শূন্য এ বুকে পাখি মোর
রেশমী দত্ত
বর্ষার শেষে বাগানের আম গাছটা তে দেখছি একটা টুনটুনি পাখির আনাগোনা। রোজ মুখে করে খড়কুটো নিয়ে আসছে আর জড়ো করছে। সারাদিন এত ব্যস্ততার মধ্যে রোজ নজর করাও হয়না। হঠাৎ একদিন দেখি একটা সুন্দর বাসা বেঁধেছে টুনটুনি। ইতিমধ্যে আমার কন্যার পরীক্ষা শুরু হল,উচ্চ মাধ্যমিকের পর সব কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিচ্ছে ও আর আমি হয়ে পড়লাম ভীষণ ব্যস্ত,বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা চললে যা হয় আরকি। এরই মধ্যে টুনটুনি ছয়টা ডিম পেড়েছে।আমার বারান্দায় দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় পাখির বাসাটা । হঠাৎই একদিন দেখি বাসাতে আর ডিম নয়,দেখা যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট ছানা। অদ্ভুত আনন্দ হল আমার,ঠিক এরকম আনন্দ হয়েছিল আঠারো বছর আগে যেদিন মামমাম এসেছিল কোল আলো করে ৷ এবার একটা অদ্ভুত অভ্যাস পেয়ে বসলো আমায়,বারে বারে বারান্দায় গিয়ে ওদের দেখা,মা টুনটুনি কি করছে ওর ছানার জন্য।ভাবলাম ওইটুকু পাখি,একটু খানি তার শরীর,ওর মধ্যে হৃদয় কোথায়? ভাবনা,চিন্তা,আবেগ কোথা থেকে আসে! কোথায় যেন ওই ছোট্ট টুনটুনি আর আমি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলাম। একটু একটু করে ছানাদের খাওয়ায় টুনটুনি,ঠিক আমি যেরকম আমার ছোট্ট মামমামকে খাওয়াতাম,সেই রকম। একদিন দেখি মা টুনটুনির বুকের ভিতর ঢুকে ছানারা ঘুমাচ্ছে,আরে ! ঠিক যে ভাবে মামমাম ঘুমাতো আমার বুকে মুখ গুঁজে | মা টুনটুনি পাহারা দেয় সারাক্ষণ,কতগুলো কাক একদিন দেখি টুনটুনির বাসার চারপাশে ঘুর ঘুর করছে,অমনি টুনটুনি বাসা ছেড়ে আর কোথাও যাচ্ছেনা,যেমন আমি মামমাম কে বাড়ির বাইরে করলে করতাম,একটুও নজরের আড়াল করতাম না ! বুঝলাম মা মাত্রই এরকম,তা সে মা টুনটুনি হোক বা আমি। এর মধ্যেই আমার মেয়ে ভর্তি হল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে,কিন্তু অন্য রাজ্যে। হস্টেলে থাকতে হবে,শুনেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল,নিজেকে বারবার প্রশ্ন করলাম,ও পারবে একলা সব করতে?আমি পারবো ওকে ছেড়ে থাকতে? অগত্যা ছাড়তে হলই,কিছু করার নেই,ওর চোখে দেখতে পেলাম অনেক স্বপ্ন। মনটা বড় খারাপ,কি রকম ফাঁকা লাগছে উনিশটা বছর কত স্মৃতি,তিলতিল করে বড় করা,একটা শূন্যতা গ্রাস করছে আমাকে। এসব কিছু ওকে বুঝতে দিলাম না,হাসি মুখে বিদায় জানালাম ওকে। বাড়ি ফিরলাম একরাশ শূন্যতা নিয়ে। বারবার মনে পড়ছিল সেই যখন ওর তিন বছর বয়স,স্কুলে ভর্তি করেছি,কিছুতেই স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকবেনা,আমার শাড়িটাকে দুহাতে চেপে ধরে কি কান্না,আমাকে ছেড়ে সে যাবে না। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল মামমাম,নিজেই বলল,’এবার তুমি এসো মা,আমি সব পারব একা একা,কোনো চিন্তা কোরনা ৷’ এই কথা শুনলে সব বাবামাই বোধয় নিশ্চিন্ত হয় যে সন্তান এখন নিজের ভাল বুঝতে শিখেছে। তবু স্নেহের কারণ যে অকারণে অনিষ্ট আশঙ্কা করা-তাই চিন্তা হয়,ভয় হয়—-সেদিন ওর কথাই বারে বারে মনে পড়ছিল,কারণে অকারণে মা মা বলে ডাকত,পেছন থেকে এসে হঠাৎ হঠাৎ গলা জড়িয়ে ধরতো—মন খারাপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি অমনি চোখ পড়ল সামনের আম গাছটায়-,আরে পাখির বাসাটা ফাঁকা,সেই ছোট্ট পাখিগুলো গেল কোথায়? মা পাখি এসে যে ওদের খাওয়াত,পাশের ডালে চোখ পড়তেই দেখি অনেক গুলো টুনটুনি পাখি এ ডাল থেকে ও ডাল উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, খেলা করছে ওরা,মা টুনটুনিকে আশে পাশে দেখা যাচ্ছে না,বোধহয় ছানারা বলেছে,’এবার তুমি এসো মা,আমরা সব পারব একা একা’——————
****************************************
লেখিকা-রেশমি দত্তঃ
জন্ম ও পড়াশোনা কোলকাতায় ৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর-পেশায় শিক্ষিকা রেশমির অবসরের বিনোদন হলো বইপড়া ৷ শৈশব থেকে বাবার অনুপ্রেরণায় গল্প ও কবিতা লেখার শুরু ৷ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ভ্রমণ ওর প্রিয় বিষয় ৷