রাগে অনুরাগে
সুরজিত সরখেল
কতদিন পর সুধাময় লোকাল বাসে উঠলো। আসলে উঠতে বাধ্য হল। করোনা অতিমারী একেবারে চলে যাবার পর,যখন মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছন্দে ক্রমশ: আসতে শুরু করেছিল, ততদিনে অনেক অভ্যাস আর বদভ্যাসও,মানুষ একটু একটু করে ভুলতে বসেছিল। যেমন, অফিস থেকে মেট্রো করে শ্যামবাজারে নেমেই ঘোষ দা,বোস দা,তন্ময়,আর সুধাময় উত্তর পূর্ব দিকে একটা ছোট্ট তেলেভাজার দোকানে নিয়ম করে প্রতিদিন গরম গরম পেঁয়াজি আর আলুর চপ গোগ্রাসে গিলতো! সেটা আবার অফিসের হেড ক্যাশিয়ার নীলিমা সেনের চোখে একদিন পড়েছিল। বেশ রাশভারী,গম্ভীর,মেজাজি ভদ্রমহিলা,চোখ সরু করে সুধাময়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,”এই ভর সন্ধ্যেবেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে তেলেভাজা না খেয়ে বাড়িতে গিয়ে হাতমুখ ধুয়েই তো খেতে পারতেন! যত্তসব! আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে কতগুলো ষাঁড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাবনা কাটছে !”
ভীষণ রেগে গিয়েছিল ওরা সবাই। আসলে ঘোষদা অফিসে সবার পিছনে লাগতে ভালোবাসতেন। সেদিনও নীলিমা দির দিকে তাকিয়ে পেঁয়াজিতে একটা করে কামড় দিয়েই আঙ্গুল চেটেপুটে খেয়ে,দোকানের মালিক শিরিঙ্গে চেহারার পটলকে হুকুম করল, “একটা চিংড়ির চপ দে |”
পটল অবাক দৃষ্টিতে ঘোষদার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার চিংড়িতে তো অ্যালার্জি! আপনি সত্যিই খাবেন ?”
“আমার কিসে অ্যালার্জি,আর কিসে এনার্জি-তা নিয়ে তোকে কে মাথা ঘামাতে বলেছে হতভাগা! আজ চিংড়ি মাছ কেন, তিমি,হাঙ্গর,সাপ,ছুঁচো,ব্যাঙ,ইঁদুর যা দিয়ে চপ বানাবি,সব খাব।” বলেই বিকট সুরে একটা ঢেকুর তুলে আড়চোখে নীলিমাদিকে একবার দেখেই রজনীকান্তর স্টাইলে একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেললেন!
নীলিমাদি কটমট করে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে চলে যাবার পর;তন্ময় ওর মিহি গলায় বলে উঠল,”সত্যিই দিনকে দিন আমাদের দিদি এক্কেবারে শ্রীমতি ভয়ংকরী হয়ে উঠছেন !”
“রাখ তোর শ্রীমতি ভয়ংকরী!এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো”,ঘোষ দা গর্জন করে উঠলেন!
“ওয়াহ্,শের কা বাচ্চা,সিপাহী কা ঘোড়া!”
বোসদা একটু উসকে দেওয়ার চেষ্টা করলেন! ঘোষদা। ফস্ করে আর একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেললেন। সুধাময় এতক্ষণ চুপচাপই ছিল। অনেকক্ষণ ধরেই একটা কাক ওর হাত থেকে পড়ে যাওয়া অর্ধেক পিঁয়াজি টা ঠোঁটে করে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সুধাময়ের নজর ছিল কাকটার ওপরেই। আসলে নীলিমা দি ওভাবে কথাটা বলার পরেই ও আধ খাওয়া পিঁয়াজিটা ফেলে দিয়েছিল। এতক্ষণ পরে খুবই আস্তে ও বলল,”আর তো তিন মাস পরেই উনি রিটায়ার করছেন। বিয়ে -সংসার কিছুই করেননি। তাই হয়তো উনি একটু খিট্ খিটে!ছেড়ে দিন না। এসব নিয়ে বেশি ভাববেন না ৷”
“মানে! কি বলছো তুমি! হোয়াট ডু ইউ মীন!—”
ঘোষ দা দোদমার মতন ফেটে পড়লেন যেন!
সুধাময়ের খেয়াল ছিল না যে ঘোষ দাও অকৃতদার! এই অপকর্মটি (এটা ঘোষদার নিজের ভাষা,বিবাহ সম্পর্কেনিজস্ব ধারণা) উনি করেন নি। মানে সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে ,ভাই, বোনেদের এবং পরবর্তী জেনারেশনের আব্দার সামলাতে গিয়ে ওটা আর করা হয়ে ওঠেনি।এই সময় বোসদা হঠাৎ একটা বিশ্রী আওয়াজ করে হেসে উঠতেই, ঘোষদা আরও ক্ষেপে গিয়ে,সামনের একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন। আসলে বোস দা ভীষণ কাঠি করতে ভালোবাসেন!ঘোষ দা হঠাৎ রেগে উঠলেও সুধাময় জানে,ঠিক সময় ঘোষ দার মোবাইল থেকে দুঃখ প্রকাশ করে একটা মেসেজ আসবে। সেদিন রাতে এসেও ছিল। উনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন নিজের বদ মেজাজের জন্য।
অতীতের স্মৃতিচারণায় সাঁতার কাটতে কাটতেই সুধাময় অনুভব করল ওর ডান পায়ের আঙ্গুল গুলোয় ভীষণ যন্ত্রণা করছে! টেরও পায়নি বাসটা কখন ধূলাগড় চলে এসেছে। কাঁথি ছাড়িয়ে একটু দূরেই ওর ছোট মাসীর বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোয় সুধাময় যাচ্ছে। বাড়িতে মা আর বাবাকে রেখে,দিন কয়েকের জন্য ও রওনা দিয়েছে। এতক্ষণ ও একটা ঘোরের মধ্যে ছিল!খেয়াল করে দেখলো যে ওর পাশেই জোড়া সিটের ধারে এক অল্পবয়সী,সুবেশা ভদ্রমহিলা কানে হেডফোন গুঁজে, দাঁড়িয়ে গান শুনছে।আর তার বাঁ পায়ের জুতোর হিল ওর ডান পায়ের পাতারওপর চেপে বসেছে! তার কোন হুঁশ নেই! মাঝে মাঝেই গানের সুরে মশগুল হয়ে মাথাটা দুপাশে দুলছে। সুধাময় ভীষণ রেগে গেল। কিন্তু,রেগে গেলেও নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো। আজ পর্যন্ত কোন মহিলার সঙ্গেই ও খারাপ ব্যবহার করেনি। মহিলাদের সঙ্গে যথেষ্ট সম্মান বজায় রেখে ও কথা বলে। কিন্তু ব্যথাটা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় ও ভদ্রমহিলার কানের কাছে প্রথমে মৃদুস্বরে বলল,”একটু ঠিক করে দাঁড়ান |” কিন্তু কে কার কথা শোনে। তিনি তো কানে হেডফোন গুঁজে কম্পমান অবস্থায় গান শুনতে ব্যস্ত! এবার সুধাময় সত্যিই রেগে গেল! ও নিজের পা একটু জোর করেই ভদ্রমহিলার পায়ের জুতোর হিল থেকে কবলমুক্ত করতে সক্ষম হল। এরফলে ছন্দের ব্যাঘাত ঘটায় মেয়েটি ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কান থেকে একপাশের ফোন খুলে বিরক্তি প্রকাশ করায়,সুধাময় খুবই মৃদু এবং ঠান্ডা গলায় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল “একটু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন! অনেকক্ষণ ধরে আপনার ভার বহন করেছে আমার পা! দেখুন তো কি অবস্থা করেছেন!” এর মধ্যে বাসে একজন লোক বাদাম বিক্রি করতে উঠেছিলেন। সেই লোকটি সুধাময়ের তীর্যক কথার ভঙ্গি শুনে ফিক্ করে একটা ফিচেল হাসি হেসে ফেলতেই মেয়েটি একেবারে গম্ভীর হয়ে গেল। কান থেকে হেডফোন খুলেই কাঁধের ব্যাগে চালান করে দিল। এতক্ষণ যে মেয়েটা গানের সুরে মগ্ন হয়ে মাথা দোলাচ্ছিল,একটা আনন্দের ঘোরে ছিল,হঠাৎ লোডশেডিংয়ের অন্ধকারের মত চোখমুখ কালো করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল খুলে ঘাঁটতে শুরু করল। এর মধ্যে দু এক বার আড় চোখে সুধাময়ের পায়ের দিকে তাকানোর চেষ্টাও করেছে ৷ সেটা সুধাময়ও লক্ষ্য করেছে। একটু পরেই ওদের সামনের জোড়া সিটের এক ভদ্রলোক উঠলেন সামনের স্টপেজে নামবার জন্য। সুধাময় মেয়েটিকে ঐ সিটে বসবার জন্য ইঙ্গিত করল। মেয়েটা একটু ইতস্তত করে সুধাময়কে বসবার জন্য অনুরোধ করে বলল “সত্যিই আমি দুঃখিত,না বুঝেই আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আপনার পায়ে অনিচ্ছাকৃত আঘাতের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনিই বসুন।”
সুধাময় আর দ্বিরুক্তি না করেই সিটে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুধাময়ের পাশে বসা এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা ওঠায়,সেই আসনে মেয়েটা বসেই সুধাময় কে বললো “ইস আপনি যদি এধরনের স্যান্ডেল না পরে জুতো পরে উঠতেন তাহলে আজ আপনার পায়ের এই অবস্থা হত না !”
এবার সুধাময় কিছুক্ষণ মেয়েটার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল! তারপর সশব্দে হেসে উঠলো! বাসে এখন লোকজনের ভিড় আগের থেকে অনেক কম। যে কজন আছে তারা একবার ওদের দিকে তাকালো। মেয়েটা ভাবাচ্যাকা খেয়ে সুধাময় কে বলে উঠলো,”সত্যিই আপনি একজন বিচিত্র মানুষ! কখনও রেগে ওঠেন;আবার কখনও হেসে গড়াগড়ি খান!” কথাটা বলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
“এ ধরনের অভিজ্ঞতা আগে তো কখনো হয়নি,এবার থেকে ভাবতে হবে আমাকে !”….
সুধাময়ের কথাটা শুনেই মেয়েটা বঙ্কিম চোখে একবার সুধাময়কে দেখে,আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েরা যে কত রকম ভঙ্গিমায় তাকাতে পারে,তা ছেলেরা কোনদিন পারা তো দূরের ব্যাপার,ভাবতেই পারবে না !
“কি জামা কাপড়,জুতো বা চটি পরবো,এটা তো আজ পর্যন্ত আপনি ছাড়া আর আমাকে কেউ কখনো বলেনি! তাই আপনার পরামর্শ শুনে আমার ওরকম প্রতিক্রিয়া হল। কিছু মনে করবেন না। আপনি এবার কানে হেডফোনটা লাগিয়ে গান শুনতে পারেন”।
সুধাময় কথা বলতে বলতে মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিল। মেয়েটা কেমন যেন একটু বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। কিন্তু যখন এক মনে গান শুনছিল,তখন আনন্দে মশগুল ছিল। সত্যিই এভাবে ওর মেয়েটিকে না বললেই হয়ত ভাল হত।
“না থাক! গান শোনার মানসিকতাই নষ্ট হয়ে গেছে ৷”
মেয়েটার স্বগতোক্তি সুধাময়কে আরো যেন অস্বস্তিতে ফেলে দিল! অস্বস্তিটুকু কাটাবার জন্য সুধাময় জিজ্ঞাসা করল,”কোথায় নামবেন আপনি ?”
“কাঁথি বাস স্ট্যান্ড”….নত মুখে মেয়েটি জবাব দিল।
“আরে আমিও তো ওইখানেই নামবো। ভালোই হলো কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে !”
এরমধ্যে বাসটা কোলাঘাটের এক বিখ্যাত ধাবায় এসে দাঁড়ালো। দূরপাল্লার বাসগুলো প্রায় ১০-১৫ মিনিট এখানে এসে দাঁড়ায়। যাত্রীরা নেমে একটু ফ্রেশ হয়ে চা টা খেয়ে নেয়। সুধাময় মেয়েটিকে বলল,”চলুন একটু চা বা কফি খাওয়া যাক। আপনার আপত্তি না থাকলে চলুন। সত্যিই ওভাবে আপনার মেজাজটা নষ্ট করে আমার খারাপই লাগছে ৷”
সুধাময় দুটো কফি আর ওমলেটের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই মেয়েটি মৃদুভাবে বলে উঠলো,
“এসব ছাইপাশ খান কেন ?”
“খুব একটা খাই না। আপনার আপত্তি যখন,খাব না….”
সুধাময় সিগারেটটা ফেলে দিল।বাস ছেড়ে দিল।
“আপনার পায়ে কি যন্ত্রণা হচ্ছে আর ?”
“না,এখন আর তেমন হচ্ছে না !”
“বাড়িতে গিয়ে গরম জলে নুন ফেলে পা টা চুবিয়ে রাখবেন কিছুক্ষণ। আরাম পাবেন।”
“এতক্ষণ কথা বলছি,আপনার নামটাই জিজ্ঞাসা করিনি ৷”
” লাবণ্য। লাবণ্য চ্যাটার্জি।”….মেয়েটি মৃদু হেসে জানালো।
“আমি সুধাময় ব্রহ্ম”……সুধাময় নিজের নাম বলতেই মেয়েটি হেসে ফেলল !
“আপনার কথা শুনলে মনে হয় কখনো কখনো আপনি আপনার নামের প্রতি অবিচার করে বসেন !”
সুধাময় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার বদলে হেসে বলল,”এটা আপনার অভিযোগ না অনুযোগ এ নিয়ে আর কোন কথাই বলবো না। চলুন ড্রাইভার উঠে পড়েছে বাসে ৷”
যাত্রীরা একে একে বাসে উঠে পড়লে বাস ছেড়ে দিল।
“কি গান শুনছিলেন তখন? মানে কি ধরনের গান শুনতে ভালোবাসেন আপনি ?”
সুধাময়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে লাবণ্য প্রশ্নের গভীরতা বুঝতে চাইল যেন !
“জগজিৎ সিং এর গজল। সব ধরনেরই গান শুনতে ভালবাসি। বিশেষত পুরনো দিনের গান |”
“এখন শুনতে পারেন তো! আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে কাঁথি পৌঁছতে। তখন আপনার ভালো লাগার মুহূর্তটা আমি নষ্ট করে দিলাম !”
“আপনি এত বিচলিত হচ্ছেন কেন বলুন তো?”
লাবণ্যের অনুযোগের উত্তরে সুধাময় কি বলবে ভেবেই পেল না। দক্ষিণেশ্বরের একটু আগেই ওর বাড়ি। ওখান থেকে অটো করে দু মিনিট লাগে বাসস্ট্যান্ড। বাসে উঠে বসার জায়গা না পেলেও খুব একটা ভিড় না থাকায় ওর সেরকম কোনো অসুবিধেই হচ্ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকায় ও পেছনের দিকে চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পরেই ও লাবণ্যের উপস্থিতি টের পায়। তারমানে ধূলাগড়ের আগেই মেয়েটা বাসে উঠেছে। ওর চিন্তা সূত্রটা ভেঙে দিয়ে লাবণ্য বলে উঠলো,”মাঝে মাঝে কি এত ভাবেন? এই নিন বাদাম খান।”
“আপনি কোথা থেকে উঠেছেন ?”….সুধাময় মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো ৷
“ডানকুনিতে আমার এক বান্ধবী থাকে। সেখান থেকে ফিরছি ৷”
“আর আপনি উঠলেন কোথা থেকে ?”…..পাল্টা প্রশ্ন এল।
“দক্ষিণেশ্বরের আগে সবেদা বাগান থেকে”…..
এরকম দু’চারটে মামুলি কথাবার্তার মাঝে কাঁথি বাস স্ট্যান্ড চলে এলো। এতক্ষণ বাসের খোলা জানালা থেকে আসা হাওয়ায় লাবণ্যের চুলের ঝাপটা সুধাময়ের মুখে এসে সরাসরি পড়ছিল। সুধাময়ের নিস্তরঙ্গ জীবনে এটা এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। এতক্ষণ সময়টা কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগার ঘোরে কেটে গেল। ওর মনে হচ্ছিল বাসটা আরো বিরামহীন গতিতে চলতে থাকুক। বাস থেকে নেমে কুশল বিনিময় করে ওরা যে যার গন্তব্যে রওনা দিল। সুধাময় ওর মাসির বাড়ির গলির দিকে হাঁটা দিতেই একবার পেছনের দিকে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করল,লাবণ্য তাকিয়ে আছে ওর যাবার পথেই। মনটা কেমন যেন ওর দ্রবীভূত হয়ে গেল!
ছোট মাসির বাড়িতে পৌঁছতেই সবাই হৈ হৈ করে ওকে ঘিরে ধরল। মেসো বলে উঠলো,”আমি তো ভেবেছি তুই আসবি না। তোর নাকি অফিসের ভীষণ কাজের চাপ!”
“ছেলেটা কতদিন পরে বাড়ি এল। আর ওমনি পেছনে লাগা শুরু করে দিলে!”,মাসি ঝাঁঝিয়ে উঠলো। মাসতুতো বোন রুণাও ছুটে এল।
“কতদিন পরে এলি দাদা। আজ তোর বাঁশি শুনবো।”
আসলে সুধাময় বেশ ভালই আড় বাঁশি বাজাতে পারে। বেশ কিছুদিন এক ওস্তাদজির কাছে তালিম নিয়েছে। এর আগের বার যখন ও এখানে এসেছিল তখন সঙ্গে করেই ওর অনেকগুলো বাঁশির মধ্যে একটা এনেছিল। আর রুণাকে সেটা দিয়ে গিয়েছিল। রুণা সেই বাঁশিটা সুধাময়কে দিতেই মাসি বলে উঠলো,”এইমাত্র ছেলেটা এল। ওকে একটু ফ্রেশ হতে দে। খাওয়া দাওয়া করুক। ও তো থাকছে কয়েকটা দিন। তখন শুনিস। তুই এবার বাথরুমে যা তো টুকাই। স্নান করে আয়। ঠাকুর মশাই এখনই এসে পড়বেন। ঝিনুক টা এখনো এলো না। রুণা একটু দেখতো !”
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে নতুন জামা কাপড় পরে সুধাময় ছাদে চলে এল। বাড়ির সামনে পিছনে কত রকমের গাছ। একটা ছোট পুকুর। বাড়িতে ক্রমশই আশেপাশের মানুষেরা পুজো দেখতে আসছেন। ছাদের চিলেকোঠা ঘরটা,ওর ভীষণ প্রিয় জায়গা। ও বাঁশিতে ওর প্রিয় কিরওয়ানী রাগের একটা ধুন বাজাতে শুরু করল। প্রথমে আলাপ,পরে বিস্তার। ধীরে ধীরে ও সুরের গভীরে প্রবেশ করলো। আশেপাশের কোন আওয়াজ,শব্দ ওর কানের ভিতরে প্রবেশ করছে না। খালি কিরবানীর নেশায় মাতাল করে দেবার সুর ছাড়া ! একটা ঘোরের মধ্যে ও যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে! বেশ কিছুক্ষণ পরে ওর ঘোরটা ভাঙলো। অনেকগুলো বিস্ময়াবিষ্ট মুখ ওর নজরে এল ! ওর পাগল করা কিরওয়ানীর সুর শুনে অনেকেই ছাদে চলে এসেছে। এমনকি পুজোতে ঢাক বাজাবেন যিনি,তিনিও চলে এসেছেন। “কি সুর শুনলাম দাদা,বহুদিন মনে থাকবে!”
“এই ঝিনুক,এদিকে আয়,আলাপ করিয়ে দিই !”
রুণার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। লাবণ্যকে ঘরে ঢুকতে দেখে সুধাময় মজা করে বলে উঠল,”ও বাবা,শ্রী কৃষ্ণের মতন আপনারও অনেক নাম আছে দেখছি !”
“আপনার মধ্যে যে এত সুর আছে…..না শুনলে বিশ্বাস করতাম না “…..
রুণা একবার ঝিনুক আর একবার ওর প্রিয় টুকাই দার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করতে থাকলো। তারপরেই চিৎকার করে মা কে ডেকে এনে হাজির করলো। পাকা গোয়েন্দার মত দুজন কে জেরা করে সব ঘটনা জেনে মাসী তখনই ফোন করে দিদিকে জানিয়ে দিল,”আমার জগদ্ধাত্রী মা তোদের জন্য যে উপহার পাঠিয়েছেন,তা দেখার জন্য কাল সকালেই জামাইবাবুকে নিয়ে চলে আয়। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করতে থাকলেন,
“এই তোরা উঁলু দে,শাঁখ বাজা,মহেন ঢাক বাজাও। এবারে আমার পুজো জমজমাট !”
***************************************
সুরজিৎ সরখেল পরিচিতি:
১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্ম। ২০১৮ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গীতে একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। সেজমাসী এবং মেজমামা প্রখ্যাত সুরকার স্বর্গীয় হৃদয় রঞ্জন কুশারীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। কলেজ জীবন শুরু হবার পর সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। অফিসে কর্মজীবনের ফাঁকেই শুরু হয় সাহিত্য চর্চা। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।