Shadow

ফানুস-দেবপ্রিয়া সরকার

 

balloon

কারশেড থেকে ধীর গতিতে একনম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল শিয়ালদাগামী দার্জিলিং মেল। ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিল শাওন। বলল,
-চলি রে। কুহু আর পিহুর খেয়াল রাখিস। মা কে দেখিস। আমি জানি তোর ওপর অনেক দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। পাড়ার দোকানের ডাব্বুকে বলে রেখেছি তোদের খবর নিতে। কিছু দরকার হলে ওকে বলবি। জানি কষ্ট হবে। তবুও, একটু মানিয়ে নিস গুড়িয়া।
কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে আলগোছে অয়ন্তিকাকে জড়িয়ে ধরল শাওন। একটা  চুমু আঁকল কপালে।  তারপর লাগেজগুলো নিয়ে এগিয়ে গেল ট্রেনের দিকে।
স্তব্ধ হয়ে অয়ন্তিকা দেখছিল শাওনের চলে যাওয়া। হুইসল বাজল। আস্তে আস্তে এগোচ্ছে ট্রেন। এতক্ষণ ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু  আর পারল না। ট্রেনটা চলে গেল দৃষ্টিপথের বাইরে। আর শাওন, তার নাগালের অনেক দূরে।

সিটিঅটো থেকে নেমে গলি দিয়ে হাঁটছিল অয়ন্তিকা। পা গুলো কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে একটা বিরাট বোঝা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলছে সে।
কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুললেন প্রতিভা। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকালেন অয়ন্তিকার দিকে। স্পষ্ট চোখে পড়ছে মুখের বলিরেখাকে ছাপিয়ে ওঠা বিষণ্ণতা। অ্যাকসিডেন্টে স্বামীর মৃত্যুর পর বুকে আগলে মানুষ করেছিলেন একমাত্র ছেলে শাওনকে। অনেক প্রলোভন, লোলুপদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। শুধু ভেবেছিলেন  ছেলের কথা। কিন্তু এখানেও বাধ সাধলেন ঈশ্বর। শাওন যত বড় হল ততই হতে লাগল বদমেজাজি, রগচটা। জড়িয়ে গেল ছাত্ররাজনীতিতে। ধরল মদ, গাঁজার নেশা।
প্রতিভা অস্ফুটে বললেন,
-পারলাম না রে অয়ন্তিকা, হেরে গেলাম আমি। ক্ষমা করে দিস আমাকে।
-এভাবে বলো না মা। তুমি একা নও, হেরেছি তো আমিও।
প্রতিভার কাঁধে মাথা রেখে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ল অয়ন্তিকা।
অয়ন্তিকার বাবা-মা কখনওই মেনে নেননি শাওনের সঙ্গে তার মেলেমেশা। কিন্তু অয়ন্তিকার মাথায় কেমন যেন একটা জেদ চেপে গিয়েছিল। সে ভেবে নিয়েছিল শাওনকে সঠিক পথে নিয়ে এসেই দম নেবে। তার মনের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে ভরিয়েছিল শাওনকে। পাশে থেকে উৎসাহ দিয়েছিল এগিয়ে যাওয়ার। একের পর এক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্যে তৈরি হয়েছিল শাওন। শেষমেশ শিকে ছিঁড়ল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ সার্ভিসে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, বদলে যাওয়া শাওনকে দেখে বড্ড ভাল লাগত অয়ন্তিকার। একঝাঁক সুখের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ভালবাসার টানে পা বাড়াল সে এক অজানা ভবিষ্যতের পথে।
ছেলেকে সংসারী হতে দেখে বেশ লাগত প্রতিভারও। অয়ন্তিকার মতো মিষ্টি বউ আর যমজ সন্তান নিয়ে ভালই কাটছিল শাওনের দিন। বছরখানেক আগে নিজের শহর শিলিগুড়িতে বদলি হয়ে আসে শাওন। আবার মেলামেশা শুরু হয় পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। ফিরে আসে পুরনো অভ্যাসগুলোও।
একদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় চলে যায় নাইট ডিউটিতে। জুনিয়ারদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে বচসায়। করে ফেলে হাতাহাতি, ভাঙচুরও। গুরুতর জখম হয় দুজন কনস্টেবল। সার্ভিস রিভলভার নিয়ে গুলি চালাতে গেলে তাকে আটকায় অন্যরা। যখন নেশার ঘোর কাটে ততক্ষণে দেরী হয়ে গিয়েছে অনেক। খবর পৌঁছেছে উপর মহলে। নেমে এসেছে শাস্তির খাঁড়া। প্রথমে টেম্পুরারি সাস্পেনশন। তারপর পানিশমেন্ট ট্রান্সফার। পোস্টিং জঙ্গলমহলে।
অয়ন্তিকার চোখের দিকে আজকাল আর তাকাতে পারেন না প্রতিভা। ছোট ছোট দুটো যমজ মেয়েকে নিয়ে বড্ড অসহায় লাগে অয়ন্তিকাকে। শাওনকে নিয়ে সুখে ঘর বাঁধার আশায় নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছিল মেয়েটা। আজ তার প্রত্যেকটা দিন বড্ড কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। 


লালগড় এখন খুব পরিচিত একটা নাম। টিভিতে, খবরের কাগজে  মাঝে মাঝেই দেখা যায় লালগড়ের জঙ্গলে ইনসাস কাঁধে, জলপাইরঙা পোশাকে ঘুরে বেড়ানো গুপ্তঘাতক, হানাদারদের ছবি। জঙ্গলমহল, লালগড়ের সব খবরই খুঁটিয়ে পড়ে অয়ন্তিকা।  ভয়ে  বুক কাঁপে তার। এক অসম্ভব দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কাটে একেকটা দিন। প্রতিটা রাত।
চারদিকে আলো ঝলমলে দীপাবলীর সন্ধ্যায় বিষাদের চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে তাদের একতলা বাড়িটা। গতকাল শাওন বলেছিল,
-এবার পুজোটা তোদের সঙ্গে কাটাতে পারলাম না। ভেবেছিলাম দীপাবলীতে যাব। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। কাল থেকে শুরু হবে সিক্রেট মিশন। মনখারাপ করিস না গুড়িয়া, এই মিশন শেষ হলেই লম্বা ছুটির আবেদন করব। তারপর সকলে একসঙ্গে বেড়াতে যাব কোনও পাহাড়ি গ্রাম অথবা সমুদ্রের ধারে, কেমন?
সকাল থেকে অয়ন্তিকা অনেকবার ট্রাই করেছে শাওনের ফোনে। কিন্তু বারবার শুধু সুইচড অফই পেয়েছে। একটু আগেই খবরে দেখল লালগড়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে একটা পুলিশের জিপ। মৃতদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। এই দুঃসহ যন্ত্রণার বোঝা আর বইতে পারছে না অয়ন্তিকা।  ক্ষতবিক্ষত মনটাকে লুকোতে উঠে এসেছে ছাদে। ঝাপসা চোখে সে দেখছে দুই নাতনিকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন প্রতিভা। কুহু, পিহু সযত্নে হাত দিয়ে আড়াল করছে তাদের, পাছে নিভে যায় হাওয়ার ঝাপটায়।
অয়ন্তিকার মাথার ওপর এখন শুধুই অমাবস্যার আকাশ। জমাট অন্ধকারের মাঝে চোখে পড়ছে মিটিমিটি আলো নিয়ে উড়তে থাকা একটা ফানুস। হয়তো একটু পরেই ফুরিয়ে যাবে হাওয়া। নিভে যাবে আলো। আর উড়বেনা সুখী সুখী আলোর ওই ফানুসটা।
বাজি-পটকার ধোঁয়া মাখা অন্ধকার আকাশের দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে অয়ন্তিকা। এলোমেলো ভাবনাগুলো লুটোপুটি খাচ্ছে তার মনের চার দেওয়ালের অন্দরে। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে একটা হালকা সুর। সুরটা মনে হচ্ছে যেন তার ভীষণ চেনা। একটু থমকাল অয়ন্তিকা। হ্যাঁ, চেনাই তো! তার মোবাইলের রিংটোন। নীচের ঘরে বাজছে ফোনটা। কী এক আশংকায় কেঁপে উঠল অয়ন্তিকার সারা শরীর। কে ফোন করেছে এই সময়? শাওন? নাকি……একরাশ অস্থিরতা আর উদ্বেগ সঙ্গে নিয়ে দৌড়ল আয়ন্তিকা, সিঁড়ির দিকে।
হাওয়ার টানে ভাসতে ভাসতে ক্ষীণ আলো বুকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ফানুসটাও। কেউ জানে না কতক্ষণ তার আয়ু, কোথায় তার গন্তব্য।।  

 

দেবপ্রিয়া সরকার

দেবপ্রিয়া সরকার:
উত্তরবঙ্গের জেলা শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। টুকটাক কবিতা এবং অনুগল্প দিয়ে লেখালিখির হাতেখড়ি হলেও ছোটগল্প লিখিয়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ ২০১৮ সালে। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘উজান’, উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায়। এরপর যথাক্রমে সানন্দা, তথ্যকেন্দ্র, শারদাঞ্জলি, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, উত্তরের সারাদিন, এখন ডুয়ার্স, আজকাল(উত্তরণ) সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন এবং ওয়েবজিনে ছোটগল্প, বড়গল্প, অণু উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে একে একে।

6 Comments

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!