রাজপথে
চিন্ময় চক্রবর্তী
এক পা দু পা করে এগিয়ে চলেছি। কাঁধে আমার ঝোলা। ফিরি করার ঝোলা। ঝোলায় বিক্রির সামগ্রীগুলো পাল্টে পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে ক্রেতার দল। এখন যা বেচি তা কেনার লোক বড় কম। তবে যারা কেনে,তারাও সাধারণ নয়। তারা আলাদা। আর আমিও কি পাল্টে যাচ্ছি? একদম নয়। আমি যা ছিলাম তাই আছি। আসলে বাজারের প্রয়োজনে বেচার সামগ্রী পাল্টে পাল্টে যায়। আর আমি নতুন নতুন রসদ সংগ্রহ করে চলি।
সামনের অসংখ্য আঁকিবুকি কাটা রাস্তা এতদিন আমায় গুলিয়ে দিয়েছে। কোন রাস্তা ধরবো বুঝতে পারতাম না। শুধু খুঁজতাম আর খুঁজতাম। ঝোলায় ছিল বিচিত্র সামগ্রী। ক্রেতাও প্রচুর। কত ঠকেছি আর জিতেছি আর ঠকেছি। বেশী ঠকেছি না বেশী জিতেছি হিসেব করিনি কক্ষণো। তবে ঠকাইনি যে,সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে এবার রাস্তার গুলিয়ে যাবার ব্যাপারটা কমে আসছে। গলিপথগুলো ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে একটা রাজপথে।
রাজপথ একটাই। গন্তব্য একটাই। আগে ছিলো শুধু গুলিয়ে যাওয়া। গোলক ধাঁধার মতন। দিনের আলোয় বা রাতের অন্ধকারে সবসময়েই এই পথ ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। ভুল হতে দেবেই না। ঝোলাটা এ কাঁধ থেকে ও কাঁধে নিই । ঝোলায় সামগ্রীগুলো কমে এসেছে। ভার আর তেমন অনুভব করি না। মানুষ? মানুষের মধ্যে দিয়েই তো রাস্তা। তবে আগের মতো সবার সাথে আর ধাক্কা লাগে না। কারো কারো সাথে দেখা হলে দাঁড়িয়ে পড়ি।
বহুকালের চেনা কোনো বান্ধবী। বান্ধবী বলবো? তেমন বন্ধুত্ব তো হয়ই নি কখনো। পরিচিতা বলা যায়। দাঁড়িয়ে পড়লাম। সে হেসে জিজ্ঞেস করলো,‘কেমন আছো নীলদা?’
আমি ভাবলাম কি বলবো! ভালই তো আছি। বললাম,’ছিলাম জানিনা। তবে তোমাকে দেখার পর বেশ ভাল আছি।’ ভাললাগা গুলো তো মানুষই বয়ে আনে তাই না? যেমন আনে খারাপ লাগা গুলোও! আসলে যে যেমন থাকতে চায়,সে তেমন মানুষকেই পেয়ে যায়।
ভাবলাম,এই রাজপথে তো যে সে মানুষ আসতে পারে না! যারা ভাল থাকতে পারে,মানুষকে ভালো রাখতে পারে তারাই আসে। সে কথাই বললাম স্নিগ্ধা কে। মনে পড়ে গেলো। ওর নাম স্নিগ্ধা। নামটিও যেমন মন ভাল করা,মানুষটিও তাই। অন্ততঃ আমার তাই মনে হলো। স্নিগ্ধাও জীবনের অনেক অলি গলি ঘুরে এসে এই রাজপথে উঠেছে। আমি জানি। ওকে প্রথম দেখি যখন তখন আমার কাঁধে ফেরিওয়ালার ঝোলাটাও ওঠেনি। আমি তখন দম দেওয়া খেলনার মতন ঘুরে চলেছি একই জায়গায়। ঠোক্কর খেতে শিখছি সবে। তারপর কবে যে ফেরিওয়ালার ঝোলা কাঁধে তুলে পথ চলতে শুরু করে দিয়েছি বুঝতেই পারিনি। কত মানুষ,মানুষী,বন্ধু পেয়েছি। কিছু বন্ধুর সাথে বন্ধুর পথও চলেছি। কিছু বন্ধু কখন যে হাত ছেড়ে চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। কিছু বন্ধু শক্ত করে আমার হাত এমন ভাবে ধরে রেখেছে,যে তাদের অস্তিত্বের সাথে নিজের অস্তিত্বও গুলিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে।
পৃথিবীটা ছোটো হতে হতে কেমন ছোট্টটি হয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে,বুঝতেই পারা যায় না।পথঘাট কমে যায়, খানাখন্দ কমে যায়,এবড়ো খেবড়ো কমে যায়। সত্যিই কমে যায়,না আমাদের মনের দৃষ্টিশক্তি আরও উজ্জ্বল হয়? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সমীকরণগুলোও হয়তো সহজ হয়ে যায় আরও। স্নিগ্ধা সহজ স্বাভাবিক ভাবে আমাকে সম্বোধন করে আমার সামনে দাঁড়ালো সঙ্কোচহীনা হয়ে। আমার ভালো লাগলো। জীবনের সব ত্রিভুজ,চতুর্ভুজ বা বহুভূজের হিমবাহগুলো কেমন বৃত্ত আর সরলরেখা হয়ে সহজ সমীকরণে ধরা দিচ্ছে এখন। সেই ছোটোবেলার শক্ত একটা কোয়াড্রাটিক সমীকরণকে কব্জা করে এক্সের মান যেমন শূন্য দাঁড়াত,তেমন।
স্নিগ্ধার সাথে হাঁটতে হাঁটতে পথ চলছি। এমন পথ তো অনেক চলেছি। অনেক রোদবৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলেছি। কিন্তু আজ কেমন অন্যরকম লাগছে। এই মেয়েটির সাথে দু তিন পাও যে একসাথে কখনো চলবো ভাবিনি। আমার মাথার বেশ কিছু চুল এখন সাদা। স্নিগ্ধার তো তেমন বুঝছি না। অবশ্য ও তো আমার থেকে বেশ কিছুটা ছোটো। কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ তো নিশ্চয়ই।
ছোটোবেলায় যখন সাইকেল করে ফুটবল খেলতে যেতাম, স্নিগ্ধার বাড়ীর পাশ দিয়েই যেতাম। ও তখন রোজ স্কুল থেকে ফিরতো। নাকি ওর স্কুল থেকে ফেরার সময়টাই আমার খেলতে যাবার সময় হিসেবে আমি নির্দিষ্ট করেছিলাম, তা জোর দিয়ে বলতে পারি না।
তবে আজ হঠাৎ স্নিগ্ধা বললো,নীলদা,মনে আছে,আমি স্কুল থেকে ফেরার সময় তুমি রোজ খেলতে যেতে? আমি চমকে উঠলাম। তখন তো মনে হতো,ও দেখতেই পেতো না আমাকে। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার কি প্রচেষ্টাই না ছিলো আমাদের। দেখে মনে হতো,খুব জটিল একটা থার্ড ডিগ্রী ইকোয়েশন মেলাবার চেষ্টা করছে মনে মনে। আজ কি সহজে রহস্যভেদ হয়ে গেলো। ইকোয়েশনটা যে সরলরেখার,তখন যে বুঝিনি! আপশোস হলো খুব। আবার নিজের বোকামিতে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম,তুমি খেয়াল করেছো? স্নিগ্ধার হাসিতে একটা নিস্প্রভ খুশীর ঝলক পেলাম।
রাজপথটা বেশ চওড়া। চকচক করছে কালো পিচ। স্নিগ্ধা কি একটা বলতে গিয়েও বললো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম না। পুরোনো পথগুলোর জটিল হিসেবগুলো মেলাতে আর করতে ইচ্ছা করে না। যা মেলবার তা মিলবেই। যা মিলবার না,যেগুলোতো হারিয়ে যাবেই গাছের ঝরাপাতার মতো।
গন্তব্য যতদূরেই হোক,পথটা যে এটাই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। স্নিগ্ধা আমার কাঁধের ঝোলাটার দিকে কৌতুহলভরে তাকালো।আমি বুঝতে পেরে হাসলাম। বললাম,বোঝোনি,আমি যে এক ফেরিওয়ালা। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। তারপর যেন অভ্যেস হয়ে গেলো। আর এখন ভাবি,ভাগ্যিস আমি একজন ফেরিওয়ালা। না হলে পথের সন্ধান আমি পেতাম কি করে? ঈশ্বর আমাকে অনেক কিছু না দিলেও,পথ দিয়েছেন যে! বললাম,এই দেখো,পথে না বেরিয়ে যদি ঠান্ডা ঘরে বসে থাকতাম,বা মন্দিরের বন্ধ দরজার আড়ালে থাকতাম,তাহলে কি তোমার সাথে দেখা হতো?
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে শুনছিলো আমার কথা।বললো,বেশ সুন্দর করে বললে তো! আমি বললাম,প্রেমে পড়ে যেও না আবার। তাহলে মুশকিল। ফেরিওয়ালাদের প্রেমে পড়লে নিস্তার নেই। যে–ই পড়েছে,সে–ই ভুগেছে। বললো,তবুও পড়েছে তো কেউ নিশ্চই? আমি অস্বীকার করি কি করে? স্নিগ্ধাকি ……..??
আমি বললাম,সেই ফুটবল খেলার দিনগুলোতে যদি ফিরতে পারতাম,তাহলে গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতো হয়তো। স্নিগ্ধা বললো,না,এই ভালো। তোমার ভাষায়,এখন সমীকরণ গুলো অনেক সহজ। তখনকার মত নয়। এই সোজা পথটাই বেশী আনন্দের । তাই না? ঠিক তাই। প্রেম তো তার বিচিত্রতা নিয়ে সারাজীবন জুড়ে থাকে। তাকে তার মতনই যাতায়াত করতে দাও না।আমরা নয় পথই চলি। আমি বললাম,তাই ভালো।
রাজপথে সন্ধ্যা নামছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুজনেই দেখলো একসারি সাদা বক কেমন সরলরেখায় উড়ে চলেছে। স্নিগ্ধা বললো,নীলদা,বেশ জল পিপাসা পেয়েছে। এখানে জল কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারো? দূরে একটা দোতলা বাড়ী দেখা গেল। আমি বললাম,চলো,ওই বাড়ীতে নিশ্চয়ই জল পাওয়া যাবে। জল খেয়ে তারপর আবার পথ চলা যাবে। স্নিগ্ধার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো।
দরজার কড়া নাড়তেই একজন দু গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে বেরিয়ে এলো। বেশ অবাক হলো ওরা। কি করে বুঝলো যে ওদের জল পিপাসা পেয়েছে? জল খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে হঠাতৎই পিছনে ফিরে তাকালাম বাড়ীটির দিকে। দেখলাম বাইরেই একটা পাথরের ফলকে লেখা আছে,“স্নিগ্ধনীল বৃদ্ধাবাস”। স্নিগ্ধা জানালা দিয়ে দেখছে আমি রাজপথে নেমে যাচ্ছি। ওর গাল বেয়ে জলের কয়েকটা ফোঁটা নেমে আসছে।
আমার ঝুলিতে কয়েকটা মুক্তোর দানা সংগ্রহ হলো। সামনে আরও পথ। ঝোলাটা অন্য কাঁধে নিলাম।
******************************
চিন্ময় চক্রবর্তী পরিচিতি:
জন্ম ১৯৬৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চন্দননগরে। রসায়নে সাম্মানিক নিয়ে স্নাতক। তারপর পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর। তারপর কর্মক্ষেত্র ও নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বুড়ি ছোঁওয়া। তার মধ্যে আই আই এম কলকাতা অন্যতম। চারটি স্বনাম ধন্য জাতীয় ও বহুজাতিক ঔষধ সংস্থায় নানান পদে কাজ করার ৩৩ বছর ৪ মাসের অভিজ্ঞতা। গত ২০২২ শের ৬ই মে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারনে একটি বহুজাতিক সংস্থার জাতীয় অধিকর্তার পদ থেকে স্বেচ্ছাবসর।
জীবন দর্শনের পাঠগুলো কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও ভ্রমন কাহিনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে ভালবাসেন। নিজের নামে ও ছদ্মনাম “নীলকণ্ঠ ফেরিওয়ালা” নামে লিখতে ভালবাসেন। পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত ।
Tomar ei bodh gulo kivabe jeno amar sathe bhison mile jai. Tafat ekta ache, tomar prokasher samartha ache amar nei. Kintu jiban pather chemistry ta pray ek. Tomar nostalgic chinta bhabna gulo montake udas kore ek anirbachanio anonda dei. Atiter na paoa gulo ekhon ar kasto dei na barong kemon ekta sukhanubhuti hoi jeta prakash kora jai na.