সংসার সীমান্তে
সম্পা চক্রবর্তী
“নন্দিনী—পাগলভাই,এই বন্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার-আমার মাঝখানটাতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে। বাকি আর সব বোজা।
বিশু—সেই আকাশটা আছে বলেই তোমাকে গান শোনাতে পারি।
গান
তোমায় গান শোনাব,
তাইতো আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুমভাঙানিয়া !
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক
ওগো দুখজাগানিয়া……।”
এই পর্যন্ত পড়তেই মেয়ের ডাকে ঘড়ির দিকে তাকায় নন্দিনী। একটু একটু করে কখন যেন রাত বেড়ে গেছে তার খেয়ালও নেই। স্নেহের কন্ঠে বলে—”ঘুম পেয়েছে? চল খেতে দেব।”
—”না মা,ঘুম না। এইমাত্র ঋষি জানাল যে আজকের চাঁদ নাকি এক্কেবারে অন্যরকম। পৃথিবীর খানিকটা কাছে নেমে এসেছে।আমাকে দেখতে বলল।”
—”তো কি? দ্যাখ ছাদে উঠে।”
—”আমি একা যাবনা,তোমাকেও যেতে হবে। একা একা চাঁদ দেখতে ভাল লাগে না।”
মুখ টিপে হেসে —”তাহলে এক কাজ কর। মোবাইলে ঋষির সঙ্গে গল্প করতে করতে চাঁদ দ্যাখ,যা। আমাকে বিরক্ত করিস না।আমি এখন বিশুর গানে মত্ত।”
খাট থেকে নেমে বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে নন্দিনী গুনগুনিয়ে চলে —”আমায় পরশ করে
প্রাণ সুধায় ভরে
তুমি যাও যে সরে…..”
মৌলি নাছোড়বান্দা। মেয়ের উচ্ছ্বলতায় নন্দিনী একটু বেশিই অবাক হয়। মনে মনে একরকম মেনেই নেয়। এই তো সবে কলেজের দরজায় পা দিয়েছে। দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও শরীরে লাবণ্যের ঢল নেমেছে। বিশেষ করে মুখে। তাই হয়তো এমন……।
ছাদের আকাশ জুড়ে তখন চাঁদের নীল আলোর বাঁধনহারা বন্যা। ওরা আশ্চর্য হয়ে দেখে সত্যিই ঝুলন্ত চাঁদটা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড় । মৌলি তার মাকে বলে—”ঋষি ঠিকই বলেছে,না দেখলে মিস্ করতাম।”
নন্দিনী অবাক হয়ে চকোরিনীর মতো তখন জ্যোৎস্না পান করে চলেছে।মায়ের নীরবতা ওকে তৃপ্ত করে না মোটেই। তাই আবার বলে—”মা,আকাশের রঙটা এখন কালচে নীল,মানে দিনের মতন উজ্জ্বল নয়—তাই না?”
—(হেসে)” তুই হঠাৎ আজকে এত রঙ খুঁজে বেড়াচ্ছিস কেন বলতো? কি হয়েছে তোর?”
—”হ্যাঁ,কিজানি কেন আমার আজকাল অমন হয় মা।”
—” জানি,কলেজে পড়লে আর অমন একটা ঋষি থাকলে সবই রঙীন লাগে।”
মৌলি পিছন দিক থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ডানগালের নীচটাতে মুখ রেখে বলে—” উম্-ম্-ম্ মা,তুমি না………।”
দুজনের খিলখিলানো হাসি বাতাসে অনুরণন তোলে।
ডিনার শেষ করে মৌলি নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপের মধ্যে ডুবে যায়। হাতে সুগন্ধী লোশন মাখতে মাখতে নেভিতে চাকুরীরত রঞ্জনের(নন্দিনীর স্বামীর) কল্ শুনতে পায় নন্দিনী। তার পোস্টিং কোচিতে। বছরের পর বছর অথই নীল জলের সঙ্গেই তার ঘরবাঁধা। তাই বোধহয় মাটির নন্দিনীর ঘেরা মনের তল সে খুঁজে পায় না। কি জানি হয়তো বা পায়ও। হয়তো বা সেই বিপুল জলরাশির উদ্দাম ঢেউয়ের মতোই তার চঞ্চল কামনা ও দুর্নিবার ভালোবাসা নন্দিনীকে পূর্ণ করে তুলেছে এতদিন।
মৌলি একবার চোখ বুলিয়ে গেল মায়ের আচরণের উপর। একবছর হোল ঠাকুমা মারা যাওয়ায় একাকিনী মায়ের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। ও জানে বাপির সঙ্গে কথা শেষ করে ওর মা তলিয়ে যাবে ওরই মতো ভার্চুয়াল জগতে ঘণ্টাখানেকের জন্য।
আজ কিন্তু নন্দিনী রোজের নিয়ম মানল না। টিং করে শব্দ হতেই সে মোবাইলে নতুনের ডাক শুনতে পেল। কয়েক দিন হোল ইনবক্সে আলাপ হয়েছে নতুনের সঙ্গে। কে জানে কোন অগম পারের দূত সে ! নন্দিনী তাকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না। পারবেই বা কি করে। নতুন কে তো সে নিজেই ডেকে এনেছে তার ঘরে,একপ্রকার জোর করে।
সুইচ্ বন্ধ করে আবার রক্তকরবী নিয়ে বসল নন্দিনী। কতবার যে পড়া এ বই তবু সে পড়ে। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তার দৃষ্টি থেমে যায় সেইখানে যেখানে নন্দিনী অধ্যাপককে বলছে—”আমার রঞ্জনের জোর তোমার ঐ শঙ্খিনী নদীর মতো। ঐ নদীর মতো সে যেমন হাসতেও পারে তেমনি ভাঙতেও পারে।”
আমার গল্পের নন্দিনীও জানে যে তার রঞ্জনের প্রেম দুরন্ত। তবুও আকাশের ওপারে আকাশ,বাতাসের ওপারে বাতাস যেমন চেয়ে থাকে তেমনই দুরন্তের ওপারে দুরন্ত আজ তাকে………। না,না। এ কী লজ্জা!!!! মৌলি বড় হয়েছে। জানতে পারলে মুখ দেখাবে কেমন করে? ঘণ্টা খানেক আগেই খেতে বসে ও বলেছিল—”মা,এত সুন্দর চাঁদের গায়ে কেমন কলঙ্ক আঁকা। সৃষ্টিটা ভারী অদ্ভুত তাই না? বল?”
নন্দিনী স্যুপে চুমুক দিয়ে বলেছিল—”ধুর্ বোকা,কলঙ্ক আছে বলেই না চাঁদের এত সৌন্দর্য।”
কেমন একটা মন খারাপের স্তব্ধতা নেমে আসে ঘরের মধ্যে। নন্দিনী শেষবার চোখ রাখে রবিঠাকুরের নন্দিনীর সংলাপে—”বিশুপাগল,তুমি আমাকে বলছ ‘দুখজাগানিয়া” আর পড়তে পারে না সে।
বই বন্ধ করে মেয়েকে জানিয়ে একা ছাদে যায়। সিঁড়ি বাইতে বাইতে ভাবে কে যেন তাকে বলেছিল “রাতজাগা পাখি”। নন্দিনী কাকে কেমন করে বোঝাবে যে রাতজাগা পাখিরাই তো দুখজাগানিয়া।
চাঁদের আলোয় ভিজে ছাদের কিনারে সে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। ওর মনে পড়ে নন্দিনীকে শোনানো বিশুপাগলের সেই গান —
” ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার
দুখের পারাবারে,
হল কানায় কানায় কানাকানি
এই পারে ওই পারে।”
আনন্দের জোয়ারে চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে নন্দিনীর।শেষ শরতের হিমেল বাতাস ওকে ছুঁয়ে অন্য কোথাও ছুটে যায়।
************************************
শম্পা চক্রবর্তী পরিচিতি –
ঠিকানা— চুঁচুড়া,হুগলী।
শিক্ষাগত যোগ্যতা— বাংলা সাহিত্যে এম্.এ.
পেশা— শিক্ষকতা।
নেশা— সাহিত্যচর্চা (মূলতঃ লেখালেখি),সিনেমা দেখা,বই পড়া,গান শোনা,অনাবিল হাসিতে ফেটে পড়া,মানুষের মনের গভীরে ডুব দেওয়া এবং কাছে-দূরে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।