Shadow

বিহানবেলায় ৪ – কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী

PC: Parimal Goswami Courtesy Ananda Bazar Patrika

সংগীত সাধক নজরুলঃ সংগীতশিল্পী গড়ার কারিগর

 সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

বিশ শতকের তিরিশের দশকের শেষ দিক। ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর প্রযোজনায় এবং দেবকী কুমার বসু-র পরিচালনায় নির্মিত হতে চলেছে একটি দ্বিভাষিক ছবির বাংলা সংস্করণ। সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল হলেও মহড়াকক্ষে ছবির গান শেখাতে বসেছেন কাহিনীকার স্বয়ং। কেননা ছবির প্রায় সবগুলি গানের গীতিকার ও সুরকার যে তিনিই। তাঁর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় বাবরি চুল। আর তাঁর সামনে বসে একাগ্রচিত্তে যিনি গান শিখছেন,তিনি একাধারে ছবিটির গায়িকা ও নায়িকা। একটি গান শেখানোর আগে আস্তে আস্তে হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে শিক্ষক মহাশয় বোঝাতে শুরু করলেন কীভাবে সেই গানে কথা ও সুরের মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে। বললেন,”মনে মনে ছবি এঁকে নাও নীল আকাশ দিগন্তে ছড়িয়ে আছে। তার কোনো সীমা নেই,দুদিকে ছড়ানো তো ছড়ানোই। পাহাড় যেন নিশ্চিন্ত মনে তারই গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আকাশের উদারতার বুকে এই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোনোটা প্রকাশ করতে হলে সুরের মধ্যেও একটা আয়েস আনতে হবে। তাই একটু ভাটিয়ালির ভাব দিয়েছি। আবার ওই পাহাড় ফেটে যে ঝরনা বেরিয়ে আসছে তার চঞ্চল আনন্দকে কেমন করে ফোটাব? সেখানে সাদামাটা সুর চলবে না। একটু গিটকিরি তানের ছোঁয়া চাই। তাই ‘রো-ও-ও-ও-অই’ বলে ছুটল ঝরনা আত্মহারা আনন্দে।” ধন্য সুরের গুরু! ধন্য তাঁর সংগীত শিক্ষা! পরে তাঁর এই শিষ্যাই এক স্মৃতিচারণে ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেছেন,”এমন করে তিনি এই মেলানোর আনন্দ আমাদের হৃদয়েও যেন ছড়িয়ে দিতেন।” তিনি আর কেউ নন। কাজী নজরুল ইসলাম। শিষ্যা কানন দেবী,সংগীতাচার্য পঙ্কজ কুমার মল্লিক যাঁকে বলেছিলেন,’ফার্স্ট সিংগিং স্টার অব নিউ থিয়েটার্স।’ যে গানটি নজরুল সেদিন কানন দেবীকে শিখিয়েছিলেন, সেটি ১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাপুড়ে’ ছবির গান-‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই/ওই পাহাড়ের ঝরনা আমি/ঘরে নাহি রই গো/উধাও হ’য়ে বই।’ কানন দেবীর কন্ঠে গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ‘সাপুড়ে’,এমনকি ১৯৩৭-এ মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিভাষিক ছবি ‘বিদ্যাপতি’-তে কাজ করারও অনেক আগে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ কোম্পানির মহড়াকক্ষে কানন দেবীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম আলাপের দিনটিতেও কানন দেবী লক্ষ্য করেছিলেন, কী ব্যাকুল আবেগে নজরুল গানের কথার ভাবের সঙ্গে মেলাবার জন্য হারমোনিয়াম তোলপাড় করে সুর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কানন দেবীকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলেছিলেন,”ডাগর চোখে দেখছ কী? আমি হলাম ঘটক,তা জানো? এক দেশে থাকে সুর, অন্য দেশে কথা। এই দুই দেশের বর-কনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দুটির জাত আলাদা হলেই বে-বন্‌তি। বুঝলে কিছু?” কানন দেবী ‘না’ বলায় তিনি হেসে বলেছিলেন, “পরে বুঝবে।” এভাবে সুরের দীক্ষা দিয়ে কানন দেবীর সংগীত প্রতিভার হীরকসম বিচ্ছুরণে অভাবনীয় অবদান রাখেন নজরুল। কানন দেবী বলেছেন, “আমি ওঁর কাছ থেকে অনেকগুলো নজরুলগীতি শিখেছিলাম।” ‘সাপুড়ে’ ছবিতে নজরুলের কথায় ও সুরে কানন দেবীর একক কন্ঠে গাওয়া ‘কথা কইবে না বউ’ গানটিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রসঙ্গত: জানাই,’নিউ থিয়েটার্স’-এ ‘সাপুড়ে’ ছবির শুটিং ফ্লোরেই স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী সুপ্রভা সরকার (ঘোষ) প্রথম নজরুলকে দেখেছিলেন। নজরুলের প্রশিক্ষণে ১৯৪১ সালে প্রকাশিত রেকর্ডে তাঁর গাওয়া প্রথম নজরুলগীতি ‘কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা’ শ্রোতাদের মধ্যে বিপুলভাবে সাড়া ফেলেছিল।
তবে এও সত্য যে নজরুলের সমকালে গান গাওয়া বা অভিনয় করাকে রক্ষণশীল সমাজ ভালো চোখে দেখত না। বিশেষত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো বেশি হত। মেয়েদের গান বা অভিনয় শেখাতেন যে পুরুষ শিক্ষকেরা,তাঁদেরও অনেককে নানারকম সামাজিক হেনস্থার শিকার হতে হত। কানন দেবী ও নজরুলের মধুর সম্পর্ককেও তৎকালীন সমাজ খোলামনে মেনে নিতে পারেনি। কানন দেবীকে গান শেখাতে নজরুল তাঁর বাড়িতে যেতেন বলে তাঁদের নিয়ে নানা ধরনের কুৎসা রটানো হয়। একবার রানু সোম (সাহিত্যিক প্রতিভা বসু)-কে গান শিখিয়ে রাতে তাঁর বাড়ি থেকে ফেরার পথে নজরুলকে স্থানীয় মাস্তান গোছের কিছু ছেলের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়। ছেলেগুলো রানু ও নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে কুরুচিকর কথা বলতে বলতে তাঁকে লাঠির আঘাতে জখম করেছিল। তবে অত্যন্ত সাহসী ও প্রতিবাদী নজরুল তাদের একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে রুখে দাঁড়ানোয় তারা ভয়ে পালায়। আর এমন গুরুর সান্নিধ্যে তাঁর শিষ্যারাও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সৃজনশীলতায় মগ্ন হওয়ার পথ খুঁজে নিতে সক্ষম হন।
১৯২৮ সালে নজরুল ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ (এইচএমভি) গ্রামোফোন কোম্পানিতে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ফলে যাঁরা এই কোম্পানিতে গানের রেকর্ড করাতে আসতেন,নজরুলের কাছে তাঁদের যেতেই হত। প্রখ্যাত গায়ক ও সুরকার আব্বাসউদ্দীন আহ্‌মদ জানিয়েছেনঃ “কাজিদা তখন গ্রামোফোন কোম্পানীর জন্য গান লিখে চলেছেন। আঙুরবালা,ইন্দুবালা,হরিমতী,কানন দেবী,কমলা ঝরিয়া,ধীরেন দাস,কমল দাশগুপ্ত,মৃণালকান্তি ঘোষ সবাই তাঁর গানের জন্য ‘কিউ’ লাগিয়ে বসে থাকে।” তাঁর গান নিয়ে কাড়াকাড়ি-ও হত। বিখ্যাত কীর্তনীয়া রাধারানী দেবী নজরুলের স্মৃতিচারণে বলেছেন,”মনে পড়ে,এক বার আমাকে গাইতে বললেন,’আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’ পাশে বসে তখন কে এল সায়গল সাহেব। কাজীদাকে থামিয়ে বলে উঠলেন,’এ গান রাধা নয়,আমি গাইব।’ তা-ই হল।” তবে রাধারানী দেবী-র খাতায় নজরুল স্বয়ং একটি গান লিখে দিয়েছিলেন-‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়,সে কি মোর অপরাধ।’ তাঁর কথা মতো এই গান রাধারানী দেবী-ই প্রথম গেয়েছিলেন। আব্বাসউদ্দীন নিজেও সেই সময়কালেই নজরুলকে বাংলায় ইসলামী গান লেখা ও সুর করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নজরুলের কথায়-সুরে অসংখ্য ইসলামী গান আব্বাসউদ্দীন গেয়ে রেকর্ড করেন। নজরুলের কাছে প্রথম ইসলামী গানটি শেখার অভিজ্ঞতা আব্বাসউদ্দীন এভাবে বর্ণনা করেছেন,”তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজিদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজিদা বলে উঠলেন,’ইন্দু তুমি বাড়ি যাও,আব্বাসের সাথে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘন্টার ভিতরই  লিখে ফেললেন,’ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।’ তখুনি সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন।” নজরুলের দ্রুত গান রচনা ও সুরারোপ করার দক্ষতার কথা খ্যাতনামা গায়িকা-অভিনেত্রী এবং নজরুলগীতির প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ইন্দুবালা দেবী-ও কথাপ্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন,”কাজীদার একটি জিনিস দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। শুধু আমি কেন,আমার মতো অনেকেই হতো। রিহার্সাল ঘরে খুব হৈ হুল্লোড় চলছে,নানা জনে করছে নানা রকম আলোচনা। কাজীদাও সকলের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় করছেন,হঠাৎ চুপ করে গেলেন। একধারে সরে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন খানিক। অনেকে তাঁর এই ভাবান্তর লক্ষ্যই করল না হয়তো। কাজীদার সেদিকে খেয়াল নেই। এতো গোলমালের মধ্যেও তিনি একটুক্ষণ ভেবে নিয়েই কাগজ কলম টেনে নিলেন। তারপর খস্‌ খস্‌ করে লিখে চললেন আপনমনে। মাত্র আধঘন্টা। কি তারও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ-ছ’খানি গান লিখে পাঁচ-ছ’জনের হাতে হাতে বিলি করে দিলেন। যেন মাথার মধ্যে তাঁর গানগুলি সাজানোই ছিল,কাগজ-কলম নিয়ে সেগুলো লিখে ফেলতেই যা দেরী!…আর শুধু কি এই? সঙ্গে সঙ্গে  হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে সেই পাঁচ-ছ’জনকে সেই নতুন গান শিখিয়ে দিয়ে তবে রেহাই দিলেন তিনি। গান লেখার সঙ্গে সঙ্গে সুরও তৈরী করে ফেলতেন কাজীদা। অপূর্ব সব সুর। যার তুলনা হয় না।” ইন্দুবালা আরো জানিয়েছেন তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গান ‘দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে’-ও মুহূর্তের মধ্যে রচনা করেছিলেন নজরুল। তাঁকে চুপটি করে পাশে বসিয়ে রেখে। প্রতিভা বসু’র লেখা থেকে জানতে পারি ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী এ কোন সোনার গাঁয়’ গানটি তাঁকে শেখানোর আগের দিন রাতে নজরুল রচনা করেন। প্রতিভা লিখেছেন,”দেখা গেলো তখনো তার বয়ান ও সুরারোপ সম্পূর্ণ হয়নি,আমাকে শেখাতে শেখাতেই বাকিটা ঠিক করে নিলেন। পকেট থেকে কলম বেরুলো,কাটাকুটি কাগজ বেরুলো,গলা থেকে সুর বেরুলো,গানে সম্পূর্ণতা এলো। দিন তিনেক বাদে আর একটি গান তৈরি হলো,’এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে’।”
তবে ‘এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল সেকালের আরেক কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী ও মঞ্চাভিনেত্রী আঙুরবালা দেবী-র কন্ঠে। ১৯২৮ সালে নজরুলের কথায়-সুরে ও পরিচালনায় আঙুরবালা প্রথম যে দুটি গান এইচএমভি থেকে রেকর্ড করেন,এটি তার অন্যতম। অন্য গানটি হল-‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’। ক্রমেই তিনি নজরুলের গানের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী হয়ে ওঠেন। “কাজীদার কাছে গানের ট্রেনিং নেওয়াটা ছিল খেলার মতো,রিহার্সালে বসে সুন্দর আবহাওয়া সৃষ্টি করতেন তিনি।” – স্মৃতিচারণায় বলেছেন আঙুরবালা।  আরো বলেছেন তাঁর কাজীদা গানের শব্দ-বিকৃতি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। যেমন তাঁর লেখা কোনো গানে যদি ‘বিন্ধিল’ শব্দটি থাকে,সেটিকে ‘বিঁধিল’ উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে ঘোরতর আপত্তি ছিল তাঁর। আর তাঁর গান শেখানোর ধরন প্রসঙ্গে আঙুরবালা জানিয়েছেন একটা গান তোলানোর পর তিনি তাঁকে সেটি গাইতে বলতেন। গলায় সুর কতটা কী লাগছে না লাগছে বুঝে সেইমতো পরিবর্তন করতেন গানটির। অনেক সময় কথাও বদলে দিতেন। খুব ভালো গাইলে বলতেন, ‘তোমার কন্ঠে আমার গান প্রাণ পেল।’ আবার কখনো বা ঠাট্টা করে বলতেন,”আমি তো কাঠামোটা তুলে দিলাম। এবার তুমি আঙুরের রস মিশিয়ে মিষ্টি করো।” নজরুলের এমন রসবোধ থাকায় সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই দ্রুত তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেত,যা তাঁদের সংগীত প্রতিভা বিকাশের সহায়ক হত।
নজরুলের সান্নিধ্য ও সংগীতশিক্ষা ইন্দুবালা ও আঙুরবালার সমসাময়িক দিকপাল সংগীতশিল্পী কমলা ঝরিয়া-কেও সমৃদ্ধ করেছে। যদিও কমলা বেশি গান করেছেন বিশিষ্ট নাট্যকার-গীতিকার-সুরকার তুলসী লাহিড়ীর কথা-সুর ও প্রশিক্ষণে,তবু তাঁর সংগীতজীবনে নজরুলের অবদানের কথা তিনি মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। একবার একজন তাঁকে নজরুলের তালিমে নজরুলগীতি গাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন:”তা গেয়েছি,তবে গোড়ার জীবনে। পরে লাহিড়ী মশাই আমাকে আলাদা করে তালিম দিয়েছেন, কত কী শিখিয়েছেন! পরে তো আমি বেশিরভাগ ওঁর গানই গেয়েছি। তবে কাজীদার দানও ভুলবো না। কত বড়ো মানুষ, কত অফুরন্ত ওঁর গানের ভাণ্ডার। কথায় কথায় মুখে মুখে গান বাঁধতে পারতেন,এমন ক্ষমতা।” এখানে লক্ষ্যণীয় নজরুলের প্রশংসা করতে গিয়ে কমলা প্রথমেই তাঁকে ‘কত বড় মানুষ’ বলে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। একইরকমভাবে ইন্দুবালা দেবী বলেছেন, “কাজীদা এতো বড় ছিলেন,এতো মহান্‌ ছিলেন,তবু তিনি আমাদের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে বন্ধুর মতো আলোচনা করতেন। এমন কি যে গানের জন্য তাঁর এতো খ্যাতি,এতো দেশ জোড়া নাম,সেই গানের বাণী তৈরীর সময়েও তিনি জিজ্ঞেস করতেন আমাদের মতামত।” ১৯৩৩ সালে প্রথম আলাপেই অসামান্য প্রতিভাময়ী সংগীতশিল্পী যূথিকা রায়-এর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন নজরুল। ১৯৩৬ সালে যূথিকা প্রথম তাঁর গান রেকর্ড করেন। ‘ওরে নীল যমুনার জল’ ও ‘তোমার কালো রূপে যাক না ডুবে সকল কালো মম’-এই গান দুখানি। তারপর একে একে  নানা ভাবের অনেক নজরুলগীতিই গেয়ে রেকর্ড করেন তিনি। যূথিকা রায়-ও ‘কাজী সাহেবের কথা’ বলতে গিয়ে বলেছেন,”ঘরোয়া মানুষ হিসাবে তাঁকে আমার খুবই সহজ সরল সুন্দর নিরহঙ্কার আনন্দময় শিশুর মতো মনে হয়েছে। আনন্দে-উল্লাসে যখন কবি হাসতেন,সেই হাসির তরঙ্গে যেন আকাশ বাতাস ভরে উঠতো। এমন প্রাণখোলা হাসি আমি আর কোথাও শুনিনি। তাঁর এই সরল সুন্দর ও উদার স্বভাবের দু’একটি ঘটনা বলছি। দমদমে,গ্রামোফোন স্টুডিওতে যখন আমি রেকর্ড করতে যেতাম,কাজী সাহেবও প্রায়ই আসতেন রেকর্ডিংএর সময়। সারা স্টুডিও ঘরে মহা আনন্দে ঘুরে বেড়াতেন আর নানাভাবে আমাদের উৎসাহ দিতেন। যখন টেষ্ট রেকর্ড শোনা হতো,কবি কনট্রোল-রুম থেকে ছুটে এসে গ্রামোফোনের কাছে দাঁড়িয়ে একমনে শুনতেন। যেখানে তার ভালো লাগতো আনন্দে মাথা নেড়ে বাঃ বাঃ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করতেন। তাঁর এই আনন্দ-উৎসাহে আমাদের সকলের উৎসাহ আরও অনেক বেড়ে যেতো। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কাজে সফল হয়ে উঠতাম! একবার আমার মা কবিকে বলেছিলেন,’যূথিকা ছোটো মেয়ে,ওকে আপনি ছোটো মেয়ের গাইবার মতো গান দিলে ভালো হয়।’ কাজী সাহেব এ-কথা শুনে মাকে তাঁর বাড়ীতে যাবার জন্য অনুরোধ করেন। মা যখন কবির বাড়ী যান,তখন তিনি তাঁর অনেকগুলি গানের খাতা মায়ের সামনে এনে বলেন,’এই আমার সমস্ত খাতা আপনাকে দিলাম,এর ভেতর থেকে যে গানগুলো পছন্দ হয় আপনার মেয়ের জন্যে নিতে পারেন।’ তাঁর এই উদার মনোভাব ভোলবার নয়।”
গান শেখানোর ক্ষেত্রে নজরুলের অপরিসীম ধৈর্যের কথাটিও আলোচনা না করলেই নয়। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলি। বিশিষ্ট সাহিত্যিক,চলচ্চিত্র পরিচালক ও নজরুলের বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তখন ‘নন্দিনী’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করছিলেন। শৈলজানন্দের অনুরোধে নজরুল ছবিটির জন্য দুটি গান তৈরি করেছিলেন। ‘চোখ গেল পাখী রে’ ও ‘পদ্মার ঢেউ রে’। ঠিক হয়েছিল গান দুটি শচীন দেব বর্মন-কে দিয়ে গাওয়ানো হবে। শচীন দেব-এর জন্ম ত্রিপুরার রাজপরিবারে। বিশাল সংগীত প্রতিভা ও অপূর্ব সুরেলা কন্ঠ থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য ত্রিপুরার বাসিন্দা হওয়ায় নিখুঁত বাংলা উচ্চারণ করতে তাঁর মাঝে মাঝে অসুবিধা হত। এবারেও সেই সমস্যা দেখা দিল তাঁকে ‘চোখ গেল পাখী রে’ গানটি তোলানোর সময়। তিনি ‘চোখ’-কে বার বার বলছিলেন ‘চো’ … | ‘খ’ অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছিল। নজরুল যত বলেন,’চোখ গেল’,সুরে সুরে শচীন দেব তত বলেন,’চো গেল’। গানটি রেকর্ডিং-এর দিন ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-তে শৈলজানন্দ ও ছবির সংগীত পরিচালক সুরসাগর হিমাংশু দত্ত দুজনেই উপস্থিত। কিন্তু তখনও ‘চোখ’ ও ‘চো’ নিয়ে বিড়ম্বনা চলছে তো চলছেই। এদিকে নজরুল-ও কিছুতেই ছাড়বেন না। স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল উচ্চারণ তাঁর চাই। একনাগাড়ে আধঘন্টা ধরে গুরু-শিষ্যের কসরত চলল। অবশেষে শচীন দেব উচ্চারণ করতে পারলেন ‘চোখ’। ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নন্দিনী’ ছবিতে শচীন দেব-এর কন্ঠে নজরুলের দুটি গানই কালজয়ী হয়। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুরসম্রাট ও অবিস্মরণীয় সংগীতশিল্পী শচীন দেব বলেছেন,”…আমার পুরোনো দিনে,কাজীদার সঙ্গলাভ করার যথেষ্ট সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর ঐ সদাহাস্যময় মুখ,দিল্‌-খোলা হাসি,মধুর ব্যবহার,সরলতা ও আপন-হারা ভাব কোনদিনই ভুলতে পারবো না। …তাঁর যে ক’খানা গান আমি রেকর্ড করেছি-তার প্রতিটিতেই কাজীদার স্নেহের স্পর্শে আমার গান সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর গান গেয়ে যে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়েছি তা আমার মনে সর্বদাই গেঁথে আছে ও থাকবে। তাঁর গান গেয়ে আমি ধন্য হয়েছি।”
তবে নজরুল ছোটোদের গান শেখানোর ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেক বেশি ধৈর্য ধরতেন। তাদের ভয় ও জড়তা কাটাতে নানান মজার গল্প শোনাতেন। এ প্রসঙ্গে নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালা দেবী-র লেখা ‘কাজীদার স্মৃতিকথা’ একটু পড়ে দেখা যাক। নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর ‘রক্তকমল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হবার সময় মাত্র ষোলো বছর বয়সে নজরুলের কাছাকাছি আসার সুযোগ ঘটেছিল সরযূবালা-র। তিনি লিখেছেন-“এই নাটকের জন্য কাজী নজরুলের কাছে আমায় গান শিখতে হবে শুনে আমি তো ভয়ে লজ্জায় প্রায় কেঁদে ফেলি আর কি! ভাবলাম,আমি গানের কী জানি যে,এতোবড়ো একজন মানুষের কাছে গান শিখতে যাবো!…তাঁকে দেখে কিন্তু আমার মনের ভয় কেটে যেতে দেরী হলো না মোটেই। কখন যে তাঁর কোলের কাছে বসে মজার মজার গল্প শুনতে শুরু করে দিয়েছি,সে খেয়ালই নেই আমার তখন। এই কথা আর গল্পের মাঝখানে ‘রক্তকমল’ নাটকের একখানি গান গুন্‌গুন্‌ করে ক’বার গেয়েই কবি বললেন,’একবার আমার সঙ্গে গাও তো দেখি-‘ আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো গাইতে শুরু করে দিলাম। তখন তিনি উৎসাহ দিয়ে বলে উঠলেন,’বাঃ,বহুত আচ্ছা। তুমি তো খুব সুন্দর গাও,তবে এতো ভয় পাচ্ছিলে কেন?'” রক্তকমলে ‘মমতা’-র ভূমিকায় সরযূবালা অভিনয় করেছিলেন। ওই ভূমিকার জন্য নজরুল পাঁচখানি গান লিখে সুর করে তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সরযূবালা লিখছেন,”সে গানগুলি স্টেজে বেশ উতরে গিয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। তারপর নাট্যকার মন্মথ রায় রচিত ‘মহুয়া’ নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করার ডাক এলো আমার কাছে। সেটা ১৯৩০ সালের কথা। কাজীদা ঐ নাটকে আমার জন্য সাত-আটটি রাগপ্রধান গান লিখেছিলেন। এর সব ক’টি গান স্টেজে উঠে আমাকে গাইতে হবে শুনে আমি বেঁকে বসলাম একেবারে, ‘ও আমি কিছুতেই পারবো না। আগেরগুলি মোটামুটি সাদা-মাটা সুরের গান ছিলো-তাই চালিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এ-সব রাগসঙ্গীত গাইতে হলে তো রীতিমতো তালিমের দরকার,গলা সাধতে হয়। একি খেলার কথা নাকি ?’ এই কথা শুনে কাজীদা হা হা করে হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন,’বাঃ বাঃ সরযূ দেবী দেখছি সত্যিই বেশ বড়ো হয়ে গেছেন,কেমন বড়ো বড়ো কথা দিব্যি গুছিয়ে বলছে দেখ ! আমরা কথার বেসাতি করি, আমাদেরও তো এতো কথা মাথায় আসে না।’ কাজীদার এই কথা আর হাসিতে আমার সমস্ত আপত্তি ভেসে যায় যেন। আমি যতো বলি,’না,হবে না।’ উনি ততোই জেদ ধরে বলেন, ‘হ্যাঁ, হতেই হবে, না হলে আমার নাম পালটে দেবো। তোমায় কিচ্ছুটি করতে হবে না-লাফাতে হবে না,ডিগবাজী খেতে হবে না, একপায়ে দাঁড়াতেও হবে না, শুদ্ধু আমার সঙ্গে গাইবে আর হাসবে। ওঃ হো,তুমি তো জর্দা খেতে ভালোবাসো-আচ্ছা দেখ, তোমায় কি সুন্দর জর্দা খাওয়াচ্ছি’ বলে তিনি নিজের হাতে পানের বাটা থেকে পান সেজে জর্দা দিয়ে আমার মুখে পুরে দিলেন। জীবনে কতো জর্দা,কতো পান খেয়েছি,কিন্তু কাজীদার হাতের সেই স্নেহ মাখানো পানের স্বাদ যেন আজও ভুলতে পারিনি। আর শুধু কি পান খাওয়ানো? নানাভাবে উৎসাহ দিয়ে মাত্র তিন দিনের মধ্যে ঐ অতোগুলি রাগপ্রধান গান একেবারে পাখী পড়ানোর মতো করে শিখিয়ে দিলেন কাজীদা। সে-সব গানের সুরও তৈরী করেছিলেন তিনি অপূর্ব। কাজীদার সেই সব গান গেয়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ বিদগ্ধ দর্শকের প্রশংসা আর আশীর্বাদ অর্জন করেছি আমি। এর জন্য ঐ একটি মানুষ – কাজীদার কাছে যে আমি কতো ঋণী তা বলে বোঝানো যাবে না। কাজীদা আমাকে বড়ো দাদার মতো উৎসাহ দিয়েছেন,স্নেহ করেছেন। তিনিই আমার মনে এই আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিলেন যে,আমার দ্বারা কিছুই অসম্ভব নয়।” এইচএমভি-র মহড়াকক্ষে সুরশিল্পী কমল দাশগুপ্তসহ বিখ্যাত অনেক লোকের মাঝে নজরুলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিন গান শোনানোর সময় লজ্জা ও সংকোচে প্রথিতযশা নজরুলগীতিশিল্পী ফিরোজা বেগমেরও সরযূবালা দেবীর মতোই অবস্থা হয়েছিল। ফিরোজা তখন নিতান্তই বালিকা। মাত্র নয় বছর বয়স। নজরুল সেদিন নানা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে ও উৎসাহ জুগিয়ে তাঁকে দিয়ে দুটো গান গাওয়ান। গানশেষে সেখানে উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলেন,”আমি ওর জন্য কিছু করতে পারব কিনা জানি না। তবে তোরা দেখিস এই মেয়ে কিন্তু খুব নাম করবে।” পরে নজরুলের কাছে কয়েকদিন গান শেখার সুযোগ-ও তাঁর হয়েছে। কিন্তু ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর প্রশিক্ষণে ফিরোজা কোনো নজরুলগীতি রেকর্ড করতে পারেননি। 
এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে নজরুল তাঁর গানের ছাত্রছাত্রীদের স্নেহের পাশাপাশি শাসন করতেন কিনা। আমার মনে হয় নিশ্চয়ই করতেন। শাসন স্নেহেরই অঙ্গ। কথায় বলে,’শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’। শাসন করার লক্ষ্য যদি হয় কারো ভুলত্রুটি সংশোধন করা, তবে সেই শাসনের ধমকে স্নেহই প্রকাশ পায়। বাবা-মা’ও সন্তানকে সন্তানের ভালোর জন্য প্রয়োজনে শাসন করে থাকেন। যদিও কোনো ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত শাসন একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। নজরুল কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের ভুল সংশোধন করতেন, তার একটা নমুনা পাই আব্বাসউদ্দিনের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন,”এই সংগীত-জগতে বেশীদিন হয়ত আমি টিকে থাকতে পারতাম না যদি না কাজিদার একদিনের একটা কথায় আমার চমক ভাঙত। রিহার্সেল-রুমের দোতালায় বসে আমি একদিন কৃষ্ণচন্দ্র দে’র একখানি কীর্তন গাইছিলাম ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু ওইখানে থাকো গো”। কাজিদা কতক্ষণ হল দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন খেয়াল করিনি। আমি কিন্তু কেষ্টবাবুর ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কি সংগীত ভেসে আসে’,’ফিরে চল ফিরে চল আপন ঘরে’,’অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’ এই গানগুলো খুব গাইতাম। আর গাইতাম অবিকল কেষ্টবাবুর গলার স্বর নকল করে। কাজিদাকে হঠাৎ দেখে গান থামিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম। মৃণাল,ধীরেন দাস এরা কাজিদাকে দেখে হেসে বললেন,’দেখুন কাজিদা আব্বাস কি চমৎকার কৃষ্ণবাবুর নকল করেছে।’ কাজিদারও খুব খুশী হবার কথা, কিন্তু তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন,’আব্বাস,চোখ তোমার অন্ধ হয়নি বরং চশমা পর্যন্ত এখনও নেওনি। কাজেই সেদিক দিয়ে তুমি কানাকেষ্ট নও। তারপর ওঁর গলা নকল করে গান গাইলে জীবন ভরে তোমাকে এই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াতে হবে যে ‘আব্বাস ! ওঃ সে তো কেষ্টবাবুর নকল’ ! কাজেই কেষ্টবাবু কেষ্টবাবুই,ধীরেন দাস ধীরেন দাসই,মৃণাল মৃণালই আর আব্বাস আব্বাসই থাকবে। কখনো নিজের স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতা যাকে বলে অরিজিন্যালিটি নষ্ট করবে না।’ সেদিন থেকে অন্যের কণ্ঠ নকল করে গাওয়ার অভ্যাস চিরদিনের মত ছেড়ে দিয়েছি।”
এইভাবে শাসনে-সোহাগে এবং নিজের প্রতিভাকে উজাড় করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে অনেক সংগীতশিল্পীর জীবনের অনেকখানিই নজরুল গড়ে দিয়েছেন। যাঁরা তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বাংলা তথা ভারতের সংগীত জগতে আজও নক্ষত্রসম বিরাজমান। এই সংগীত সাধক যদি আরো বেশ কিছু বছর সুস্থ শরীরে বাঁচতেন,তাঁর দীক্ষায় আরো অনেক সংগীতশিল্পী তাঁদের প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পেতেন। তাতে সমৃদ্ধ হতাম,ধন্য হতাম আমরা। তাঁর গানের প্রেমিক শ্রোতারা।
                                                               ***
তথ্যসূত্রঃ  
(১) সবারে আমি নমি-কানন দেবী; অনুলিখন-সন্ধ্যা সেন
(২) কাননবালা; সংকলন ও সম্পাদনা-বীজেশ সাহা,চন্ডী মুখোপাধ্যায়
(৩) কথায় ও সুরে; Interview with Suprava Sarkar; DD Bangla; https://www.youtube.com/watch?v=nN1svFNaFak
(৪) জীবনের জলছবি-প্রতিভা বসু
(৫) আমার শিল্পী জীবনের কথা-আব্বাসউদ্দীন আহ্‌মদ
(৬) ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে-আনন্দবাজার পত্রিকা; Article on musical artist Radharani Devi 
(৭) নজরুল স্মৃতি-বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
(৮) www.theoffnews.com-Angurbala Devi
(৯) স্মৃতি সত্তা নাট্য–শ্যামল ঘোষ
(১০) সুর-সভায় নজরুল-শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়; সাম্প্রতিক দেশকাল
(১১) Feroza Begum Er Shonge/Asaduzzaman Noor/Interview/Desh TV/2014/ https://www.youtube.com/watch?v=Zi2Q901A5q8
(১২) Feroza Begum/Debasish Basu/Interview/Doordarshan Bangla/2014/   https://www.youtube.com/watch?v=f9yQt8Q2CJU
ছবিঃ গান শেখাচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরিমল গোস্বামীর তোলা ছবি। আনন্দবাজার পত্রিকা-র সৌজন্যে প্রাপ্ত।
****************************************

সুতপা  বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন’-এ স্নাতকোত্তর সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম আগ্রহের বিষয় লেখালেখি। ‘কালান্তর’, ‘সুস্বাস্থ্য’, ‘উৎস মানুষ’, ‘টপ কোয়ার্ক’, ‘যুক্তিবাদী’, ‘এখন বিসংবাদ’, ‘মানব জমিন’, ‘আবাদভূমি’, ‘সাহিত্য সমাজ’, ‘অভিক্ষেপ’ ইত্যাদি বেশ কিছু পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র প্রকাশিত। তাঁর সম্পাদনায় ‘র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন’ প্রকাশন থেকে ড. পবিত্র সরকারের ভূমিকা সহ প্রকাশিত ‘ছোটোদের কুসংস্কার বিরোধী গল্প’-র দুটি খন্ড। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে মরণোত্তর দেহদান-আন্দোলন ও উত্তরণ’ বইটি বিশেষভাবে প্রশংসিত। একটি ‘ফেসবুক পেজ’-এ চলচ্চিত্রাভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী কানন দেবীর জীবনভিত্তিক তাঁর একটি গবেষণামূলক কাজ-ও পাঠকমহলে সমাদৃত। লেখার জগতের বাইরে সংগীতশিল্পী এবং বিজ্ঞান ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী হিসাবে তিনি সমধিক পরিচিত।
===================================

অন্তরের কবি নজরুল

দেবলীনা সরকার

…..”উস্কুদারা গিদার ইকেন/আলদি দা বির ইয়াগমুউউর../কাআটিবিমিন সেটরেসি/উউজুন্ এটেগি কামুররর”.**-.
(যখনি  তোমার কাছে আমি উসকুদারে যাই/তখনি মেঘ বর্ষাতে থাকে বৃষ্টি/ তবে আমার জ্যাকেটটা বেশ লম্বা/শুধু কিছু কাদায় মাখা নীচ টি..)
তুরস্কের এই প্রাচীন লোকসঙ্গীত টি ইস্তাম্বুলের একটি জনপ্রিয়  প্রেমের গান। তুরস্ক এমনিতে লোকসঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত।অনেকটা নদীমাতৃক বাংলার মতন। এইধরনের সঙ্গীতকে টার্কি (Turkey) ভাষায় বলা হয় উস্কুদার কাটিবিম। এই বাংলার গানের কবি নজরুল “উস্কুদারা গিদার ইকেনের..”সুরে প্রভাবিত হয়ে বাংলায় রচনা করলেন একটি কালজয়ী ইসলামিক সঙ্গীত
…”ত্রিভুবনের প্রিয় মহম্মদ এলো..”। ইসলামী সঙ্গীতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে ওঠা কাজী নজরুল ১৯৩১ সালে লিখলেন এই গানটি। পরে পরেই আবার লিখলেন একই সুরে বাংলাতেই “শুকনো পাতার নুপুর পায়ে..”।
নজরুল ইসলাম বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র কবি যিনি এক ধর্মবিশ্বাসী হয়ে অন্য ধর্মের দেবদেবী কে নিয়ে অসাধারণ সব সঙ্গীত রচনা করে গেছেন।’কালো মেয়ের পায়ের তলায়’,’আমার হাতে কালি মুখে কালি’,’হে গোবিন্দ রাখে চরণে..’ গানগুলি শুনলে কখনও কি মনে হয় যে নজরুল একজন মুসলমান? ইসলামী সঙ্গীত সৃষ্টি তে নজরুল যেমন দক্ষ,হিন্দু ভক্তি গীতিতেও ঠিক ততটাই।
ইসলামি সঙ্গীতের দুটি প্রধান দিক হলো হামদ এবং নাত। সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ্পাকের প্রশস্তি করে রচনা করা হয়’ হামদ’ এবং নবি মহম্মদের গুণগান করা হয় ‘নাত’-এ। ইসলামী সঙ্গীতের ভাষা মূলতঃ উর্দু।তরুণ কবি নজরুল এই সঙ্গীত লিখলেন বাংলায়।তিনি ইসলামী সঙ্গীতে বাংলা ভাষায় তুলে ধরলেন ইসলামের ইতিহাস,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,কোরাণ হাদিশের প্রসঙ্গ অত্যন্ত সহজ ভাবে,সহজ কথায়। তাঁর গানে কখনও তিনি বাংলার সঙ্গে নিপুণভাবে উর্দু ভাষাকে মিশিয়েছেন। যেমন “হে নামাজি আমার ঘরে/নামাজ পরো আজ,/দিলাম তোমার চরণতলে/হৃদয় জায়নামাজ”। এসব গানে ইসলামী ভাব,ভক্তি যেমন অটুট থেকেছে তেমনি এসেছে ঠুমরী গজলের শাস্ত্রীয় হারমোনি। মার্গ সঙ্গীতে দক্ষ নজরুলের গানগুলিতে তাই সুরে সুরে উদ্ভাস হয় রাগরাগিণীর। বাংলায় নজরুল অত্যন্ত রোমান্টিক ভাবে উর্দু বাংলা মিশিয়ে সৃষ্টি করেন “আলগা করো খোঁপার বাঁধন/দিল ওহি মেরা ফাঁস গইই….”এর মতন গজল। শাস্ত্রীয় ছোঁওয়ায় তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয় মালকোষ রাগে শ্যামাসঙ্গীত “শ্মশানে জাগিছে শ্যামা”,আবার তিনিই রচনা করেন পিলু রাগে “সুরের বাণীর মালা দিয়ে”,মান্ড রাগাশ্রিত রোমান্টিক গান “উচাটন মন ঘরে রয়না”,কিছুটা না পাওয়ার বেদনায়”জানি জানি প্রিয়”,আনন্দ আশায় “ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান”,রোমান্স চর্চিত মিশ্র পিলু ও ভৈরবী তে”আধো আধো বোল..”,নির্মল নিবেদনে “নয়ন ভরা জল”,অন্তরের বাসনা মাখা”মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী..”ইত্যাদি। এরকম অজস্র সঙ্গীতে নজরুল তাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং সুর করে গেছেন।
জন্ম অত্যন্ত দরিদ্র এক পরিবারে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে,১৮৯৯ সালের ২৪ মে। স্থানীয় মসজিদের ইমাম ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাবেদা খাতুনের ষষ্ঠ গর্ভের সন্তান নজরুল দুখু মিয়া নামেও পরিচিত। দারিদ্রতার কারণে শিক্ষা জীবন বার বার বাধা প্রাপ্ত হয়। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। ১০ বছর বয়স থেকেই জীবিকার জন্য লড়াই শুরু। হোটেলে রুটি বানানো,এক ইংরেজের খানসামা,মোক্তবে শিক্ষকতা থেকে সেনাবাহিনী তে সৈনিক,পরে রেডিও র চাকরি,সাংবাদিকতা,সব করেছেন এই বাঙালি কবি,ঔপন্যাসিক,নাট্যকার,গীতিকার,সংগীতজ্ঞ। বাংলাদেশের তিনি জাতীয় কবি।
একটি রচনায় তাঁর জীবনের সমস্তদিক তুলে ধরা অসম্ভব।
১৯২১ সালে প্রমীলা দেবী নামে কুমিল্লার এক হিন্দু রমণীকে তিনি বিবাহ করেন। সঙ্গীতজ্ঞ কবি নজরুল ইসলামের প্রতিবাদী লেখনির জন্য তাঁকে বিদ্রোহী কবিও বলা হয়। দেশাত্মবোধক এবং প্রতিবাদী সঙ্গীতেও তাঁর কলম সমান শক্তিশালী।
সম্প্রতি তাঁর একটি শিকল ভাঙার গানের সুর পাল্টানো নিয়ে বিতর্ক চলছে।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে একের পর এক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে বৃটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে চলেছে। গ্রেপ্তার হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। বৃটিশ সরকার তাঁকে হুগলী কারাগারে বন্দী করলো। দেশবন্ধু র সহধর্মিণী র অনুরোধে নজরুল লিখলেন “কারার ওই লৌহকপাট..” কবিতাটি।পরে যা গান হয়ে বেরোয়।এই সুর পরিবর্তন নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও প্রতিবাদ হলেও নজরুল ইসলামে র বহু গানের সুর পাল্টে,এদিক ওদিক করে গান নিয়ে ব্যবসা কিন্তু দীর্ঘ দিনের। পুত্রশোকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কবি ১৯৪২ সালে বেতারকেন্দ্রে চাকরি করতে করতে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাকশক্তি হারান এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অথর্ব হয়ে পড়েন। বিদেশে চিকিৎসায়ও লাভ হয়নি। তিনি দুরারোগ্য “পিকস্” রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে অসুস্থ কবি সস্ত্রীক বাংলাদেশে চলে যান। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব প্রদানের পাশাপাশি জাতীয় কবি বলে ঘোষণা করে। সে বছরই ২৯ আগস্ট বিদ্রোহী কবির জীবনাবসান হয়। ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কাছে ঢাকা মসজিদ প্রাঙ্গনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।কবির অকাল অসুস্থতার ফলে আমৃত্যু তিনি সাংস্কৃতিক কাজকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাঁর সমস্ত অমূল্য সৃষ্টি টলোমলো হয়ে যায় | কপিরাইটের বাধা না থাকা এবং তাঁর রচিত সঙ্গীত সাহিত্যকর্মের বিপুল ভান্ডারের যথাযত সংরক্ষণ নিয়ে কবি পরিবারের কিছু সদস্যদের অনীহা এবং লোভ এর অন্যতম কারণ। নজরুল বিশেষজ্ঞ,এক নামী বেতার প্রযোজক তো নিজের মত সুর লাগিয়ে তা নজরুলগীতি বলে চালিয়েছেন একাধিকবার। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দক্ষ বাংলার এক শ্রদ্ধেয় সুরকার এবং শিল্পী তো তাঁর গায়নে বহু নজরুলগীতির অন্তরা সঞ্চারীর সুর নিজের মতন করে পাল্টে নিয়েছেন। গানের বৈঠকী রূপ দিতে গিয়ে তানকারী যোগ করেছেন। এই সস্তা চটকদারিতে এসব শিল্পীর জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি,ব্যক্তিগত ভাবে আর্থিক স্ফিতি হলেও নজরুল গীতি কিন্ত এসব কারণে তার মূল ভাব থেকে নিজস্বতা হারিয়ে অনেকটাই সরে গেছে।
তবুও নজরুল আছেন আমাদের হৃদয়ে। তাঁর রচনা,তাঁর সুর,তাঁর সমস্ত সৃষ্টির নির্যাস নিয়ে। তাঁর সৃষ্টি কালজয়ী। একে নিয়ে ব্যর্থ পরীক্ষা,সংযোজন বিয়োজন যতই হোক না কেন,আমাদের অন্তরের ফল্গুধারায় নজরুল চিরকাল থাকবেন। অমলিন রয়ে যাবেন যেমন ছিলেন এবং রয়েছেন।
***********************************

debolina

দেবলীনা সরকার পরিচিতি
সাহিত্য সংস্কৃতির পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা। পড়াশোনা সঙ্গীতশাস্ত্র নিয়েই। বিবাহসূত্রে তিনদশক ধরে দক্ষিণভারতে থাকাকালীন বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেবার কাজে যুক্ত থেকেছেন আন্তরিকভাবে। মিলে গিয়ে মিলিয়ে দেবার ভাবনাতেই কুলায় ফেরার জন্মলগ্ন থেকে যুক্ত হওয়া।
=================================

‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভাষা, চিত্রকল্প এবং প্রাসঙ্গিকতা

দীপন মিত্র

১. শুরুর কথা
বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখজনক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা কবিতাকে যাঁরা সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন,বাংলা কবিতাকে জনপ্রিয় করেছেন,তাঁদের অন্যতম পুরোধা কবিদের মধ্যে তাঁর নাম নিঃসন্দেহে প্রথম ও প্রধান। তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতাটি এক কালজয়ী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা। এই লেখাটিতে আমরা “বিদ্রোহী” কবিতাটির লিখনের ইতিহাস,তার কাব্যভাষা,ব্যবহৃত চিত্রকল্প (ইমেজারি) এবং তার চলন অথবা ছন্দ নিয়ে আলোচনা করব এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করে তার প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে চেষ্টা করব।
 
২. লেটো গান ও নজরুল  
নজরুল একেবারেই মাটি থেকে উঠে আসা এক কবি। তাঁর শৈশব কেটেছে রাঢ় বাংলায়। ওই অঞ্চলের লোকগান,যাত্রা,পালা ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা। তিনি নিজেও লেটো গানের একটা দল তৈরি করেছিলেন সেখানকার দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলেদের নিয়ে। তিনি বেশ কিছু লেটো গানও রচনা করেন। প্রায় দুই  দশক পূর্বে এই লেখকের নজরুলের গ্রামে গিয়ে তাঁর লেটো গানের এক সঙ্গীর সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়। তাঁর নাম ছিল ইয়াকুব শাহ। ৯৫ বছর বয়সে সেই জ্বরতপ্ত শরীরে, শীর্ণ খেত মজুর তাঁর কণ্ঠে একটি লেটো গান আমাদের শোনান। সেই গান টেপ করে রাখি আমরা। নজরুল অথবা ইয়াকুব তাঁদের ছোটবেলায় গ্রামে লেটো গানের আসরে হিন্দু ও ইসলামি পৌরাণিক চরিত্রগুলির অভিনয় করতেন এবং গ্রামের হিন্দু-মুসলমান মানুষেরা সেগুলি একসঙ্গে উপভোগ করতেন। রিজার্ভ ব্যাংক কর্মচারীদের একটি সংগঠন,তাঁদের পত্রিকা “পদক্ষেপ”-এর নজরুল বিশেষ সংখ্যায় তাঁর সাক্ষাৎকারটি সযত্নে প্রকাশ করেছিলেন। নজরুলের প্রচুর লেটো গানের সন্ধান পাই কাটোয়ার কিংবদন্তী-সম সংগ্রাহক-সংকলক-গবেষক মুহম্মদ আয়ুব হোসেনের কাছে।

৩. নজরুলের কবিতা লেখা
ফিরে যাই নজরুলের কথায়। কৈশোর বেলায় নজরুল রুজি রুটির খোঁজে এবং খানিকটা অ্যাডভেঞ্চারের টানে আসানসোলে আসেন এবং একটি বেকারি কারখানায় কাজ করেন। আসানসোলে সেই বেকারিটির অস্তিত্ব পনেরো কুড়ি বছর পূর্বেও ছিল। পরবর্তীতে নজরুল আবার সেনায় যোগ দিয়ে হাবিলদার হন। সেই সময় থেকেই তিনি লেখা পাঠাতেন কলকাতার পত্র-পত্রিকায়। তাঁর বেশ কিছু লেখা জায়গা করে নিতে সক্ষম হয় সেই সময়ের কবিতা-সাহিত্যের পত্রিকাগুলোতে। তারপরে দেখা যায় তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায় এবং পুরোপুরি লেখালিখি নিয়ে মেতে উঠলেন। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সাম্যবাদী সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া নেহাত শৌখিন হুজুগ ছিল না, তিনি মানসিক ভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন। সাম্যবাদী পত্রিকা “লাঙল” তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশ পায়। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির এটিই ছিল প্রথম পত্রিকা।

৪. চারণকবি নজরুল
লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নজরুলের ছিল নাড়ির টান। তিনি একজন অভিনেতা,গায়ক ও কলাকুশলী,ইংরেজিতে বললে পারফর্মার ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সাম্যবাদী চেতনায় রঞ্জিত হন। ফলে যেমন গীতিকার হিসেবে তাঁর সাধারণ প্রবৃত্তি ছিল আসরে, সাধারণ শ্রোতাদের ভিড়ে গান করার তেমনই কবি হিসেবেও তাঁর প্রবৃত্তি ছিল সাধারণ শ্রোতাদের সামনে কবিতা পাঠ করা। বেশির ভাগ আধুনিক কবি এটা করেন না,অথবা বলা ভালো তাদের কবিতার প্রকৃতির জন্য এই পারফর্ম করা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্যও হয় না। কিন্তু নজরুলের এটি সহজাত প্রতিভা,এটা তাঁর জন্মগত অধিকার,রুচিগত প্রবৃত্তি এবং চরিত্রগত অভিব্যক্তি। আদতে তিনি ছিলেন একজন চারণকবি। এই চরিত্রই তাঁর অভিজাত মহলে স্বীকৃতি দাবি করার প্রতি কোনো দুর্বলতা জন্মাতে দেয়নি,কোনো ইচ্ছে আকাঙ্খাও তৈরি করেনি। জন-মানুষের মধ্যে মিলে মিশে থেকেই তিনি বড় হয়েছেন,একান্ত ব্যক্তিগত ছিল না তাঁর বেঁচে থাকা। তাই তিনি একজন জনকবি,একজন পরিব্রাজক কবি অথবা চারণকবি হয়ে ওঠেন। (ইতালি ও দক্ষিণ ফ্রান্সের অসিটান ভাষায় বলে ত্রুবাদুর)। বরিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ কবি মলয় রায়চৌধুরী নজরুলের ওপর একটি চমৎকার লেখায় নজরুলকে বাংলার ত্রুবাদুর কবি হিসেবে দেখিয়েছেন। অনেক বছর আগে পড়া হলেও সেই লেখাটি তাঁর বলিষ্ঠ ভাষা এবং মৌলিক ব্যাখ্যা,বিশ্লেষণের জন্য ভারি ভালো লেগেছিল এবং আজও মনে আছে।
প্রকৃত অর্থেই নজরুল কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় গান করে বেরিয়েছেন। তাঁর গানের দৃপ্ত কথা,স্পর্ধিত বজ্র-ঘোষণা ও কণ্ঠের মাধুর্য ও শৌর্য মানুষকে এমন আকৃষ্ট করত যে তাঁর পিছনে পিছনে শ্রোতাদের ভিড় তাঁকে অনুসরণ করতে করতে চলত। ত্রুবাদুর তো তিনি বটেই। নিজের জানলা থেকে এই দৃশ্য দেখে খুব অপছন্দ করেন নীরদ সি চৌধুরী। তাঁর কাছে এ হলো কবিতা ও শিল্পের অবনমন। এই পরম্পরা কিন্তু আজও বর্তমান। অনেক আধুনিক কবিই নজরুলের ব্যক্তিত্ব কে শ্রদ্ধা করলেও, তাঁর কবিতাকে শ্রদ্ধা করেন না। অথচ আমরা দ্বিধাহীনভাবে নজরুলের ভূমিকা আমেরিকান কবি ওয়াল্টহুইটম্যান,রুশি কবি মায়াকভস্কির সঙ্গে তুলনা করতে পারি। বলতেই পারি বিশ্ববিখ্যাত পাবলো নেরুদা,নাজিম হিকমত,দারভিজ,ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ছিলেন সেই অর্থে ত্রুবাদুর। মায়াকভস্কির কবিতা পাঠ শুনতে একটা আস্ত স্টেডিয়াম ভরে যেত। নজরুলের সঙ্গে সঙ্গে আরো আছেন আমাদের একেবারে কাছের কবি সুকান্ত। বর্তমানে হিন্দি কবি নাগার্জুন অথবা আলোকধনবা এই গোত্রের শক্তিশালী কবি। এঁদের কবিতা আজ ও সভায়,সমিতিতে হাজার হাজার মানুষের সামনে পাঠ করা হয়।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার চালচিত্র
উপরের এই সামান্য আলোচনার মধ্য থেকে নজরুলের “বিদ্রোহী” কবিতার তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকের উৎস আমরা পেয়ে যাই। একটি হলো হিন্দু ও ইসলামিক পৌরাণিকতা,তাঁর বাল্য-কৈশোরের সাংস্কৃতিক কাজকর্ম,কৃষ্টি ও সৃষ্টির সঙ্গে যা জড়িয়েছিল। আরেকটি হলো তাঁর ত্রুবাদুর চরিত্র অর্থাৎ জনগণের মধ্যে,সাধারণ শ্রোতাদের ভিড়ে,রাস্তা ঘাটে কবিতা পাঠ করা যা তাঁর চালচুলোহীন আশ্রয়হীন ভবঘুরে জীবনের অংশই ছিল এবং তৃতীয়টি হলো তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বা,যার জন্ম তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনের মধ্য থেকে তিনি আহরণ করেন। 
নজরুলের কবিতায় যে আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার দেখা মেলে সেটিও তাঁর গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে বিভিন্ন জায়গায় জীবিকা ধারণের মধ্য দিয়ে বিবিধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি অর্জন করেন। তাঁর যে সাম্যবাদী চেতনা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগ তাঁর এই নাগরিক জীবনের অংশ। সন্দেহাতীত ভাবে তিনি তাঁর আধুনিক নন্দনবোধ তৈরি করেছেন তাঁর সামগ্রিক নাগরিক জীবন থেকে।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রেক্ষিত
নজরুলের বিখ্যাত এবং বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা “বিদ্রোহী” বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবিতা যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মন ও হৃদয়কে আচ্ছন্ন করার ক্ষমতা ধরে। এই কবিতাটি বাংলার বিখ্যাত আবৃত্তিকারেরা পাঠ করেছেন। আজও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই কবিতাটি আবৃত্তি করা হয়। 
কমরেড মুজফফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন,”…. বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। সেটা ছিল ক্রিসমাসের রাত। কলকাতার ৩/৪সি,তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে এই কালজয়ী কবিতা লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে,সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। রাতারাতি নজরুল বিখ্যাত হয়ে পড়লেন এই কবিতাটির দরুণ।
বিদ্রোহী কবিতাটি পাঠ করে মানুষ কেমন উদ্বেলিত হন সেটা উপরের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু এই কবিতাটি নেহাত পাঠ নয় বরং উচ্চস্বরে আবৃত্তির জন্য একটি আদর্শ কবিতা। “বিদ্রোহী” মধ্যে যে প্রবল ছন্দ,যার মধ্যে তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বা,তাঁর প্রেমিক মন, তাঁর ইসলাম ও হিন্দু দুই ধর্মের প্রতি গভীর মমত্ববোধ,তাঁর শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেতনা,তাঁর মানুষের ওপর প্রবল বিশ্বাস জনিত মানবিকতাবাদ মন সমস্ত প্রবণতাই ধরা পড়ে যায়। এমন উচ্চস্বরে পাঠ করার মতো তেজস্বী,পরাক্রমী এবং বিদ্রোহের কবিতা যে কোনো ভাষাতেই দুর্লভ। এই কবিতার শব্দে যেমন শক্তি ও শৌর্য দেখা যায় তেমনি তার ছন্দের মধ্যে উচ্চ স্বরে পাঠ করার বাসনাও জাগ্রত করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। এই কবিতার মধ্যে রোমাঞ্চ,নাটকীয়তা,উৎক্ষেপণের বৈচিত্র আছে। 
এ সমস্ত বলার পরও বলা প্রয়োজন যে কবিতাটির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য তার নিভৃত,নিবিড় পাঠও একান্ত কাম্য।

বিদ্রোহী কবিতা ও নজরুলের কাব্যভাষা 
“বিদ্রোহী’ কবিতা আজও আমাদের কাছে একটি ঈর্ষণীয় সম্পদ,আমাদের গর্বের উত্তরাধিকার। এই কবিতাটি একটি আলাদা স্বাধীন সাংস্কৃতিক সম্পদ। এই কবিতাটির কথা মনে পড়লেই একটি দীর্ঘাঙ্গ,দ্যুতিময়,দারুণ গর্জাস কীর্তির কথা মনে পড়ে। একটি কম্পমান,মাদক ও হিমালয় সদৃশ ধ্বনি তরঙ্গের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে একটি ইতিবাচী,দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং অবশ্যম্ভাবীতার কথা।
প্রথম চিত্রকল্পটি নেওয়া যাক তৃতীয় স্তবক থেকেঃ প্রথম পংক্তিতেই চমকে উঠতে হয়। “আমি চিরদুর্দম,দুর্বিনীত,নৃশংস”। এই শব্দগুলি আজ ও যদি কোনো তরুণ কবি লিখতেন,অবশ্যই কবিতার অনেক সিরিয়াস পাঠকেরই তা দৃষ্টি কেড়ে নিত। একই কবিতায় তিনি বলছেন ….আমি সাইক্লোন,আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়,আমি অভিশাপ পৃথিবীর। এই কথা বলা যে আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর–অত্যন্ত কঠিন,কেননা কবিতায় মিথ্যে বলা চলে না,বললে বা লিখলে তার মধ্যে কাব্যিক চৌম্বকত্ব থাকতে পারে না। আমি মহাভয়,পৃথিবীর অভিশাপ–এই ধরনের বোধ একজন বিপ্লবী স্বপ্নদর্শী ছাড়া কেউ লিখতে পারবে না (অন্যথায় সেই কথাগুলি ফ্ল্যাট হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে),এই কারণেই “বিদ্রোহী’ কবিতাটির অনেক পংক্তি চিরস্মরণীয়। জীবনানন্দ বলে গেছেন কবিতার স্মরণযোগ্যতাও তো জাত কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কবি বলছেন “আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,আমি দ’লে যাই যত বন্ধন,যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! / আমি মানি নাকো কোন আইন….। মনে পড়ে যায় মায়াকভস্কির আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত সব উচ্চারণ  “Beat the squares with the tramp of rebels! / Higher, rangers of haughty heads! / We’ll wash the world with a second deluge, / Now’s the hour whose coming it dreads”
তিন পংক্তি পরেই অসাধারণ এক উচ্চারণ শুনি,“…আমি এলোকেশে ঝড় অকালবৈশাখীর”। শব্দগুলির উচ্চারণে কী গভীর কাব্য-সৌন্দর্য তৈরি হয়। পরের স্তবকেই পাই,“আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,/ আমি আপনার তালে নেচে যাই,আমি মুক্ত জীবনানন্দ!”। অথবা “আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা / করি শত্রুর সাথে গলাগলি,ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা / আমি উন্মাদ,আমি ঝঞ্ঝা!”। কী অসম্ভব উচ্চারণ,আমি উন্মাদ,আমি ঝঞ্ঝা! উদাহরণের পর উদাহরণ দেওয়া যায়,‘আমি দুর্দম,মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ”। অনায়াসে কয়েকটি হিন্দি শব্দ ঢুকিয়ে দিলেন। শব্দ ব্যবহারে তাঁর কোনো বাছ-বিচার নেই।
যাক আমরা ফিরে আসি নজরুলে,যিনি বলছেন,“…আমি লোকালয় আমি শ্মশান/আমি অবসান নিশাবসান”। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উচ্চস্বর ও ছন্দের তীব্র দোলায় এই কবিতার মধ্যে অসাধারণ সমস্ত চিত্রকল্প এবং ভাষার সৌন্দর্য অনেক সময়ই হারিয়ে যায়। ধরা যাক “…আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ! / আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস–আমি সৃষ্টি বৈরী মহা ত্রাস / আমি কভু প্রশান্ত, কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী”। আমেরিকার কবি হুইটম্যানের কথা মনে পড়ে যায় ~ 
“I celebrate myself, and sing myself,
And what I assume you shall assume….”
এই যে মন ও মানসিকতা, এই যে আবেগ এবং ঘোষণা,তা চিনিয়ে দেয় সত্যিকারের কবিকে। “আমি উন্মন মন উদাসীর” কী সুন্দর ভাষা। নজরুলের প্রকাশ ক্ষমতা অবাক করার মতো। যেমন উনি বলেন “…আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর”,কী অপূর্ব প্রকাশ,ঊষার আলোর মতই নম্র-কোমল ভাষা। 
এই কবিতায় কবির দুর্বার,দুর্দম,মরিয়া আবেগ এমন ভাবে ফুটে উঠেছে যা সত্যিই খুব বিরল। খুব কম কবিতায় সচরাচর নতুন কাব্যভাষার খোঁজ পাওয়া যায়। নিজস্ব নতুন কাব্যভাষা তাঁরাই আনতে পারেন যাঁদের জীবনে এক নতুন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে।  ধরা যাক, তিনি যখন বলছেন “আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি,একি উন্মাদ আমি উন্মাদ! / আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!”–তিনি এখানে নিজেই স্বীকার করছেন তাঁর মধ্যে তাঁর এক অন্য সত্ত্বা প্রকাশ পাচ্ছে। নিজের ভিতরে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই প্রাণের আবির্ভাব বড় কবিদের ভাগ্যেই ঘটে–সৎ ও মহৎ কবিতা সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তাঁর সদ্য তরুণ বয়সে সদর স্ট্রিটের বাড়ির ছাদে ভোরবেলা হাঁটার সময়,তাঁর নিজের বর্ণনা থেকেই আমরা জানতে পারি,সহসা তাঁর মধ্যে বেজে ওঠে একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তিঃ ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর / কেমনে পশিল প্রাণের পর’। এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটিই ছিল তাঁর কবিজন্ম। নজরুলের ক্ষেত্রে “বিদ্রোহী কবিতা সেই কাজ করে, কবি নিজের মধ্যে এক বিদ্রোহী কবির সত্ত্বাকে খুঁজে পান। কবি লেখেন “আমি যজ্ঞ,আমি পুরোহিত,আমি অগ্নি”,অথবা “আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি”। 
বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল বলছেন,“…আমি লোকালয় আমি শ্মশান / আমি অবসান নিশাবসান”। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উচ্চস্বর ও ছন্দের তীব্র দোলায় এই কবিতার মধ্যে অসাধারণ সমস্ত চিত্রকল্প এবং ভাষার সৌন্দর্য অনেক সময়ই হারিয়ে যায়। ধরা যাক “…আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ! / আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস – আমি সৃষ্টি বৈরী মহা ত্রাস / আমি কভু প্রশান্ত,কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী”। এই যে মন ও মানসিকতা,এই যে আবেগ এবং ঘোষণা,তা চিনিয়ে দেয় সত্যিকারের কবিকে। “আমি উন্মন মন উদাসীর” কী সুন্দর ভাষা। নজরুলের প্রকাশ ক্ষমতা অবাক করার মতো। যেমন উনি বলেন “…আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর”,কী অপূর্ব প্রকাশ,ঊষার আলোর মতই নম্র-কোমল ভাষা। এই কবিতায় কবির দুর্বার, দুর্দম, মরিয়া আবেগ এমন ভাবে ফুটে উঠেছে যা সত্যিই খুব বিরল। কবি লেখেন “আমি যজ্ঞ,আমি পুরোহিত,আমি অগ্নি”,অথবা “আমি অন্যায়,আমি উল্কা, আমি শনি”। 
নজরুল নিজের কবিসত্ত্বা নিয়ে কখনো অহংকার করেননি। কোনো যশোলিপ্সা তাঁকে তাড়িত করেনি। তবেই তো তিনি লিখতে পারেন “আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!” এই পংক্তি চিরস্মরণীয় থাকবে। এই তো আসল কবিতা।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বিপ্লবীদের শাশ্বত বেদনাবোধ যে ভাবে তিনি লিখেছেন,তা অমর হয়ে থাকবে। এই পংক্তিগুলো চিরকাল ফিরে ফিরে আসবেঃ

মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না–
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না–
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত | |
===================================

স্বদেশপ্রেমিক সাম্যবাদী কাজী নজরুল ইসলাম

কাকলী সেন

বিদ্রোহী কবি নজরুল সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন সাম্যবাদী | ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে তিনি ছিলেন সমদর্শী | তাঁরই ভাষায় বলি,’গাহি সাম্যের গান – 
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান,
নাই  দেশ কাল পাত্রের ভেদ,অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে সবকালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি |’ 
কাজী নজরুলের লেখা বহু গান কবিতা ও নিবন্ধে তাঁর এই মানবিকতার প্রকাশ ছড়িয়ে আছে |  কিশোর নজরুলের হৃদয়ে স্বদেশপ্রেমের প্রথম বীজটি রোপণ করেছিলেন তাঁর শিক্ষক সিয়ারসোল  হাই স্কুলের মাস্টারমশাই নিবারণ চন্দ্র ঘটক |  নিবারণ বাবু ছিলেন সেকালের বিপ্লবী দল ‘যুগান্তরের’ সদস্য। তাঁর মতবাদ ই নজরুলকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল | 
১৯২২ সাল | ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারত | ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাগণ স্বরাজ বা স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন | স্বাধীনতার কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না | সেই সময় ২২ বছর বয়সী টগবগে যুবক তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন | 
‘ধূমকেতুর আদর্শ সম্বন্ধে নজরুল বলে,’ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না | ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও  বিদেশীর অধীন থাকবে না | ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব,সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা,শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে|  যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগর পারে  পাড়ি দিতে হবে |’ এই হলেন বিদ্রোহী নজরুল | 
তাঁর বিখ্যাত ভাঙার গান ”কারার ঐ লৌহ কপাট” এই ঐতিহাসিক গানটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল | কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (১৯২৬) পর কৃষ্ণনগরে তিনটি সম্মেলন হয়েছিল |  (১) বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন, (২)ছাত্র সম্মেলন (৩) যুব সম্মেলন | এই  তিনটির জন্যই উদ্বোধনী সংগীত লিখলেন ও গাইলেন তিনি | সেই তিনটি গান যথাক্রমে ১) দুর্গম গিরি কান্তার মরু,২) আমরা শক্তি আমরা বল (৩) চল্ চল্ চল্ | হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়ে ইংরেজ মধ্যস্থতার ভারতকে দ্বিখন্ডিত করে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলছেন,”(যত) মাদী তোরা বাঁদী-বাচ্ছা দাস-মহলের খাস গোলাম |
(হায়) মাকে খুঁজিস ? চাকরানী সে,জেলাখানাতে ভানছে ধান | |
(মার) বন্ধ ঘরে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হ’ ল দুই নয়ান | 
(তারা) শুনতে পেয়েও শুনলিনে তা ‘মাতৃ হন্তা কুসন্তান | |
এই গানে কবির বেদনারই প্রকাশ আমরা দেখতে পাই | আরেকটি গান যাঁর  বক্তব্য আজও অম্লান – 
“কর্তা হবার সখ সবারই স্বরাজ ছল কেবল ! 
ফাঁকা প্রেমের-মন্তর,মুখ সরল আর মন গরল ! 
যেথায় মিথ্যা ভন্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ! 
ধামা-ধরা! জামা-ধরা ! মরণ ভীতু! চুপ রহো |” 
মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনেও তাঁকে দেখা গিয়েছে সক্রিয় ভূমিকায় | কংগ্রেসের “হীন জাতির জলচল (হরিজন) আন্দোলন,”নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন”,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে “তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলন” প্রভৃতি  বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন | এইসব আন্দোলনের জন্য বহু গান ও কবিতা,তিনি রচনা করেছেন আবৃত্তি করেছেন,গেয়েছেন | দেশ বলতে তিনি বুঝতেন দেশের মানুষকে | তাই দেশের ছোট বড় ধনী-দরিদ্র আতুর বিকলাঙ্গ সর্বস্তরের মানুষের জন্যই তিনি ছিলেন সমর্পিত প্রাণ। মানব দরদী নজরুল সব রকম রাজনীতির উর্ধ্বে স্থান দিতেন মানুষকে |  কবি চন্ডীদাসের মতো তাঁরও মর্মবাণী ছিল,”সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই |” 
সাম্যবাদী মন না হলে মানুষ মাত্রই তাকে ভালোবাসা যায় না | কবির কথায় আবার বলি নবীনের প্রতি আহ্বান-“বিধি নিষেধের ভাঙো ভাঙো অর্গল 
ধর্ম বর্ণ জাতির উর্ধ্বে জাগোরে নবীন প্রাণ-
তোমার অভ্যুদয়ে হোক সব বিরোধের অবসান |” 
আক্ষরিক অর্থেও তিনি ছিলেন মনে প্রাণে সাম্যবাদী | সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই বাম,দক্ষিণ,নরম গরম সব পন্থীদের হয়েই সংগ্রাম করেছিলেন | কাজী সাহেবের অতি প্রিয় বন্ধু মুজাফফর আহমেদ সাহেব বলেছেন,”জীবনের পথে অনেক বিচ্যুতি তাঁর ঘটেছে এ কথা সত্য কিন্তু ‘লাল’ কখনো তাঁর নিকট ‘কালো’ হয়নি | জীবন চর্চায় এবং জীবনের সাধনায় সাম্যবাদী নজরুলের সম্বন্ধে এর চেয়ে বড়ো শংসাপত্র আর কি হতে পারে?
**********************************************

কাকলী সেন: সঙ্গীত শিল্পী ও নজরুল গবেষক।

==================================

গাহি সাম্যের গাননজরুলের সাম্যবাদী চেতনা

মণি ফকির

সমকালীন স্রষ্টাদের মধ্যে নজরুল একমাত্র মানুষ যাঁর সাম্যবাদী ভাবনার প্রকাশ খুবই স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ। বার বার তাঁর কলম,সুর,সাম্প্রদায়িকতা ও আর্থ সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে। ব্রিটিশ শাসকের স্বৈরতন্ত্র হোক অথবা ধর্মীয় গোঁড়ামি-তিনি ছেড়ে কথা বলেন নি। সেখানেই তিনি বাকি সকলের থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র।
নানাবিধ সমস্যা-সঙ্কটে যখন সারা বিশ্ব আলোড়িত তখন আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। সালটি ১৮৯৯। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যখন মানবতা ধূলায় লুণ্ঠিত তখন তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের গান। একই কণ্ঠে হামদ-নাত এবং শ্যামা সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী। নজরুলের সাম্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৫২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন- ‘সাম্যবাদী’,’নারী’,’মানুষ’,’বারাঙ্গনা’,’রাজা-প্রজা’,’ঈশ্বর’,’পাপ’,কুলি-মজুর’,’চোর-ডাকাত’,’সাম্য’ ও ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’। মূলত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের কবিতাগুলোয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব রয়েছে।
তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতাটি বহুল প্রশংসিত। ‘নারী’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষে সাম্যের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করেছেন। কবির ভাষায়-
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।’
আর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি অধিক সমালোচিত। কবিতায় কবি-
‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা,কে দেয় থুতু ও-গায়ে?/হয়তো তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।’
তিনি মন্দির-কাবার চেয়ে মানুষের হৃদয়কে বড় জ্ঞান করেছেন। কবি বলেছেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।’ 
ভারতে কমিউনিস্ট মতধারার পথিকৃৎ মুজাফফর আহমেদ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একবার কথাও হয়েছিল পার্টি তে যোগদানের। কিন্তু শেষমেশ আর হয়নি। ঐ যে উনি মুক্তমনা। স্বকীয় ভাবে নিজের কথা সপাট বলা তাঁর রক্তে। 
তবে ভুলে গেলে চলবে না নজরুলের সাম্যবাদ রুশ কিংবা চৈনিক কমিউনিজম নয়,আবার তিনি নাস্তিক কমিউনিস্টও নয়। তিনি ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’,ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! বলে ঘোষণা করায় অনেকেই তাঁকে নাস্তিক ভাবেন। তাঁরা হয়ত খেয়াল করেন না-তিনি তাঁর আগেই বলেছেন,‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু’। 
হিমালয়ের মত এই ‘উন্নতশির’ হতে পেরেছিলেন তাঁর সাম্যবাদী চেতনার কারণে। নজরুল রচনাবলীর সম্পাদক যথার্থই বলেন, ‘নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের দ্বিতীয় যুগের সূচনায় যে মতবাদের প্রবক্তা হন,তা প্রত্যক্ষত: গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজম)। … ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজমের প্রতি নজরুলের মনের প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁর সাম্যবাদী,সর্বহারা,ফণি-মনসার বহু কবিতা ও গানে পরিস্ফুট।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় নজরুল অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই ধূমকেতু পত্রিকাকে আশীর্বাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘আয় চলে আয়,রে ধূমকেতু,/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!/ … জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন!’ ধূমকেতু পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুল লেখেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা। ধূমকেতুর এই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত হয় এবং কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। নজরুল তখন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে আত্মগোপন করেন এবং সেখান থেকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ তারিখে নজরুল গ্রেপ্তার হন। এ সময় বিচারাধীন বন্দি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩) গীতিনাট্য উৎসর্গ করেন এবং জেলে আমরণ অনশনরত নজরুলের উদ্দেশে টেলিগ্রাম পাঠান (২১ মে ১৯২৩) কিন্তু তা নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি।
কবি বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষবাষ্পের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তো তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ,মুসলমান,সবাইকে একই কাতারে স্থান দিয়েছেন।
“গাহি সাম্যের গান 
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।” (সাম্যবাদী) 
শুধু তাই নয় তিনিই একমাত্র কবি যিনি পৃথিবীর সকল ধর্মকে এক কাতারে স্থান দিয়েছেন-
“কোৱান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক 
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত সখ।” (সাম্যবাদী) 
জীবনের গোড়ার দিকে যুদ্ধে যাওয়ার সূত্রে আরবীয়, তুর্কি সঙ্গীত শৈলীর সংস্পর্শে আসেন। তাই অটোমান লোকগীতি কাতিবিম কে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে”। আমি একে বলি ভাবনার সাম্যবাদ।
“অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট”-কথা বলতে বুকের পাটা লাগে। নজরুলের তাই ছিল। জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না করে যিনি লিখতে পারেন “তবে মন্দির মসজিদে প্রভু নাই মানুষের দাবি” । 
আবার এই মানুষই যখন লেখেন “অরুণ কান্তি কে গো যোগী ভিখারি”-মন আত্মস্থ হয়ে যায়। 
আজীবন নিজের কাজে,ভাবনায়,কথায়,সুরে,চেতনায় সাম্যের জয়গান গেয়েছেন যে শিল্পী,যে কবি,নাট্যকার,সুরকার,গীতিকার- তাঁর কথা এই স্বল্প পরিসরে বলা অসম্ভব। শুধু মাথা নত করে কুর্নিশ জানিয়ে বলা যায় “অন্তরে তুমি আছ চিরদিন,ওগো অন্তর্যামী |”
******************************************

মনি ফকির

মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত্য চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।
===================================

নজরুলেরবিদ্রোহীকবিতা 

মোতাজিদ খুররম

কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের শতবর্ষ পার হয়ে গেছে দুবছর আগে। কবিতাটি যখন কবির কলমে জন্ম নেয়, তখন অগ্নিগর্ভ এক সময় পার করছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সময়টাকে এখন আমরা অগ্নিযুগ বলে জানি।
মরণপণ লড়াই করছিল তখন বাংলার মানুষ—ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে। সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছে যুব সমাজ। ক্ষুদিরাম বসু,প্রফুল্ল চাকি আত্মাহুতি দিয়েছেন,লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর বোমা হামলার অপরাধে ফাঁসি হয়ে গেছে বসন্ত বিশ্বাসের। বীরের মর্যাদায় শহীদ হয়েছেন বাঘাযতীন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে জাপান চলে গেছেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। এইসব ঘটনার পর নির্মম নৃশংস এক ক্ষত তৈরি করলো ব্রিটিশ সরকার মানুষের মনে,জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নাইটহুড ফিরিয়ে দিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ—সেই সঙ্গে শাণিত প্রতিবাদের এক চিঠি লিখলেন তিনি বড়লাটকে উদ্দেশ্য করে।
এরকম ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত হলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। কবিতার বিষয় ও বক্তব্য দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। গ্রেফতার হলেন কবি নজরুল। তিনি হয়ে উঠলেন বিদ্রোহ আর যৌবনের প্রতীক। ফুঁসে উঠলো বাংলার যুবসমাজ। ধীরে ধীরে আবার শক্তি সঞ্চয় করলো তারা। প্রায় নিভে আসা সশস্ত্র বিপ্লবের অঙ্গারে যেন ঘৃতাহুতি হলো। ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে আবার উঠে এলেন বিপ্লবীরা। শুরু হলো অগ্নিযুগের আরেক অধ্যায়-চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন—জ্বলে উঠলো সাহসের অনির্বাণ শিখা। যে শিখায় আবারও আত্মাহুতি দিলেন বীর চট্টলার মানুষ-সূর্যসেন,প্রীতিলতা ও তাঁদের সহযোদ্ধাগণ। তাঁদের আত্মত্যাগ ধসিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের ভিত-এদেশ ছেড়ে চলে যায় ব্রিটিশরা বাধ্য হয়ে। অবশেষে আসে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
বিদ্রোহী কবিতার কবিকে একদিন নিজ চোখে দেখতে পাবো ভাবিনি কখনো—সেই সৌভাগ্য ছিল আমার জীবনের পরম পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁর গান গেয়ে আমরা নিদ্রাহীন রাত পার করেছি,যাঁর কবিতা ছিল আমাদের শক্তি আর সাহসের অফুরন্ত উৎস, তাঁকে ছুঁয়ে দেখার দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবো—এই অভাবনীয় ঘটনাও একদিন সত্যি হলো। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে কবিকে কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে ছিলেন তিনি। কবি তখন নীরব নিথর ভাষাহীন। অথচ এই মানুষটিই ধূমকেতুর মতো ছুটে বেড়িয়েছেন একসময়—এসেছেন এই ঢাকা শহরেই বহুবারii তাঁর যুবক বয়সে-দৃপ্ত তেজে জ্বলেছেন দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতো।
আমরা যখন তাঁকে পেলাম,সূর্যের তেজ শেষ হয়ে গেছে—জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গেছে দিবাকর-ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। ফুলার রোডের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে গিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে। বড় বড় চোখে শুধু তাকিয়ে ছিলেন কবি—‘নিশ্চল নিশ্চুপ, আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ।’ থেমে গেছে তাঁর গান,থেমে গেছে রুদ্রবীণা,শ্রান্ত হয়ে চুপ করে আছেন বিদ্রোহী রণক্লান্ত। তাঁর পাশে কবির দুই নাতনি মিষ্টি কাজী,খিলখিল কাজী। কবির পায়ের কাছে ফুল রাখলাম দেহখাঁচারআমরা,দু’এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম। আঠারো বছরের কৌতূহলী চোখে আমি দেখলাম ক্লান্ত শ্রান্ত বিদ্রোহী কবির ক্ষীয়মান ছায়াকে। প্রজ্ঞাহীন তরুণ বয়সের কারণে সেদিন যা বুঝতে পারিনি,এখন বুঝি ঐ শান্ত ক্লান্ত  ভিতরেই কোথাও ছিলেন যৌবনের নজরুল,চির তারুণ্যের নজরুল। নাহলে শতবর্ষ পার হবার পরে আজও কেন তিনি এত উজ্জ্বল,কেন এত প্রাসঙ্গিক তাঁর কবিতা?
শুধু বাঙালির জীবনেই নয়,বিশ্বের নানা দেশে নজরুলের সৃষ্টি খুঁজে পেয়েছে নতুন নতুন প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা। তেমনি একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করি। জাপানের ইয়োকোহামা শহরে একটি আর্ট মিউজিয়াম আছে,শিল্পের জাদুঘর। আজ থেকে কয়েক বছর আগে এই জাদুঘরে একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান হয়েছিল—একে বলা যায় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান অথবা আসর। তবে ঠিক প্রচলিত আসর নয়। যে বই থেকে কবিতা পাঠ করা হয়,সেটা সাধারণ কোনো বই নয়—মঞ্চের উপর ডায়াসে রাখা আছে বিরাট আকৃতির বইটি। এই বইয়ের ভিতরে আছে পৃথিবীর আটটি ভাষায় রচিত সাতটি অধ্যায়। তাতে আছে নানা দেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি, আছে কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-কম্পোজারদের লেখা ও সৃষ্টি। বইটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘যে কথা আগুনে পোড়ে না’।
বইয়ের মূল বক্তব্য হচ্ছে দুঃসময়ে রচিত কোনো সৃষ্টিকে ধ্বংস করা যায় না—যদি তা হয় মানুষের দুঃখ ও মর্মযাতনার কথা, যদি হয় মানুষের লড়াই ও সংগ্রামের দীপ্ত বিবরণ। এই সূত্রেই পৃথিবীর বিখ্যাত সব সৃষ্টির মাঝে ঠাঁই পেয়েছে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। শ্রোতাদের সামনে কবিতাটি পাঠ করেছেন মঈনুল শাওন নামে জাপানে বসবাসরত একজন বাঙালি। পাঠ করার পর তিনি তাঁর আবেগ-অনুভূতি এভাবে প্রকাশ করেছেন-‘বিদ্রোহী পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল,পৃথিবীর সামনে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য আর সাহসকে হাজির করছি। ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে জাপানে দাঁড়িয়ে আছি-আশেপাশের দর্শনার্থীদের কারও বাংলা জানা নেই। কবিতাটি পড়তে পড়তে ফিরে গেলাম যৌবনে,আমাদের ইতিহাস আর আন্দোলনে,যেখানে ‘বিদ্রোহী’ আমাদের মাথা উঁচু করতে শিখিয়েছে,প্রেরণা জুগিয়েছে বারবার। আমি পড়ে চলি,‘বল বীর/ চির উন্নত মম শির…।’
হলঘর ভর্তি জাপানি শ্রোতা-দর্শক। বিপুল বিস্ময় আর আগ্রহ নিয়ে বিদ্রোহী কবিতার শব্দ আর ঝঙ্কার শুনছে তারা-হয়তো দেখতেও পাচ্ছে শব্দ থেকে ছিটকে ওঠা অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ। নজরুলের কবিতার শব্দ ও ছন্দের সম্মোহনী শক্তি দেখে সেদিন বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন পাঠক মঈনুল শাওন।
এই চমৎকার ঘটনা নিয়ে একদিন কথা হচ্ছিলো আমার প্রকাশক-বন্ধু কমলকান্তির বুকশপে বসে। সেখানে প্রায়ই আড্ডা হয়। লেখক-কবি-সাহিত্যিকরা আসেন। সেদিনও অনেকে এসেছেন। আমার কবি-বন্ধু শাকেরউল্লাহও আছে। একসময় সে কবিতা লিখতো,‘ঊষালোকে নামে একটা লিটল ম্যাগ পত্রিকা বের করতো,বইমেলায় বাংলা একাডেমী চত্বরে স্টল দিত।এখন বাধ্য হয়ে তাকে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করতে হয়। ব্যবসার চাপে কাব্যদেবী অভিমান করে তার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে, ঊষালোকে ছাপানো বন্ধ। তবু বইপাড়ার মায়া শাকেরউল্লাহ কিছুতেই ছাড়তে পারে না—দু’চারদিন পরপর সে চলে আসে আড্ডায়। তার কাঁধে সবসময় একটা ঝোলা থাকে,ঝোলার ভিতরে থাকে আড্ডার জন্য গরম সিঙাড়া কিংবা পুরি,আর থাকে নানারকম গল্প।
সেদিন শাকেরউল্লাহ বললো,‘এতক্ষণ তো নজরুলকে নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা হলো,এবার একটু গল্প হোক। গল্পটা অনেকেরই হয়তো জানা,তবু বলি।’ এটুকু ভনিতা করে শুরু করলো শাকের—‘কবি নজরুল হুগলি জেলে। অনশনের সাতাশ দিন পার হয়েছে। সবাই চিন্তিত। অনেকে অনুরোধ করলো অনশন ভাঙতে,কবি অটল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠালেন—Give up hunger strike, our literature claims you-নজরুল নির্বিকার। শেষে সবাই গিয়ে ধরলো কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু অচিন্ত্য সেনগুপ্তকে—তিনি অনুরোধ করলে হয়তো প্রিয় বন্ধুর কথা ফেলতে পারবেন না নজরুল। সঙ্গে গেলেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য,জেলগেট থেকেই তাঁদের ফিরে আসতে হলো।
কবি কারও সঙ্গেই দেখা করছেন না। ফেরার পথে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। পাশেই হুগলি জেলের উঁচু পাঁচিল। অচিন্ত্যর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো,পবিত্রকে বললেন,‘আমাকে ঘাড়ে নাও।’
দাঁড়াও।’
অ্যাঁ…ঘাড়ে নেবো! কেন?
আহা নাও না। আমি পাঁচিল টপকে নজরুলের কাছে যাবো।
মাথা খারাপ নাকি?
না,মাথা ঠিক আছে। তুমি দেয়ালের এখানে এসে দাঁড়াও-এখন আশেপাশে তেমন কেউ নেই,দু’একটা ফকির ছাড়া…।
হ্যাঁ,দু’একটা ফকির আর একটা উন্মাদ।
আহা এদিকে এসো না। দেয়াল ঘেঁষে বোসো। হ্যাঁ এখানে।
প্রায় জোর করে পবিত্রকে বসিয়ে তার ঘাড়ে চাপলেন অচিন্ত্য। ‘হ্যাঁ,এবার পবিত্র উঠে দাঁড়ালে অচিন্ত্য পাঁচিলের মাথা ধরে ফেললেন। তারপর হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে গেলেন পাঁচিলের মাথায়। উঠেই দেখেন বিপদ—ওপারে দেয়ালের পাশে গভীর ট্রেঞ্চ। লাফ দিয়ে নামলে হাড্ডিগুড্ডি কিছু আস্ত থাকবে না। এদিকে বন্ধুকে পাঁচিলে তুলে দিয়ে পবিত্র একছুটে পালিয়ে গেছেন। এপাশে সিমেন্টের প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে নামলেও হাত-পা ভাঙবে। কী করা! বেচারা অচিন্ত্য দাঁড়িয়েও থাকতে পারছেন না,তাঁর পা কাঁপছে। ঘোড়ার পিঠে বসার মতো করে তিনি বসে পড়লেন পাঁচিলের উপর। তারপর চিৎকার-চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিলেন।
কয়েদিদের তখন মাঠে হাঁটাহাঁটির সময়। তারা দৌড়ে এসে এই অবাক কাণ্ড দেখলো। দূরে মাঠের এক কোণে এসে বসেছেন অনাহার ক্লিষ্ট নজরুল। তাঁকে দেখেই অচিন্ত্য পাঁচিলের উপর থেকে চিৎকার করে বন্ধুকে বলছেন—‘অনশন ভেঙে ফেলো…দোহাই লাগে!’ কীসের কী।
কোনো দোহাই কাজে লাগলো না। ওদিকে কয়েদিরা হাসছে এই দৃশ্য দেখে। এপাশে প্ল্যাটফর্মে লোক জমে গেছে—এ আবার কোন পাগল জেলের পাঁচিলে বসে আছে…?’
দৃশ্যটা কল্পনা করে আড্ডার সবাই হেসে উঠলো। আমার মনে পড়লো ‘সম্পাদকের দপ্তরে’ বইটার কথা। সাগরময় ঘোষের লেখা। সেই বইয়ের মধ্যে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে এরকম অনেক মজার গল্প আছে। প্রকাশক বন্ধু কমলকান্তির দপ্তরে এসে প্রায়ই এরকম গল্প শুনি—গল্পের জোগানদার আমার বন্ধু শাকের।আড্ডা যখন ভাঙলো,কমলকান্তিকে বললাম,‘আপনিও একটা বই লিখে ফেলেন। নাম দেবেন ‘প্রকাশকের দপ্তরে’।
*************************************

মোতাজিদ খুররম – জিও ফিজিসিস্ট,বাংলাদেশ
===================================

সামিয়ানা  

বিদ্যুৎ পাল 

একচল্লিশে রবি গেলেন, 
                   তিনি বেয়াল্লিশে স্তব্ধ!
বলতে গেলে রবিঠাকুরেরই 
বাঁধা সামিয়ানায়
গোলাম-সৈনিকের জ্বলুনি নিয়ে ঢুকে 
শোনালেন  
সৃষ্টিযন্ত্রণার ওম; 
রবিও চিনলেন বিদ্রোহী!

রোদে আসা মানুষকে নিজের 
গান শুনিয়েছেন, 
ঝগড়া বাঁধলে ঢুকে তুমুল ক্রোধে 
থামিয়েছেন –
                  ‘উচ্ছন্নে যাবে জীবন 
               জাত-ধর্মের এই কোন্দলে
            রক্ত খাবে ক্ষেত-কল-মালিকদের 
                              মুনাফারাজ’।

শাসিয়েছেন বেধড়ক–অত্যাচারী 
                              ফিরিঙ্গিদের!
ধরে নিয়ে গেছে পুলিস, 
কয়েদ খেটে ফিরেছেন।
আবার সেই সামিয়ানায়, 
                  রবি জার্মান,আইরিশ,
উনি আরবের সুর বুনেছেন, 
                        গজলের বাঁক … 

বৃষ্টির জল জমলে বাঁশ 
                   উঁচিয়ে ঝরিয়েছেন,
ঝড়ে খুলে গেলে নতুন 
              পাকিয়ে বেঁধেছেন দড়া।
ভাষায়,ছন্দে,সুরে,সত্ত্বায় 
বহুধা ব্যস্ত,চঞ্চল!  
কাজীর যুগ ওই সামিয়ানা 
ধরে রাখছে আজও।
*************************************

This image has an empty alt attribute; its file name is 10402428_692796074129862_2677252761706232863_n-150x150.jpg

বিদ্যুৎ পাল পরিচিতি
জন্মতারিখ ২৪শে জুলাই ১৯৫২। জন্মস্থান পাটনা (বিহার)। পড়াশুনো সবটাই পাটনায়। চাকরি  ব্যাঙ্কে,বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিনের ব্যস্ততায় শামিল নিজের লেখালিখি,পড়াশুনো,বিহার হেরল্ডের সম্পাদনা,দেশবিদেশের সঙ্গীত শোনা,বইপত্র সম্পাদনা। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা,গল্প ও প্রবন্ধ (প্রবন্ধটা অবশ্য বাংলা,হিন্দী এবং ইংরেজি,তিন ভাষাতেই লিখতে হয়) প্রকাশিত। আপাততঃ ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরল্ড’এর সম্পাদক,ও বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র যুগ্মসম্পাদক।
===================================

চিরকালীন

তীর্থঙ্কর সান্যাল

ধূমকেতুর মত তোমার প্রকাশ,
অগ্নিবীণা হাতে তোমার প্রবেশ।
হে বিদ্রোহী। অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ
ভীত,সন্ত্রস্ত
তোমার ধারালো মসীঅস্ত্রে।
স্বদেশ প্রেমী;দেশ আর হৃদয় জুড়ে
তুমি ছড়িয়ে রয়েছ।
তুমি নজরুল।
জাতীয়তা,চিরন্তন প্রেম আর
রাগ রাগিণীর সুরধারায় তুমি অমলিন।
তুমি চিরকালীন।
****************************************

তীর্থংকর সান্যাল : ছাত্র-রামকৃষ্ণ মিশন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা: এম.কম,এম এ (সাইকোলজি),এ সি এম এ (কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট) ও এ সি এস (কোম্পানি সেক্রেটারি)
রামকৃষ্ণ মিশনের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট স্বামী রঙ্গনাথানন্দ দ্বারা দীক্ষিত। মা ও বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা।
পেশা : বহুজাতিক কোম্পানির সিইও ও মেন্টর ছিলেন। বর্তমানে হিউম্যান সিগমা ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্সি সংস্থার সিইও।
লেখালেখি,গান ও সমাজসেবায় নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছেন।
===================================

নজরুল  

চিন্ময় চক্রবর্তী 

তখন শুধু আগুন ছিলো
দুখুমিঁয়ার মনে,
প্রেম ছিলো,তাই সৃষ্টি ছিলো
পাহাড় নদী বনে।
লাভার মত আগুন স্রোতে
বইতো প্রেমের বানী,
বিদ্রোহী মন থমকে ছিলো
আগুন ভরা পানী।
দুখু মিঁয়ার দুঃখ ছিলো 
গোলাপ ফুলের মত,
আঘাত পেলেও মাটির ওপর
ঢাকতো লালে ক্ষত।
তখন শুধু আগুন ছিলো
ভীষণ দাবানল।
জ্বলছে পাহাড় অরণ্য সব
সাগর নদীর জল।
বুকের ভিতর ভালবাসার
তুফান,সাগর ঢেউ,
কেউ রাখেনি মনের খবর
রাখতো না গো কেউ।
চোখের কোনে জমাট ছিলো
অশ্রু,হৃদয় বারি,
হাতের মুঠোয় বাগিয়ে ধরা
কঠিন তরবারি।
সে যে আমার দুখু মিঁয়া, 
প্রানের কবি সে।
আর কি এলো এমন টি কেউ
আমার এ দেশে?
আমি তোমায় ভালবাসি,
তোমার ভাষায় বলি।
তোমার আগুন পথ দিয়ে যে
সারাটা পথ চলি।
তোমার পথেই খুঁজে পেলাম
কৃষ্ণ,হজরত,
তোমার চোখের দিকে চেয়েই
আমার এ শপথ।
সাম্যবাদেই আমার ভাষা,
নারীর অসম্মান 
সহ্য কভু করবো না গো
প্রেমের ভগবান!
তোমার গাছে দুটি কুসুম
সুবাস ভরে দেবে
হিন্দু মুসলমানের গাথা
প্রেমের সুরে গা’বে।
তোমার বাঁশী আজও শুনে
রক্তে জোয়ার আনে।
কোথাও ভালবাসছে যে কেউ
এই গ্রহে কোনখানে।
দুখু মিঁয়া, আজও আছো
আমার হৃদয় জুড়ে,
আমার নজরুলের কথায়,
গানের সুরে সুরে।
তুমি আছো,গান কবিতা,
বারুদ আছে আর,
ভালবাসার ফল্গু আছে
তোমার এ বাংলার।
তুমি আমার প্রানের কবি,
মনের তোলা পড়া,
তোমার যাদু দন্ডে দোলে,
আমার লড়াই লড়া।
প্রণাম কবি দুখু মিঁয়া
প্রণাম হে নজরুল।
সৈনিকেরই সাজপোশাকে
প্রেমের গোলাপ ফুল।
——-নীলকন্ঠ ফেরিওয়ালা
********************************

চিন্ময় চক্রবর্তী পরিচিতি:
জন্ম ১৯৬৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চন্দননগরে। রসায়নে সাম্মানিক নিয়ে স্নাতক। তারপর পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর। তারপর কর্মক্ষেত্র ও নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বুড়ি ছোঁওয়া। তার মধ্যে আই আই এম কলকাতা অন্যতম। চারটি স্বনাম ধন্য জাতীয় ও বহুজাতিক ঔষধ সংস্থায় নানান পদে কাজ করার ৩৩ বছর ৪ মাসের অভিজ্ঞতা। গত ২০২২ শের ৬ই মে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারনে একটি বহুজাতিক সংস্থার জাতীয় অধিকর্তার পদ থেকে স্বেচ্ছাবসর।
জীবন দর্শনের পাঠগুলো কবিতা,ছোটগল্প,উপন্যাস ও ভ্রমন কাহিনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে ভালবাসেন। নিজের নামে ও ছদ্মনাম “নীলকণ্ঠ ফেরিওয়ালা” নামে লিখতে ভালবাসেন। পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত ।
========================================

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

কলমেঅজন্তা প্রবাহিতা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুলের জীবন আর পাঁচজন কবির মতো ছিল না। কাজী নজরুলের জীবনের আনন্দ-বেদনা,হাসি-অশ্রু,শ্রদ্ধা-গ্লানি,অভাব-অভিযোগ,জীবন মৃত্যুর টানাপোড়েন সমসাময়িক অন্যদের মধ্যে বিরল।
দুখুমিয়া সারা জীবন দুঃখকেই সঙ্গী করেছেন। বহু মানুষের ভিড়েও তিনি ছিলেন একা। তিনি মন্দিরের ছিলেন না,মসজিদও তাঁকে ধরে রাখতে পারে নি। বরং,মন্দির মসজিদের দুই পৃথক অবয়ব তাঁর চোখে এক হয়ে একাকার হয়ে গেছিলো।
“মুসলিম তাঁর নয়নমণি,হিন্দু তাঁহার প্রাণ”,একই দেহে দুই বিরাজমান,কিভাবে তাদের আলাদা করা যায়? নজরুল ধর্মের চেয়ে মানুষকে বড় করে দেখেছেন সবসময়,তাই,জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রিয়  নজরুল। 
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সাল ২৪ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বিখ্যাত কবি। পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম এবং মা জাহেদা খাতুন ছিলেন গৃহবধূ।
মাত্র দশ বছর বয়সে পিতার অকাল মৃত্যুর পরে পরিবারের  দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাঁধে। স্কুলে না গিয়ে বাবার মতই মাজারের খাদেম ও মসজিদের ইমামতির কাজ নিলেন। কিন্তু মক্তবের ওই সামান্য আয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। প্রথম জীবনে তিনি খুব কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন বলেই গ্রামবাসীরা তাঁকে ‘দুখুমিয়া’ ডাকনাম দিয়েছিল।
চুরুলিয়া অঞ্চলে চাচা কাজী বজলে করিমের এক লেটো গানের দল ছিল। চাচার সঙ্গে নজরুল ইসলামের খুব ভাব ছিল ছোটবেলা থেকেই। দলের জন্য কাজী বজলে করিম নিজেই গান লিখতেন। আরবি,ফার্সি আর বাংলা ভাষায় তাঁর ভাল দখল ছিল। তাঁর কাছেই নজরুলের হাতেখড়ি হয় পদ্য লেখায়। এতে তাঁর দুপয়সা রোজগার ও হতো। অল্প বয়সেই তাঁর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল এবং তাঁর লেখা গানের কদর বেড়ে গিয়েছিল। দলের সাথে ঘুরে ঘুরেই তাঁর পরিচয় ঘটে নানা জাতের,বর্ণের,ধর্মের মানুষের সাথে। এসময় তিনি লিখেছেন বাংলা-উর্দু-ফারসি-ইংরেজি ভাষা মিশ্রিত গীতিকাব্য,প্রহসন,পাঁচালী,কবিগান।
তিনি ছিলেন জ্ঞান পিপাসু। একদিন গানের দল ছেড়ে আবার তিনি পড়াশোনায় ফিরে যান। রানীগঞ্জের শিয়ালসোল (বর্ধমান) হাইস্কুলে ভর্তি হলেন। এখানে স্থানীয় জমিদারের বদান্যতা পেলেন। অবৈতনিক ছাত্রের তকমা এবং মুসলিম হোস্টেলে থাকা-খাওয়া ছাড়াও মাসিক সাত টাকা বৃত্তিও পেলেন।
অষ্টম শ্রেণীতে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করায় তাঁর মেধা দেখে কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডবল প্রমোশন দিয়ে দশম শ্রেণীতে উঠালেন।
এরই মধ্যে তাঁর পরিচয় হয় শৈলজানন্দের মতো লেখকের সাথে। ১৯১৭ সালে স্কুলের শেষ ধাপে এসে পড়াশোনার পাট চুকালেন। যোগ দিলেন কিশোর নজরুল ডাবল কোম্পানিতে। ট্রেনিং শেষে শিগগিরই তাঁকে নওশেরার সীমান্ত প্রদেশে এবং সেখান থেকে রেজিমেন্টসহ করাচি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
তাঁর কর্মদক্ষতা দেখে দ্রুত হাবিলদার পদে প্রমোশন হয়। এটি ছিল ইন্ডিয়ান কমিশন্ড অফিসার পদ। তিনি কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন। এই সময় তাঁর মুক্তমন ও সাহিত্যের প্রভাব অন্যদের অনুপ্রাণিত করত।
এভাবে তিনি কৈশোরের চাঞ্চল্য কাটিয়ে ধীরে ধীরে সম্মুখে এগোতে থাকেন। নজরুলের প্রথাগত অ্যাকাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও তিনি অসম্ভব প্রতিভাধর ছিলেন। আত্মসচেতনতা তাঁকে সুশিক্ষিত করে তোলে।
অনেক জ্বালাময়ী কবিতা ও গান লেখার জন্য কবি নজরুল পরিচিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। বিভিন্ন রূপে পাই তাঁকে,এক নির্ভীক সৈনিক রূপে,এক বিদ্রোহী সিংহ রূপে,অগ্নিবীণা বাজাতে–জাতিকে জাগাতে-জাগিয়ে রাখতে। এভাবেই আমরা পেয়ে থাকি শতমুখী প্রতিভা ধর নজরুলকে।
সেদিন সমগ্র বাংলাদেশ এই তরুণ কবিকে মাথায় তুলে রেখেছিল। তাঁর প্রচার এবং প্রসার তখন তুঙ্গে। কবির চারিপাশে তখন ভক্ত–অনুরক্ত এবং গুণগ্রাহীদের ভিড়।
তারপরে এমন এক দিন এল,যখন দুর্ভাগ্যবশত,কবি অসুস্থ এবং অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
বাংলার হিন্দু মুসলিম দুই জাতির কাছেই কেমন অপাঙক্তেয় হয়ে উঠলেন। হঠাৎ ঝড়ে উৎসব বাড়ির ঝাড় লন্ঠন নিভে গেলে যেমন অন্ধকার ও স্তব্ধ পরিবেশের সৃষ্টি হয়,ঠিক তেমনটাই ঘটলো কবির জীবনে।
নজরুলের জীবনে রোগ,ভোগ অভাব ও দুর্যোগের ইতিহাস শুরু হল।
১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪২ সালের ১০ই অগাষ্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ১০টি বছরে কবির জীবনে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এক সময়ে,কবির বাসভবনে মোতায়েন ছিল নেপালি দারোয়ান,ছিল মোটর গাড়ি ও আর্থিক সাচ্ছ্বল্য। বেশ জাঁকজমক এবং সাড়ম্বরে কবির সংসার চলছিল। দেখতে দেখতে অবিশ্বাস্য ভাবে কর্পূরের মত সব মিলিয়ে গেল। এ সময়ের মধ্যে তাঁর জীবনের  উত্থান পতন নিতান্তই বেদনা দায়ক।
তিনি শুধুই বিদ্রোহী এবং শুধুই বিপ্লবী কবি ছিলেন না। কবির সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন,কবির রুচিবোধ,দৃষ্টিভঙ্গী এবং বন্ধু বাৎসল্য অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই চির দুর্দম বিদ্রোহী কবিও এক সময় জীবনের কাছে হেরে গেলেন। অসহায় শিশুর মতোই এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন মস্তিষ্কের দুরারোগ্য কঠিন ব্যাধিতে। তারিখটি ছিল ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই।
এর আগে ১৯৪০ সালে কবিপত্নী প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর সুস্থতার জন্য কবি অজস্র অর্থ ব্যয় করেন। কিস্তিতে কেনা মোটরগাড়ি,বালিগঞ্জের ভক্তের দান করা জমি,গ্রন্থাবলির কপিরাইট,রেকর্ড করা গানের রয়্যালটির টাকা সবই স্ত্রীর চিকিৎসায় খরচ করেন। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। এদিকে অসুখের জন্য কবির কথা বলার ও লেখার শক্তি হারিয়ে যায়।যত দিন কবিপত্নী প্রমীলা জীবিত ছিলেন,কবির প্রতি সেবাযত্ন,ভক্তি,ভালোবাসার কোনো ত্রুটি ছিল না। পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় শুয়ে শুয়ে সংসার চালানো ছাড়াও কবির সেবা শুশ্রূষা করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাঁর অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। এরপর তাঁকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তাঁর অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি।
প্রথম অবস্থায় কবির সুচিকিৎসা হলে হয়তো আমরা কবিকে জীবন্মৃত অবস্থায় না পেয়ে সুস্থ অবস্থায় পেতাম।
১৯৪২ সালের ২৫ শে অক্টোবর তাঁকে তিলজলার লুমবিনি মানসিক হাসপাতালে ডাক্তার গিরীন্দ্র শেখর বসুর তত্ত্বাবধানে ভর্তি করা হয়। এখানেই কবিকে চিকিৎসার জন্য শেকল দিয়ে বেধে রাখা হল।
তাঁর ডান পায়ে পড়ানো হয়েছিল শেকল। সেই শেকল ভাঙার জন্য সারাদিন কবি উন্মত্ত হয়ে থাকতেন। লুমবিনি হাসপাতালের চিকিৎসা ছিল অত্যন্ত ব্যয় বহুল। সেই খরচ নজরুল পরিবার টানতে পারল না। ফলে চার মাসের মাথায় ১৯৪৩ সালের ২৪/২৫ ফেব্রুয়ারী কবিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল।
যে জাতিকে কবি অকাতরে অনেক কিছুই বিলিয়ে দিয়েছেন,তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখার সময় এমন-কি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কয়েক বছর সরকার বা আমাদের হয়ে ওঠেনি। প্রথম অবস্থায় কবি পরিচিত কাউকে দেখলেই মুখে অদ্ভুত শব্দ করে কী যেন বলতে চাইতেন। হয়তো-বা তাই—যে দেশ এবং জাতির জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করলাম,ওরা কেন আজ আমার খোঁজ নেয় না ? আমার আজ এই দুর্দশা কেন ?
১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাষ্ট দেশ স্বাধীন হল। অসুস্থ কবি কিছুই জানতে পারলেন না।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল নিরাময় সমিতি,এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোনো উন্নতি না হওয়ায় ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায়।
১৯৫৩ সালের ১০ মে সরকারী খরচে নীরব এবং নির্বিকার কবি ও তাঁর পত্নীকে পাঠানো হলো লন্ডনে। ডা. উইলিয়ম স্যারগ্যান্ট, ই এ বেটন,রাসেল ব্রেন নজরুলকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু চিকিৎসার ব্যাপারে তাঁরা একমত হতে না পারায় কবি ও তাঁর স্ত্রীকে পাঠানো হয় ভিয়েনায়। ৯ ডিসেম্বর নজরুলের ওপর সেরিব্র্যাল অ্যানজিওগ্রাফি পরীক্ষা করানো হয়। ফলস্বরূপ প্রখ্যাত স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডা. হ্যান্স হক বলেন,নজরুল ‘পিকসডিজিজ’ নামক এক প্রকার মস্তিষ্কের রোগে ভুগছেন যা নিরাময়ের বাইরে। এই রোগে রোগী শিশুর মতো ব্যবহার করেন এবং মস্তিষ্কের সামনের ও পাশের অংশগুলো সংকুচিত হয়ে যায়।
সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩’র ১৪ই ডিসেম্বর।
এর পরেও ২৩ বছর জীবিত ছিলেন নজরুল। বাংলা দেশের বিস্মৃতপ্রায় এক কবি আর তাঁর নম্র সহচরী জনমানবের অবহেলার বস্তুর মতো পড়ে ছিলেন।
১৯৬২র ২৩শে জুন দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলা দেবী মাত্র ৫৪ বছর বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। কবি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। অভাবের তাড়না,মানসিক কষ্ট,নিঃসঙ্গতা,পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া,অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনের সঙ্গী।
১৯৭১ সালে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। স্বাধীন  বাংলাদেশের নাগরিকরা কবির জীবদ্দশায় তাঁকে যথার্থ সম্মান দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। ১৯৭২ সালের ২৪ মে,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমায়িক আন্তরিকতায় রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে কবিকে নিয়ে আসা হলো ঢাকায়। জীবনের শেষ চার বছর কবি এখানেই ছিলেন।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সন্মান একুশে পদক দিয়ে তাঁকে প্রাপ্য সন্মান এবং সমাদর জানানো হয়। ১৯৭৫ সালে চলে গেলেন কবির কনিষ্ঠ পুত্র ‘নিনি’ অর্থাৎ কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম। স্তব্ধবাক কবি কিছুই বুঝলেন না,কিছুই জানলেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই অগাষ্ট ঘাতক বাহিনীর দ্বারা নৃশংস ভাবে নিহত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
জেনেরাল জিয়াউল রহমানের সামরিক শাসনে নজরুলের ভাগ্যে আবার কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। শোনা যায়,সেনাবাহিনীর কোনো এক উচ্চ পদস্থ কর্মচারীর পছন্দ ছিল নজরুলের সরকারী বাসভবন। পরিকল্পনা মাফিক অসুস্থ জড়বত নজরুলকে বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। প্রশস্ত বাসভবন থেকে সোজা হাসপাতালের ছোট্ট কেবিন,কবি নির্বাক,নিশ্চুপ হলেও তার শরীর এ ধরণের আকস্মিক পরিবর্তন আর সইতে পারল না। একবছর হাসপাতালের কারাগারে থাকতে থাকতে তাঁর শরীর ভাঙতে শুরু করে,আক্রান্ত হন জ্বর এবং নিউমনিয়াতে। জীবন মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকা শরীরকে মৃত্যু সম্পূর্ণ ভাবে গ্রাস করল ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট।
“মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”:- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সেই অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়। ‘যেদিন আমি চলে যাব,সেদিন হয়তো বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা,কত কবিতা বের হবে হয়তো আমার নামে। দেশপ্রেমী,ত্যাগী,বীর,বিদ্রোহী-বিশেষণের পর বিশেষণ,টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে,বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না।’
**************************************

অজন্তা প্রবাহিতা
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।
=================================

মানবতার পূজারী দুখু মিঞা

শ্রুতি দত্ত  রায়

বাংলার সারস্বত সাধকদের মধ্যে যিনি আজও স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল,যিনি দেশপ্রেমের কবি,মানবতাবাদের কবি,সকল নিপীড়িত-শোষিত-অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের কবি,সাম্যের কবি,তিনি হলেন দুখুমিঞা। আমাদের সকলের প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম।
           অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি পরাধীন ভারতের গ্লানিজড়িত প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করে গেয়ে গিয়েছিলেন সাম্যের গান,জীবনের সঙ্গীত। বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধূমকেতুর মত আবির্ভূত হয়ে একদিকে যেমন ললিত-মধুর-সুরের ঝংকারে মানুষের হৃদয় সরোবরে তুলেছেন ঢেউ,তেমনই অন্যদিকে উদ্দাম যৌবনের দৃপ্ততায় উড়িয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহের প্রবল ধ্বজা।
       সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের বিরুদ্ধে এবং বিদ্বেষে তাঁর লেখনী যেমন প্রতিবাদ করে উঠেছিল,একইভাবে ইংরেজ শাসকরা তাদের নিজেদের স্বার্থে গোপনে জাতিভেদের যে মন্ত্র প্রচার করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল,তার বিরুদ্ধেও তাঁর কলম সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। তাই তো উদাত্ত কন্ঠে তিনি বলেছেন-
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,নহে কিছু মহীয়ান।”
        যেখানেই মানবতার অপমান,মানুষের অবমাননা,মনুষ্যত্বের অবমাননা দেখেছেন,সেখানেই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। সে যুগের মোল্লা-পুরোহিতের দল জীবনের আসল সত্যকে লুকিয়ে রেখে,মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের পথ রুদ্ধ করে ও মনগড়া শাস্ত্রীয় বিঘ্ন রচনা করে মানবতাবাদ ও সামাজিক বিকাশের পায়ে যে শৃঙ্খল পরাতে চেয়েছেন বারবার,তার বিরুদ্ধেই নজরুলের বিদ্রোহী মন সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া।
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।”
     এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে কবি মোল্লা পুরোহিতদের মুখের সামনে বলতে পেরেছেন,
“পুঁথির বিধান যাক পুড়ে তোর বিধির বিধান সত্য হোক।”
সর্বপ্রকার ভেদবুদ্ধি ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ঘোষনা করেছেন–
“মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি,হিন্দু তাহার প্রাণ।”
                     কবি নিজেই তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পত্রে লিখেছেন–
“আমি বিদ্রোহ করেছি–বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে,অত্যাচারের বিরুদ্ধে,–যা মিথ্যা,কলুষিত,পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে,ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে (অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খান সাহেবকে লিখিত)। কবির এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তাঁর অসংখ্য কবিতা ও গানে ব্যক্ত হয়েছে। “কান্ডারী হুঁশিয়ার” কবিতায় কবির তাই জিজ্ঞাসা –
“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ,সন্তান মোর মা’র।”
        নজরুল ছিলেন এমন একজন মানুষ যাঁর নিজের ব্যক্তিজীবনে ধর্মাচরণে ছিলনা নিষ্ঠার অভাব। কিশোর বয়সে একদিকে যেমন তিনি মাদ্রাসায় “এমারতি” বা ধর্ম ব্যাখ্যাকারের কাজ করেছেন,তেমনই নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করেছেন রামায়ণ,মহাভারত,ভাগবত। পীর-ফকির,সাধু-সন্ত তাঁকে সমানভাবেই আকর্ষিত করত। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মন্দির,মসজিদ,গির্জা সবই হচ্ছে বাহ্যিক দেবস্থান। কিন্তু হৃদয়মন্দিরে সবাই একাকার। আর এখানেই জাগে সত্যানুভূতির অভীপ্সা। আর এই অনুভব থেকেই কবি হয়তো লিখতে পেরেছেন-
“মসজিদ এই,মন্দির এই,গীর্জা এই হৃদয়।
এইখানে বসে ঈশা-মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কোথা নাই।”
           আর তাঁর সেই সত্য উপলব্ধি থেকেই তিনি যেমন গীতিকার হিসেবে একদিকে লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত,কীর্তন,বাউল,ভজনের মত ভক্তিমূলক সঙ্গীত,অন্যদিকে রচনা করেছেন কাওয়ালী এবং অন্যান্য ইসলামী গান। রামপ্রসাদ,কমলাকান্তের মত তিনিও ছিলেন একনিষ্ঠ সাধক,আধ্যাত্ম পথের পথিক। প্রকৃত মানবতার পূজারী ছিলেন বলেই নিজের ধর্মের ঊর্ধ্বে  উঠে মানবধর্মের পূজা করতে পেরেছিলেন। তাই শাক্ত,বৈষ্ণব,ইসলামিক সাধকদের হাতে হাত মিলিয়ে কখনো লিখেছেন,
“আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন” অথবা কখনো লিখেছেন
“গোঠের রাখাল বলে দে রে কোথায় বৃন্দাবন
যেথা রাখাল রাজা গোপাল আমার খেলে অনুক্ষণ।”
আবার কখনো গেয়ে উঠেছেন,
“ও মন,রমজানে ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।”
   এখানেই নজরুল ব্যতিক্রমী,অনন্য,স্বাতন্ত্র্যে চিরভাস্বর। প্রকৃত প্রগতিশীল,মানবতাবাদী এই কবি তাই আজকের সামাজিক,রাজনৈতিক পটভূমিতে,এই বিশ্বায়নের পৃথিবীতে আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
**************************************

শ্রুতি দত্ত রায় পরিচিতি:সুন্দরী ডুয়ার্সের মফস্বল শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পেশায় সরকারি বিদ্যালয়ের ভাষা সাহিত্যের শিক্ষিকা। ভালবাসেন গান শুনতে,বই পড়তে,ডুয়ার্সের প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে। আর গান গাইবার মধ্যে খুঁজে পান মুক্তির স্বাদ। 
============================

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!