Shadow

বিহানবেলায় ৪ – প্রবন্ধ ও গল্প

PC: Behance

“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে”

মধুমিতা মিত্র

“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী”-বহুল প্রচলিত এই সংস্কৃত প্রবাদ বাক্যটি বাংলা তর্জমায় স্বর্গের চেয়েও গরিমান্বিত জননী এবং জন্মভূমি-এ বোধহয় আমাদের কারুরই অগোচর নয়। সেই জন্মভূমির পূজার থালিতে যে নৈবেদ্য পরিবেশিত হয় তার অন্যতম উপকরণ ভাষা-ভাষাই আমাদের নিজেদেরকে প্রকাশের স্হূলতম এবং সূক্ষ্মতম মাধ্যম। অঞ্চল বিশেষে ভাষার তারতম্য হয়-নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রচলিত ভাষাটিই সেই অঞ্চলের মাতৃভাষা।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা আমাদের জীবনে এবং যাপনে মাতৃভাষার গুরুত্ব এবং স্হান নিরূপণ করে শুধুই যে মাতৃভাষাকে মহিমান্বিত করি তা-ই নয়,পরোক্ষে এই আলোচনায় আমরা অঞ্জলি দিই আমাদের জননী রূপী জন্মভূমিকে তথা দেশ মাতৃকাকে।
সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিহার্য হয়ে ওঠে নিজের প্রকাশ-নিজেকে প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হয় ভাষা সে কথা আগেই বলেছি। কাল প্রবাহে সেই ভাষা বিবর্তিত হয়-এই বিবর্ত্তন কিন্তু এক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া,বলা যেতে পারে এক চির প্রবাহী ধারাপাত। ভাষার প্রয়োগ ব্যবহার যেমন ব্যক্তিবিশেষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম বলে পরিগণিত,স্বাভাবিক ভাবেই তেমনই সামাজিক প্রকাশ এবং যাপন মাধ্যম এই ভাষাই। এবার আরও বৃহত্তর পরিসরে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান মাধ্যমও এই ভাষাই। কিন্তু মজা হচ্ছে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে কিন্তু শাসকের নির্ধারিত ভাষাই হয়ে ওঠে প্রচলিত মাধ্যম-অতএব তখন অবহেলিত হয় আঞ্চলিক ভাষা,এ ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলের মাতৃভাষা। আমাদের বঙ্গভূমির বেলাতেও এমনটাই হয়েছে। বণিকের মানদন্ড যখন রাজদন্ডে পরিণত হয়েছে-সেই সময়ে বঙ্গবাসী শাসকের অভিপ্রায়েই বিদেশী ভাষার দাসত্ব করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনোত্তর কালেও যখন মাতৃভাষা তার পরিপূর্ণ মর্যাদা পায় না,বিদেশী ভাষার প্রাধান্যে এবং কৌলীন্যে মাতৃভাষার স্হানাঙ্ক যখন নিম্নগামী হতে থাকে তখন বুকে সেই বেদনা বাজে বৈকি!
অথচ বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ঘেঁষা গদ্যরীতি এবং ইসলামিক বাক্যের প্রয়োগরীতি সময়ের নিয়ম মেনে পরিবর্তিত হয়েছে। বিদেশী পরিভাষা এবং শব্দের সংযোজন বাংলা ভাষাকে পল্লবিত করেছে। রামমোহন রায়ের গদ্যরীতির আধুনিকীকরণ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের আগমণে বাংলা সাহিত্য রীতির পরিমার্জন হয়েছে। শরৎচন্দ্র সাধারণ মানুষের দুঃখ সুখের গাথায় বাংলা সাহিত্যকে জনমুখী এবং জনপ্রিয় করে তুলেছেন। মধু কবির অমিত্রাক্ষর ছন্দ কাব্য জগতে নিয়ে এসেছে বিপ্লব। আর রবীন্দ্রনাথ এসে তো পুরো কাঠামোটারই বদল ঘটিয়েছেন-রবীন্দ্রোত্তর যুগেও অগ্ৰগতির পথ রুদ্ধ থাকে নি। এখন প্রশ্ন মাতৃভাষা তো বেশ তার নিজের নিয়মে নানান প্রাজ্ঞ মহাজনদের হাত ধরে সময়ের সাথে নব কলেবর ধারণ করছিলই। তবে সমস্যা কোথায়? কোথায়ই বা ভাষার সমৃদ্ধি বাদ সাধল?-কেনই বা ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হল? ঐ যে! শাসকের অভিপ্রায়ে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনে,যখন শাসকের ইচ্ছা অনুসার ভাষার প্রয়োগ হয়,তখন সেই অঞ্চলের মাতৃভাষা স্বাভাবিক ভাবেই অবহেলিত হয়। তেমন স্বাধীনতা পূর্ব ভারতবর্ষে তা আগেই হয়েছে,কিন্তু নব জাগরণের প্রভাবেই হোক অথবা গান্ধীজী কিংবা নেতাজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণে আঞ্চলিক ভাষা তথা মাতৃভাষার গুরুত্ব দেশবাসীর কাছে কখনোই ম্লান ছিল না।আমরা যদি আমাদের সেই সময়ের বঙ্গ ভাষার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখা যায় ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি সমাজের পথিকৃৎ এরা মাতৃভাষাকে ও সমান ভাবে মর্যাদা দান এবং পুষ্টি সাধন করেছেন,এ কিন্তু সম্পূর্ণতঃই বাংলার নবজাগরণের প্রভাব।
কিন্তু ভাষা আন্দোলন! এবার কিঞ্চিৎ প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের প্রয়োজন। নব জাগরণের সময় অতিক্রান্ত বহুদিন-ভারতবর্ষকে চিরে ভারতবর্ষ অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতাপ পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষা বাংলাকে দাবিয়ে এবং দাপিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার আপামর বাঙালি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হন। শুধু মাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা না,পাশাপাশি বিকল্প হিসাবে আরবি হরফে বাংলা লিখন এবং সমগ্ৰ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। আবার সমগ্ৰ পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমাণীকরণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। এ সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বাঙালির মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে-১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে,যার এক চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। এই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে ১৪৪ ধারা জারি হয় ঢাকা শহরে-মিছিল,সমাবেশ ইত্যাদি বে-আইনি, নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) তে আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র‌ ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিল টি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে-এরপর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত আত্ম-সমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দু কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাই ঘোষিত হয়। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর  বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদায় উৎযাপন করা হয়।
                    এই প্রসঙ্গে আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন অবশ্য উল্লেক্ষ্য। বরাক উপত্যকার সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালীরা আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষা কে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ,প্রতিরোধ সংগঠিত করেন। এই গণ আন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯শে মে ঘটে। সেদিন এগারো জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। তাই প্রতি বছর বরাক উপত্যকা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ১৯শে মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এখানেও বাঙালির রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আসাম সরকারকে বাধ্য করেছিল বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে।
         বর্তমান সময়ে আমাদের বাংলা তথা মাতৃভাষা কে প্রকৃত মর্যাদা আমরা দিতে পেরেছি তা পর্যালোচনার সময় বোধহয় এখন উপস্থিত। এখনকার ভাষা সংকট উৎসারিত অন্য জায়গা থেকে। ইংরেজ শাসন কাল থেকেই ইংরেজী হয়ে গিয়েছে সরকারী,প্রশাসনিক ভাষা। স্বাধীনোত্তর সময়ে দিনে দিনে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে,তার সঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটেছে হিন্দি ভাষার। সমাজে তৈরি হয়েছে দুই সমান্তরাল শিক্ষা মাধ্যম–ইংরেজী মাধ্যম এবং মাতৃভাষা মাধ্যম (আমাদের পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যম)। আমাদের ঔপনিবেশিক চরিত্র বজায় রেখে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা কৌলিন্য লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষা মাধ্যম শিক্ষা হয়ে উঠেছে ব্রাত্য। ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্হার জয়জয়কার চতুর্দিকে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্হাই হয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার দাস। এমত অবস্থায় আমাদের লড়াই ইংরেজি ভাষার ওপরে নয়,ইংরেজী মাধ্যমের পাশাপাশি বাংলাও হয়ে উঠুক সর্বজনপূজ্য। আমাদের বাংলা ভাষা ঐতিহ্যে,কৃষ্টিতে রত্ন আকর সম–সেই বাংলা ভাষার মর্যাদা পুনঃ স্হাপন হয়ে উঠুক আমাদের ব্রত। শুধুমাত্র মাতৃভাষা দিবস উৎযাপনের মধ্যে দিয়ে নয়,মাতৃভাষা কে আমরা আমাদের শ্রদ্ধায়,চর্চায়,ব্যবহারে দিই তার প্রায়লুপ্ত মূল্য। আগামী প্রজন্মকে শেখাই মাতৃভাষা তর্পনের মন্ত্র-এই হয়ে উঠুক আমাদের প্রতিটি জনের শপথ। সর্বশেষে গুরুদেবের উক্তিতেই আমাদের মাতৃপূজার ডালির শেষ পুষ্পটি অর্পণ করি–
“শিক্ষা’ প্রবন্ধে কবির আরও অভিব্যক্তি ‘যখন আমরা একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখি যে,আমরা যেভাবে জীবন নির্বাহ করিব আমাদের শিক্ষা তাহার আনুপাতিক নহে,আমরা যে গৃহে আমৃত্যু বাস করিব সে গৃহের উন্নত চিত্র আমাদের পাঠ্যপুস্তক নহে,যে সমাজের মধ্যে আমাদের জীবনযাপন করিতে হইবে সেই সমাজের কোন উচ্চ আদর্শ আমাদের নতুন শিক্ষিত সাহিত্যের মধ্যে লাভ করি না,আমাদের পিতামাতা,আমাদের সৃহৃদয় বন্ধু,আমাদের ভ্রাতা-ভাগ্নিকে তাহার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি না,আমাদের দৈনিক জীবনের কার্যকলাপ তাহার বর্ণনার মধ্যে স্থান পায় না। আমাদের আকাশ এবং পৃথিবী,আমাদের নির্মল প্রভাত এবং সুন্দর সন্ধ্যা, আমাদের পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত্র এবং দেশলক্ষ্মী স্রোতস্বিনীর কোন সঙ্গীত তাহার মধ্যে ধ্বনিত হয় না,তখন বুঝিতে পারি আমাদের শিক্ষার সহিত আমাদের জীবনের তেমন নিবিড় মিলন হইবার কোন স্বাভাবিক সম্ভাবনা নাই। উভয়ের মাঝখানে একটা ব্যবধান থাকিবেই থাকিবে,আমাদের শিক্ষা আমাদের জীবনের সমস্ত আবশ্যক অভাব পূরণ হতে পারিবে না।’ তাই কবি মনে করতেন শিক্ষার সঙ্গে জীবনের নিবিড় সংযোগই নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দীপ্ত করবে। এ সবের সেতুবন্ধনের প্রধান বাহন মাতৃভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি।”—-
*********************************

This image has an empty alt attribute; its file name is --150x150.jpg

মধুমিতা মিত্র: পেশা–স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর,উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ..
=================================

সুন্দরবন ভ্রমণ

জলি চক্রবর্তী শীল

সুন্দরবনে সুন্দরী গাছ
সবচেয়ে সেরা সেই যে গাছ
গাছটি সুন্দরবনে..

সেই কবে থেকেই গানটা শুনছি | কিন্তু সুন্দরবনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি নানান কারণে | গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী‚ ২০২৪ তাই আমরা কয়েকটি পরিবার  সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ট্রেন ধরতে | আমাদের যাত্রা শুরু হল বিরাটি থেকে | বিরাটি থেকে  শিয়ালদহগামী ট্রেন ধরে আমরা যখন শিয়ালদহে পৌঁছলাম তখনও শিয়ালদহ সাউথ সেকশনে ক্যানিং লোকালের খবর হয়নি |  স্টেশন চত্বরে প্রচুর মানুষের ভিড় | কেউ যাচ্ছে প্রাত্যহিক কাজে আবার কেউ বা আমাদের মতই ঘুরতে চলেছে সুন্দরবন বা অন্য কোথাও অন্য কোনখানে | স্টেশনে রুটি-সব্জির দোকানে লম্বা লাইন | দিস্তে দিস্তে রুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে | আবার সেখানে উঠে আসছে নতুন করে বানানো রুটি | সাদা ময়দা নাকি সাদা আটার এই রুটি দেখলে খেতে ইচ্ছে করে ঠিকই তবু কোনদিন খাওয়া হয়নি | ওদিকে হলদিরামের দোকানেও পন্যসম্ভার লোভনীয় | পাশেই ডিম টোস্ট আর ঘুগনীর ডেকচি শেষ হয়ে এসেছে | আমাদের আশেপাশে অনেকেই অপেক্ষারত ক্যানিং লোকালের জন্য | ইলেকট্রনিক বোর্ডে ফুটে উঠল আটটা আটত্রিশের ক্যানিং লোকাল ২২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে রওনা হবে | আমরা নিজেদের ল্যাগেজ নিয়ে সেদিকেই রওনা হলাম | ট্রেনে যতটা ভিড় আশা করেছিলাম তেমন একটা ভিড় শিয়ালদহ থেকে হয়নি | বেশ আরাম করে বসে গেলাম আমরা | এক ঘন্টা দশ মিনিটের পথ | বিভিন্ন স্টেশন থেকে লোক উঠছে নামছে | দেখতে দেখতে ভিড় হয়ে গেল ট্রেনে | প্রতিটা স্টেশন থেকেই উঠছে হকার | কি-না নেই! কমলালেবু‚ হজমিগুলি‚ চালের পাঁপড়‚ছোলামাখা‚কফি-চা সবই আছে | আকাশ এখানে অংশত মেঘলা | মাঝে মাঝেই দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে | ক্যানিং স্টেশনে  নামলাম যখন তখন প্রায় দশটা | কাজ চলছে স্টেশনে‚তাই একটু অসুবিধে হচ্ছিল ল্যাগেজগুলো টেনে নিয়ে যেতে | বেশ জমজমাট জায়গা ক্যানিং | কলকাতার বাজারের মাছের প্রধান জোগানদার এই ক্যানিং | প্রচুর মানুষের বাস | এখানে দাঁড়িয়ে মনেই হচ্ছিল না কলকাতার বাইরে কোথাও এসেছি | এখানে আমরা একটা দোকান থেকে চা খেলাম |
স্টেশন থেকে বেরিয়েই বড় বাজার‚দোকানপাট‚মস্ত ক্রীড়াঙ্গন | সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বাস‚টোটো আর অটো |  লোকজনের ভিড় পেরিয়ে আমরা টোটো চেপে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে রওনা হলাম সোনাখালির উদ্দেশ্যে | একটা টোটোতে ৭ জন করে নিচ্ছে | টোটোর মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হল ল্যাগেজ | টোটো ভাড়া যথাযথ | এখান থেকে সোনাখালি প্রায় ১৮ থেকে ২০ কিমি| রাস্তা বেশ চওড়া এবং জ্যামমুক্ত | ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে আমাদের টোটো | চোখের সামনে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে একের পর এক বাড়ি‚ক্ষেত-খামার‚জলাশয়‚ছাগল‚গরু‚হাঁস,মুরগী | রাস্তায় যেহেতু গাড়ির চাপ তত নেই তাই অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সোনাখালি | এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের সুন্দরবনভ্রমণ | আমরা আমাদের লঞ্চে করে  রওনা হব পাখিরালা বা পাখিরালয়ের উদ্দেশ্যে |
লঞ্চঘাটে পর পর একাধিক লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে | বর্তমানে পর্যটন এখানকার একটি বড় ব্যবসা | স্টেশনের কাছেই একাধিক পর্যটানের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার  অফিস | ব্যক্তিগতভাবে লঞ্চ বা বোর্ড ভাড়া নেবারও ব্যবস্থা আছে | আমাদের লঞ্চের নাম রাজদূত | ল্যাগেজ পাড়ে রেখে আমরা লঞ্চের ক্রু-দের সাহায্যে উঠে গেলাম লঞ্চে | ল্যাগেজও তারা উঠিয়ে দিল |  সার সার চেয়ার লঞ্চের দুইধার ধরে | এই প্রথম জলপথে ভ্রমণ | বেশ উত্তেজক একটা ব্যাপার | লঞ্চে পৌঁছে ফ্রেশ হতে না হতেই এসে গেল ব্রেকফাস্ট ফুলকো লুচি‚আলুর তরকারি আর রসগোল্লা | বেশ খিদে পেয়েছিল খাবার মুখে দিয়েই বুঝলাম | একটা একটা করে লঞ্চ ছাড়ছিল | লঞ্চই এদের লক্ষী | তাই লঞ্চের গোড়ার দিকে ফুল-মালা-সিঁদুর দিয়ে এরা পুজো করে তবেই লঞ্চ ছাড়ে | ঐ স্থানে পা দেওয়া নিষেধ | লঞ্চ ছাড়ার আগে পাটাতনের উপরিভাগ ওরা বালতি করে নদী থেকে জল তুলে ধুয়ে দিয়ে প্রণাম করে লঞ্চ ছাড়ল | এ এক অনন্য অনুভুতি | চারিদিকে বিস্তীর্ণ বনভুমি | যেদিকে চোখ যাচ্ছে শুধু সবুজ আর সবুজ | বুক ভরে অক্সিজেন শুষে নিতে হলে আসতেই হবে সুন্দরবন | বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরন্য এই সুন্দরবন | আধুনিক শহুরে মানুষ আমরা‚তাই প্রকৃতিকে এইভাবে খুব একটা পাই না আমরা | তাই প্রকৃতিকে পেয়ে তাতে হারিয়ে যেতে সময় লাগে না | চারিদিকে ঝলমলে রোদ‚তার সাথে হাওয়া‚ জলের ওপর তরঙ্গ‚জল কেটে এগিয়ে যাওয়া ইতি উতি নৌকা‚লঞ্চ‚বোট | আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চলেছে গোসাবা ব্লকের দিকে |
আমরা  গোসাবা ব্লকে ঢুকে পড়ি | সকালের ভরপেট প্রাতরাশের পর আবার আমোদি মাছের ফ্রাই | মন্দ লাগে না শিরশিরে হাওয়া‚ মিঠে রোদ্দুর মেখে ফটো তুলতে তুলতে এই মাছের ফ্রাই খেতে | আমাদের প্রথম গন্তব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলোতে | বাংলোটি ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত | অনেকগুলো গ্রীষ্ম এখানে কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর| এটি একটি মিউজিয়ামও বটে,এখানে রাখা আছে বিশ্বকবির রাইটিং ডেস্ক‚কিছু ম্যানুস্ক্রিপ্ট | যদিও এখন সব বন্ধ করে রাখা আছে| আমরা জানলার ফাঁক দিয়েই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি | ঐতিহাসিক জায়গা | এই বাংলোটিকে ঘিরে বর্তমানে একটি পার্কও করা আছে যেখানে বেশ কিছু মূর্তি আছে যেমন হ্যামিলটন সাহেব ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  একটি মিনিটস ওফ মিটিং‚রয়েল বেঙ্গল বাঘ‚একটি বড় বুদ্ধ মূর্তি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো | ঢুকতে মাথাপিছু বড়দের ২০ টাকা ও ছোটদের ১০ টাকা ফি| পরবর্তী গন্তব্য হ্যামিলটন সহেবের বাংলোতে|
এখানে একটু সুন্দরবন সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নিই | জানি গুগল করলে এসব জানা কোন ব্যাপার নয় | তবু  বলি‚বিশ্বের প্রথম বিস্ময়কর ম্যানগ্রোভ অরণ্য বৃটিশ এদেশে আসার পর মুঘল শাসকদের কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পায় | অষ্ঠাদশ শতকে কিছুটা বনাঞ্চল কেটে শুরু হয় বসতি | ফলে সুন্দরবনের আকৃতি কিছুটা খর্ব হয় | ড্যানিয়েল হ্যামিলটন নামে একজন স্কটিশ ব্যবসায়ী ১৯০৩ সালে এই জলা জঙ্গলে নয় হাজার একর জমি কিনে শুরু করেছিলেন গোসাবা জমিদারী | প্রসঙ্গত গোসাবা নামটিও তারই দেওয়া| তিনি দেখেছিলেন গোরু এখানকার মানুষের খুবই প্রয়োজনীয় প্রাণী | সাপ আর বাঘের আক্রমণ এখানে পদে পদে | তার থেকেই গোসাবা নামের উৎপত্তি | ভিন্ন মত থাকতে পারে | তিনি এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা অনুভব করেছিলেন | তিনি কিছু জনহিতকর কাজও করেছিলেন | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এইসব অঞ্চলের মানুষের কিভাবে উন্নতি করা যায় সেই নিয়ে একাধিক আলাপ আলোচনা ও পত্রবিনিময়ও হয়েছিল | ১৯৩২ সালে রাবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ড্যানিয়েল সাহেবের ঐ আলোচনাই হয়ত পার্কটিতে স্থান পেয়েছে মূর্তি দুটির মাধ্যমে |  সাহেব ঐ অঞ্চলের জন্য নোটও প্রচলন করেছিলেন | যাইহোক গোসাবার মানুষজনের কাছে তিনি নমস্য | কিন্তু বাংলোটি বাদে সেইভাবে হ্যামিলটন সাহেবের অবদান সেখানে সংরক্ষিত নেই| সম্ভবত বৃটিশ অত্যাচারের স্মৃতিকে ধরে রাখতে চায়নি‚ঠিক নিশ্চিত নই আমি |
এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে চলি লঞ্চের দিকে| পেটে ছুঁচোর কীর্তন |  আমাদের এই লঞ্চের ধারণক্ষমতা চল্লিশজনের | আমাদের আগে আগে অনেকেই খেতে বসে গেছেন | আমরা টেবল খালি হতে খেতে বসি| আয়োজন দারুন | আর রান্নাও অপূর্ব বললেও কম বলা হয় | ভাত‚ডাল‚আলুভাজা‚লাউঘন্ট‚ভেটকি কালিয়া‚কাঁকাড়ার কারি‚চাটনি আর পাঁপড়।                                                        আপনি প্রকৃতিকে অনুভব করতে আর যদি খাদ্য রসিক হন তবে আমি বলব অবশ্যই এখানে একবার আসতেই হবে আপনাকে | খেতে খেতে নজরে পড়ে একাধিক জাহাজ | যেগুলো সবই বাংলাদেশের | ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে  বা অন্য কোন কাজে আসা |  তার মাঝেই জেনে নিই বোট আর লঞ্চের পার্থক্য | খেয়ে দেয়ে গড়াবার আগেই আবার কাঁচা পেয়ারায় নুন দিয়ে মাখিয়ে সবাইকে দিয়ে গেল | আহা এমন যদি প্রতিটা দিন হত | পড়ন্ত রোদের আলো পড়ে  এক মায়াবী মুহুর্ত সৃষ্টি হয় | গল্পে -ছবি তোলায় মেতে উঠি আমরা | সতর্ক চোখ খুঁজে ফেরে বাঘ | উঁচু উঁচু জাল দিয়ে ঘেরা খাড়ির দিকে বার বার চোখ চলে যায় | বেশ কিছু বাঁদর পাড় দিয়ে ছুটে চলে যেতে থাকে | একটু একটু করে দিন নিভে আসার আগেই আমরা পৌঁছে যাই পাখিরালয় |এখানে একাধিক লজ | আমরা সুন্দরী লজে উঠি |  নিজেরা ফ্রেশ হয়ে আবার বের হই যখন তখন প্রাঙ্গনে শুরু হয়ছে ঝুমুর নৃত্য | বেশ উপভোগ্য লাগে | গ্রাম্য গলায় ঝুমুর গান‚তার সাথে সন্মিলিত নৃত্য বেশ উপভোগ করি আমরা | কিন্তু আমাদের জন্য আবার ইভনিং স্ন্যাক্স রেডি| চাউমিন আর কফি | না এরা দেখছি হজম হতেও দেবে না | অল্পবিস্তর খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি | আশেপাশে প্রচুর দোকান | সফট টয়েস থেকে শুরু করে কাঠের প্রচুর জিনিস‚ব্যাগ‚দুল‚ক্লিপ‚চুড়ি-মানে বলতে গেলে সবই আছে | কেনাকাটার ভিড়ও আছে| বিভিন্ন লজ থেকে ঝুমুর গানের কলি ভেসে আসে | হাঁটতে হাঁটতে ঘাটের দিকে চলে যাই | নিকষ কালো জলে তখন পূর্নিমার চাঁদ মোহ বিস্তার করেছে |
আয়লা আর আম্ফান এই দুটি দুর্যোগ সুন্দরবনের ওপর প্রচন্ড প্রভাব বিস্তার করেছে | পাখিরালয়ে বসে সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয় | যে লজটিতে আমরা উঠেছি সেটি শুনলাম আম্ফানে একতলা পুরোপুরি জলের তলায় চলে গেছিল | লজে ফিরে আড্ডা আর নাচ | মেতে গেল সন্ধে | এখানে কোন ঘরেই দেখলাম টিভি নেই | অতএব নিজেদের মধ্যে আড্ডা‚নাচ গান আর গল্পে মাতা ছাড়া কিছু করার নেই | তার মাঝেই রাতের খাবার হাজির | ভাত‚আলুরদম‚পাঁঠার মাংস আর স্যালাড | কাল সকাল সকাল বের হওয়া তাই খেয়ে দেয়ে আরও একটু আড্ডা দিয়ে সোজা বিছানায় | সারাদিন ধকল গেছে‚শুতে না শুতেই ঘুম |

২৪ শে ফেব্রুয়ারী‚ ২০২৪

ভোর ভোর ঘুম ভেঙেছে | সকাল ৭ টার মধ্যেই বের হতে হবে | আমাদের কলকাতায় গরম বেশ পড়ে গেলেও এখানে বাতাস বেশ ঠান্ডা | গতরাতে পাখা চালিয়েও বন্ধ করে দিতে হয়েছে | কম্বল লাগেনি ঠিকই কিন্তু একটা পাতলা চাদর লেগেছিল গায়ে দিতে | স্নান করতে গরম জল লাগবে | ব্রাশ করে আমরা বসে আছি কিন্তু গরম জলের দেখা নাই রে | গতকাল রাতেই বলেছিল এক বালতি গরম জল ২০ টাকা করে | ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে সক্কাল সক্কাল | সকালে জানলাম লজ জল দেবে না | লজেরই কেউ একজন জানালো‚জল গরম বসেছে লজের পিছনে | বেশ অন্ধকার‚স্টোলটা গায়ে জড়িয়ে ঘুরে আসি | দারোয়ান গোছের কেউ একজন দেখিয়ে দেয়‚’ঐ তো ঐদিকে গিয়ে বলে আসেন |’ অন্ধকার ঠাহর করে একা একা বেরিয়ে ভয় ভয় লাগে | মানুষজন দেখি না | এত গাছপালার মাঝে কে জানে কোথায় কিছু লুকিয়ে আছে কিনা | কাউকেই দেখি না | অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে  ঠাহর হয় আগুনের ফুলকি আর গোটা দুই মস্ত কালো কালো জালা | একজন  বলে‚’জল গরম হলেই  দিতে আসবো দিদি ‘| ঘরে চলে আসি | খানিক পরে ফুটন্ত গরম জল আসে | পুকুরের জলে স্নান করা অভ্যেস নেই | যাই হোক করে সেরে নি | সকাল ৭ টায় বেরিয়ে পড়ি আমরা | ঘাটে পর পর লঞ্চ ছাড়ছে | আমরা রাজদূতে উঠে বসি |
লঞ্চে ওঠার সাথে সাথেই সকালের চা | চা খাবার পর আমাদের প্রথম গন্তব্য সজনে খালি | সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য| প্রায় ৩৬২ বর্গকিলোমিটার  এলাকা জুড়ে অবস্থিত | ১৯৬০ এবং ১৯৭৬ সালে এটিকে ভারত সরকার অভয়ারণ্যরূপে ঘোষনা করেন |প্রসঙ্গত বর্তমানে সুন্দরবনের ৩৪ শতাংশ ভারতের অন্তর্ধীন এবং ৬৬ শতাংশ বাংলাদেশের অধীন |
আমাদের পরিচয় হয় অনুপের সথে | অনুপ আমাদের গাইড | তিনি আমাদের সুন্দরবন সম্পর্কে তথ্য দিলেন | গেওয়া‚গরান‚ গোলপাতা‚সুন্দরী গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন |
এখানকার বাদাবনের প্রয়োজনীয়তা‚ম্যানগ্রোভ অরণ্য যে ধ্বংসের মুখে‚বাঘ কেন জন বসতিতে শিকার খুঁজতে আসে এ সবই আমাদের ব্যখ্যা করে বোঝালেন | এইসব গুলো বুঝতে গেলে‚জানতে গেলে একবার কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে সুন্দরবন | সমগ্র সুন্দরবনের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের অন্তর্গত এবং দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে | ভারতের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলটি তিনটিভাবে বিভক্ত | অভয়ারণ্য এলাকা বা স্যাংচুরিয়ান এরিয়া‚বাফার জোন বা নিরাপদ অঞ্চল এবং কোর এড়িয়া বা মুল বনভুমি অঞ্চল |  অভয়ারণ্য এলাকা একেবারেই পর্যটকদের জন্য এবং বাফার জোনে ঘুরতে যেতে পারে পর্যটকরা এবং ভূমিপুত্ররা মধু সংগ্রহ করতে  কিন্তু কোর এলাকায় প্রবেশ সম্পুর্ণভাবে নিষিদ্ধ | মধু সংগ্রহের ব্যাপারটিও খুব কষ্টদায়ক | মধু আর মোম সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিবছর অনেকগুলো প্রাণ বাঘের পেটে চলে যায় কিন্তু কাঙ্খিত দাম এরা পায় না |
আমরা সজনেখালি অভয়ারন্যে বেশ কিছু কুমীর দেখি | বাঘ সহ অন্যান্য প্রাণীরা মিঠে জল খেতে আসে | তার জন্য একটা মিঠে জলের পুকুর ওয়াচ টাওয়ার থেকেই দেখা গেল | সেখানেও বেশ কিছু কুমীর চোখে পড়ল | আর কিছু বানরও হুটোপাটি করছিল | দেখলাম এক মস্ত মৌচাক| কিছু জলজ প্রাণীও চোখে পড়ল | এখান থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা গেলাম লঞ্চে | প্রাতরাশে কচুরী‚ ছোলারডাল আর খইয়ের মিষ্টি | তারপর সেখান থেকে আমরা সুধন্যখালি টাইগার ক্যাম্পের দিকে রওনা হই | এই ওয়াচ টাওয়ারটি সজনেখালি ওয়াচ টাওয়ের থেকে আরও উঁচু | অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায় | ঘন জঙ্গলের কিছু অংশ পরিস্কার করে রাখা আছে পর্যটকদের জন্য যাতে জঙ্গলের প্রাণীরা জল খেতে এলে দেখা যায় | দুর্ভাগ্যবশঃত কিছু কুমীর‚হরিণ বাদে আর কিছুই চোখে পড়ে না | এখান থেকে আবার আমরা লঞ্চে ফিরে যাই | সেখানে অনুপের কাছেই শুনি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা‚সুন্দরবনের উৎপত্তি‚চুয়ান্নটি গ্রামের বর্তমান অবস্থা‚বাঘের চরিত্র‚কিভাবে তারা তাদের এলাকা নির্ণয় করে ইত্যাদি আকর্ষক বিষয়| এবার আমাদের গন্তব্য দোবাকি টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট | এখানে মাটির প্রায় ২০ মিটার ওপর দিয়ে সেতু করা আছে | সেতুর দুইধার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা | এখানে প্রচুর চিতল হরিণের দেখা মিলেছে | নরম মাটির ওপর টাটকা বাঘের পায়ের ছাপ দেখে আফশোষ হচ্ছিল চাক্ষুষ বাঘ দেখতে পেলাম না | পাখি চোখে পড়ল কিছু কিছু | এখানেও ওয়াচ টাওয়ার থেকে একটি বড় গোসাপ দেখা গেল | কিছু অদ্ভুত ফুল‚প্রচুর গাছ‚এইসব দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল |
লঞ্চে ফিরে পকোড়া সহযোগে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই হঠাৎ চোখে পড়ল একটি হরিণ সাঁতরে নদী পার হচ্ছে | কি অপুর্ব সে দৃশ্য | মোবাইলের ক্যামেরা আর মনের ক্যমেরায় তুলে রাখলাম সে ছবি | এবার যেতে হবে অনেকটা রাস্তা ঝড়খালি | যেখানে রাখা আছে তিনটি বাঘ যেগুলো কোন না কোন সময়ে অসুস্থ হয়ে বন দপ্তরের হাতে ধরা পড়েছে| তাদের ঐ রিহ্যাবিলেটেশনে রাখা হয়েছে| ওদের আর কোনদিনই জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে না | আছে প্রজাপতি গার্ডেন‚বাচ্চাদের পার্ক এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ গাছের অরণ্য‚পুরানখ্যাত নেতি ধোপানীর ঘাট ইত্যাদি আছে | কিন্তু সেখানে যেতে অনেকটাই সময় লাগবে | তাই লাঞ্চব্রেকটা হয়ে গেল | আজকের মেনু ভাত‚শুক্তো‚ডাল (এমন অসাধারণ ডাল আমি কোনদিন‚কোথাও খাইনি)‚পোস্ত দিয়ে আলুভাজা‚কাতলা কালিয়া‚চিংড়িমাছের মালাইকারী‚চাটনি আর পাঁপড় | ঝড়খালিতে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় তিনটে তিরিশ | এখানে টাইগার রিহ্যাবিলেটেশন সেন্টারে কাজ চলছে | টিকিট বড়দের তিরিশ ছোটদের দশ| ভিতরে ঢুকে তিনটি বাঘ দূর থেকে দেখা গেল | সত্যিই রাজকীয় চলন‚মেজাজ | দেখেই মন খুশ হয়ে যাবে | তেড়ে এলে কি করব কে জানে | প্রচুর সাদা কুমীর‚কুমীরের ডিম আর বানরের উৎপাত| এখান থেকে বেরিয়ে আমরা আবার লঞ্চে করে ফিরব পাখিরালয় | অনেকটা রাস্তা | ঝড়খালিতেই অনুপের সাথে আমাদের যাত্রা শেষ হয়ে যায় |
এবার শুধু ভেসে যাওয়া | লঞ্চে ফিরতেই হাতে হাতে ধরিয়ে দেয় কমলালেবু | আকাশে তখন পড়ন্ত দিনের সূর্য | একটু একটু দিন নিভে গিয়ে নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চরাচর | এমন অন্ধকারে লঞ্চে বসে থাকাও জীবনে প্রথমবার | চারিদিকে কালো জল‚ আর দূর দূরান্তে টিমটিমে আলো | কেমন যেন এক মন কেমনিয়া সন্ধ্যে |  লঞ্চের ইঞ্জিন আর জেনারেটারের ঘড় ঘড় শব্দ‚ চাবুক হাওয়া আর টিমটিমে আলো‚জমাটি আড্ডা | আকাশে গোল থালার মত চাঁদ| সহযাত্রীদের উদাত্ত গান নেশা ধরিয়ে দেয় | হাতে হাতে চলে আসে চিকেন পকৌড়া আর চা | কি বিরতিহীন সেবা এদের |
প্রায় রাত আটটায় আমাদের লঞ্চ নোঙর করে ঘাটে | লজের  ঘরে ঢোকার অবকাশ হয় না | ঝুমুর শিল্পীদের সাথে মেতে উঠি | ওদের গানের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে ওদের রোজকার কঠিন জীবনযাত্রার কথা | অল্পবয়সী বৌদের এই সাংসারিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এই উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠাকে কুর্নিশ করি |
একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি আমরা |  টুকটাক কিছু কেনা কাটা | বাঙালী আমরা‚যেখানেই যাই হামলে পড়ে কিনি এ দুর্নাম তো আমাদের আছেই | রাতে স্যালাড‚চিলিচিকেন আর ফ্রায়েড রাইস দিয়ে ডিনার সেরে আমরা যে যার ঘরে চলে যাই | দুটো দিন শেষ| আগামীকাল সকাল নটায় চেক আউট |

২৫শে ফেব্রুয়ারী‚ ২০২৪

আজ তৃতীয় তথা আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণের শেষতম দিন |  সকাল থেকেই আবহাওয়া মেঘলা| শিরশিরে  হাওয়া বইছে | ঘাটে আজ প্রচুর ভিড় | সবাই আজ ফিরে চলেছে | লঞ্চে লঞ্চে রেষারেষি | কারটা আগে ভিড়বে | আমাদের রাজদূত আসতে আমরা চড়ে বসলাম | পাটাতনে বসাই যাচ্ছে না আজ | এত হাওয়া যে পুরো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে | শীতপোশাকে সবাই নিজেদের মুড়ে নিয়েছে তবু ঠান্ডা মানছে না | কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাতরাশ দেওয়া হল আমাদের | লুচি‚চানামসালা আর খইয়ের মিষ্টি | এই খইয়ের মিষ্টিটা ছানা আর খই দিয়ে বানিয়েছে | দারুন খেতে | খেয়ে দেয়ে আমরা কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বিজয়নগরে | এখানে পর পর চাষের জমিতে ডাল চাষ হয়ে ফসল উঠে গেছে | কোথাও কোথাও কাঁকড়া চাষও হচ্ছে | এখানে একটি লোকনাথবাবার মন্দির আছে শ্রদ্ধানন্দজী মহারাজের‚ যারা সেবামূলক কিছু কাজ করে | মন্দিরের সেবায়েত খোল বাজিয়ে কীর্তনে মাতোয়ারা | বেশ ছিমছাম মাটির মন্দির | দেখা হল একটি টার্কির সাথে | ঠুকরে ঠুকরে খাবার খাচ্ছে | আশেপাশে বাজার বসেছে | অনেক টুরিস্ট বাজার সেরে নিচ্ছে সেখান থেকে | এখানে টাটকা ডাব খেয়ে দেখলাম‚ কি  অপূর্ব স্বাদ | জল অনেক আর খুব মিঠে | কৎবেলমাখা‚কুলমাখা‚তেঁতুলমাখা সব বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই কিনছে | মন্দির ঘুরে অনেকেই যাচ্ছে বাঘের হাত থেকে বেঁচে ফেরা জনৈক ব্যক্তিকে দেখতে | বীভৎস দৃশ্য | জীবন এখানে প্রতিপদে বিপজ্জনক | জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘ | এই নিয়েই সুন্দরবন | প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকুল করে এরা এখানে বসবাস করছে বছরের পর বছর |
সেই সঙ্গে শিয়রে বিপদ‚এই বাদাবন‚এই ম্যানগ্রোভ ধংসের মুখে | পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার সবধান করছেন‚এখুনি সচেতন না হলে আগামীদিনে তলিয়ে যাবে সুন্দরবনের সাথে সাথে কলকাতাও | সুন্দরবনের পরিবেশকে বাঁচাতে ডিঙি নৌকা করে একদল মানুষ তুলে ফেলছে আমাদের মত সভ্য মানুষদের ছুঁড়ে ফেলা প্ল্যাস্টিক‚বোতল ইত্যাদি কৃত্রিম বর্জ্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে | কোন খাড়ি থেকে কখন বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়বে বা কুমীরে পা টেনে নেবে এই বিপদকে মাথায় রেখে | শুধু কি তাই‚এই যে পর্যটন বর্তমান সুন্দরবনের অর্থনীতির একটি বিশেষ অঙ্গ সেটিকে বাঁচাতে গেলেও পর্যটক সংস্থাগুলিকে সচেতন হতে হবে‚এই যে এত খাওয়া-দাওয়া এসব বর্জ্য নদী গর্ভে না ফেলে এর যথার্থ  সাইকিলিং এর ব্যবস্থাও করতে হবে এদের |
আমরা আবার  লঞ্চে উঠি | এত ঠান্ডায় আর পাটাতনে বসা যায় না | নিচে চলে যাই| গত কয়দিনে এখানে আসার‚বসার প্রয়োজন মনে করিনি | আজ কিন্তু এই ঠান্ডায় এখানেই ভালো লাগছে | দেখতে দেখতে লাঞ্চের টাইম হয়ে যায়| আজ ভাত‚ডাল‚আলুভাজা‚ কাতলামাছ আর ভোলামাছের ঝাল‚চাটনি আর পাঁপড় | খেয়ে দেয়ে আমরা ফটো তোলাতে মেতে উঠি | আর তো বেশিক্ষণ নয় |  দূরে বাসন্তী হাই ওয়ে চোখে পড়ে | প্রায় বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা ফিরে আসি সোনাখালি | এখান থেকে ছেড়েছিল আমাদের লঞ্চ| আবার ফিরে চলা নাগরিক জীবনে  কিছুটা অক্সিজেন ভরে নিয়ে সেইভাবে যেভাবে এসেছিলাম  দিন দুই আগে|
পথনির্দেশ:- ব্যক্তিগতভাবে যদি আসেন তবে  শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং লোকাল ধরে ক্যানিং | সেখান থেকে আগে কোন লঞ্চ বা বোটে বুকিং করে নিতে হবে প্ল্যান প্রোগ্রামিং হওয়ার সাথে সাথে | ওরাই বাকি দায়িত্ব আপনার বইবে ক্যানিং অবধি | আপনি চাইলে কোন ভ্রমন সংস্থার সাথেও যেতে পারেন সেক্ষেত্রে আপনাকে শুধু টাকাটা ধরে দিলেই হবে‚বাকি দায় তারাই নেবে | এছাড়া গোসাবা ব্লকের দুলকিতে হোটেল সোনার বাংলাও আছে‚সেখানেও থাকতে পারেন‚এদের নিজস্ব বোটও আছে| তবে একটা কথা বলব প্রকৃতিতে উপভোগ করতে চাইলে আপনার অবশ্য গন্তব্য হতে পারে সুন্দরবন ।।
*****************************************

জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতিঃ
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি  সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে,জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।
===================================

pc. Facebook

তবু আনন্দতবু অনন্ত জাগে !

ব্রতী ঘোষ

ঝিল্লিকে পুল কারে তুলে দিয়ে অঞ্জনা এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে বসলো | এই সময়টা বড্ড আরামের-বড় নিজের। চা খেতে খেতে রাস্তার লোকজনদের পর্যবেক্ষণ করা ওর একটা মজার খেলা। দক্ষিণ কলকাতার এই পাড়াতে আসার এতটুক ইচ্ছা অঞ্জনার ছিল না | কিন্তু অনিন্দ্য আর শ্রী,ওদের এই ফ্ল্যাটটা ভীষণ পছন্দ | অগত্যা ! কিন্তু এখানে আসার পর অঞ্জনার ও বেশ ভালো লেগে গেছে পাড়াটা। ছিমছাম এবং বেশ সংস্কৃতিমনস্ক | কেউ কারোর ঝামেলায় থাকে না | বিমল কান্তি চলে যাবার পর উত্তর কলকাতার অত বড় বাড়ি যেন গিলে খেতে আসছিল ওকে। 
‘মা-তুমি কোথায় ?’  অনিন্দ্যর  ডাক শুনে মনের ভাবনাগুলোকে সরিয়ে রেখে সাড়া দেয় অঞ্জনা,’এইতো বাবু !’ 
‘মা,আজ আমাদের ফিরতে দেরি হবে। তুমি ঝিল্লিকে আজ একটু টিউশানে দিয়ে এসো | আমি গোপালদাকে বলে যাচ্ছি রিক্সা করে নিয়ে যাবে |’ 
মমতা এসে সকালের সব কাজকর্ম করে বেরিয়ে গেল-‘দিদা,আসছি গো ! দরজাটা দিয়ে দাও |’ 
এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেল | একলা ফ্ল্যাটে এবার অঞ্জনার সারাটা দিনের অপেক্ষা-কখন সবাই আবার এক এক করে ফিরবে | ঝিল্লি ফিরতে ফিরতে তা দুপুর দুটো হয় | তারপর ওকে চান করিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বেলা সাড়ে তিনটে বেজে যায়। কোথা দিয়ে সময়টা যে কেটে যায় | মাঝে মাঝে হাঁফিয়ে ওঠে অঞ্জনা। সারাটা জীবন তো স্কুল,সংসার,ছেলেমেয়ে মানুষ করা,সব সামলাতে হয়েছে এক হাতে। ভেবেছিলেন অবসর নিয়ে ছেলের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে সংসারের দায়িত্ব থেকে একটু রেহাই নেবেন। কিন্তু এই আর এক মহা দায়িত্ব এসে পড়ল ওর ঘাড়ে। যদিও নিজের সব ভালো লাগা মন্দলাগা এক লহমায় ভেসে চলে যায় যখন ঝিল্লি ঠাম্মি ঠাম্মি করে গলাটা জড়িয়ে ধরে। সংসারের ওপর করা সব অভিমান তখন ভেসে চলে যায় ওর স্নেহের বাণে | অনিন্দ্য আর শ্রী ওর কোন জিনিসের অভাব রাখে না | কিন্তু মাঝে মাঝে সেটাও যেন দেওয়া নেওয়ার হিসেব বলে মনে হয়। ওরা বেড়াতে গেলে অঞ্জনার জন্য কিছু না কিছু  উপহার নিয়ে আসে,হোটেলে খেতে গেলে খাবার নিয়ে আসে শ্রী | কিন্তু কেন যে অঞ্জনার মনটা খারাপ হয়-কেন যে জীবন খাতার হিসেব-নিকেশ গুলোকে ক্লিশে বলে মনে হয় অঞ্জনা ভেবে পায় না |  জীবনের সব হিসেব-নিকেশ গুলো কি ওলোট-পালট হয়ে যায় এভাবেই ? 
আবার আর একটা নতুন দিন আসে | সারাদিনের একই রুটিন | অঞ্জনা বড্ড হাঁফিয়ে ওঠে | যতদিন স্কুলে যেতেন ততদিনই যেন  উনি বেঁচে ছিলেন | এখন এক এক সময় নিজের ওপর বড় বিরক্তি লাগে ওর | একঘেয়েমিতে অঞ্জনা জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ ও হারিয়ে ফেলেছে | এক এক সময় মনে হয়-আচ্ছা-ও যদি পৃথিবীতে না থাকে তবে কি খুব ক্ষতি কিছু হবে ? হ্যাঁ-অনিন্দ্য আর শ্রীর খুব অসুবিধে হবে সেটা ও জানে-কিন্তু সবই অভ্যাসের ব্যাপার | কারুর জন্যই কিছু পড়ে থাকে না-কোন শূন্যস্থানই শূন্য থাকে না-এ কথা অঞ্জনা ভালো করেই জানে | তবু শূন্যতা আর হাহাকার কখন যেন এক হয়ে গিয়ে পাক খেতে খেতে বুকের ভেতরটাকে একেবারে গর্ত করে ফেলে | 
‘আচ্ছা ! অঞ্জনা বসু কি এখানে থাকেন ? শুনছেন ?’ -চমক ভাঙে অঞ্জনার | 
‘হ্যাঁ ! আপনি? আরে গোরা !’ 
‘যাক্ ! চিনতে পেরেছিস তাহলে ?’
‘তোকে চিনবো না ? কলেজ জীবনকে ভোলা যায় ?’ 
‘তুই কি ওপর থেকে নেমে এসে দরজাটা খুলবি না কি ওপর থেকেই বক্ বক্ করবি ?’
‘এমা ! ছিছি ! দেখেছিস আমার অবস্থা ! আসছি আসছি |
‘তুই এখানে ?’ অঞ্জনার  অপার বিস্ময়ের সীমা নেই |
‘জানিস্ ! আমি কোথা থেকে তোকে খুঁজতে খুঁজতে আসছি ? নে! শিগগিরি এক কাপ চা খাওয়া |’
ঘরের ফ্যানটা খুলে দিয়ে অঞ্জনা শিগগিরি এক কাপ চা করতে রান্নাঘরে ঢোকে |
‘তোর ছেলের কি খবর ? কি যেন নাম ? ভুলেও গেছি |’
‘অনিন্দ্য ! অনিন্দ্য আর আমার বৌমা শ্রী একটা চার্টাড ফার্ম খুলেছে | দুজনেই নটার মধ্যে বেরিয়ে যায় | আর ঝিল্লি স্কুলে | দুপুরে ফিরবে |’
‘ও ! তুই তাহলে এখন গভর্নেসের কাজ করছিস |’
‘কি যে বলিস ! গোরা !  নিজের নাতনিকে দেখাশোনা করবো না তো কে করবে শুনি ?’
‘এই গুলোই ভুল করিস অঞ্জনা | ওর মেয়ের দায়িত্ব ও বুঝে নেবে | তুই যখন তোর ছেলেকে মানুষ করেছিস তখন কে ছিল ? একে দায়িত্ব পালন বলে না সংসার আঁকড়ে থাকা বলে।’
‘যাক্ গে ! তুই এসব ছাড় !’ – গোরার থেকে জীবনের সারসত্যকে শোনার ইচ্ছে এতটুকুও অঞ্জনার নেই | তাই যেন একটু থামানোর চেষ্টা করে বলে,’নে তো ! চা খা !’ 
গোরাও যেন নিজেকে একটু সামলে নেয় । বুড়ো বয়সের এই এক সমস্যা,দুম করে মাথা গরম হয়ে যায়।
‘আহ ! দারুণ চা করেছিস তো !’ তৃপ্তির চুমুক দিয়ে গোরা পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে |
‘আচ্ছা ! শোন ! কত কান্ড করে তোর খোঁজ পেয়েছি তা জানিস? রবি নাকি এখান দিয়ে একদিন যাবার সময় তোকে ব্যালকনিতে দেখতে পেয়েছে। শেষে আমাকে ঠেলে পাঠিয়েছে। আগামী রবিবার ওর প্রথম বই প্রকাশ অনুষ্ঠান | তুই  অবশ্যই আসবি |’
‘রবির বই মানে ? ও কবে লেখক হলো ?’
‘কেন ভুলে গেছিস ? তুই ই তো ওকে বলে বলে লিখতে শিখিয়েছিলিস !’ 
‘কি বলছিস ? তাহলে কি ফেসবুকে রবির ভাষায়’ কলামটা ওর ? আমাদের রবি কিশোরের ? ওটা আমি নিয়মিত পড়ি-অঞ্জনার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল | 
‘ঠিক ধরেছিস |’ – ঘাড়  নাড়ে গোরা |
‘তুই আগামী রবিবার আশুতোষ হলে চলে আয়,হাজরাতে।’
‘দেখ আমি কিন্তু কথা দিতে পারছি না- ‘অঞ্জনার গলায় ইতস্ততঃ ভাব | 
‘না না! তোকে আসতেই হবে।’
‘আচ্ছা সে দেখবখন |’
এরপর অনেক জোরা জুরিতেও আর বসে না গোরা । অনেক কাজ আছে বলে হাঁটা দেয় ।
অনিন্দ্য আর শ্রীর আজ বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয় । শ্রীর মাঝে মাঝে বেশ খারাপই লাগে কারণ যতটা সম্ভব ও ঝিল্লিকে দেখার চেষ্টা করে | কিন্তু মাঝে মাঝে কাজের চাপে সত্যিই মেয়ের জন্য সময় বার করাটা একেবারে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । শাশুড়ি মা সারাদিন একা একা থাকেন,ঝিল্লির আদর আবদার সামলান | ও বেশ বুঝতে পারে যে মাঝে মাঝে উনি অধৈর্য হয়ে পড়েন | ওর শুকনো মুখটা দেখতে একটুও ভালো লাগেনা শ্রীর | উনিও যে এই বয়সে এসে একটু শুয়ে বসে থাকতে ভালোবাসেন,সেটা শ্রী বেশ বুঝতে পারে | আজ শ্রী চাওমিন নিয়ে এসেছিল কিন্তু উনি মুখেই তুললেন না | 
পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে অঞ্জনা গোরার কথা খুলে বলেন ওদের।
‘আমি কিন্তু যাবো না ! এসব আর এখন ভালো লাগেনা না |’
‘না মা তুমি যাবে | আমি রাজুকে বলে দিচ্ছি তোমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যাবে |’ – শ্রী বলে | 
দেখতে দেখতে রবিবার এসে পড়ে,শ্রী আজ বাড়িতেই থাকবে ঠিক করে রেখেছে | আজ শাশুড়ি মাকে পাঠাতেই হবে রবিবাবুর বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে | অঞ্জনা কে নিজের পছন্দ করা শাড়ি বার করে খুব সুন্দর পরিপাটি করে শ্রী সাজিয়ে দেয়।
বাড়ির গাড়িতে করে যেতে যেতে অঞ্জনা ভাবেন সত্যিই শ্রীর মতো এত ভালো বৌমা,ছেলে,নাতনি সব রয়েছে তার অথচ কেন যে তিনি গুমড়ে মরেন ! মন চলে যায় চল্লিশ বছর পিছনে | সেদিনও ছিল এমনই এক রবিবার | চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক গোধূলি বিকেলের ছবি | দুপাশে দুই বিনুনি করে শ্যামলা মেয়েটি সেতারে গৌর সারং এর ঝংকার বাজিয়ে চলেছে এক মনে। সামনে বসে আছেন বিমল কান্তি,বাবার পাশে | তার দু চোখের মুগ্ধতার রেশ এসে মিশে যাচ্ছিল গৌর সারং এর তানে তানে |  ঝংকার শেষ হলে শ্বশুর মশাই বলেছিলেন,’মা রে ! তুই কবে আসবি আমার বাড়ি ?’
কিন্তু ওর বাবাকে দেওয়া কথা ‘আপনার মেয়ে সারা জীবন এরকমই সেতার বাজাবে।’ – সে কথা তিনি রাখতে পারেননি। কারণ শাশুড়িমা চাননি | আর সেই দুঃখ অমৃত্যু তিনি পোষণ করে গেছেন। এরপর কত ঝড় যে বয়ে গেছে | নিজের সব শখ আহ্লাদ  জলাঞ্জলি দিয়ে সংসার করে গেছেন অঞ্জনা মুখ বুজে | আর আজ যখন বিমল কান্তি ও নেই-বড় একা লাগে | জীবন সায়াহ্নে এসে এমন একাকীত্ব তিনি কোনদিন ভাবতেও পারেননি |  নিজের অজান্তেই কখন যেন এক দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে উঠে আসে।
‘মাসিমা এসে গেছি | আপনার হয়ে গেলে আমাকে ফোন করবেন।’ – রাজুর গলার আওয়াজে স্বম্বিত ফিরে আসে অঞ্জনার | 
হলে পৌঁছে অঞ্জনা অবাক | গোরা অঞ্জনা কে দেখতে পেয়েই এগিয়ে আসে-,’আমি জানতাম তুই আসবি’ | 
এরপর পরমা,শ্যামলী, শর্মিষ্ঠা,সুজন,নবীন,সুধন্য সবাই মিলে একে একে এগিয়ে এসে ওকে মুড়ে দেয় ভালবাসা আর সুখস্মৃতির মোড়কে | বয়স যেন কিছুক্ষণের মধ্যে কমে যায় চার দশক | ‘আচ্ছা ! রবি কোথায় ?’ 
‘ওর স্ত্রী আজ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই ওকে নিয়ে আসতে একটু দেরি হচ্ছে ওর’ – গোরা বলে |
আশুতোষ হলটি খুব বড় না হলেও মাঝারি মাপের | আসন সংখ্যা শ পাঁচেক হবে | পুরো হল ভরে গেছে | এত লোক কারা? সবাই রবির বন্ধু? ভাবতে ভাবতেই অঞ্জনা দেখে রবি ওর স্ত্রীকে নিয়েই স্টেজে উঠছে | সেই রবি,কালো,রোগা ছেলেটা এখন এত সুদর্শন হয়ে গেছে ? তবে হাসিটা যেন এখনো সেই আগের মতই সরল রয়ে গেছে | কালের নিয়মে অভিজ্ঞতার পলি পড়েছে ওর মুখে আর কপালে | রবি স্ত্রীকে ধীরে ধীরে চেয়ারে বসায়,স্টেজ থেকেই অঞ্জনার দিকে হাত নাড়ে | স্টেজে উপস্থিত রয়েছেন আশুতোষ কলেজের প্রিন্সিপাল বিনয় কৃষ্ণ বাবু,অঞ্জনা দেখেই চিনতে পারে | গোরা সঞ্চালকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর একে একে পরিচয় করিয়ে দেয় দর্শকদের সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত গুণীজনদের | অঞ্জনা অভিভূত হয়ে যায় একথা জেনে যে হলে উপস্থিত দর্শকদের বেশিরভাগই রবি কিশোরের ফ্যান,আর এরা প্রায় সবাই ‘রবির ভাষায়’ পড়ে থাকে নিয়মিত | 
‘আপনাদের সবাইকে জানাই আমার অসীম কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা। আজ সভাগৃহে যেমন উপস্থিত আছেন আমার বন্ধুরা তেমনি আছেন আমার লেখাকে যারা ভালোবাসেন আর আমার পরম শ্রদ্ধার মানুষ বিনয় কৃষ্ণ স্যার এবং আর আমার স্ত্রী রমা |  আজ ১২ ই মার্চ দিনটি আমার কাছে বড়ই স্মরণীয়। কারণ আমাদের একমাত্র সন্তান সৌমাভর আজ জন্মদিন |’ এই পর্যন্ত বলে রবি থামেন | সবার গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়।
‘আজ আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধু উপস্থিত আছেন যিনি না থাকলে হয়তো আমি কলম ধরতাম না। অঞ্জনা ! উঠে আয় |’ 
অঞ্জনা যেন প্রস্তুত ছিলেন না মানসিকভাবে | গোরা এসে হাত ধরে স্টেজে নিয়ে বসায় ওকে |
আমার আরেক বন্ধু ছিল আমার ছেলে সৌম্য। আমার প্রত্যেকটা গল্প লেখার প্রথম শ্রোতা | জানেন,সেই ছোট্টবেলা থেকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে ওকে ঘুম পাড়াতাম। আর আমার সব গল্প ও প্রিন্ট করে ফাইল করে গুছিয়ে রাখত | ওর খুব ইচ্ছা ছিল সেগুলোকে বই হিসেবে প্রকাশ করার | অথচ আজকের দিনে ও উপস্থিত থাকতে পারছে না | পারছেনা তার কারণ আজ এক বছর হল ও আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে,যেখান থেকে কেউ কখনো আর ফেরেনা | আমি তোকে দেওয়া কথা রেখেছি সমু !! দেখ !!’ রমা এসে পাশে দাঁড়ান। বিনয়কৃষ্ণ স্যার ওঁর হাতটা রবির পিঠে রাখেন | প্রকাশিত হয় রবিকিশোরের প্রথম বই | অঞ্জনার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে রবি ওর বইতে ওর নাম কে স্থান দিয়েছে।
বাড়ি ফেরার পথে রাজুর সঙ্গে একটাও কথা বলেন না অঞ্জনা । শত দুঃখ শত কষ্ট আর যন্ত্রণাকে বুকে চেপেও এই যে মানব জীবনের এগিয়ে চলা এতো কবিগুরুরই দেখানো পথে পা ফেলে চলা |  রবি আর রমা এত কিছুর পরেও এগিয়ে চলেছে দুঃখকে বুকে আঁকড়ে,থেমে থাকেনি,বই প্রকাশ করেছে, লিখে চলেছে,জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে | 
বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বাজে | শ্রী দরজা খুলেই জিজ্ঞাসা করে,’মা কেমন লাগলো ?’ 
‘ভালো !! ঝিল্লি ঘুমিয়ে পড়েছে ?’
দায়সারা ভাবে কথা বলে অঞ্জনা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় | 
পরদিন ভোর হয় | শ্রীর প্রথম কথা মনে পড়ে-আজ সোমবার। হঠাৎ ই পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে সেতারের মূর্ছনা। সে সুর  যেন অনেক পথ পেরিয়ে নদীর ধারার মতো বয়ে চলেছে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে। শ্রী হাউসকোট টা পরে দ্রুত এগিয়ে আসে বাজনা লক্ষ্য করে। অবাক হয়ে শ্রী দেখে এই অপূর্ব সুর ভেসে আসছে তার শাশুড়ি মার ঘর থেকে। আস্তে করে কান পাততে গিয়ে দরজাটা খুলে যায় | শ্রী দেখে চোখ বন্ধ করে অঞ্জনা তাঁর মনপ্রাণ সমর্পণ করেছেন সেতারের সুরবন্ধে | এত অপূর্ব,এত সুন্দর ও হয় সেতারের ঝংকার ? এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি ! শ্রী দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে দেয়। এবার থেকে ও নিশ্চিন্ত | বুঝতে পারে অঞ্জনা আবার জীবনকে নতুন সুরে বেঁধে ফেলতে শিখে গেছে |  
*******************************************

This image has an empty alt attribute; its file name is --150x150.jpeg

ব্রতী ঘোষের পরিচিতিঃ
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷
====================================

PC Printerest

নারী

মেরী খাতুন

 “বাংলার বধূ বুক ভরা মধু”—কবি বলেছেন। ঠিক তাই,বুক ভরা স্নেহে বাংলার নারী  তার অঙ্গন সাজায়। নারী শক্তি, নারী মুক্তি। নারীই সমাজের মান। নারীর গর্ভ থেকেই সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ- নজরুলের। নারীর এলো চুল ঢেকে ফেলে পরিবারের আসন্ন বিপদ, নারীর নীলাভ আঁচলের ছায়ায় বেঁচে থাকে সংসার।নারীর স্তন পানে বাঁচে আগামী। নারীর জন্ম না হলে থেমে যাবে আগামী পৃথিবীর ধুকপুকনি। 
নারী বললেই চোখে ভেসে ওঠে লাল পাড় সাদা শাড়ি,বড় এলো খোঁপা,কপালে একটা টিপ। এই ছবিটা চিরন্তন বাঙালি নারীর, মায়া, মমতা আর ভালোবাসা নিয়ে,কিন্তু আজ যুগ পাল্টেছে,নারীর রূপও পাল্টেছে। যুগের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে নারী আজ আধুনিকা পারফেক্ট। সে এখন ঘরে বাইরে সমান পারদর্শী।
এই বাঙালির নারীর একাল সেকাল নিয়ে ভাবতে বসে-পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি আজ হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। নেই  রোদে শুকনো বড়ি দেওয়া,নেই আচারের বয়ামও। ঠাকুমা,দিদিমা-র সেলাই করা কাঁথা শুধু সযত্নে রাখা স্মৃতি মাত্র। ধোঁকার ডালনা, শুক্তো, মোচার কোপ্তা আর পিঠেপুলি এখন রেস্তরাঁর মেনু। তার বদলে নারী আজ পিৎজা-পাস্তা,চাইনিজ,মোগলাই আর ইডলি-ধোসা রেঁধে রসনা তৃপ্ত করেন তার গ্লোবাল পরিবারের। ঠাকুমা,দিদিমা,কিংবা খানিকটা মা,কাকিমাদের মত সকাল থেকে রাত যৌথ পরিবারের বায়নাক্কা তাকে হয়তো সামলাতে হয় না। কিন্তু বিরামহীন সেও। সকালবেলার সংসার,সারাদিন কর্মক্ষেত্র,সন্ধেয় সন্তানের পড়াশোনা,রাতের রান্না,সপ্তাহান্তে বাজার দোকান,আর মাঝে মাঝেই লোক-লৌকিকতা। এইসব কিছু নিয়ে ট্রাপিজের খেলায় সে সদা ব্যস্ত। জীবনের নানা ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসিমুখে আগলে রাখে নারী তার সংসার। রকম পাল্টেছে,ধরন পাল্টেছে,সাজে,পোশাকে,কাজে এবং অবশ্যই সম্পর্কের সমীকরণে। ‘বাবু’দের আমলের বাঙালি নারী আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সঙ্গ দেয় তার স্বামীর। তারপরেও এখনো বন্ধ হয়নি নারী হত্যা,কিংবা পনের জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা। আজও কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয় নির্বিবাদে। মেয়ে সন্তানের জন্ম দেবার অপরাধে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয় তাকে। সন্তানহীনতার জন্য সমাজের গ্লানি এখনো তাকেই সহ্য করতে হয়। ধর্ষণ তো এখন জলভাত। সে দু’বছরের শিশু হোক কিংবা আশি বছরের বৃদ্ধা। কেউই ছাড় পায়না এই নৃশংস ধর্ষণের। স্টিয়ারিং-এ হাত তার সমান গুরুত্বে। সমাজের যে কোন স্তরের নারীদের রকমফেরে এই অবস্থা। প্রশ্ন আসে সেখানেই। তাহলে কোথায় পাল্টেছে সমাজ? শিক্ষা,চাকুরি,স্বনির্ভরতা এর কোনটাই কি তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে না? নারীকে বলা হয় গৃহলক্ষী। সেকাল-একালের সব দায়িত্বতোই সে পালন করে চলেছে। বিনিময়ে সামান্য সম্মান ও মর্যাদা পাবার অধিকারটুকুও কি তার নেই। কি পার্থক্য বাংলার নারীর সেকাল-একালে? যে নারীরা মানে আমরা তুলনামূলক ভাবে উন্নত পরিস্থিতিতে রয়েছি,আমাদেরই বোধহয় এবার এগিয়ে আসার সময় হয়েছে। আমাদের শিক্ষা,জ্ঞান সবকিছু কাজে লাগিয়ে অর্জন করে নিতে হবে নিজেদের প্রাপ্য অধিকারটুকু এবং তার অংশীদার করতে হবে অন্য নারীদের। আমরা ট্রফি ওয়াইফ নই। নই শুধুমাত্র সংসার বাগানের মালিনী। আমরা সংসারে-ই অংশ-অঙ্গ। সংসারের সমান অধিকার আমাদের। আর সেই অধিকার অর্জনের জন্য বধূরূপী—নারী তুমি বিদ্রোহ করো,সমাজের সভ্যতার গভীরে বিদ্রোহ করো। অকরুণ পৃথিবীতে অশ্রুজলে তুমি আর এ জীবন নিঃশেষ হতে দিও না। জ্বলে ওঠো। অশ্রুহীন কঠিন শপথে পৃথিবীকে একবার পদাঘাত করো। নারী তুমি হয়ো না সর্বংসহা,সত্ত্বা হারা। নারী তুমি স্বয়ংসিদ্ধা হও। সৃষ্টির আনন্দে পৃথিবীতে জেগে ওঠো,শক্তির তাণ্ডবে মেতে ওঠো। নারী তুমি একবার শেষবার বাঁধভাঙা বিদ্রোহ করো। ——পূর্ণ করো তোমার নারী রূপ। 
নারী হলো কবিতা,নারী হলো ব্রততী। 
**********************************************


=====================================================================================================================
Sahos 24.com

রাজভোগ 

রাজর্ষি দত্ত

‘তোমার ভাগ্নে তো ভারী অদ্ভুত! এইভাবে গুণে গুণে ঠিক সাতটি মিষ্টি কেউ আনে?’,পৃথা ভুরু কুঁচকে তাকায় সায়ন্তনের দিকে। 
-‘পাক্কা হিসেব-আমাদের তিনজনের দুটো করে ছয়,মায়ের একটা…’ সায়ন্তনের সহজ ব্যাখ্যা।
-‘বাহ,এই না হলে ভাগ্নে…যেমন তুমি মামা!’ পৃথা বাক্স থেকে মিষ্টিগুলি সাবধানে বের করে একটা স্টিলের বাটিতে ভর্তি করতে করতে বলে ‘এই শুনছো, তোমার মা এখন একটি মিষ্টি খাবে কিনা জিজ্ঞেস কর…’
-‘করেছি, বললো এখন খিদে নেই-পরে খাবে’।   
ভাগ্নে, মানে অতীন এসেছিল ওর দিদার সাথে দেখা করতে । ইনি,অর্থাৎ সায়ন্তনের মা অতীনের আপন দিদার বোন। তবে অতীনের ছোটবেলায় সর্বত্র যৌথ পরিবারের মধ্যে আপন-পর বলে কোন ভেদাভেদ ছিল না । এই দিদা, অর্থাৎ শান্তা দিদা অতীনকে খুব যত্ন করতেন। ওঁর স্বামী,যিনি বছর চারেক আগে গত হয়েছেন-তিনিও অতীনকে পেলে পাগলের মত করতেন। ছোটবেলা থেকে পড়তে ভালবাসে বলে ওকে বই কিনে দিতেন রাশি রাশি। দোকানে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াতেন-অতীনের প্রিয় কাঁচাগোল্লা,ডিমসন্দেশ। আর বাড়ির জন্য অবশ্যই কিনতেন এক হাঁড়ি রাজভোগ-শান্তা দিদার ভীষণ পছন্দের!
বাসস্ট্যান্ডে নেমে সামান্য হাঁটলেই জিতেন ঘোষের পুরনো মিষ্টির দোকান-‘রসনা সুইটস’,যা এখন দুই ভাগ-তাঁর দুই ছেলের।একটির নাম ‘অরিজিনাল রসনা সুইটস’,অন্যটি ‘নিউ রসনা সুইটস’। রাজভোগটা অবশ্য নিউ-তেই পেল।
অতীন শুনেছে,শান্তা দিদা অনেকদিন ধরেই নানা অসুখে ভুগছেন।বয়সটাও আশি পার হয়ে গেছে।কখন কি হয়ে যায়–তাই অতীন সময় পেয়েই চলে এসেছে প্রিয় দিদাকে দেখতে। অতীনের বাবা-মা আসতে চেয়েছিলেন। বয়স তো তাঁদেরও অনেক, তাই ওদের হয়ে অতীন একাই এসেছে।
চার বাই সাড়ে-ছয়ের একটি খাটে শুয়েছিলেন শান্তা দিদা। ইস,কি রোগা হয়ে গেছে বরাবরের গোলগাল মানুষটা ! অতীনকে দেখেই উঠে বসলেন–তাঁর ঠিকরে আসা দুই চোখে আলোর বন্যা।
‘অনতু এসেছিস?কতদিন পর! এত শুকনো লাগছে কেন তোকে?আয় এখানে বোস!’
বিছানায় অতীনকে পাশে বসিয়ে উনি এক নিমেষে পিছিয়ে গেলেন চল্লিশ বছর।‘যা দুরন্ত ছিলি রে বাবা! চানের ভয়ে গাছের সরু উঁচু ডালে বসে থাকতিস-নামানো যেত না।প্রতিবার বিলু এসে…বিলুকে মনে আছে না তোর? ওর গরুর খুঁট উখরে দিতিস দৌড়ে পালাবে বলে…কি দুষ্টু ছেলে!’
এভাবে টানা কিছুক্ষণ কথা বলে শান্তা দিদা হাঁফিয়ে উঠলেন।হাসিতে টেনে থাকা মুখের পেশীগুলো শিথিল হয়ে এলে সেই স্থির প্রান্ত জানতে চাইল-‘ভালো আছিস তোরা?’
জানালার বাইরে গাছের পাতাগুলি হাওয়ায় দুলছে। তার দোলানো সাদাকালো ছায়াও দুলছে ঘরের দেয়ালে।দিদার দিকে চেয়েই অতীন মাথা হেলালো। যদিও গলায় আটকে থাকা আবেগের ডেলাটি তাকে বলতে দিল না যে সে ভালো নেই…একেবারেই না!
তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা শান্তা দিদা সেকথা পড়তে পারলেন বোধহয়। খানিকটা নিশ্চুপ থেকে তিনি জানালার বাইরে তাকালেন।তার একলা জীবনের সঙ্গী বিছানায় গলে আসা সোনালি রোদ্দুর; টেবিল থেকে প্রেসক্রিপশন উড়িয়ে নেওয়া দমকা বাতাস; কাক,ঘুঘু বা ফেরিওয়ালার ডাক;পুরনো ঘরের স্মৃতিভেজা গন্ধ…এমন আরও আছে।কিছু রোজকারের মত।আর কিছু বদলায়।যেমন বদলায় ছায়া…যেমন বদলায় ঋতু…ইচ্ছে…ভাবনা…বোধ…
‘তোর মামা-মামি বাইরে গেছে-এসে পড়বে। দুপুরে খেয়ে যাবি!’ নিস্তব্ধতা ভাঙলেন তিনি।
-‘না দিদা,আর একদিন! বরং এই মিষ্টিটা এনেছি…তুমি খেয়ো…তোমার প্রিয় রাজভোগ!’
শান্তা দিদার মুখটি আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-‘পাগল ছেলে-এসব যে আজকাল আমার খাওয়া বারণ রে!’
প্রণাম করলে দিদা তাঁর শীর্ণ হাতখানি অতীনের পাতলা চুলে রাখলেন।সে হাতের শীতলতায় লেগে আছে এক আকাশ আশীর্বাদ।
অতীন চলে যাবার ঘণ্টা দেড়েক পরের কথা।
একটা গোঙানি মত শুনে পাশের ঘর থেকে সায়ন্তন ছুটে এসে দেখে ওর মা কেমন যেন করছে। শরীরে তাঁর একটা ভীষণ অস্বস্তি! গা গুলোচ্ছে। কপালে ঘাম।সায়ন্তন এসে ধরতে না ধরতেই হড়হড় করে বমি করে দিল মেঝেতে। 
সকাল থেকে এখন অবধি ওর মা চা বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই খায় নি। তবুও বমির সাথে টুকরো টুকরো সাদা দানাগুলি দেখে সাতটি রাজভোগের রহস্য বুঝতে বাকি রইলো না সায়ন্তনের।
‘লোভে পাপ,আর পাপে একদিন মৃত্যু হবে তোমার…বুঝলে মা?’ সায়ন্তন রেগে বলে-
বমির পর অস্বস্তিটা কমেছে অনেকটা। শ্রান্ত দেহে এলিয়ে আছে বিছানায়। তবুও বৃদ্ধার শান্ত চোখ ছেলেকে যেন বলে দিচ্ছে, মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে হারানো জীবনের লোভটা কি মাত্রায় হয় সে তোরা পরে বুঝবি! এটাই যদি পাপ হয়–তো তাই!
*************************************

রাজর্ষি দত্ত পরিচিতি:
শিলিগুড়িতে জন্ম ও উত্তরবঙ্গের আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন চা-শিল্পের সাথে যুক্ত। পরিবেশ ও মানুষের প্রতি টান তার লেখার প্রেরণা। ভালবাসেন বই পড়তে,গান শুনতে,খেলাধূলা আর প্রকৃতির সান্নিধ্য।
================================

PC: meng.ru

ফেরা

    চন্দ্র কান্তি দত্ত

হেমন্তবাবু একজন বিত্তবান মানুষ। মোট আট কামরার এক বিশাল দোতলা বাড়িতে সংসার নিয়ে বাস করেন। সংসারে তিনি নিজে ছাড়াও গৃহিণী আছেন,আছে স্ত্রী ও এক সন্তান সহ  বড় পুত্র ও অবিবাহিত ছোট পুত্র। দুই পুত্রই অবশ্য বর্তমানে চাকরীসূত্রে অন্য শহরে। এছাড়াও বাড়িতে একজন মালি সহ তিনজন সর্বক্ষণের কাজের লোক ও একজন অল্পসময়ের ঠিকে কাজের লোক নিয়োজিত আছে। বাড়ির লাগোয়া যে পরিমাণ জমি আছে তাতে একদিকে ফল-সবজি ইত্যাদি ও অন্যদিকে ফুল ফোটানোর জন্য একজন সর্বক্ষণের মালি আছে। মালিও চব্বিশ ঘন্টার জন্য বহাল থাকে। বাগানের এক দিকে এদের থাকার ঘরও আছে। হেমন্তবাবু ও তাঁর ছেলেরা তিনটি গাড়ির মালিক। তার মধ্যে একটি মোটরসাইকেল ও দুটি চার চাকার গাড়ি। হেমন্তবাবুর বিষয়-আশয় বোঝানোর জন্য এই বিবরণটুকুই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়।
হেমন্তবাবুর বাড়িকে এ অঞ্চলের মানুষজন আমলাবাড়ি নামেই চেনে। কারণ,হেমন্তবাবু নিজে একজন দুঁদে সরকারী আমলা ছিলেন। তাঁর দুই পুত্রও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে। এমন কি,বছর চারেক আগে হেমন্তবাবু তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন একজন হবু আমলারই সাথে। এসব দেখে একথা বলাই যায় যে,সরকারী আমলা বা হবু আমলা ছাড়া অন্য কারও এ সংসারে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এরই মধ্যে আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে,হেমন্তবাবুর স্ত্রী ও বড়বৌমা কোন চাকরি বাকরি করেন না। এখন অপেক্ষা ছোটবৌমাটির জন্য। তিনি কোন সরকারী আধিকারিক হবেন,নাকি একান্তভাবে গৃহিণী, সেকথা বলার সময় এখনও আসে নি।
আমাদের কাহিনী কিন্তু এ বাড়ির কারও সরকারী আধিকারিক হওয়া বা না হওয়া নিয়ে নয়। এ কাহিনীর প্রধান কুশীলব হলেন শ্রী হেমন্ত কুমার বাগচি বা হেমন্তবাবু। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হবে আমাদের আজকের কাহিনীর ঘটনাপ্রবাহ।
হেমন্তবাবু এমন এক সংসারে মানুষ হয়েছেন,যেখানে অনটনই ছিল তাঁদের নিত্য সঙ্গী। হেমন্তের বাবার যা রোজগার ছিল তা দিয়ে সাত সদস্যের একটা বড় সংসারের সারা মাসের গ্রাসাচ্ছাদন চলত না। ফলে মাসের প্রথম থেকে টেনেটুনে চালালেও শেষ আট-দশ দিন যেন আর চলতে চাইত না। তখন কোনক্রমে এক বেলা আধপেটা ফেনা ভাত জুটলেও সন্ধেবেলা আর কিছু জুটত না। কখনো একমুঠো মুড়ি,কখনো বা শুধু এক ঘটি জল। ক্রমাগত এভাবে দিন যাপনের ফল হয়েছিল মারাত্মক। অপুষ্টিজনিত কঠিন রোগ অল্পবয়সেই কেড়ে নিয়েছিল তাদের পাঁচ ভাইবোনের দুজনকে। পরপর দুটি সন্তানকে হারিয়ে আশাপূর্ণা শোকে ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁরও জীবনসংশয় দেখা দিয়েছিল। কারণ,চিকিৎসা করানো ছিল এ সংসারে বিলাসিতা। শেষে সব সংশয় দূর করে আশাপূর্ণা উঠে দাড়িয়েছিলেন। এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছিলেন যে,প্রাত্যহিক এই দুর্বিষহ জীবন যন্ত্রণা থেকে অন্ততঃ দুজন মুক্তি পেয়েছে।
এই পরিমন্ডলে বড় হচ্ছিল হেমন্ত ওরফে নাড়ু। অপুষ্টিতে জর্জরিত শরীর। অথচ,দুচোখে দিগন্ত ছোঁওয়ার স্বপ্ন,মনে সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খা। কিন্তু  দিশা দেখাবার কেউ নেই,নেই প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান। কি করবে নাড়ু? কে দেখাবে পথ? ওকে যে অনেক বড় হতে হবে।
          *  *  *  *  *  *  *  *
সোমনাথ রায় একটা কোচিং ক্লাস চালান। সেখানে পঞ্চম শ্রেণী থেকে স্নাতক পর্যন্ত সব ক্লাসেরই কোচিং পাওয়া যায়। সোমনাথ নিজে যেমন নিয়মিত ক্লাস করান,সেইরকম সোমনাথের সাথে আরো বারো জন শিক্ষিত মানুষের একটা দল আছে যাঁরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত কিন্তু সামান্য অর্থের বিনিময়ে সোমনাথের কোচিং ক্লাসে নিয়মিত ক্লাস করান। এঁদের কাজটা যত না পেশা তার চেয়ে অনেক বেশী নেশা। সোমনাথ ও তাঁর সঙ্গীরা একটা ব্রত নিয়ে চলেন। বিদ্যাবিমুখ ছেলেমেয়েদের এঁরা বিদ্যামুখী করেন,মধ্য মেধার ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ মেধার পথ দেখান এবং উচ্চাকাঙ্খী,মেধাবী  ছেলেমেয়েদের তাদের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সাহায্য করেন।
পাড়ার এক দাদার হাত ধরে নাড়ু একদিন পৌঁছে যায় সোমনাথ রায়ের পাঠশালায়। সোমনাথ যখন বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, তখন অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে হেমন্ত তাঁর বাড়ির আর্থিক অবস্থা জানায়,একই সাথে জানায় তাঁর মনের কথা। সোমনাথ বোঝেন ছেলেটির সাধ আছে,আছে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার উচ্চাকাঙ্খা। কিন্তু সাধ্য নেই। টিউশন ফি দেওয়ার ক্ষমতা নেই,নেই বইপত্র কেনার ক্ষমতা। কিন্তু চোখে তাঁর আকাশ ছোঁওয়ার স্বপ্ন,মনে তাঁর সামনে ছুটে চলার উদগ্র বাসনা। সোমনাথ হেমন্তকে নিরাশ করেন নি।
সোমনাথ রায়ের সাথে দেখা হওয়ার পর নাড়ু বা হেমন্তকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
সোমনাথ ও তাঁর বন্ধুদের পৃষ্ঠপোষকতায় হেমন্ত একে একে স্নাতক,স্নাতকোত্তর ও সবশেষে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার গন্ডি সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে পেরেছেন। তারপর,দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরী জীবন শেষ করে সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা হিসেবে যখন তিনি অবসর নিলেন,তখন তাঁর জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের খাতাটা কানায় কানায় পূর্ণ। এতটুকুও ফাঁকফোকর কোথাও নেই।
অবসর গ্রহণের পর হেমন্তবাবু যে বাড়িতে এসে উঠলেন,সেটা তিনি নিজে করেন নি। এটা তিনি নতুন অবস্থাতেই কিনেছেন। তবে চাকরি থেকে অবসরের আগে তিনি এখানে বসবাস করেন নি। তাঁর শেষ পোস্টিং ছিল দিল্লীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে। পরবর্তী দিন পনেরোও সেখানে কেটেছে। স্বভাবতঃই,এ অঞ্চলের মানুষজনের সাথে তাঁর বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরিচয় ছিল না। মাস ছয়েকের ব্যবধানে তাঁর ছেলেরা ও একমাত্র বৌমা সমাজে কিছুটা মিলেমিশে গেলেও হেমন্তবাবু বা তাঁর স্ত্রী এখনও সে পথে হাঁটেন নি। যদিও দুজনের ক্ষেত্রে কারণ এক নয়। এই পরিবারের অলিখিত নিয়ম অনুসারে অথবা প্রয়োজন পড়েনি তাই,অনুপমা কখনও একা কোথাও যান নি। যখন বেরিয়েছেন তখন কারও সাথে বেরিয়েছেন এবং তাও বাড়ির গাড়িতে। ফলস্বরূপ গত দেড় বছরে এ অঞ্চলের কোন মানুষের মুখও ভাল করে দেখেন নি।
কিন্তু হেমন্তবাবুর ক্ষেত্রে কারণটা স্বতন্ত্র। তিনি বহুবার একা বেরিয়েছেন। পায়ে হেঁটেও বেরিয়েছেন। রোজ সকাল-সন্ধ্যে নিয়ম করে অনেকটা হাঁটেন। কিন্তু তবু মেলামেশা দূরস্থান,সামান্য আলাপটুকুও কারও সাথে হয় নি। এর কারণ আর কিছুই নয়, কারণ হল হেমন্তবাবুর দম্ভজনিত অনীহা। হেমন্তবাবু মনে করেন অন্ততঃ এ অঞ্চলে তাঁর মত একজন এতটা উচ্চপদস্থ সরকারী আধিকারিক কেউ ছিলেন না বা এখনও নেই। অর্থাৎ মেলামেশার ব্যাপারে তাঁর সমগোত্র বা সমকক্ষ কেউ নেই। তাই  পাড়ায় বসবাসকারী অনেককে রোজ দেখলেও তাঁদের সাথে আলাপ-পরিচয় করেন না বা অন্য কারও মধ্যে তেমন আগ্রহ অনুভব করলে সযত্নে এড়িয়ে যান।
হেমন্তবাবুর এই দাম্ভিক মনোভাব কিন্তু এখানে আসার পর রাতারাতি গড়ে ওঠে নি। হেমন্তবাবুর অবসরের অন্ততঃ বিশ বছর আগে থেকে যাঁরা তাঁকে চেনেন,তাঁরা হেমন্তবাবুর স্বভাবের এই দিকটা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। বছর দশ-বারো চাকরী করার পরই হেমন্তবাবুর মধ্যে ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন দেখা যায়। হেমন্তবাবু ক্রমশঃ গম্ভীর হতে থাকেন। নিজের সমকক্ষ বা উঁচুতলার লোকজন ছাড়া অন্যদের সাথে কথাবার্তা দপ্তরের কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। সর্বোপরি নীচুতলার কর্মচারীদের সাথে হেসে কথা বলা পুরোপুরি পরিহার করেন। দপ্তরে বা বাইরে যেখানেই তিনি গেছেন,সব সময় তাঁর পরনে দামী স্যুট-টাই ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় নি। এমনকি,ঘরে যখন থেকেছেন তখনও ধোপদুরস্ত পায়জামা-পাঞ্জাবীর সাথে উৎকৃষ্ট মানের গাউন ব্যবহার করেছেন।
ছেলেবেলায় অপুষ্টিজনিত রোগে দুটি ভাইবোন মারা যাওয়ার পর হেমন্তবাবুরা তিন ভাই একসাথে বড় হয়েছিলেন। হেমন্তবাবু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিলেও বাকি দুজন কিন্তু নিজের নিজের চেষ্টা ও সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। হেমন্তবাবুর সমকক্ষ না হলেও নিজেদের জীবনে তাঁরা সুখী ছিলেন। হেমন্তবাবু নন, এঁরা দুজনই বাবা-মাকে সুখের মুখ দেখিয়েছিলেন। আবার,এই দুটি সন্তানের সাথেই তাঁদের বাবা-মা সুখে শান্তিতে  তাঁদের শেষ জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। যদিও নাড়ুর পর হয়ে যাওয়া নিয়ে একটা চোরা দুঃখ দুজনেই অনুভব করেছেন। কারণ,জীবনে বড় হওয়ার পর হেমন্ত নিজের বাবা, মা, এমন কি ভাইদেরও অপাঙতেয় মনে করে অথবা নিজের উন্নতির পথের কাঁটা মনে করে দূরে সরে যেতে দেরী করেন নি।
সমাজে বাস করতে হলে ন্যূনতম কিছু সামাজিক কর্তব্য মেনে চলতে হয়। কোন একজন মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সেখানে গৌণ,  মূল্যহীন। হেমন্তবাবু কি চান বা না চান সেটা না জেনেই পাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক একদিন হেমন্তবাবুর সাথে দেখা করতে এলেন। উদ্দেশ্য আলাপ করা এবং আগামী দুর্গাপুজোর বিষয়ে কিছু আলোচনা করা। এ পাড়ায় দুর্গাপুজোর যে কার্যকরী সমিতি তৈরী হয় তাতে সমাজের বয়স্ক ভদ্রলোকেদের রাখা হয়,যদিও পুরো কাজটা সুষ্ঠভাবে সমাধা করতে সকলে মিলে হাত লাগান।
হেমন্তবাবু এঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করলেন না। কিন্তু একই সাথে তাঁর অতি শীতল ব্যবহারে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি এঁদের সান্নিধ্য পছন্দ করছেন না বা এঁদের সাথে কোন সামাজিক কর্তব্যে যোগদান করতে তিনি কোনভাবেই রাজি নন। ভাবে ভঙ্গিতে হেমন্তবাবুর মনোভাব বুঝতে পেরে ওঁরা চারজন রুষ্ট হয়ে বেরিয়ে গেলেন। পড়ে থাকল চারটে কাপ ভর্তি চা,যা ক্ষুব্ধ ভদ্রলোকেরা স্পর্শ পর্যন্ত করেন নি।
অবশেষে এসে গেল বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জাঁকজমক নিয়ে পালিত হল এপাড়ার পুজো। এরই মধ্যে পরিকল্পনা করে বাদ দেওয়া হল একটি মাত্র পরিবারকে। সেখানে না গেল  চাঁদার আবেদন,না দেওয়া হল কোন নিমন্ত্রণপত্র। সমাজবদ্ধ জীব হওয়া সত্ত্বেও অসামাজিক জীবের মত একটা আলাদা দ্বীপে বাস করতে লাগলেন হেমন্তবাবু ও তাঁর পরিবার। এভাবেই পেরিয়ে গেল আরও কিছু সময়।
            *  *  *  *  *  *  *
সেদিন আকাশে ঘন মেঘ জমেছিল। সন্ধ্যের দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল। হেমন্তবাবু কোথাও গিয়েছিলেন। ফেরার পথে হেমন্তবাবুর গাড়ি বাড়ির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তিন-চারশো মিটার দূরেই হেমন্তবাবুর বাড়ি। হঠাৎ সামনে একটু তফাতে কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটল। হেমন্তবাবুর গাড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। পথ বন্ধ। হেমন্তবাবু বিরক্ত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,”কি হল? থামলে কেন?”
চালক বললেন,”একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে স্যার। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।”
– “অ্যাক্সিডেন্ট? কিসের অ্যাক্সিডেন্ট?”
– “একটা অটোরিক্সা বাঁদিকে কাত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় কেউ নেই। দেখব স্যার?”
– “হ্যাঁ,দেখ। কি আর করবে?” হেমন্তবাবুর জবাবে চরম বিরক্তি প্রকাশ পেল।
চালক নেমে গিয়ে আবার ছুটে এলেন। বললেন,”স্যার,দু-তিনজন নীচে আটকে আছে। বার করতে হবে। কেউ নেই। কি করব স্যার?”
হেমন্তবাবু সভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন,”তা আমাকে কি করতে হবে?”
হেমন্তবাবুর মনোভাব বুঝতে পেরে ফিরে গিয়ে চালক নিজেই চেষ্টা করতে লাগলেন।
হেমন্তবাবু এক মুহূর্ত কিছু ভাবলেন। চালকের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে তাঁর মনে একটা প্রতিক্রিয়া হল। মনে হল,মানুষের বিপদে কি এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিৎ! হেমন্তবাবু নেমে এলেন। দেখলেন,একটা অটোরিক্সা প্রায় উল্টে গেছে আর তার তলায় কেউ আটকে আছে। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। হেমন্তবাবুর মনে হঠাৎ কিছু পরিবর্তন দেখা দিল। তিনি কালক্ষেপ না করে চালকের সাথে ধরাধরি করে যাদের উদ্ধার করলেন, তারা বছর পাঁচ-ছয়েকের একটি ফুটফুটে মেয়ে ও তার মা। সেই মুহূর্তে সেখানে চলে আসা আরও দুজন মানুষের সাহায্যে জ্ঞান হারানো ওদের দুজনকে নিজের গাড়িতে তুলে হেমন্তবাবু দ্রুত কাছের  হাসপাতালের পথে রওনা হলেন। অটোরিক্সার চালককেও উদ্ধার করা হল। তবে তার আঘাত তেমন গুরুতর নয়।
অবশেষে হেমন্তবাবুর জীবনে এল সেই বিশেষ ক্ষণ,যখন হেমন্তবাবু ভুলে গেলেন এতগুলো বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা তাঁর একমাত্র মূলধন-তাঁর অহংকার। নিজেকে সবার থেকে স্বতন্ত্র,বিশিষ্ট ভাবার অহংকার। সমাজের আম জনগনকে ঘৃণাভরে দূরে ঠেলে দেওয়ার অহংকার।
হাসপাতালে যখন হেমন্তবাবু গাড়ি থেকে নামলেন, জ্ঞান হারা ছোট্ট মেয়েটি তখনও তাঁর কোলে। রক্তে ভিজে গিয়েছে তাঁর দামী পোষাক। কিন্তু কোন ভ্রূক্ষেপ নেই হেমন্তবাবুর। আজ তিনি এক অন্য নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। বহু বছর পরে আজ তিনি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি ডাক্তারদের বললেন,”আপনারা দয়া করে ওদের বাঁচান। পুলিশ বা অন্য বিষয় আমি দেখে নিচ্ছি।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অবসরপ্রাপ্ত আমলার সৌজন্যে চিকিৎসার কোন ত্রুটি হল না। সারাটা সন্ধ্যে ও রাত্রি চরম উদ্বেগে কাটানোর পর সকালে একে একে দুজনের জ্ঞান ফিরল। রাতে খবর পেয়ে ওদের প্রতিবেশী তিনটি ছেলে এসে রক্ত দিয়ে গিয়েছে। ওরা আত্মীয় নয়, শুধুই প্রতিবেশী। তবু প্রয়োজনে রক্ত দিতে এক মুহূর্ত ভাবে নি। হেমন্তবাবু বিস্মিত এদের দেখে,এদের সাথে কথা বলে।
সকালে হেমন্তবাবু হাসপাতালে টাকাপয়সা দিয়ে ওদের সম্পূর্ণ চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে বাড়ি ফিরলেন। আবার আসবেন। মনে আজ তাঁর গভীর প্রশান্তি। গত সন্ধ্যায় বুকে  অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকা ছোট্ট মেয়েটির হৃদস্পন্দন তিনি এখনও শরীরে অনুভব করছেন। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। হেমন্তবাবু সে অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছেন।
পাড়ার কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন। হেমন্তবাবু নিজে বেরিয়ে এসে ওঁদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। চা খাওয়ালেন। তাঁর ব্যবহারে আজ আন্তরিকতার বাড়বাড়ন্ত। শরীরে রাত জাগার ক্লান্তি সত্ত্বেও মন আজ তরতাজা-সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের মতো বিকশিত।
ওঁরা চলে গেলে গিন্নীকে বললেন,”অনুপমা। জলখাবার খেয়ে আমি একটু শোবো। শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে। তবে কেউ খোঁজ করতে এলে ডেকে দিও। কেমন!”
অনুপমা বিস্মিত,হতবাক। কি হয়েছে এতকালের চেনা মানুষটার?
বিছানা ঠিক করে দিয়ে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন,”তোমার শরীর ভাল আছে তো?”
হেমন্তবাবু একটা লম্বা হাই তুলে বললেন,”শরীর আমার ভালই আছে। জানো অনু,মানুষের সান্নিধ্য যে এত মধুর,নিজের দোষে আমি সেটা এতকাল ভুলেছিলাম। আজ আমার সব ভুল ভেঙ্গে গেছে। আজ আমি বুঝেছি,মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে বড় অন্যায় করেছি আমি। বুঝেছি,মানুষের সান্নিধ্য,প্রয়োজনে মানুষের এতটুকু উপকার-এগুলোই জীবনের প্রকৃত মূলধন। আজ আমি শাপমুক্ত।
আমি এখন কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমবো। তুমি দরজাটা টেনে দিয়ে যাও।”
***************************************

চন্দ্রকান্তি দত্ত

লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে  লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
=================================

PC-shodography-stock.adobe

ইচ্ছা পূরণ

রেশমি দত্ত

                                        অনিরুদ্ধবাবুর যমজ মেয়ে,সূর্যশিখা ও শুকতারা। তাদের নাম গুলোর মত স্বভাবটাও ছিল একেবারেই বিপরীত। সূর্যশিখা ছিল তেজী,স্পষ্ট বক্তা,অতি উজ্জ্বল গায়ের রঙ ও দীর্ঘাঙ্গী। আর শুকতারা স্নিগ্ধ,মিষ্টভাষী,একটু শ্যামলা বর্ণ, মিষ্টি মেয়ে। সূর্যশিখা খুব সুন্দর নাচে আর শুকতারা গান করে,একজনের প্রিয় বিষয় গণিত অন্য জনের সাহিত্য। দুজনের মধ্যে এত অমিল থাকা সত্ত্বেও,দুজনে দুজনের প্রাণ,ওরা যেন একে অন্যের পরিপূরক। ধীরে ধীরে তারা যখন বড় হয়ে উঠল তখন অনিরুদ্ধবাবু ভাবলেন এবার মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে। তিনি পাত্র খোঁজা শুরু করলেন। পাত্র পেলেন অজয়কে সূর্যশিখার জন্য। অজয় সরকারি চাকুরে,শিক্ষিত,নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার,আর কি চাই ! সুপাত্র হিসাবেই বিয়ের বাজারে গণ্য হবে সে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল ওদের। একটি বছর দুজনে একটু মেলামেশা করবে,দুজনে দুজনকে একটু বুঝে নেবে আর তারপর বাজবে বিয়ের সানাই। ওরা এখন প্রায়ই বেরোয়,ভিক্টোরিয়া,রবীন্দ্র সদন,নন্দন,কফি হাউস…….ওদের গল্পে প্রেমালাপ ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কথা হত। কার বাড়িতে কে কেমন স্বভাবের,কে কি পছন্দ করেন বা করেন না ইত্যাদি। সূর্যশিখার গল্পে প্রায়ই উঠে আসত শুকতারার কথা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি অজয় যেদিন সূর্যশিখাকে দেখতে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে সেদিন শুকতারার সঙ্গেও তার আলাপ হয়। আর মনে মনে শুকতারাকে বেশ ভাল লেগেছিল,কিন্ত একথা প্রকাশ্যেই আনা যাবে না। অগত্যা নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই শ্রেয়। এরকম কত ভালোলাগা যে আমাদের মনে উদয় হয় আবার সবার অজান্তেই গোপন থেকে যায়,সারাজীবনে হয়ত কেউ জানতেও পারেনা। যাকগে এসব কথা ভুলেও বলবেনা অজয় কাউকেই। কিন্ত যখন সূর্যশিখা তার বোনের কথা অজয়কে বলে তখন মন্দতো লাগেই না বরং ভালোই লাগে শুনতে,আর মনে মনে বিধাতা পুরুষের ওপর একটু রাগ ও হয়,ভাবে সূর্যশিখা না হয়ে শুকতারার সঙ্গে তো সম্পর্ক হতে পারতো !  
এদিকে অনিরুদ্ধ বাবু ভাবছেন সূর্যশিখার তো একটা ব্যবস্থা হল,যদি শুকতারার জন্য একটা সম্বন্ধ পাওয়া যেত তাহলে উনি দুই মেয়েকে একই সঙ্গে পার করতেন। অজয় কে একদিন ডেকে বললেন,’বাবা তোমার শালির জন্য একটি ছেলে দেখনা,যদি একই সঙ্গে……বাকিটা আর বলতে হলনা,অজয় বুঝে গেল। অজয় ভেবে দেখল তার বন্ধু অর্ঘ্য পাত্র হিসাবে মন্দ হবে না,সে তো বিয়ে করবে একবার বলেও ছিল।যা ভাবা তাই কাজ,অর্ঘ্যর বাড়ি থেকে একদিন শুকতারাকে দেখতে এল,পছন্দ হয়ে গেল দুই পরিবারের দুই পরিবারকে,ঠিক হয়ে গেল বিবাহ,দিন তো আগেই ঠিক করা ছিল। আমার অনুভব বলে প্রেমের বিয়েতে যেমন পাত্র পাত্রীর পছন্দ আগে প্রাধান্য পায়,সম্বন্ধের বিয়েতে পরিবারের পছন্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঠিক সেরকমটাই হল অর্ঘ্যর ক্ষেত্রেও। সূর্যশিখার কথা বলার ধরণ,ব্যক্তিত্ব,সৌন্দর্য সব মুগ্ধ করেছিল অর্ঘ্যকে। কিন্ত সে কথা ভাবলে তো চলবে না,কাউকে সেকথা বলাও যাবেনা,এমনকি বন্ধু অজয় কেও নয়।ওই কিনা সম্বন্ধ টা করল,আর তাছাড়া সূর্যশিখার সাথে তার বিয়ে ঠিক তা সে আগে থেকেই জানত,তাই বন্ধুর ভাবি বৌয়ের কথা মনে মনে ভাবলেও বাস্তবে তা অসম্ভব। কখনও কখনও আমাদের মনে হয় বাস্তবে যা ঘটছে তার থেকে ভাবনায় অনেক স্বস্তি,যাকগে একেই বলে  বিধির বিধান,’জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে’। শতকরা নব্বই  ভাগ মানুষের জীবনে এমন টাই হতে দেখা যায়,দুটো একদম বিপরীত চরিত্রের মানুষের একসাথে জোট বেঁধে বছরের পর বছর চলাকেই বোধহয় বিবাহ বলে। ব্যতিক্রমী যারা তারা বোধহয় ঈশ্বরের বিশেষ কৃপা প্রার্থী। অর্ঘ্য বরাবর সূর্যশিখার মত চাকুরীরতা মেয়েই পছন্দ করত।সারাজীবন সে দেখেছে মাকে বাবার কাছে টাকার জন্য হাত পাততে। তাই তখন থেকেই সে ভাবত ‘আমার বউ কে যেন আমার কাছে হাত পাততে না হয়। আর অজয়ের পছন্দ ছিল একটি ঘরোয়া মেয়ে,ভাল রান্না করবে,ঘরটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখবে,ছোট থেকে হস্টেলের রান্না খেয়ে আর বিশ্রী একটা ঘরে থেকে জীবন টা যেন এলোমেলো হয়ে গেছে।
এরপর একদিন সময় করে দুই বন্ধু আড্ডা দিতে বসেছে,রোজ হয়ত সময় হয়না | তবে মাঝে মধ্যেই ওরা এরকম আড্ডা দেয়,একে অপরের মনের কথা আদান প্রদান করে,রাজনীতি,খেলা,সিনেমা,সমাজ সব কিছু নিয়েই আলোচনা চলে তা সে দুজনে সহমত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে তবে তাতে তাদের বন্ধুত্বে কোন আঁচ পড়েনা।আড্ডা দিতে দিতে আবেগে একদিন বলেই ফেলল একে অপরের পছন্দের কথা,আর বলা মাত্রই সিদ্ধান্ত নেওয়া পাত্রী বদলের। অনিরুদ্ধ বাবুর এতে কোন আপত্তি নেই,দুজনেই যোগ্য পাত্র,তার দুই  মেয়ের সম্মতি থাকলেই হল। এই সিদ্ধান্তে প্রথমে সূর্যশিখার একটু আপত্তি থাকলেও পরে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছিল। অবশেষে এই ঘটনার পর অনিরুদ্ধ বাবু আর বেশী দেরী না করে শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন করলেন। বিয়ের সানাইয়ের  রেশ যখন ফিকে হল,বেনারসি আর জোড়ের গিট আলগা হল,শুরু হল রোজনামচা,দুই পুরুষই পেয়ে গেছে তাদের কাঙ্খিত নারীকে,এবার জীবন হবে মনের মতন। অর্ঘ্য আর সূর্যশিখা দুজনেই অফিস জয়েন করল,ওদিকে অজয়ের অফিসের সাথে সাথে শুরু হল শুকতারার গেরস্থালি। একই সময় অর্ঘ্য আর সূর্যশিখা অফিস বেরোয় সকাল আটটা,আর একই সাথে বাড়ি ফেরে রাত আটটায়। বাড়ি ফিরে দুজনেই এত ক্লান্ত থাকে যে একে অপরের মুখের দিকে তাকায়,চা টা আজ কে করবে!রাতে খেতে বসে অর্ধেক দিন কিছু খেতে পারেনা অর্ঘ্য,রান্নার লোকের করা রান্না মুখে তোলা যায়না একেবারে। অফিস যাওয়ার আগে কিছুই খুঁজে পায়না অর্ঘ্য,ঘর যেন লণ্ড ভণ্ড। চিৎকার করে সূর্যশিখার ওপর,সূর্যশিখাও সহ্য করার পাত্রী নয়,ঝামেলা লাগে প্রায়ই। এদিকে অজয় যখন সেদিন শুকতারাকে বলল,অনলাইনে ইলেকট্রিক বিলটা জমা করে দিতে সে বলল ওসব সে করতে জানেনা,ওসব কারিগরি বিদ্যায় সে অপটু। বাজার টাজার করতেও তার ভালো লাগেনা,বাজারে যে বড়ো কোলাহল, দরদাম এসব তার দ্বারা হবেনা। মোট কথা বাইরের সবটাই অজয়কে একা হাতে সামাল দিতে হয়। এদিকে বিয়ে করতে গিয়ে দুই বন্ধুরই বাজারে কিছু ধার হয়েছিল আর সেটা শোধ করতে হচ্ছিল মাসের মাইনে থেকেই,তাতে হিমশিম খাচ্ছিল অজয়,তার একার রোজগার । অন্যদিকে অর্ঘ্যর পক্ষে খুব সহজ ছিল লোনের ই এম আই দেওয়াটা। সংসার চলত সূর্যশিখার টাকায়।অজয় আরো একটা পার্ট টাইম জব নিল। তা নাহলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে,ফলে সে সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরতো আর রাত এগারটায় ফিরতো,শুকতারা যে পরিপাটি করে রান্না করত তার স্বাদ,গন্ধ বোঝার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই সম্ভব হচ্ছিল না।এমনকি শুকতারার সুন্দর করে সাজানো ঘরে সে থাকতই বা কতক্ষণ। একদিন তো অজয় শুকতারাকে বলেই বসল,’সারাদিন ঘরে বসে করটা  কি! আর ওদিকে অর্ঘ্য রান্নার লোকের রান্নায় এত তেল মশলা খেয়ে অসহ্য পেটের যন্ত্রণা,বাড়িতে থাকতেই ইচ্ছা করেনা,বাড়ির বাথরুম টাও পরিষ্কার করার লোক নেই। এভাবেই কোন রকমে চলতে লাগল দুই বন্ধুর বিবাহিত জীবন। তাদের পছন্দ গুলো বাস্তব জীবনের সঙ্গে একেবারেই বেমানান হয়ে উঠল তা বলা বাহুল্য। বিধাতা পুরুষ যেন মুচকি মুচকি হাসছেন আর মনে মনে বলছেন,’কি বাছাধনেরা কেমন মজা এবার,আমার পছন্দের ওপর জোরাজুরি’……….এই সবের  মাঝে দুই বন্ধুর অনেক দিন আড্ডা দেওয়াই হয়না। তাই দুজনে একদিন অনেক কষ্টে সময় বার করল আড্ডা মারার। অফিসের পরে দুজনে মিলে ওদের পছন্দের বার কাম রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে ওদের চির পরিচিত কোনের টেবিল টায় চলে গেল,এই টেবিল টায় বসে এর আগেও বহুবার ওরা আবেগে ভেসেছে,এবারও তার ব্যতিক্রম হলনা।আজ তারা আবার নিজেদের সুখ দুঃখ শেয়ার করবে।দীর্ঘ দিন বাদে দুই বন্ধু আড্ডা দিতে বসেছে,দুজনের হাতেই পানীয়,উল্লাস বলার পর,ঠোঁট টাকে ভিজিয়ে নিয়ে একসঙ্গে দুজনে দুজনকে জিজ্ঞেস করে উঠল,’কেমন আছিস বন্ধু’?আর উত্তর দেওয়ার  আগে এক ঢোঁকে গ্লাস ফাঁকা করে বলে উঠল এক সঙ্গে,’যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,যাহা পাই তাহা চাই না…….’
***********************************

লেখিকা-রেশমি দত্তঃ
জন্ম ও পড়াশোনা কোলকাতায় ৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর-পেশায় শিক্ষিকা রেশমির অবসরের বিনোদন হলো বইপড়া ৷ শৈশব থেকে  বাবার অনুপ্রেরণায় গল্প ও কবিতা লেখার শুরু ৷ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ভ্রমণ ওর প্রিয় বিষয় ৷
==================================

পলাশীর প্রান্তরে গুপ্তিপাড়ার মোহনলাল আসলে কে ? 

অনির্বান সাহা

বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের এক বাঙালি মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু রহস্য তথা অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তা আমরা জানি। কিন্তু নেতাজির জন্মের অনেক পূর্বে আরও একজন বীর বাঙালির মৃত্যু তথা অন্তর্ধান নিয়েও ঐতিহাসিকেরা এখনও পর্যন্ত ভিন্নমত তথা বিতর্ক পোষণ করেন তা আমরা অনেকেই জানি না। তিনি হলেন বাংলা,বিহার,উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া নবাবের বিশ্বস্ত ও অন্যতম প্রধান সেনাপতি মোহনলাল। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে এহেন বীর বাঙালি সন্তানের জন্মস্থান ছিল হুগলী জেলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ গুপ্তিপাড়াতেই। আসুন তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি।
১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে নবাবের আসনে বসেই সিরাজদ্দৌলা দুজন দক্ষ কর্মকর্তার ওপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মোহনলাল। তাঁকে নবাব দেওয়ানখানার পেশকার নিযুক্ত করে মহারাজা উপাধি প্রদান করেন। সাথে সাথে তাঁকে বিহারের পূর্ণিয়া অঞ্চলের শাসনভারও অর্পণ করা হয়। সিরাজের দরবারে মোহনলালের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল অভাবনীয় ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়,পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিনি। এহেন বীর বাঙালি সন্তানের জন্মস্থান ছিল হুগলী জেলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ গুপ্তিপাড়াতে। তবে তাঁর জন্মসাল বা তারিখ সম্পর্কেও ঐতিহাসিকেরা নির্দিষ্ট কোন মতামত প্রদান করতে পারেননি। নবাবের দরবারে আগত ফরাসি দূত মঁসিয়ে ল’-এর স্মৃতিকথায় মোহনলালের বিভিন্ন কৃতিত্ব ও অবদান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর স্মৃতিতে ১৯৫৬ সালে ড: প্রফুল্ল চন্দ্র সেনগুপ্ত এবং শ্রী শ্রী বৃন্দাবন জিউ এস্টেটের তৎকালীন ম্যানেজার শ্রী যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের উদ্যোগে একটি স্মৃতি ফলকও নির্মিত হয়। এটুকু ছাড়া জন্মভিটেতেই আজ মোহনলাল বিস্মৃত। মোহনলালের স্মৃতিতে নির্মিত সেই ফলকে লেখা আছে, 
ইমান রাখিলে তুমি সেনাপতি তোমারে নমস্কার,
বীর প্রতিভায় তুমি যে বাঙ্গালী তোমারে নমস্কার”।
এখানেও রয়েছে বিতর্ক,অনেকে আবার মোহনলালকে কাশ্মিরী বলে উল্লেখ করে বলেছেন “মোহনলাল কাশ্মিরী”। কিন্তু ১৮ শতকে বাংলায় কাশ্মিরীদের আগমন ছিল অত্যন্ত বিরল। এছাড়া ১৯ শতকে আগত পরিব্রাজক মোহনলাল কাশ্মিরীর সঙ্গে তাঁকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে কিনা তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট প্রশ্ন।
The Business Standard (বাংলা) ওয়েবপেজ থেকে জানা যায়,সিরাজের বংশধর হিসেবে পরিচিত লালা দে পরিবারের পারিবারিক তথ্য অনুযায়ী,সিরাজ পত্নী হীরা ওরফে আলেয়ার আপন ভাই ছিলেন মোহনলাল। এখান থেকেই তাঁর উত্থান এবং পরবর্তীতে নবাব সিরাজদৌল্লার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও অন্যতম প্রধান সেনাপতি হন। নবাব সিরাজদ্দৌলার হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৭৫৭ সালে যোগদান করেন পলাশীর যুদ্ধে। কিন্তু পলাশীর ময়দানে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন মোহনলালের সঙ্গে কী ঘটেছিল ? এক্ষেত্রে যদুনাথ সরকার সম্পাদিত হিস্ট্রি অব বেঙ্গল (ভলিউম ২) বই থেকে জানা যায় যে,”সেদিন মীরমদনের নেতৃত্বে ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে নবাবের সেনাবাহিনী যুদ্ধ শুরু করেন । তবে মীরমদনের মৃত্যুর পর সিরাজ দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলেন । বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের পরামর্শে নবাব সেদিনের মতো সৈন্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন । মোহনলালকেও তিনি যুদ্ধ করতে বারণ করেন । নবাবের চরম বিপর্যয়ের শঙ্কায় মোহনলাল প্রথমে পিছিয়ে যেতে সম্মত না হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর কথামতো যুদ্ধ বন্ধ করেন । ফলে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে । সেনাবাহিনীতে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। বেলা ৪টার পরে নবাব নিজেও পালিয়ে যান “। কিন্তু কোথায় গেলেন মোহনলাল? তিনি কি আহত বা নিহত হলেন নাকি নিরুদ্দেশ হলেন কোন ছদ্মবেশে? 
এখান থেকেই বিতর্কের শুরু। যদুনাথ সরকারের মতে পলাশীর যুদ্ধে মোহনলাল আহত হন। নীরদভূষণ রায়ের মতে মোহনলাল নিহত হন বলে জানা যায়। আবার অধ্যাপক রজতকান্ত রায় সিরাজউদ্দৌলা এবং মোহনলাল নিহত হন বলে উল্লেখ করেন তবে সেটা পলাশীর যুদ্ধের পর। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে মোহনলাল জীবিত ছিলেন এবং পরে কোনো এক সময়ে তাঁর মৃত্যু হয়। অন্য এক জায়গায় রজতকান্ত রায় লেখেন মোহনলাল যুদ্ধে ‘জখম’ হন। আবার অনেক ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে,যুদ্ধোত্তর পর্বে তাঁর জন্মস্থান হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে তিনি আত্মগোপন করে থাকেন বেশকিছু কাল। আবার The Business Standard (বাংলা) ওয়েবপেজে বর্ণিত হয়েছে যে,সিরাজের বংশধর হিসেবে পরিচিত লালা দে পরিবারের তথ্য থেকে জানা যায় যুদ্ধের পরিস্থিতি বুঝে তিনি সিরাজের তিন বছরের পুত্র তথা নিজ ভাগ্নেকে নিয়ে ছদ্মবেশে মুর্শিদাবাদে পাড়ি দেন। সেখান থেকে পদ্মা নদী পেরিয়ে ময়মনসিংহের তৎকালীন জমিদার রায় চৌধুরী বংশের অন্তর্গত বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় নেন। এই পুরো পথে মোহনলালের সঙ্গে ছিল বাসুদেব ও হরনন্দ নামের দুই বিশ্বস্ত অনুগামী। এই পুরো যাত্রাপথে তথা পরবর্তী সময়েও ব্রিটিশদের চোখে ধূলো দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ও তাঁর দুই সঙ্গী আত্মগোপনের জন্য সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করেছিলেন। ময়মনসিংহের তৎকালীন জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর ছোট ছেলে কৃষ্ণগোপাল রায় চৌধুরী এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরাজ পুত্রকে দত্তক নেন। ছেলেটির নতুন নাম হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। পারিবারিক নথি অনুযায়ী,উক্ত অনুষ্ঠানে ছদ্মবেশে মোহনলাল উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি কোথায় যান?
মোহনলাল নিজে শাক্ত ছিলেন। নদীয়া,বর্ধমান ও হুগলি জেলার ইতিহাস ও কিংবদন্তী অনুযায়ী মোহনলাল পলাতক অবস্থায় এই সকল জেলার বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন মন্দিরে সন্ন্যাসীর বেশে অবস্থান করেন। শুধু অবস্থানই নয় সেই সকল মন্দিরে তন্ত্রসাধনার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন বলেও লোকগাথা প্রচলিত রয়েছে। The Business Standard (বাংলা) ওয়েবপেজ থেকে জানা যায় যে,তৎকালীন সময়ে নদীয়া জেলার জুরানপুর অঞ্চলে অবস্থিত কালী পীঠ থেকে ভাগীরথী নদী পর্যন্ত একটি গুপ্তপথ ছিল। যে পথটি তৎকালীন সময়ে বহু সন্ন্যাসী ও বিদ্রোহীদের যাতায়াত ও আত্মগোপনের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হত বলে প্রচলিত রয়েছে। কিংবদন্তী অনুযায়ী এখানে মোহনলাল ও তাঁর ছোট ছেলে হুক্কালাল আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে আশ্রয় নেন। মোহনলালের বংশধর হিসেবে দাবি করা যাদব বংশের তথ্য অনুসারে,জুড়ানপুরের সতীপীঠের গর্ভগৃহের নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন কালে স্থানীয় যুবক,সন্ন্যাসী ও ফকিরদের তিনি যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলেন। তাহলে কি মোহনলাল এর সাথে ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলনেরও যোগসূত্র রয়েছে? তিনিই কি তাহলে নেতৃত্ব দেন সন্ন্যাসী আন্দোলনের? রয়ে গেছে প্রশ্নচিহ্ন। এর সঠিক উত্তর আজও আমাদের কাছে গুপ্ত। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকবিদরাই তৎকালীন সময়ের ইতিহাস এবং ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সম্পর্কে মূলত সরকারি নথির ওপরেই নির্ভর করেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ের সরকারি নথি এবং মোহনলাল সম্পর্কিত নথি ব্রিটিশরা সংরক্ষণের চেয়ে নষ্ট করে দিতেই বেশি উদ্যত ছিল,ফলে হারিয়ে যায় অনেক অজানা ইতিহাস। অনেকের মতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত “দেবী চৌধুরানী” উপন্যাসের ভবানী পাঠকই হলো মোহনলাল। এখানেও রয়েছে বিতর্ক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রয়াত ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে’র মতে,”পলাশী যুদ্ধের বিপর্যয়ের পরে মোহনলালের গতিবিধি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরকারি নথিভুক্ত ছিল না বলেই হয়তো স্বাভাবিকভাবেই কেউ তাঁকে ভবানী পাঠক হিসাবে চিহ্নিত করেনি”। কিন্তু কেউই মোহনলালের সঠিক মৃত্যু বর্ষ বা সমসময়িক কাল সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য দিতে পারেন নি।
তথ্যসূত্র :
–”The Business Standard (বাংলা)” ওয়েবপেজে ২০ই জানুয়ারি,২০২২ তারিখে প্রকাশিত তামারা ইয়াসমিন তমা কর্তৃক লিখিত “সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালই কি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভবানী পাঠক?” শীর্ষক প্রতিবেদন।
–উইকিপিডিয়া ওয়েবপেজ।
চিত্র: গুপ্তিপাড়ার মঠের নিকটে মোহনলালের স্মৃতিতে স্থাপিত স্মৃতিসৌধ।
************************************

This image has an empty alt attribute; its file name is -.jpg

অনির্বাণ সাহা (ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক)
===================================

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!