গুপ্তিপাড়ার রথ
অনির্বাণ সাহা
রথের কথা এলেই সর্বপ্রথমে আমাদের মাথায় আসে পুরীর রথের কথা। যে রথটি ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ রথ। পুরীর রথের পরে যে রথটি উচ্চতার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে,সেটি হল আমাদের বাংলার অতি প্রাচীন জনপদ গুপ্তিপাড়া এলাকার রথ। এটি ভারতের দ্বিতীয় এবং পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম দূরত্ব (প্রায় ২ কিলোমিটার) অতিক্রম করে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি পৌঁছানোর জন্য। শুধু তাই নয় প্রাচীনত্বের দিক থেকেও এটি ভারতের চতুর্থ প্রাচীনতম রথ হিসাবে বিবেচিত হয়। আবার গুপ্তিপাড়ার রথ বাংলার সর্ববৃহৎ কাঠের রথ। এরূপ ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ রথযাত্রা সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো বিশেষভাবে অবগত নই। তবে আজ যে রথটিকে আমরা দেখি সেটা প্রাচীন রথটি নয়।
“পথের আলাপ” ওয়েবপেজে ১১শে ডিসেম্বর,২০১৯ তারিখে প্রকাশিত “গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,১৭৪৫ সালে (মতান্তরে ১৭৪০ সাল) আলীবর্দী খাঁয়ের সমসাময়িক সময়ে গুপ্তিপাড়া মঠের নবম দণ্ডীস্বামী পীতাম্বরানন্দের আমলে এই রথের যাত্রা শুরু হয়। এই রথযাত্রার প্রচলন হওয়ার পিছনে মধূসুধানন্দ নামক এক জনৈকের বিপুল অবদান রয়েছে বলেও অনেকে দাবি করে। এই রথটি তৎকালীন সময় থেকে আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কাঠের রথ হিসেবে রয়েছে। মূল বৈশিষ্ট্য হল এটি মূলত বৃন্দাবন চন্দ্রের রথ, সাথে অবশ্যই থাকেন জগন্নাথ বলরাম এবং সুভদ্রা। রথের মাঝের তলায় দেবতার সাথে তৎকালীন সময়ে বসানো হত নানান রকম কাঠের পুতুল । তাদের মধ্যে প্রধানত ছিল কলসী কাঁখে নারী,মাছ কুটছে মেছুনী,ঢোলক বাজাচ্ছে বৃহন্নলা,শিশুকে স্তন্যদান করছে মা, ইঁট ছুঁড়ছে ডাকাতেরা,আর তাদের শায়েস্তা করার জন্য পুলিশেরা। বহুবার এই রথের কাঠামোর সংস্কার এবং পরিবর্তন সত্ত্বেও এই রীতি বর্তমানেও অবিকল এবং অবিচল। এই সকল পুতুল বা মূর্তি থেকেই তৎকালীন সমাজের একটা সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি আজও আমরা দেখতে পাই। এইসব মূর্তির কারিগর হিসেবে তৎকালীন সময় থেকেই অমর হয়ে আছেন এবং চিরকাল থাকবেন পূর্ব সাতগাছিয়ার মৃৎশিল্পী শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম পাল।
গুপ্তিপাড়ার রথটিতে রয়েছে চারটি তলা। বর্তমানে এই রথটি দৈর্ঘ্যে ১৮ফুট সাড়ে ৬ইঞ্চি,প্রস্থে ২৮ফুট সাড়ে ৬ইঞ্চি এবং উচ্চতায় ৫১ফুট। রথটিতে মোট ৫ফুট ৩ইঞ্চি ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট ১৬টি চাকা রয়েছে। এই রথটি নবরত্ন অর্থাৎ নয়টি চূড়া বিশিষ্ট রথ। তবে জানা যায় প্রাচীনকালে এই রথটি ছিল তেরো রত্ন বিশিষ্ট অর্থাৎ মোট তেরোটি চূড়া ছিল এই রথটিতে। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে,প্রাচীনকালে এই রথটি দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে বর্তমানের থেকে বেশ কিছুটা বড় ছিল। কিন্তু একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর এই রথটির সংস্কার করা হয়। তখনই চূড়ার সংখ্যা কমিয়ে ১৩ থেকে ৯ করা হয়। দীর্ঘ ১২৫ বছরের বেশি সময় ধরে তেরো চূড়া বিশিষ্ট এই রথটি সফলতার সাথে তার যাত্রা সম্পন্ন করলেও ১৮৭৩ সাল নাগাদ ঘটে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। উক্ত বছরের উল্টোরথের দিন চলন্ত অবস্থায় রথের চাকার তলায় পৃষ্ঠ হন ৭ জন পুণ্যার্থী। এছাড়াও অনেকে গুরুতর ভাবে জখম হয়। এমনকি স্বয়ং তৎকালীন মঠাধ্যক্ষ তেইশতম দণ্ডীস্বামী পৃত্থ্বানন্দ মহারাজও গুরুতর ভাবে আহত হয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন। এই মর্মান্তিক ঘটনার পরেই রথের আকার ছোট করার সিদ্ধান্ত নেন,এই ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষ্যদর্শী অপর এক দণ্ডীস্বামী পূর্ণানন্দ মহারাজ। তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো এটিই গুপ্তিপাড়ার রথের প্রথম দুর্ঘটনা নয়। শিবশঙ্কর ভারতী লিখিত “সেকালের পুজো পার্বণ মেলা উৎসব” নামক বইটি থেকে জানা যায় যে,১৮৪৫ সালে “কলকাতা রিভিউ” পত্রিকায় রেফারেন্ট লং নামক ব্রিটিশ এক সাহেব উক্ত বছরের গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় উক্ত বছরে গুপ্তিপাড়ার রথকে কেন্দ্র করে প্রচুর জনসমাগম দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। উক্ত বছরে এই রথযাত্রায় উপস্থিত হবার জন্য একদল পুণ্যার্থী জলপথে নৌকা করে আসছিলেন। তবে নৌকাটি উল্টে গিয়ে গঙ্গায় ৪৫ জন পুণ্যার্থীর সলিল সমাধি ঘটে। কি কারণে এই নৌকাটি হঠাৎ করে গঙ্গায় উল্টে গেল,তার সঠিক তথ্য প্রমাণ যদিও জানা যায়নি। তবে মনে করা হয় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের ফলেই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকেই রথটিকে আকারে ও আকৃতিতে ছোট করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টাকে ফলপ্রসূ বা বাস্তবায়িত করতে সময় লেগে যায় প্রায় আটটি বছর। ১৮৭৮ সাল নাগাদ রথটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করা হয়। ওই সময়েই পূর্বের ১৩টি চূড়া থেকে রথটির চূড়া সংখ্যা নামিয়ে নিয়ে আসা হয় নয়টিতে। ফলত রথটি আকারে, আকৃতিতে এবং আয়তনে পূর্বের থেকে যথেষ্ট ছোট হয়। তবুও শ্রীরামপুরের মহেশের রথের থেকে তার আকার আকৃতি ও আয়তন অনেকটাই বেশি ছিল। এরপরেও প্রয়োজনমতো ছোটখাটো কিছু সংস্কার রথটিতে সময় অনুযায়ী হয়েছে। ১৯৫৭ সালে এলাকায় বন্যার প্রকোপ দেখা যায়। এই বন্যায় রথটিও প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মঠের আঠাশতম দন্ডীস্বামী খগেন্দ্রনাথ আশ্রমের তত্বাবধানে আর গুপ্তিপাড়াবাসীর সক্রিয় অর্থ সাহায্যে ১৯৫৮ সালে আবার রথটি তৈরী করা হয়। ১৯৭৮ সাল নাগাদ আবার এই অঞ্চলটি বন্যার কবলে পড়ে। রথটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুনরায় তার কিছু সংস্কার করা হয়। ২০০০ সালের বন্যায় রথটি তৃতীয় বারের জন্য পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পুনরায় তার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এই নয় চূড়া বিশিষ্ট রথটিই ২০১২ সালেও সচল ছিল। সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বিভিন্ন রকম দিক থেকে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়ে সংস্কার সম্ভবপর হয়নি দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালে ২০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় রথ পুনর্গঠন কমিটি। এই কমিটির মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ও পুরাতত্ব বিভাগে বহুবার দরবার করা হয়েছে রথটির সংস্কারের জন্য। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণবশত সংস্কারের কার্য শুরু হয়নি। কেটে যায় আরো কয়েকটা বছর। অবশেষে নবদ্বীপ পুরাতত্ব পরিষদের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ব ও প্রত্নতত্ব বিভাগকে মন্দির,রথের পুতুল আর কাঠামো দেখানো হয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে। তাতেও বিশেষ কিছু লাভের লাভ হয়নি কোন এক অজ্ঞাত কারণে । ২০১১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তারিত খবর প্রকাশ করে। এরপরে বিডিও সাহেবের উদ্যোগে আবার সরকারী দপ্তরে দরবার করা শুরু হয়। এবার মেলে এক সদর্থক ফল। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর তহবিল থেকে দশলক্ষ টাকা মঞ্জুর করা হয় রথ ও মন্দির সংস্কারের জন্য। অবশেষে ২৫শে এপ্রিল,২০১৩ (বৃহস্পতিবার) নতুন করে রথ নির্মাণ শুরু হয়। বর্তমানে এই নবনির্মিত রথটিকেই আমরা দেখতে পাই।
গুপ্তিপাড়া রথের কথা এলেই প্রসঙ্গত চলে আসে রথের দিনের রথযাত্রা উৎসবের পূর্বে পালিত তিনটি রীতির কথা। সেগুলি হল নিম্নরূপ :
জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা :
রথ যাত্রার কথা এলেই সর্বপ্রথম যেটা আমাদের মাথায় আসে তা হল জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা। এই স্নানযাত্রার রীতিটি পালিত হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পূর্ণিমার দিন দুপুরে। এই রীতিটি এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অতি পুণ্য ও উল্লেখযোগ্য রীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। মঠে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার দারুমূর্তির স্নানযাত্রার রীতি বা অনুষ্ঠানটি পালিত হয় একটি দোলমঞ্চে। এই মঞ্চটি মঠের উত্তর–পশ্চিম কোণে অবস্থিত। মঞ্চটির বহির্ভাগ শ্বেত–শুভ্র রঙে রঞ্জিত। দুটি তল বিশিষ্ট নিচের তলে রয়েছে একটি দরজা। দ্বিতীয় তলে যাবার সিঁড়িটি মঠের ভিতরের মাঠ দিয়ে রয়েছে। যেখান দিয়ে সরাসরি দ্বিতীয় তলে যাওয়া যায়। এই সিঁড়ি দিয়েই স্নানযাত্রার দিন জগন্নাথ বলরাম এবং সুভদ্রাকে দোলমঞ্চের দ্বিতীয় তলে নিয়ে গিয়ে একটি টিনের পাতে মোড়া কাঠের চৌকির উপর রাখা হয়। তারপর গুনে গুনে ১০৮ ঘড়া জল দিয়ে তাদের স্নান করানো হয়। স্থানীয়দের কাছে জগন্নাথ দেবের স্নানের এই জল অতি পবিত্র। কেউ কেউ স্নানের এই জল মাথায় নেন আশীর্বাদস্বরূপ। আবার কেউ কেউ বোতলে করে নিজে বাড়িতে নিয়ে যান পবিত্র জল হিসেবে। আবার স্থানীয়দের মধ্যে অনেকে মনে করেন স্নানের এই জল পান করলে অনেক রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
কলমী শাক ও পটলের বালিশে শয়ন :
প্রতিবার স্নানযাত্রার দিন ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করার পর জগন্নাথ দেবের তুমুল জ্বর আসে। রথযাত্রার আগের দিন অব্দি তিনি নিজেকে মন্দিরের গভৃ গৃহের মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন। এই সময় এই এলাকার রীতিনীতি অনুসারে জগন্নাথ দেব কলমী শাকের বিছানায় শয়ন করেন এবং মাথা রাখেন পটলের বালিশে। ১৫ দিন এই অবস্থায় থাকার পর রথযাত্রার দিন তিনি গর্ভগৃহ থেকে বের হন দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে। এই সময় গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের স্থানীয়রা কলমি শাক ও পটল এই দুটি জিনিস ভক্ষণ করেন না। আবার অনেক ঐতিহাসিক এবং অনেক স্থানীয়রাও মনে করেন জগন্নাথদেবের জ্বর আসাটা একটি গল্পকথা মাত্র। কারণ সারা বছরের বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে এবং ১০৮ ঘড়া জল ঢালার পরে জগন্নাথ,বলরাম এবং সুভদ্রার গায়ের রং অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। এই অবস্থায় দেব–দেবীর বিগ্রহগুলি দর্শনার্থী বা পুণ্যার্থীদের সামনে বার করাটাও ঠিক নয় বা সম্ভব নয়। আর সেই কারণেই এই সময়কালের মধ্যে এই দারু মূর্তিগুলি রং করে শুকানো হয়। এই রং করা এবং সেগুলি শুকনোর জন্য এই সময়কালের মধ্যে এই তিন বিগ্রহগুলিকে সকলের চক্ষুর অন্তরালে গর্ভগৃহে আবদ্ধ রাখা হয়।
নেত্রোৎসব :
জগন্নাথদেবের জ্বর সেরে গেলে বা নবকলেবরে সুসজ্জিত হয়ে ১৫ দিন পর রথযাত্রার ঠিক আগের দিন বিশেষ পূজা এবং হোম–যজ্ঞ সহযোগে গর্ভগৃহ থেকে বার হন। উক্ত দিনটি হয় আষাঢ় মাসের কোন পক্ষের প্রতিপদের দিন। এই অনুষ্ঠানটি স্থানীয় গুপ্তিপাড়া এলাকায় নব যৌবন বা নেত্রোৎসব নামে পরিচিত। আগেকার দিনে এলাকার স্থানীয়দের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটি “টাটিভাঙ্গা দর্শন” নামেও পরিচিত ছিল। এর ঠিক পরের দিনই অর্থাৎ শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার দিন হয় রথযাত্রা। এই দিনটিতে পুরাতন রীতি অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত কোনো মেলা আয়োজিত হয় না।
রথের দিন সকাল থেকেই চলে রথ সাজানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি। বিভিন্ন প্রকার ফুল ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে রথটিকে সুসজ্জিত করে তোলা হয়। বেলা ঠিক বারোটার সময় প্রথম টান দেওয়া হয় রথের দড়িতে। উক্ত দিন সকালে বিশেষ পূজাপাঠের পর গর্ভগৃহ থেকে একে একে জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রাকে রথের সামনে নিয়ে আসা হয়। এরপর লাল শালুর মতো নতুন কাপড়কে দড়ির মতো করে এই বিগ্রহগুলির গলায় প্যাঁচ দিয়ে জড়িয়ে তোলা হয় রথের দ্বিতীয় তলে। সেখানে জগন্নাথ,বলরাম এবং সুভদ্রার সাথে থাকে ছোট ছোট কাঠের পুতুল। যা তৎকালীন সময়কার সামাজিক, অর্থনৈতিক কাঠামোর একটা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। রথে তোলার পরও দেবতার বিগ্রহগুলির উদ্দেশ্যে চলে আরও কয়েকপ্রস্থ পূজার্চনা। সাথে থাকে কীর্তনের দলের অবিরাম নামগান। পূজার শেষে রথে যুক্ত করা হয় দুটি কাঠের ঘোড়া। এই সম্পূর্ণ কাজটির দায়িত্বে স্থানীয় সূত্রধর বংশের সারথী সম্প্রদায়ের মানুষেরা যুক্ত থাকেন। রথে যুক্ত করা একটি ঘোড়া সাদা এবং অন্যটি নীল। স্থানীয় জনতার সাথে কথা বলে জানা যায় যে,নীল ঘোড়াটি চঞ্চলতা ও উগ্রতার প্রতীক এবং সাদা ঘোড়াটি শান্তির প্রতীক। এ এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। তিনটি দেবতার উদ্দেশ্যে এই রথটিতে থাকে তিনটি রাশি (প্রতিটি দড়ি বা রাশি প্রায় ৩০০ ফুট দীর্ঘ) এবং রথের পিছনে থাকে আরও একটি রাশি । সামনের তিনটি রাশির মধ্যে একটি রাশি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। রথের পিছনের দড়িটি মূলত জরুরিকালীন অবস্থায় রথটিকে থামানোর জন্য ব্রেকের কাজ করে। এই দড়িটির দায়িত্ব থাকেন বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কমিটির নির্বাচিত কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা। বর্তমানে তাদের সাথে প্রশাসনের তরফে থাকে কিছু সিভিক ভলান্টিয়াররা। রথের দড়ি স্পর্শ করা এবং রথের টান দেওয়ার জন্য বলবান পুরুষদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি এবং প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগে থেকেই। এই ধাক্কাধাকি সম্পূর্ণটাই চলে খেলার ছলে। গুপ্তিপাড়ার রথে দূর–দূরান্ত থেকে আগত পুণ্যার্থীদের মধ্যেও রথের দড়ি স্পর্শ করার জন্য দেখতে পাওয়া যায় মর্মস্পর্শী আকুলতা। স্থানীয় বিশ্বাস মতে এই গুপ্তিপাড়া রথের দড়ির আঁশ বাড়িতে রাখলে বিভিন্ন বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আর এই বিশ্বাস অনুযায়ী অনেকেই রথটি টানার সময় খুঁটে খুঁটে দড়ির আঁশ সংগ্রহ করেন।
ঠিক দুপুর বারোটার সময় রথের দড়িতে পড়ে প্রথম টান। হাটখোলা পাড়ায় অবস্থিত গুপ্তিপাড়ার মঠের ঠিক সামনে থেকে রথের যাত্রা শুরু হয়। এখানকার রথের সম্পূর্ণ যাত্রাটি দুটি পর্বে বিভক্ত। এটি ভারতের দ্বিতীয় এবং পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম পথ (প্রায় ২ কিলোমিটার) অতিক্রমকারী রথ। প্রথম পর্বে রথটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রা শুরু করে দেশকালীমাতা মন্দির পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে থেমে যায়। শুরু হয় সাময়িক বিশ্রাম পর্ব। চলে আরও এক প্রস্থ পূজা–অর্চনা। এখানকার রথের যাত্রার দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় বিকেল চারটের সময়। আবার ঠিক বিকেল চারটের সময় রথের দড়িতে পড়ে টান, এগোতে থাকে এই বিশাল আকৃতির রথটি। রথযাত্রার দ্বিতীয় পর্বেও স্থানীয় ও বহিরাগত পুণ্যার্থীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। রথের দড়ি অন্তত একবার স্পর্শ করার জন্য তাদের কাতর ও মর্মস্পর্শী চেষ্টা সত্যিই দেখবার মত। এই বিপুল জনসমাগম ও তাদের এই মর্মস্পর্শী উৎসাহের মধ্যেও বাতাবরণ থাকে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠ। এর জন্য অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সকলেই কৃতজ্ঞ। অতীতের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্য ক্রমাগত মাইকে সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষিত হতে থাকে সতর্কবার্তা। দেশকালীমাতা মন্দির এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে স্থানীয় ষষ্ঠীতলা বাজার পেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে এগোতে থাকে রথটি। আরও কিছুটা পথ এগিয়ে রথটি স্থানীয় গোঁসাইগঞ্জ–বড়বাজার এলাকায় অবস্থিত মাসির বাড়িতে অর্থাৎ গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছায়। জগন্নাথ দেবের এখানকার মাসির বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে “গুণ্ডিচা বাড়ি” নামে পরিচিত। এখানেই পরবর্তী সাত দিন অবস্থান করার পর উল্টো রথের দিন পুনরায় রথটি একই পথ ধরে গুপ্তিপাড়ার মঠের সন্নিকটে এসে পৌঁছায়। উক্ত দিনে প্রায় প্রতি বছরই দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত সারদা মঠের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা মঠের প্রথম অধ্যক্ষা ভারতীপ্রাণা দেবীর জন্মস্থান ও জন্মদিন হিসেবে এই অঞ্চলে আসেন।
এবার আসা যাক গুপ্তিপাড়ার উল্টো রথের কথায়। এই রথযাত্রাটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একমাত্র রথযাত্রা যেখানে রথে “চতুর্মুখী টান” দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ গুন্ডিচা বাড়ির অবস্থানগত কারণের জন্য রথটি গুপ্তিপাড়া মঠের সামনে তার যাত্রা শুরু করে উত্তর থেকে দক্ষিনে এগোতে থাকে। তারপর পশ্চিমমুখী হয়ে গুন্ডিচা বাড়িতে এসে পৌঁছায়। আবার উল্টো রথের দিন পূর্বমুখী হয়ে তার যাত্রা শুরু করলেও ষষ্ঠীতলা বাজার থেকে দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী হয়ে এগোতে এগোতে গুপ্তিপাড়া মঠের সামনে রথটি তার যাত্রা শেষ করে।
তথ্যসূত্র :
— “সববাংলায়” ওয়েবপেজে প্রকাশিত “গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা” শীর্ষক প্রতিবেদন ।
— স্থানীয় যেসকল বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলাপচারিতা ও লিখিত মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে । তারা হলেন নিম্নরূপ :
# শ্রীযুক্ত তারক নাগ বা নায়েক (সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিক তথা ভোলা ময়রার পরিবারের নবম পুরুষ) ।
# শ্রীযুক্ত সুজিত মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন মহাশয় (পৌরহিত্য প্রশিক্ষক,ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ও লেখক) ।
# সুব্রত মন্ডল মহাশয় (রথ কমিটির সদস্য) ।
*******************************
অনির্বাণ সাহা-ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক