষা ৷ বাংলা পড়তে সায়নের বেশ ভালো লাগে । একে তো শেষ পরীক্ষা তার ওপর বাংলা তাই সকাল থেকে সায়নের মনটা একেবারে ফুরফুরে৷ পরীক্ষার শেষ প্রশ্নের উত্তরটা লিখতে লিখতেই ওর মাথার দুষ্টু পোকাগুলো নাচানাচি করতে থাকে ৷ আর লিখতেই ইচ্ছা করছে না ৷ কতক্ষণে বাড়ি ফিরে ক্রিকেট খেলবে অভিষেকের সঙ্গে,এই আনন্দে ওর শেষ উত্তরটাই ঠিকঠাকভাবে লেখা হলো না । মাথার পোকাগুলো যদি এইভাবে নাচানাচি করে তাহলে ওর কি দোষ?
পরীক্ষা শেষ হলে মার সঙ্গে বাড়ি ফিরে ও ছুট্টে চলে আসে ছাদের ঘরে। এই ঘরটা এক্কেবারে ওর নিজের ৷ একদম ছোটবেলা থেকে ওর যত খেলনা ছিল সব গুলোর ধ্বংসাবশেষ এখানে আছে ৷ কি নেই তাতে? প্রথম জন্মদিনের পাওয়া তিন চাকার সাইকেল,ওর স্নান করার বড় গামলা,ক্যারাম বোর্ড,ক্রিকেটের সব সরঞ্জাম,সব,সবকিছু। তাড়াতাড়ি করে ক্রিকেট খেলার সরঞ্জামগুলো নিয়ে সায়ন নীচে আসে ৷
‘সায়ন-হাত মুখ ধুয়েছ ?’
‘এই ধুচ্ছি মা ৷’
‘এখনো ধোওয়া হয় নি? তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না৷ শিগগিরই হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নাও।
একি? এগুলো কি হবে? তুমি এখন ক্রিকেট খেলবে?’
‘হ্যাঁ মা! সবাই অপেক্ষা করছে ৷ ‘
‘কোন প্রশ্নই ওঠে না ৷ তুমি এখন তবলা নিয়ে বসো ৷ ভুলে যেও না সামনেই তবলার পরীক্ষা ।’
‘না মা!’ গলার স্বরটা আস্তে আস্তে কমে আসে সায়নের । মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল টলটল করতে থাকে ওর৷ কিন্তু মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার মতো ক্ষমতা ওর নেই ৷ সায়ন মনে মনে জানে ওর মতো বাবা ও মাকে ভয় করে । আর তাই তো বাবার ইচ্ছা থাকলেও বাংলা গল্পের বই ও পড়তে পারে না ৷ মায়ের ইচ্ছে মতো ওকে ইংরেজী গল্পের বই পডতে হয়৷ তাও মায়ের তৈরী রুটিনের সময় মতো,ওর ইচ্ছানুযায়ী নয় ৷
তবলা নিয়ে বসে সায়ন ৷
ধা গে তেটে না ক ধি না ৷
বোলগুলো তবলায় পড়ছিল না ৷ পড়ছিল ওর মাথার ভেতর ৷ গলার কাছটা দলা পাকিয়ে আছে ওর ৷ মাথার পোকা গুলোও কেমন যেন চুপ মেরে গেল ৷
‘সায়ন-এখন উঠে পড়৷ স্নান করে খেয়ে নিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও ৷ ঘুম থেকে উঠে দীপ স্যারের কোচিং এর পড়াটা শেষ করে নিও ৷ ”মা !!!’
“বলো” ~
“মা~আজ কেউ যাবে না পড়তে ৷”
“তো?”
“আমিও যাবো না ৷”
“কি?”
সায়নের আর গলা শোনা যায় না! মায়ের এই গলাটা ও ভীষণ ভয় করে । কেমন যেন বুকের ভিতরটা ধুকপুক করতে থাকে ৷ সত্যি! দীপ স্যারের কোচিংয়ে ও আর শুভম ছাড়া কেউ আসে না পড়তে ৷ স্যারের কোচিং থেকে বাবার সঙ্গে ফিরতে ফিরতে সায়ন আজকের সব কথাগুলো বাবাকে খুলে বলে ৷
‘মা তোমাকে তোমার ভালোর জন্যই বকেন সায়ন ! তুমি বড় হবে ! ভালো রেজাল্ট করবে! কত বড় চাকরি করবে ! তখন দেখবে তোমার মনে হবে ভাগ্যিস মা আমাকে বকেছিল তাইতো আমি এত বড় হতে পারলাম ৷ ‘
‘বাবা ! আমাকে একটা গল্পের বই কিনে দেবে?’
‘নিশ্চয়ই দেবো। কি নিবি বল?’ ‘রাজকাহিনী’ |
বাবা বেশ অবাক হয় সায়নের কথা শুনে৷ সঙ্গে বেশ গর্ব হয়৷ না ছেলেটা ওর মতোই হয়েছে৷
‘নিশ্চয়ই দেব কিন্তু মাকে দেখাস না । কেমন?’
বাবা আর সায়নের এই একান্ত পরিসরে মার কোন জায়গা নেই। কারণ বাবা সুকোমল মানুষটা নামী কর্পোরেট সেক্টরের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়া সত্ত্বেও কর্পোরেট জীবনের তথাকথিত দেখানেপনাগুলোর সঙ্গে এখনো মানিয়ে নিতে পারেননি বা চেষ্টা করেননি ৷ তবে একেবারে করেননি বলাটা হয়তো ঠিক হবে না,যতটা প্রয়োজন চাকরি বজায় রাখার জন্য ততটাই করেছেন ৷
বাড়ি ফিরে আবার সায়ন পরের দিনের স্কুলের পড়া নিয়ে বসে ৷ এখনো দুটো বিষয়ের পড়া রেডি করতে হবে ৷ ইতিহাস আর জি কে ৷ চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। চোখের পাতা বেয়ে নেমে আসে ঘুমের পরীরা সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে। ‘সায়ন ! সায়ন !’ মার গলার আওয়াজে স্বপ্নের পরীগুলো কোথায় যে লুকিয়ে পড়ে অনেক ডাকাডাকি করলেও আর ফেরে না।
‘সায়ন! ওঠো বাবা! পাঁচটা বেজে গেছে৷ ওঠো! ওঠো ! ‘
‘মা প্লিজ! আর পাঁচ মিনিট। প্লিজ মা।’
‘না সোনা! তোমার দেরি হয়ে যাবে । কালকে তো ঘুমিয়ে পড়লে এখনো তোমার জি.কে পড়া হয়নি!’
মা সায়নকে ধরে বসিয়ে দেয়। কোন রকমে চোখ মুখ ধুয়ে জি.কে. বইটা নিয়ে বসে সায়ন ৷
সপ্তাহখানেক পরের কথা ।
সন্ধ্যেবেলায় কোচিং থেকে ফিরে সায়ন দেখে মা আজ ভারী ব্যস্ত ।
‘মা~’ বলে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে সায়ন,সেই একদম ছোট্টবেলার মতো ।
‘ও মা! মা!’
‘বলো’- মা চোখ তুলে তাকায় ।
সেই চোখ দেখে সায়ন যা ভেবেছিল তা বলার আর সাহস পায় না ৷
‘কি বলো? ‘
‘কিছু না মা৷ এখন কি পড়বো? ‘
‘তুমি এখন অংকটা করে ফেলো৷ রোজ কুড়িটা করে অংক৷ স্যার বলেছেন৷’ সায়ন আবার অংক খাতা খুলে বসে । পাশের ঘর থেকে শুনতে পায় সামনে রবিবার ওর জন্মদিনের আমন্ত্রিত অতিথিদের লিস্ট তৈরি হচ্ছে ।
‘সায়ন! তোমার বন্ধুদের লিস্ট টা দিও |’ সায়ন কোন সাড়া দেয় না ৷ জন্মদিন নিয়ে ছোটবেলার মতো আনন্দ বা উৎসাহ কোনটাই এখন আর সায়নের লাগেনা | ও বুঝে গেছে ওর জন্মদিনের দিন টা মা আর বাবা দুজনেই তাদের বন্ধুদের আর তাদের ছেলেমেয়েদের ডেকে শুধুই পড়াশোনার আলোচনা করেন আর কার ছেলে মেয়ে বড় হয়ে কি হবে সেই নিয়ে কথা বলেন । তারপর সবাই চলে গেলে বাবা মা নিজেদের মধ্যে অন্যদের নিয়ে সমালোচনা করেন। আর মনে মনে সায়নের সঙ্গে তুলনা করেন ৷ ‘সায়ন তোমার অংক হল? খেতে এসো৷’ ডাইনিং টেবিলে এসে বসে সায়ন |
‘রিটার্ন গিফট কি দেবে ঠিক করেছো?’ সায়ন কোন উত্তর দেয় না৷ ওর চোখে জল টলটল করছে৷ ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে সায়ন ওর নিজের ঘরে চলে যায়৷ মা ভীষণ অবাক হয়ে সুকোমল বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন-তোমার আস্কারাতেই ও এত সাহস পায় ৷
সুকোমলবাবু,ওর পড়ার ঘরে ঢোকেন৷ দেখেন ছেলে খাটে শুয়ে পড়েছে ৷ বাবা এসে মাথায় হাত দিতেই সায়নের চোখের জল আর বাঁধ মানে না ৷
‘ছিঃ সায়ন । বল কি হয়েছে? বল?’
‘’আমার জন্মদিন কোরো না । আমার ভালো লাগেনা |’
‘কেন? সে কি? জন্মদিন ভালো লাগেনা? কেক কাটবি,কত গিফট পাবি, কত আনন্দ হবে !! ‘
‘না!’
‘কি না!’
‘আমার দরকার নেই ৷’
‘সেকি সায়ন! সবাই কি ভাববে? প্রতিবার যারা আসেন তাদের না বললে হয়? তোমার মা তো সবাইকে প্রায় বলেই দিয়েছেন৷ এখন না বললে আর কি করে মুখ দেখাবেন বলো?’
আচ্ছা শোন। তোর কেন ভালো লাগছে না আমাকে বল ।’
‘তোমরা শুধু শুভ্রাংশু নীলেশ অয়নাংশু ওদের সঙ্গে আমাকে তুলনা করবে বলে ওদের ডাকো,আমার ভালো লাগে না ৷’ সুকোমল স্তব্ধ ছেলের কথা শুনে৷ এতোটুকু ছেলে কি করে এতটা বুঝতে পারল? এসব কি বলছে ও?
‘বাবা তুমি আর আমি মিলে চলো না কোথাও চলে যাই-বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে সায়ন ।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি মাকে বলে দেব। তুই মন খারাপ করিস না । তুই এখন বল আমার কাছে কি গিফ্ট নিবি? কিরে বল? ক্রিকেট বল,গ্রাফিক্স কার্ড,নাকি অন্য কিছু?’
‘বাবা আমাকে একটা দিন ছুটি দেবে? যেদিন আমি স্কুলে যাব না,পড়াশোনা করব না,কোচিং যাবো না,কোথাও যাবো না৷ আমার যা ইচ্ছে তাই করবো৷ মা আমাকে একবারও বকবে না৷ তুমি কিছু বলবে না ৷ ওটাই হবে আমার গিফট । দেবে বাবা?’
সুকোমল ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেন,’-দেবো বাবা ৷ তুই ভালো থাক আমি আর কিচ্ছু চাই না ।’
**************************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷
Bratidi mon chue galo. Buker vitorta jano nore galo. R kono ak chena koste golar kachta jano pakie uthche . Khub bastobmukhi lekha
থ্যাঙ্কু ! মহাশ্বেতা !!
খুব ভালো লাগলো। চলমান সমাজের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে রুদ্ধ শৈশবের চমৎকার ছবি এঁকেছ 🥰
অনেকেরই মনে কথা বলেছো।এরকম সায়ন দের জন্য পৃথিবীটা ক্রমশই ছোট হয়ে যাচ্ছে! খুব ভাল লেগেছে।