” আয় তবে সহচরী ……. “
ব্রতী ঘোষ
দীপম স্যারের কোচিং এ আসতে আজকে বেশ দেরি হয়ে গেছে নীলের | কোনরকমে সাইকেলটাকে রেখে হুড়মুড় করে ও যে চেয়ারটা খালি পায় সেটাতেই আজ বসে পড়ে | দীপন স্যার অঙ্ক করান | এমনিতে স্যার খুব ভালো কিন্তু দেরি করে ক্লাসে ঢুকলে স্যার বেশ রেগে যান | ওদের সবার নির্দিষ্ট চেয়ার আছে। কিন্তু আজ দেরি হয়ে যাওয়াতে নীল সৃজনের খালি চেয়ারটাতে বসে পড়ে। ওর স্যার অঙ্কের বই থেকে চোখটা তুলে একবার নীলকে দেখে নিলেন। নীল একবারও স্যারের দিকে তাকালো না। অঙ্কতে খুব একটা চৌখশ কোনদিনই নয় নীল কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালে স্যারের অদ্ভুত একটা মায়া হয়। আর সেই জন্য নীলকে কিছু বলতে পারেন না উনি। নীল পৌঁছবার আগেই স্যার দুটো অঙ্ক করিয়ে ফেলেছেন | কি হবে এখন ? ক্লাস শেষ হওয়ার পর তড়িঘড়ি ক্লাস থেকে বেরিয়ে নীল স্যারের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর সম্প্রীতি বেরোয় |
‘কি রে নীল ? তুই আজও দেরি করলি ? ‘
‘কি করবো বল ? পাঁচটা থেকে তো কম্পিউটার পড়া ছিল | যাগ্গে,তুই আগের অঙ্ক দুটো আমাকে দে |’
নীল মোবাইলে অঙ্ক দুটোর ছবি তুলে নেয় |
‘হ্যাঁ রে ! সৃজন আজ এলো না কেন রে ? ‘ সম্প্রীতি চুলটা ঠিক করতে করতে বলে | ‘জানিনা তো !! ‘
‘এই ! আমাকে আজ একটু বাড়িতে ছেড়ে দিবি রে ? বাড়ি থেকে বেরোবার সময় দেখি সাইকেলের চাকায় হাওয়া নেই | ‘
‘হ্যাঁ হ্যাঁ চল্ ! এ আর এমন কি ? ‘
নীলের জন্মদিনে ওর বাবার দেওয়া সাইকেলটা আজ সার্থক হল | আচ্ছা সম্প্রীতি কি শ্যাম্পু মাখে চুলে ? জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করে না নীল | হঠাৎ বুকের ভেতরটা বেশ ধড়াস ধড়াস করছে |
‘নীল ! এই নীল ! কিরে ? সাড়া দিচ্ছিস না কেন ?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বল্ ! ‘ নীলের সম্বিৎ ফিরে আসে |
‘তোর কি হলো বলতো ?’
নীলের কি হলো তা যদি সত্যিই ও বলতে পারতো সম্প্রীতিকে |
‘আচ্ছা শোন্ ! পরের শনিবার স্যার অঙ্ক পরীক্ষা নেবেন,মনে আছে তো ?’ সম্প্রীতি বলে |
‘হ্যাঁ !’ অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয় নীল |
কেন যে এই অঙ্কটা নিতে গেল ও ? শুধুমাত্র সম্প্রীতির সঙ্গে কোচিং করবে এই লোভে ? কিন্তু এখন মাঝে মাঝেই নিজের মাথাটা দেওয়ালে ঠুকতে ইচ্ছা করে |
পরদিন সকালে–
‘নীল ! এই নীল ! দেখ ! সৃজন তোকে ডাকছে |’ মায়ের ডাকে জামার বোতামটা আটকাতে আটকাতে নীল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে | ছোটবেলা থেকেই এই একটাই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। দুজনে ঝগড়াও করবে আবার একসঙ্গে ঘুরতেও যাবে ।
‘কিরে ? সকাল সকাল কি ব্যাপার ? কাল দীপন স্যারের কোচিং এ গেলি না কেন রে ?
কিরে কিছু বলছিস না যে ?’ নীলের কথার কোন উত্তর দেয় না সৃজন |
ক্লাস নাইনে পড়ে দুজনেই | কিন্তু নীলের থেকে সৃজন যেন একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেছে। কালো কালো ঝাঁকড়া চুল,গালে ব্রণ ভরে গেছে | সব সময় হৈ হৈ করছে–এক্কেবারে দিল খোলা–হা হা করে হাসছে | সৃজনকে নীলের এই জন্যই বেশি ভালো লাগে। অথচ আজকে ওর মুখটা ভারি শুকনো লাগছে–নীল ভাবে |
‘নীল ! সম্প্রীতি কিছু বলেছে তোকে ? ‘
‘কি বলবে? ‘
‘এই আমার কথা ? ‘
‘না তো ! কি হয়েছে ?’ নীল বেশ অবাকই হয়। গতকাল সম্প্রীতি ওকে কিছু বললো না তো |
‘আমি সম্প্রীতিকে খুব ভালোবাসি নীল | গতকাল স্কুল থেকে বেরোনোর সময় ওকে বলে দিয়েছি এই কথা |’
‘তোর কি সাহস সৃজন ? তুই বলতে পারলি ?’
আমি ওকে বলেছিলাম যে ও যদি আমাকে একসেপ্ট করে তাহলে যেন একটা মিসড্ কল দেয় । কিন্তু ও কোন কলই দেয়নি, তাই আমি গতকাল পড়তে যাইনি।
‘ধুর বোকা ! এইজন্য কেউ পড়তে যায় না ? তুই পারিস বটে,এখন কি এসব করার সময় ? সামনে প্রি টেস্ট আর তুই এখন সম্প্রীতির সঙ্গে এইসব করছিস ? তোর লজ্জা করে না ?’
সৃজন মাথা নিচু করে বসে থাকে ।
‘দেখ ভাই। এখন একটু পড়াশোনায় মন দে | সারা জীবন তো আছেই এসব করার জন্য।‘ নীলের এতো জ্ঞানদানে সৃজনের মাথাটা গরম হয়ে যায় | বলে,’ধুর! থাম তো! সেই এক কথা–যেমন বাবামায়েরা বলে | বলি পড়াশোনা শেষ করা পর্যন্ত সম্প্রীতি কি আমার জন্য বসে থাকবে ?’
সৃজন রেগে গিয়ে চলে যায়। সৃজনের কথাগুলো নীলকে যেন নাড়া দিয়ে যায়।
‘সম্প্রীতি কি আমার জন্য বসে থাকবে ?’
২
আচ্ছা ! এই যে নীল সম্প্রীতির সঙ্গে কোচিং ক্লাস করবে বলে ক্লাস নাইনে অঙ্কটা নিল আর এখন সম্প্রীতি চলে যাচ্ছে সৃজনের হাত ধরে ? গতকাল যে এতক্ষণ সম্প্রীতি ওর সঙ্গে থাকলো অথচ কিছুই বলল না সৃজনের কথা | সত্যি ! মেয়েরা এরকমই হয় | ওরা কিছুতেই ভালো বন্ধু হয় না ।
পরদিন দীপম স্যারের কোচিংয়ে নীল একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছল | পৌঁছে দেখলো সম্প্রীতি ওর আগেই চলে এসেছে |
‘কিরে নীল ? আজ এত তাড়াতাড়ি এলি?’ নীল যেন সম্প্রীতির কথা শুনেও শুনলো না | ‘কিরে তোর কি হয়েছে ?’
এর পরই দীপম স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। যে যার মত ক্লাস করে বাড়ি ফিরে গেল। ক্লাস থেকে বেরোনোর আগে স্যার নীলকে জিজ্ঞাসা করলেন,’হ্যাঁ রে নীল ! সৃজনের কোন খবর আছে? ও আসছে না কেন ?’
‘আমি ঠিক জানিনা স্যার |’
‘তোর বন্ধু, তুই জানিস না ? আজকেই খোঁজ নিবি | বুঝলি ?’
ক্লাস শেষ হবার পর নীল হুড়মুড় করে বেরিয়ে সাইকেলটা তাড়াতাড়ি চালিয়ে চলে যায় | সম্প্রীতির মুখোমুখি ও কিছুতেই হতে চায় না। প্রথম কারণ সৃজন ওকে ভালবাসে কাজেই নীলের মনে যা কিছু আছে সব ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে। আর দ্বিতীয়ত: সেদিন সম্প্রীতি ওকে সৃজনের কথাটা বলতে পারতো তো ! এই না বলাটা নীল কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না |যদিও বা সম্প্রীতিকে ও আপ্রাণ ভুলে যেতে চেষ্টা করবে কিন্তু এই অঙ্ক নিয়ে ও এখন কি যে করবে ? ওর যে অঙ্ক পড়াই সম্প্রীতির জন্য | বাবা কতবার বারণ করেছিলেন কিন্তু ওর যে আত্মবিশ্বাস ছিল যে সম্প্রীতির জন্য ও অঙ্কে পাস করে দেখাবেই | কিন্তু সম্প্রীতির সঙ্গে ও যদি কথাই না বলে তবে যে ওর আত্মবিশ্বাস একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে |
সম্প্রীতির কাছে নীলের এই আচরণ সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার | ও বুঝতে পারে সৃজনের সব ঘটনা নীল জানতে পেরেছে আর তাই এইরকম তড়িঘড়ি ওর চলে যাওয়া | আর সৃজনটাই বা কি? ছেলেটা এত ইমোশনাল ? ও ভেবেছিল সৃজন বুঝি মজা করে বলছে যে ও আর স্কুলে,কোচিংয়ে আসবে না | কোন মানে হয় ? কিন্তু সৃজন যে ওর খুব ভালো বন্ধু আর বন্ধু হলেই কি প্রেম ভালোবাসা এসব করতে হবে? এই ছেলেগুলো না একেবারে ডিসগাস্টিং | সেই ‘তোর জন্য মরে যাব‘,’তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি‘,এই কথাগুলো শুনলে ওর কেমন গা ঘিন ঘিন করে | আরে বাবা ! বন্ধু হবি তো হ‘ না ! এসব কেন? আর নীলটাও একই রকম | আসলে সব ছেলেগুলোই একরকম,ন্যাকা ন্যাকা বোকা বোকা |
‘তুই আজও কোচিংয়ে এলি না সৃজন ?’ ফোনের ওপাশে সৃজন চুপ করে আছে |
‘তুই কি বোকামি করছিস বল তো? তুই পড়া ছেড়ে দিলে সম্প্রীতির কিছু আসে যায়? আর তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস কোথায়?’
‘ আমি এখন গিটার শিখছি। গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে পয়সা রোজগার করব।‘
‘তোর মাথাটা পুরো গেছে সৃজন |’
নীল বুঝে উঠতে পারে না ওর এখন কি করা উচিত! ওকি সৃজনের মা রত্না আন্টিকে সব খুলে বলবে ? নাকি ওর মাকে বলবে ? নাকি সম্প্রীতি কে বলবে ? এদিকে সামনেই পরীক্ষা,তার প্রস্তুতি আছে |
৩
দিন দুয়েক পরে –
সুপ্রিয়া নিজের ছেলেকে খুব ভালো করে চেনেন | দুদিন হয়ে গেল নীল ঠিক করে খাচ্ছে না,কথা বলছে না,কথায় কথায় মেজাজ দেখাচ্ছে | না: যে করে হোক আজ জানতেই হবে যে ছেলেটার কি হয়েছে! রাতে সুশোভনকে লুকিয়ে চুপিচুপি নীলের কাছে যায় সুপ্রিয়া | মাকে নিজের ঘরে দেখে একটু অবাকই হয় নীল | তবে ও জানে মুখে কিছু না বললেও মা ওর মনের কথা সব বুঝতে পারে সেই ছোট্টবেলা থেকে |
‘নীল ! বল আমাকে কি হয়েছে?’ মাথায় হাতটা বুলিয়ে সুপ্রিয়া ছেলের মাথাটা কাছে টানতেই নীল ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সুপ্রিয়া সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। বুঝে উঠতে পারেন না কি বলবেন |
‘আচ্ছা ! আমি রত্নাকে সব বুঝিয়ে বলবো | তুই একটা সত্যি কথা বলতো ! তুই কি সম্প্রীতির জন্যই অঙ্কটা নিয়েছিস ?’ নীল মাথা নিচু করে থাকে।
সুপ্রিয়া জানেন নিজের ছেলেকে যতই সান্ত্বনা দিক না কেন যে রত্নাকে বুঝিয়ে বলবেন কিন্তু এ কথা ও জানেন রত্না সবকিছু বোঝার পাত্রী নন। উল্টে রত্না সম্প্রীতির মার কাছে গিয়ে হয়তো বা উল্টোপাল্টা কিছু বলে আসবেন। এদিকে নিজের ছেলেকে ও চেনেন,হয়তো বা এবারে ও অঙ্কে গাড্ডু খাবে। কি যে ঝামেলায় পড়া গেল | তবে একথাও ওর কাছে বেশ স্পষ্ট যে সম্প্রীতির মনে কিন্তু এই দুজনকে নিয়ে কোন দুর্বলতাই নেই | এদেরকে ও বন্ধু হিসেবেই পেতে চায়। সারারাত এইসব ছাই পাশ চিন্তা করতে করতে ঘুমই এলো না সুপ্রিয়ার। শেষে মাথায় এলো যে একবার যদি সম্প্রীতির মা জয়ন্তীর সঙ্গে কথা বলা যায়। ওকে অনেকটা বোঝদার বলে মনে হয়| জয়ন্তীর সঙ্গে সুপ্রিয়ার কথা হলো | জয়ন্তী সব শুনে বললেন,’কোন প্রয়োজন নেই। ওদের সমস্যা ওরা নিজেরাই বুঝে নেবে।‘
মুখে কিছু না বললেও জয়ন্তীর কথাটা সুপ্রিয়ার ঠিক মনের মত হলো না। তবে ওরা সত্যিই নিজেদের সমস্যা নিজেরা মেটাতে পারবে কিনা সেটা দেখা ছাড়া আর উপায়ই বা কি !
এক সপ্তাহ হয়ে গেল সৃজন স্কুলে আসে না, টিউশনে আসে না | ওর বাড়ির লোকরাই বা কি? ওরা কি জানে না যে সৃজন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে ? সম্প্রীতির মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। শতহোক,একসময় তো সৃজন ওর খুব ভালো বন্ধু ছিল আর নীল ও তো কথাই বলছে না | যেন সব দোষ সম্প্রীতির | অথচ এই নীল আর সৃজনই ওর সবচেয়ে বেশি বন্ধু ছিল | আজকে আবার দীপন স্যারের কোচিং এ পরীক্ষা আছে। সম্প্রীতি পরীক্ষার দিকেই মনটাকে দেবার চেষ্টা করলো প্রাণপণে | বিকেলে পরীক্ষা শেষ হতেই নীল তড়িঘড়ি বাড়ি চলে গেল | সম্প্রীতি ভেবেছিল আজকে সৃজনের কথা জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু নীল সুযোগই দিল না |
৪
দেখতে দেখতে আরো দুটো দিন কেটে গেল | আজ দীপন স্যারের অঙ্ক পরীক্ষার খাতা বেরোবে | স্যার সবাইকে হাজির থাকতে বলেছেন | সম্প্রীতি বেশ অবাকই হয়ে গেল যখন দেখলো যে সৃজন সেদিন টিউশনে এসেছে। আজ সকাল থেকে নীলের বুক দুড়দুড় করছে। পরীক্ষা যে কি হয়েছে সে তো ও ভালো করেই জানে | আর দীপম স্যার যে ওকে কি করবেন সেটা ভেবেই ওর আরো পেট গুড়গুড় করছে | যথারীতি অংক পরীক্ষার খাতা বেরোলো | ক্লাসে দশ জনের মধ্যে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে নীল আর সবচেয়ে বেশি পেয়েছে সম্প্রীতি | আর সৃজন তো পরীক্ষাই দেয় নি | কিন্তু ওর মাকে ফোন করে স্যার সব জানিয়েছেন | আর আজ মায়ের ব্যাপক মার খেয়ে সৃজন মুখ গোমড়া করে ঘরের এক কোনায় বসে আছে | দীপন স্যার নীলকে বেশি কিছু বকলেন না । শুধু বললেন,’এইভাবে চললে তুই ক্লাস টেনে উঠবি? কে বলেছিল তোকে অঙ্ক নিতে?’ সম্প্রীতির সামনে নীলের আর মান সম্মান বলে কিছু রইল না | ছি: ছি : এরপর কি করে যে ও সম্প্রীতিকে মুখ দেখাবে? এই সৃজনটার জন্য যত ঝামেলা হলো | কে বলেছিল তোকে এত প্রেম নিবেদন করতে? নীলের মনটা যে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে গেল সে খবর কি আর সৃজন রাখে না সম্প্রীতি রাখে? ও ঠিক করে ফেলেছে যেও হেড স্যারের পায়ে ধরে বলবে যে ও আর অঙ্ক করতে পারবেনা | স্যার নিশ্চয়ই ওকে কমার্স স্ট্রিমে ভর্তি করিয়ে দেবেন | ও কি করবে অঙ্কটা যে ওর মাথায় একদম ঢোকে না ! কিন্তু সম্প্রীতি যখন একটু হেসে কথা বলে তখন যে ওর মনে হয় এই হাসিটার জন্য ও সবকিছু করতে পারে | স–ব ! সব অঙ্ক গড়গড় করে দিতে পারে | কিন্তু এখন সম্প্রীতিও নেই,হাসি তো দূর অস্ত! ওর সঙ্গে কথা বলাও অন্যায় | সৃজন যে ওর জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বসেছে আর ও সৃজনের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে কি করে সম্প্রীতির সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখে? স্যার আজকে সৃজনকে আর কিছু বললেন না | ওর মুখ দেখেই বোধহয় বুঝেছিলেন যে আজ ওর উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে | শুধু ওকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর বললেন মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। কোচিং শেষ হতেই সম্প্রীতি সবার আগে বেরিয়ে দাশুদার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল | ওর মন বলছিল নীল আর সৃজন ওই দিক দিয়েই যাবে। ওদের আসতে দেখেই ও একটু আড়ালে সরে গেল | নীল আর সৃজন দাশুদার দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর কথা বলছে । আড়ালে দাঁড়িয়ে ও শুনতে পেল দুই বন্ধুর কথোপকথন ।
‘না: নীল এই দু সপ্তাহ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আমি খুব ভুল করেছি | বুঝলি?’
‘ও ! এই কথাটা মার খাওয়ার পর বুঝলি?’ ‘না রে!’ সৃজন কেমন উদাস গলায় বলে। ‘মায়ের এত মার খাবার পর একটুও বুঝিনি। বুঝলাম–বাবা এসে যখন বললেন যে আমার এ মাসের স্কুলের মাইনে দেবার জন্য অফিস থেকে টাকা ধার করেছেন তখন আমার মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল। বাবাকে কথা দিয়েছি আর কোনদিন এরকম করবো না।‘
নীল আনন্দে সৃজনকে জড়িয়ে ধরলো | ‘তোকে একটা সত্যি কথা বলবো সৃজন ? আমারও না সম্প্রীতিকে খুব ভালো লাগে। জানিস তো–ওর জন্য না আমি অঙ্ক নিয়েছি। আর দেখেছিস তো? আমার অবস্থা ?’
নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে সৃজন ফিক করে হেসে ফেলে | তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে বলে‘ শালা ! তোর পেটে পেটে এত?’ সম্প্রীতি বোঝে এবার আর ওদের মধ্যে ওকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই | ও বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে। বলে,’বাহ! আমে দুধে তো বেশ মিশে গেল। আর আমি বুঝি আঁটি?’ নীল আর সৃজন দুজনেই হতচকিত হয়ে সম্প্রীতির দিকে তাকায়।
‘আর আমি কি দোষটা করলাম শুনি? দুজনে মনে মনে উল্টোপাল্টা ভাববে আর তার ফল বুঝি আমাকে ভুগতে হবে? আমার বুঝি কষ্ট হয়না ?’
নীল আর সৃজন দেখে সম্প্রীতির মুখটা দুঃখে একেবারে মাখামাখি।
‘নীলের অঙ্ক নেবার কারণ আমি জানি।‘
নীল মাথা নিচু করে | এ লজ্জা ও কোথায় রাখবে ?
‘শোন এবার থেকে আমি যেভাবে বলবো সেভাবে অঙ্ক করবি | বুঝলি ?
নীল হেসে ফেলে তাকায় সম্প্রীতির দিকে। ‘বোকা ছেলে দুটো | এবার থেকে আমরা তিনজনেই আবার আগের মতো খুব ভালো বন্ধু থাকবো | কেমন ?’
সৃজন চুপ করে থাকে |
নীল সৃজনের হাতটা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় সম্প্রীতির হাতের দিকে ।
****************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷