Shadow

অনন্তবাবুর সমস্যা – চন্দ্র কান্তি দত্ত

pc. ShareChat

অনন্তবাবুর সমস্যা

চন্দ্র কান্তি দত্ত

আমার কাছেমানুষ চেনাকথাটার দুটো অর্থ হয়। একটা অর্থ হল মানুষটা কে,কি নাম,সেটা মনে রাখা,আর একটা অর্থ হল কোন একজনের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। অনন্তবাবুর ক্ষেত্রে নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ, দ্বিতীয় কাজটা তো দূর,তিনি প্রথম কাজটাই ইদানীং ঠিকমতো করে উঠতে পারছেন না। কি যে হয়েছে বা হচ্ছে কে জানে। হঠাৎ দেখা হলে অনন্তবাবু পরিচিত মানুষকেও চিনতে পারছেন না। সেদিন যেমন হল। পাশের বাড়ির বিশু কোথাও যাচ্ছিল। অনন্তবাবুও কোন কাজে বাইরে ছিলেন। বিশুকে দেখে ডাক দিলেন,”আরে,সুবল যে? সকাল সকাল কোথায় চললে?”
বেচারা বিশু। ডাক শুনে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চাইল। তারপর তৃতীয় কাউকে দেখতে না পেয়ে বলল,”কাকা,আপনি কি আমাকে ডাকলেন?”
অনন্তবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন,”হ্যাঁ! এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কাউকে তো দেখছি না।
বিশু তখন আরও বিহ্বল। বলল,”কাকা! আমি তো সুবল নই। আমার নাম বিশু। আপনি তো জানেন !”
অনন্তবাবু জিভ কাটলেন।এই দেখো। সকাল সকাল কি ভুলটাই না হল। যাক গে। যা হয়েছে হয়েছে। তা,তোমরা কেমন আছো? তোমার বাবা ভাল আছেন? কোথায় চললে?”
হ্যাঁ কাকা। আমরা ভালই আছি। একটু বাজারে যাব“,বলে বিশু কোনরকমে সে যাত্রা পালিয়ে বাঁচল।
অনন্তবাবু একটু চিন্তায় পড়লেন। বিশুকে তো আমি ওর জন্ম থেকে দেখছি। অথচ,এত বছর পরে ওকেই কিনা ভুল নামে ডাকলাম। ওকে আমার পালপাড়ার সুবল কেন মনে হল?
অনন্তবাবু সকালে খানিক হাঁটেন। বেশি কিছু নয়। ঢাকুরিয়া লেক গিয়ে মিনিট পনেরোর মত হাঁটা তারপর ঘন্টাখানেক আড্ডা,চা খাওয়া,এসব করে মোটামুটি আটটার কাছাকাছি বাড়ি ফেরেন। সব ঠিকঠাকই চলছিল। গোলমালটা হল আজ। হাঁটার পর অনন্তবাবু যখন নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলেন,তখন পাশের ভদ্রলোককে আগে কোথাও দেখেছেন বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না ঠিক কোথায় দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন। ভদ্রলোক তো পুরো বাকরূদ্ধ। কি হয়েছে অনন্তবাবুর? প্রায় বছর চারেক রোজ সকালে যাঁর পাশে বসে চা খাচ্ছেন,বিস্তর পরচর্চা করছেন,তাঁকেই কিনা চিনতে পারছেন না? আর শুধু তিনিই নন,সাতআট জনের পুরো দলটাই দিশাহারা। একজন তো বলেই ফেললেন,” অনন্তবাবু,সক্কাল সক্কাল কেন তামাসা করছেন দাদা? দিলেন তো সান্যালকে কাঁদিয়ে! দেখুন,আপনি চিনতে পারেন নি শুনে বেচারার প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।একটা হাসির রোল উঠল। সবাই বিষয়টা রসিকতা হিসেবেই নিলেন। কিন্তু অনন্তবাবু মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন। এরপর অনন্তবাবু সবার সাথে চা খেলেন ঠিকই। কিন্তু চায়ের স্বাদ গন্ধ কিছুই অনুভব করতে পারলেন না। কারণ,তখন তিনি অনন্ত চিন্তায় নিমজ্জিত।
অনন্তবাবুর চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। মাত্র সাতআট দিনের মধ্যে অতি পরিচিত কাউকে চিনতে না পারার ঘটনাটা দুবার ঘটল। কিন্তু কেন? কেন এরকম ঘটছে? তিনি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন? তাঁকে কি কোন রোগে ধরল? অনন্তবাবু অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছেন। অথচ কারও সাথে আলোচনা করতেও পারছেন না। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তাঁরভুলোরোগ ধরেছে, একথা কাউকে বলা যায় না। এমন কি গিন্নীকেও না। অন্যেরা শুনে হাসবে। কেউ আড়ালে,কেউ বা সামনেই ঠাট্টা তামাসা করবে। আর গিন্নী? সে বেচারী হয়তআমার কি হবেভেবে কেঁদে ভাসাবে। অতএব,কাউকে বলা যাবে না।
অনন্তবাবু বেশ সাবধান হয়ে গেছেন। সহজে কাউকে নাম ধরে ডাকেন না। কাউকে চিনতে না পারলেও কিছু বলেন না। কে জানে কাকে কি নামে ডেকে ফেলেন। তবে বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে। কারণ,আজকেও পাড়ার একজন ভদ্রমহিলাকে বাজারে চিনতে পারেন নি। অনন্তবাবু অবশ্য বুঝতে দেন নি। হেসেছেন,কথাও বলেছেন। তবে সবই ভাসা ভাসা। কারণ, ভদ্রমহিলা যে কে,তা-ই তিনি তখন মনে করতে পারেন নি।
না। কিছু একটা করতে হবে। অনন্তবাবু অনেক চিন্তাভাবনা করে শ্রীরামপুরের এক বাল্যবন্ধুর ফোন নাম্বার খুঁজে বের করলেন। বন্ধু উজ্জ্বল ডাক্তারী পাশ করেছে। ওর কাছেই একবার যাবেন।
বন্ধুর ওখানে খাতির যত্ন ভালই হল। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও ঢের হয়েছিল। খাওয়ার শেষে পান মুখে দুই বন্ধু গল্প করতে বসলেন। উজ্জ্বল বললেন,”তারপর? বল,তোর ব্যবসা কেমন চলছে?”
অনন্তবাবু বললেন,”মুদির দোকানের ব্যবসা আবার কেমন চলবে? চলছে কোনরকমে।
উজ্জ্বল হাসলেন। বললেন,”কেন বাবা? চেহারা দেখে তো কোনরকমে চালানো ব্যবসাদার বলে মনে হচ্ছে না। চেহারায় তো বেশ একটা অভিজাত ভাব,একটা চটক এসেছে।
অনন্তবাবু উশখুশ করছিলেন। এবার বলার সুযোগ পেয়ে বলেই ফেললেন,”তা দোকানটা মন্দ চলে না। বাড়িতে আমরা মাত্র তিনটে মানুষ। অসুবিধা কিছু হয় না। বরং খানিক ভবিষ্যৎ ভাবা যায়। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। তোর কাছে পরামর্শ নেব বলেই আজকে এখানে আসা।
বন্ধু আগ্রহ দেখালেন,”বল না কি ব্যাপার? কিছু সমস্যা হয়েছে?”
– “না,তেমন কিছু না। এই দেখ্ না। মাস ছয়েকের বেশী হবে। কি যে হয়েছে,মাঝে মাঝে চেনা মানুষকেও চিনতে ভুল হয়ে যাচ্ছে। কেন যে হচ্ছে,বুঝতে পারছি না। তুই ডাক্তার হয়েছিস। তাই ভাবলাম,তোর কাছেই যাই। তুই ঠিক বলতে পারবি।
এবার উজ্জ্বলের ভিরমি খাওয়ার পালা। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন,”সমস্যাটা সত্যিই গম্ভীর। তবে,তুই এখানেও ভুল করেছিস। আমি ডাক্তার হই নি। ডাক্তার হয়েছে সজল। এখন তোদের কলকাতাতেই আছে। আমি তোকে ওর ঠিকানা ফোন নম্বর সব দিচ্ছি। দেখিয়ে নে।               
আচ্ছা সজল! আমাকে কি অ্যালজাইমার ধরল?”
সজল হাসলেন,”আরে না। এই বয়সে অ্যালজাইমার হয় না। কোন কারণে মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়েছে। বইটই পড়,রোজ প্রাণায়াম কর,সব ঠিক হয়ে যাবে। কোন চিন্তা করিস না। আমি তো আছি।
মাস ছয়েক পরের কথা। বন্ধু ডাক্তারের কথামতো ওষুধ খেয়ে,বই পড়ে প্রাণায়াম করে অনন্তবাবু ভাল আছেন। ভুল হওয়ার ঘটনা অনেক কমে এসেছে। গত ছমাসে মাত্র একবার একটা ভুল হয়েছিল। অনন্তবাবু সেবার দ্রুত সামলে নিয়েছিলেন। কোন ক্ষতি হয় নি।
পার্ক সার্কাস ময়দানে বেঙ্গল সার্কাস তাঁবু ফেলেছে। এখনও চলছে। মেয়ে বায়না করছে। অনন্তবাবু মেয়েকে সার্কাস দেখাতে নিয়ে গেলেন। সার্কাস শেষ হওয়ার পর বাসে চড়া একটা যন্ত্রণা। অনন্তবাবু ট্যাক্সির সন্ধান করতে আরম্ভ করলেন। মিনিট পনেরোর চেষ্টায় একটা ট্যাক্সি পেয়ে যখন বাড়ি পৌঁছলেন,দেখলেন,মেয়েকে পার্ক সার্কাসেই ফেলে এসেছেন। অনন্তবাবু এবং তাঁর স্ত্রী,দুজনেরই তখন পাগলের মতো অবস্হা। কি করবেন এখন?
ট্যাক্সিচালক তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে ওদের নিয়ে পুরনো অবস্হানে ফিরে এলেন। না,মেয়েকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মাত্র দশ বছরের মেয়ে। কোথায় হারিয়ে গেল? অনন্তবাবুরা দুজনে পাগলের মতো চারিদিকে ছুটোছুটি করতে লাগলেন। সারা শরীর ঘামে ভেজা,দুচোখ থেকে অঝোরে অশ্রু বিসর্জিত হচ্ছে। অনন্তবাবুর স্ত্রী কাঁদছেন,কাঁদছেন অনন্তবাবুও,”হে ঈশ্বর! আমার ভুলের জন্য কি শাস্তি আমাকে দিলে? নিজের একমাত্র সন্তানকে আমি রাস্তায় ভুলে গেলাম? আমি কি করলাম? ফিরিয়ে দাও ঠাকুর! ফিরিয়ে দাও!”
না। গভীর রাত পর্যন্ত খুঁজেও পেলেন না মেয়ের সন্ধান। হারিয়েই গেল অনন্তবাবুর চোখের মণি একমাত্র সন্তান।
অনন্তবাবুর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। স্ত্রী স্হায়ীভাবে বিছানা নিলেন। গোছানো সংসার অবিন্যস্ত হয়ে পড়ল। অনন্তবাবুর স্ত্রী খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন। অনন্তবাবুর অবস্হাও একরকম তাই। তাঁর একমাত্র কাজ হারানো কন্যার খোঁজ করা। দিন নেই,রাত নেই,যখন যেখান থেকেই কোন ইঙ্গিত পান ছুটে যান। ফল হয় না কিছুই। শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়।
মাস খানেক এভাবেই কাটল। অনন্তবাবুর শরীর ভাঙছে। চরম অনিয়মের ধকল শরীর আর বইতে পারছে না। সকালে একবার বজবজ গিয়েছিলেন। কোন সন্ধান পান নি। বাড়ি ফিরে এক ঘটি জলেই খিদেতেষ্টা সব মেটালেন। দাওয়ায় বসে একটু দম নিচ্ছিলেন। একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। পুলিশের গাড়ি। দুজন পুলিশ কর্মচারীর সাথে অনন্তবাবুর হারানো মানিক। উত্তেজিত অনন্তবাবু লাফিয়ে উঠতে গেলেন। দুর্বল শরীর বিদ্রোহ করল। অনন্তবাবু মেঝেতে পড়ে গেলেন। জ্ঞানও হারালেন। যখন জ্ঞান ফিরল দেখলেন,পুলিশ কর্মচারীদের মধ্যে একজন স্থানীয় থানার বড়বাবু। মিটমিট করে হাসছেন। বললেন,”আমাদের উপরে একদম বিশ্বাস নেই,তাই তো?”
দুর্বল গলায় অনন্তবাবু বললেন,”না। ঠিক তা নয়।
বড়বাবু মৃদু ধমকের সুরে বললেন,”তা যদি না হয় তাহলে দুজনে একসাথে মরতে যাচ্ছেন কেন? মেয়েকে কে দেখবে, হ্যাঁ?”
এই দুর্ঘটনার পর অনন্তবাবুরভুলোরোগ পুরোপুরি সেরেছে কিনা ঠিক জানি না। হয়ত সেরেছে।
               —- শেষ —-
*******************************
চন্দ্রকান্তি দত্ত
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।

 

1 Comment

  • Chanchal Kumar Chakraborty

    Khub valo likhechhen.Ei saririk o manosik obosthateo eto gochhano,ek kothay,’Osadharon’. Valo thakun. Porer golper pratiksha roilam.

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!