Shadow

রাঙা ঘোড়ার খোঁজে রাঙা মাটির দেশে – সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভুতনাথ কুম্ভকারের কর্মশালায় পোড়ামাটির ঘোড়া

রাঙা ঘোড়ার খোঁজে রাঙা মাটির দেশে

                   সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি ছিল আমার ভারি পছন্দের। মা ‘সঞ্চয়িতা’ থেকে প্রায়ই পাঠ করে শোনাতেন বলে পুরো কবিতাটিই আমার ঠোঁটস্থ ছিল। আধো আধো উচ্চারণে আবৃত্তি করতাম-
                                              ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
                                              মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
                                              তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
                                              দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
                                              আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
                                              টগ্‌বগিয়ে তোমার পাশে পাশে
এটুকু বলেই খানিক থামতামমনে প্রশ্ন জাগত যে! রাঙা ঘোড়া কেমন দেখতে? কোথায় দেখা মেলে সেই ঘোড়ার? বাস্তবে তখনও অবধি একটাও রাঙা ঘোড়া দেখিনি কিনাপ্রশ্ন শুনে বাবা-মা খুশি হতেন। বুঝতেন ওই অতটুকু বয়সে কবিতাটি আমি শুধু মুখস্থই করিনি,আত্মস্থ-ও করেছি। বাবা একদিন মৃদু হেসে বলেছিলেন,”তোমার একটা রাঙা ঘোড়া চাই?” তারপর দিনের পরে দিন কাটে। আমি আর একটু বড় হই। প্রাথমিক স্কুলের পাঠ সম্পূর্ণ করি। বাবা তাঁর স্কুলের সহকর্মী শিক্ষক বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়েন সাইকেল ভ্রমণে। আমাদের বাংলার বুকেই এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে শেষে গেলেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে এলেন সেখান থেকে কেনা লাল রঙের একজোড়া পোড়ামাটির ঘোড়া। নলের মতো সরু গলা। বাঁশপাতার মতো খাড়া কান। ছোটো বাঁকানো লেজ। ছোটো ছোটো পা। লাগাম পরানো মুখে নজর কাড়া নিষ্পলক ছিদ্রযুক্ত চোখ। সওয়ার বা চালক না থাকলেও পিঠে কারুকাজ করা বসার আসন। বুকে ও পায়ে-ও অনেক কারুকাজ। বাবার হাত থেকে ঘোড়া দুটো নিয়েই অস্ফুটে বলে উঠলাম,’রাঙা ঘোড়া!’ বাবা জানালেন এই পোড়ামাটির ঘোড়াগুলো তৈরি হয় পাঁচমুড়ায়। কোন পাঁচমুড়া? মনে আবার প্রশ্ন। সেই যে রবি ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের দইওয়ালার গ্রাম ছিল যেখানে? “না,সে তো পাঁচমুড়া পাহাড়। আর এই পাঁচমুড়া বাঁকুড়া জেলায়। বিষ্ণুপুরের কাছেই এক ছোটো গ্রামসেখানে পাহাড়-ও নেই। শ্যামলী নদী-ও নেই।”-বললেন বাবা। তা না-ই বা থাকুক। এমন সুন্দর রাঙা ঘোড়াদের জন্ম হয় যে পাঁচমুড়া গ্রামে,সেখানে একবার যেতেই হবে। মনে মনে স্থির করে ফেলি তখনই। সুযোগ মিলতে মিলতে সময় গড়িয়ে যায় প্রায় পঞ্চাশ বছর। ততদিনে জেনে নিয়েছি পাঁচমুড়া গ্রামের নামের ইতিহাস। স্থানীয় ভাষায় ‘মুড়া’ শব্দের অর্থ মাথা। পাঁচ মাথা অর্থাৎ পাঁচজন ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন বলে গ্রামের এই নামকরণ। তবে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া ছাড়াও বিষ্ণুপুর,নাকাইজুরি,সোনামুখী,হামিরপুর,কামারডিহা,বিবড়দা,সেন্দরা,উলিয়াড়া,জয়কৃষ্ণপুর,রাজগ্রাম,রুইশহর- এইসব গ্রামেও পোড়ামাটির কাজ হয়। আসলে এই অঞ্চলের মাটি পোড়ামাটি বা টেরাকোটা শিল্পকলার উপযোগী। এখানকার মৃৎশিল্পী কুম্ভকার সম্প্রদায়ের মানুষেরা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে অসামান্য অলঙ্করণযুক্ত যেসব টেরাকোটার ফলক দেখা যায়, সেগুলো পাঁচমুড়া ও তার আশেপাশের অঞ্চলেই তৈরি  হতো। এছাড়াও এখানে টেরাকোটা শিল্পের উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে ওঠার আর একটি বিশেষ কারণ হল লোকায়ত শিল্প ও সংস্কৃতির আঙিনায় এর ঐতিহ্যগত প্রাধান্য। ঘর-গেরস্থালির প্রয়োজনীয় পোড়ামাটির জিনিসপত্র বানানোর পাশাপাশি ঢাক,মাদল,দুন্ধুভি,খোল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের অংশ বানানোর মতো নান্দনিক কাজের কারিগর এখানকার কুম্ভকার পরিবারগুলো। তারপর এও দেখা যায়-পশ্চিমবঙ্গে,বিশেষত বাঁকুড়া,মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার মতো রাঢ়বঙ্গের জেলাগুলোতে কোনো গাছতলায় বা কুঁড়েঘরে পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়া বিভিন্ন আদিবাসী ও লৌকিক দেবদেবীর প্রতীক হিসাবে পূজিত হয়। নানা কামনায় গ্রামের মানুষ মানত করে। মনোস্কামনা পূরণ হলে পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়ার মাথায় সিঁদুর লেপে এইসব দেবতার থানে তারা রেখে আসে। জঙ্গলাকীর্ণ,সর্পবহুল হওয়ায় এইসব অঞ্চলে মনসা পুজোরও ব্যাপক প্রচলন আছে। তাই স্থানীয় চাহিদাকে সম্বল করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কুম্ভকারেরা পোড়ামাটির হাতি,ঘোড়া,মনসা চালি ও মনসা ঘট তৈরিকেও জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে এসেছেন। ক্রমে সবাইকে ছাপিয়ে পাঁচমুড়ার মৃৎশিল্পীরা তাঁদের কাজের নিজস্ব ধাঁচ বা ধরন দিয়ে শিল্পজগতে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৬৯ সালে পাঁচমুড়ার মৃৎশিল্পী রাসবিহারী কুম্ভকার পোড়ামাটির ঘোড়ার একটি বিশেষ শিল্পশৈলী সৃষ্টি করে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেনের হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার পান। তারপর থেকে শুধু বাংলায় নয়, পাঁচমুড়ার শিল্পীদের হাতে তৈরি পোড়ামাটির ঘোড়াসহ অন্যান্য টেরাকোটার সামগ্রীর কদর বাড়ে সারা দেশে,এমনকি বিদেশের বাজারেও। পরবর্তীতে গ্রামের আরো অনেক শিল্পী তাঁদের কাজের জন্য জেলা ও রাজ্য স্তরে  প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। বিদেশে আয়োজিত শিল্প উৎসবে অংশ নিয়ে নিজেদের শিল্পকর্ম তুলে ধরার সুযোগও পেয়েছেন অনেকে। ‘All India Handicrafts Board‘-এর উদ্যোগে ‘Central Cottage Industries Emporium’ তাদের প্রতীক (Logo) হিসাবে নির্বাচন করেছে এখানকার পোড়ামাটির ঘোড়াকে। ২০১৮ সালে এটি জি আই ট্যাগ (Geographical Indication Tag)-ও লাভ করে। সাথে।বাঙালি হিসাবে আমাদের কাছে এসব কি কম গর্বের কথা! গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচমুড়া যাওয়ার পথে সেসব কথাই হচ্ছিল আমাদের গাড়ির চালক রাজু গরাই-এর ।
মুকুটমণিপুরের কংসাবতী বাঁধ থেকে গাড়িতে টেরাকোটার আঁতুড়ঘর পাঁচমুড়া যেতে বড়জোর সোয়া এক ঘন্টা সময় লাগে। আমরা সপরিবারে বাঁধের কাছেই একটা হোটেলে ছিলাম। সেখান থেকে সকালের জলখাবারের পাট চুকিয়ে বেরোতে বেরোতেই বেলা দশটা বাজল। তারপর ঠিক হল আমরা পুরুলিয়ার বুধপুর শিব মন্দির ও পাকবিড়রা জৈন মন্দির দেখার পর পাঁচমুড়া যাব। ফলে পাকবিড়রা থেকে বাঁকুড়ার হাতিরামপুর ও বিবড়দা হয়ে তালডাংরা ব্লকের পাঁচমুড়া গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেলযাত্রাকালে সড়ক পথের দুই ধারে রাঙা মাটির ছোঁয়া,মাঝে মাঝে মনোরম সবুজ বনস্থলি মন ভরিয়ে দিয়েছেতালডাংরার কাছে একটি দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় স্থানীয় এক বৃদ্ধ মানুষ জানালেন তাঁর পিতৃপিতামহের আমলে এইসব এলাকায় গভীর জঙ্গল ছিল নেকড়ে,হায়না,শেয়াল,শজারু,বনবিড়াল,খরগোশ ও নানা জাতের সরীসৃপ ছাড়াও বাঘ-ও নাকি থাকত সেই জঙ্গলে! যেখানে শাল,পিয়াল,শিমুল,মহুল ইত্যাদি বড় বড় গাছেদের নিবিড় জড়াজড়ি কোথাও কোথাও সূর্যের আলোকেও ঢোকার পথ দিত নাএখন জঙ্গল নেই। কৃত্রিম বনসৃজন হয়েছে। সেখানে ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমণি গাছের ছড়াছড়ি।
”বাংলার এ সম্পদ সম্বন্ধে যে ওয়াকিবহাল নয় সে বাংলার কিছুই জানে না”-সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখা ‘রবার্টসনের রুবি’ গল্পে বাংলার টেরাকোটা শিল্প সম্পর্কে এই সংলাপ বসিয়েছিলেন ফেলুদার মুখে। পাঁচমুড়ায় টেরাকোটা শিল্পীদের বসতি অঞ্চলে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই আমার উপলব্ধি হল,বাংলাকে জানতে হলে জীবনে অন্তত একবার এখানে আসা দরকার। প্রায় বিরাশিটি কুম্ভকার পরিবার এই শিল্পতালুকে টেরাকোটার কাজের সাথে যুক্ত। আশেপাশে তাকিয়ে যে কজন শিল্পীর বাড়ি প্রথমেই নজরে এল,তাঁদের প্রত্যেকের ঘরের সামনে খোলা বারান্দায় থরে থরে সাজানো তাঁদের হাতের শিল্পকর্মকী নেই সেখানে! ছোটো-বড় নানা আকারের পোড়ামাটির হাতি,ঘোড়া,মনসা চালি – এসব তো আছেই। এছাড়াও আছে বিভিন্ন দেব-দেবী ও মনীষীর মূর্তি,বাসনপত্র,মেয়েদের গয়না,ধূপদানি,প্রদীপদানি,কলমদানি,ফুলদানি থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর রকমারি শৌখিন সামগ্রী। সেগুলোর নিপুণ কারুকাজ ও শিল্পসুষমা চোখ ফেরাতে দিচ্ছিল না। আমাদের আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে এবং আমরা টেরাকোটা শিল্পকর্মের করণকৌশল জানতে চাইছি শুনে একজন শিল্পী আমাদের নিয়ে চললেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর কর্মশালা পরিদর্শন করাতে তখনও তাঁর দুপুরের খাওয়া সারা হয়নি। কিন্তু সেজন্য তাঁর আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি দেখলাম না। তিনি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত রাসবিহারী কুম্ভকারের প্রপৌত্র ভূতনাথ কুম্ভকার। ভূতনাথবাবু ও তাঁর স্ত্রী উর্মিলা কুম্ভকার-দুজনেই রাজ্যস্তরে পুরস্কৃত। তাঁদের পুত্র নীল নবীন প্রজন্মের শিল্পী। সে-ও ছোটো থেকেই তাঁদের দেখাদেখি মাটি নিয়ে ছানাছানি করতে করতে এখন মাত্র সতেরো বছর বয়সেই রপ্ত করে ফেলেছে এই কাজ। এইভাবেই বংশপরম্পরায় কাজ শিখে এখানকার শিল্পীরা শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই শিল্প তাঁদের কাছে পেশা ও নেশা দুই-ই

কর্মশালায় শিল্পকাজে ব্যস্ত ভূতনাথ কুম্ভকার

ভূতনাথবাবুর বাড়িতে ঢোকার মুখে পরিচয় হল তাঁর বাবা ধীরেন্দ্রনাথ কুম্ভকারের সাথে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হাট’ কবিতার ‘কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি’-কে বিষয় করে ধীরেন্দ্রনাথের সৃজিত টেরাকোটা ভাস্কর্য রাজ্যস্তরে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলমৃদুভাষী অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা বাড়ির লাগোয়া কর্মশালায় প্রবেশ করলাম। সে যেন এক সাধনকক্ষ! ঘরের মেঝেতে ছড়ানো মৃৎশিল্পের যন্ত্রপাতি,সরঞ্জাম,কাঁচামাটির তাল,আর সেসব দিয়ে তৈরি অসমাপ্ত কাজ। দেওয়ালের পাশে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা পোড়ামাটির নানা জিনিস। দেওয়ালের তাকেও সাজানো তাঁদের শিল্পকর্মের সম্ভার এইসব দেখতে দেখতে হঠৎ চোখ পড়ল দেওয়ালে লাগানো একটি বড় পোড়ামাটির টাইলসের দিকে। কাশবনের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে অপু-দুর্গা ট্রেন দেখতে যাচ্ছে -‘পথের পাঁচালি’ ছবির সেই চিরস্মরণীয় দৃশ্য টাইলসটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই অনবদ্য কাজটির স্রষ্টা ভূতনাথবাবু আসলে টেরাকোটা শিল্পের পীঠস্থান এখন আর শুধু হাতি-ঘোড়া,হাঁড়ি-কলসি ইত্যাদি তৈরিতেই থেমে নেই। সময়ের চাহিদায় প্রাচীন মৃৎশিল্পের কৌলিন্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নিত্য-নতুন ভাবনা। তারই ফসল এই ধরনের টেরাকোটার টাইলসের কাজ। ভূতনাথবাবু জানালেন টেরাকোটা টাইলসের বাজার ভালো। বাঁকুড়া ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ডার আসে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ছাড়াও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের বাড়ির দেওয়ালে বসানোর জন্যও টাইলসের অর্ডার দেন। যে যেমন চান,ঠিক তেমন টাইলস-ই তাঁরা তৈরি করে দেনতা সে নন্দলাল বসু, সুকুমার রায়,যামিনী রায়ের আঁকা ছবি বা বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরের কারুকাজ-যা-ই হোক না কেন। তবে টাইলসের কাজ সময়সাপেক্ষ। একটা বড় টাইলসের কাজ শেষ করতে প্রায় একমাস সময় লাগে টাইলসের পাশাপাশি পাঁচমুড়ার শিল্পীদের হাতে তৈরি দুর্গা ও সরস্বতী প্রতিমার চাহিদাও বাড়ছে। প্রায় তিন দশক আগে দুর্গোৎসবের সময় বিভিন্ন বারোয়ারিগুলো আকর্ষণীয় সব থিম গ্রহণ করে পুজো শুরু করায় বরাত পেতে শুরু করেন এখানকার শিল্পীরা। কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো দুর্গা প্রতিমা ও মন্ডপসজ্জার জন্য টেরাকোটার সামগ্রী তাঁরা সরবরাহ করেন। ২০১৮ সালে কলকাতার বাবুবাগান সর্বজনীনের ৫৭ তম বর্ষের দুর্গাপুজোয় টেরাকোটার প্রতিমা গড়েন ভূতনাথ কুম্ভকার ও বিশ্বনাথ কুম্ভকার। পুজো এলে তাই হাসি ফোটে এখানকার শিল্পীদের মুখেশীতকালেও বিকিকিনি ভালো হয়। এমনিতে সারা বছর এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকায় টুকটাক বেচাকেনা হলেও ওই সময়টা পর্যটন মরশুম হওয়ায় লোকের ভিড় বাড়ে। যাঁরা মুকুটমণিপুর,বিষ্ণুপুর বা শুশুনিয়া-বিহারীনাথের পাহাড় ও জঙ্গলে বেড়াতে যান,তাঁদের অনেকেই একবার পাঁচমুড়া ঘুরে যান। তখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত এক করে কাজ করতে হয় শিল্পীদের। তবে এখানে শিল্পকাজের সাথে আট থেকে আশি সবাই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে। ঘরকন্না সামলে বাড়ির মেয়েরাও যেমন কাজে অংশ নেয় বা বিক্রিবাটার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়,পরিবারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সদস্যরাও লেখাপড়ার অবসরে পারিবারিক পেশায় হাত লাগিয়ে অভিভাবকদের সাহায্য করে যদিও কঠোর কায়িক শ্রম করতে হয় বলে এবং সেই অনুযায়ী পারিশ্রমিক তেমন না মেলায় পেশা হিসাবে এই কাজকে গ্রহণ করতে আধুনিক প্রজন্ম খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না বর্তমানে অবশ্য অতীত দিনের তুলনায় শিল্পীদের খাটুনি কিছু কমেছে। আগে কাজের উপযুক্ত এঁটেল মাটি সংগ্রহ করতে তাঁদের দূর-দূরান্তে যেতে হত। তারপর নিজেরাই জমিতে গর্ত খুঁড়ে সংগৃহীত তাল তাল মাটি গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতেন। গভীর নিচ থেকে মাটি খুঁড়ে উপরে তোলার কাজে ঝুঁকিও ছিল। মাটির ধ্বসে চাপা পড়ে মারা গেছেন ভুবনমোহন কুম্ভকার। আহত-ও হয়েছেন অনেকে। পা ও কোমর ভেঙে প্রতিবন্ধীর মতো জীবন কাটাতে হয়েছে কালিপদ কুম্ভকার-কে। এখন পাঁচমুড়ার ‘মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতি’-র কেনা জমি থেকে সব শিল্পী মাটি পাচ্ছেন। ডোজার দিয়ে মাটি কেটে শিল্পীদের বাড়ি বাড়ি গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে জ্বালানীর অভাব এখনও রয়ে গেছে। পোড়ামাটির কাজে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কাঠ-পাতার জ্বালানি। আজকাল জঙ্গলে কাঠ-পাতা সেভাবে না মেলায় শিল্পীরা অসুবিধায় পড়ছেন। জঙ্গলে জ্বালানি সংগ্রহ করতে যাওয়ার বিপদও আছে। জঙ্গল থেকে কাঠ-পাতা আনতে গিয়ে টেরাকোটা শিল্পী সুদর্শন কুম্ভকার ও দুর্গাপদ কুম্ভকারের ছোটো মেয়ে খৈরী কুম্ভকারের মৃত্যু হয়েছিল বুনো হাতির আক্রমণে। এইভাবে ভূতনাথবাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল তাঁদের জীবন-জীবিকার আরো নানা সমস্যা ও সুখ-দুঃখের কথা। জানলাম করোনার কারণে সংকটে পড়েছিল এখানকার টেরাকোটা শিল্প-ও বছর দুয়েক পুজোয় কাজের বরাত মেলেনি। লকডাউনে পর্যটক না আসায় সেভাবে বেচাকেনা হয়নি। কোনোরকমে সংসার চলেছে শিল্পীদের। কোভিড আবহে বিশ্বজুড়ে অনলাইন কেনাকাটা বাড়লেও  উপযুক্ত প্যাকেজিং ব্যবস্থার ঘাটতি তাঁদের ভঙ্গুর প্রকৃতির শিল্পসামগ্রীর ই-কমার্স বিপণনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এইসব আলোচনার পর তাঁদের হাতে একটি শিল্পকর্ম কীভাবে সৃষ্টি হয় জানলাম। জানলাম ‘রাঙা ঘোড়া’ তৈরির কৌশল-ওসাধারণত তিনভাবে টেরাকোটার জিনিস তৈরি হয় হাতের নৈপুণ্যে আঙুলে টিপে টিপে কিছু জিনিস গড়া হয়। কিছু তৈরি করা হয় চাকায়। আবার ছাঁচে-ও কিছু জিনিস তৈরি হয়বাড়িতে শিল্পের প্রধান কাঁচামাল অর্থাৎ মাটি এসে পৌঁছানোর পর প্লাস্টিক চাপা দিয়ে ঘরের এক কোণে বা ঘরের বাইরে ছায়াঘেরা ঠান্ডা জায়গায় গাদাবন্দি করে রাখা হয়। সদ্য আনা মাটি দিয়ে কাজটা তাড়াতাড়ি করা যায়। বেশিদিন ফেলে রাখলে মাটি শুকিয়ে যায়। তখন সেই শুকনো মাটি জলে ভিজিয়ে কাজ করতে হয়। প্রথমে গাদাবন্দি মাটিকে সরু তার দিয়ে ফালি ফালি করে কেটে নিয়ে পুরোপুরি কাঁকরমুক্ত করে জল ছিটিয়ে নরম করা হয়। তারপর তার সাথে চালনি দিয়ে চেলে নেওয়া মিহি বালি সঠিক অনুপাতে মেশাতে হয়। সেই বালিমাটির মিশ্রণকে পায়ের গোড়ালি দিয়ে বারে বারে ঠেসে কাজের উপযোগী মাটি তৈরি করতে হয়এই ঠাসার কাজ খুবই পরিশ্রমের। ছেলেরাই এই কাজ করে। মেয়েরা রং তৈরি ও মাটির জিনিসের গায়ে সেই রং লাগানোর কাজ করে থাকে এই রং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। পোড়ামাটির কাজের জন্য দু’রকম রঙের মাটি বিশেষ বিশেষ স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়। একটা একটু হলদেটে। অন্যটি কালচে। হলুদরঙা মাটি জলে গুলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় যে রং তৈরি করা হয়,তাকে বলে ‘গাদ’। কালচে মাটি জলে গুলে একইরকমভাবে তৈরি করা হয় ‘বনক’ রং। চাকায় বা হাতে তৈরি মাটির জিনিসকে ‘উঁচা’ ও ‘চিয়াড়ি’ দিয়ে বার বার ঘষামাজা ও অলঙ্করণ করার পর তার গায়ে দুটি পর্যায়ে গাদ লাগানো হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিক রং (প্রাইমার) হিসাবে যে গাদ লাগানো হয়,তাকে বলে ‘খড়িয়া গাদ’। দ্বিতীয় পর্যায়ে যে গাদ লাগানো হয়,তা চকচকে হওয়ায় সেটিকে বলা হয় ‘ভালো গাদ’। গাদ দেওয়ার পর রোদে পুরো শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর তৃতীয় পর্যায়ে বনকের প্রলেপ দিয়ে আবারও একবার রোদে গরম করে নিয়ে পোড়ানোর জন্য ভাটিতে দেওয়া হয়। গাদ ও বনক দেওয়ায় পোড়ামাটির জিনিসে ঔজ্জ্বল্য আসে। ভাটির ভিতর জাঁত বা জালির উপর মাটির তৈরি অনেক জিনিস একসাথে সাজিয়ে দেওয়া হয়। অপেক্ষাকৃত বড় ও ভারি জিনিসগুলো নিচে রেখে তার উপর ছোটো ও হালকা জিনিসগুলো ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়। এরপর ভাঙা হাঁড়ি,কলসির ছোটো-বড় টুকরো দিয়ে জিনিসগুলো ঢেকে তার উপর খড় বিছিয়ে নরম কাদামাটির একটা প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রলেপের উপর বেশ কিছু ছিদ্র রাখা হয়। এছাড়া আট-দশটা হাঁড়ি,কলসির কানা প্রলেপের সাথে জুড়ে ভাটির ভিতর দেওয়ালের চারদিকে রাখা হয়। এইসব ভাঙা হাঁড়ি-কলসির মুখ ও ছিদ্রগুলো জ্বালানির ধোঁয়া বেরোনোর পথ। তাছাড়া এগুলো দিয়ে দেখে বোঝা যায় পোড়ানো কেমন হচ্ছে এবং মাটির জিনিসগুলোর গায়ে টেরাকোটার রং ঠিকঠাক ধরছে কিনা। জালির নিচে থাকে কাঠ-পাতার জ্বাল দেওয়ার ব্যবস্থা। ভাটির জিনিসপত্র প্রথমে কম তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়। সেজন্য শুকনো পাতা দিয়ে ধীরে ধীরে আগুন দিতে হয়। শেষে কাঠ দিয়ে তাপমাত্রা বাড়ানো হয়। আস্তে আস্তে তাপমাত্রা না বাড়ালে জিনিসগুলো ফেটে যেতে পারে। ভাটির তাপমাত্রা যখন প্রায় ৭৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছায়,তখন জিনিসগুলো পুড়ে লাল টকটকে হয়ে যায়। তারপরেও অনেকক্ষণ আগুন দিয়ে যেতে হয় তাপ ধরে রাখার জন্যভাটিতে রাখার সময় এক একটা জিনিসের ক্ষেত্রে এক এক রকম। টাইলসের ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগে। প্রায় ছয়-সাত ঘন্টা। ফাঁপা জিনিস হলে একটু কম সময় লাগে। চার-পাঁচ ঘন্টা। কাজ হয়ে যাওয়ার পর গরম থাকে বলে সেদিন ভাটি খোলা হয় না। পরদিন সকালে ঠান্ডা হলে সব জিনিস বের করা হয়। পোড়ামাটির ঘোড়া-ও মোটামুটি এভাবেই তৈরি করা হয়। শুধু পার্থক্য এটুকুই,ঘোড়ার দেহের সাতটা অংশ (মাথা,গলা,ধড় ও চারটে পা) চাকায় নরম মাটি দিয়ে প্রয়োজনমতো ব্যাস বাড়িয়ে-কমিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়। তারপর এগুলো রোদে কিছুটা শুকিয়ে নিয়ে একটার সাথে আর একটা যথাস্থানে জুড়ে ঘোড়ার আকৃতি দেওয়া হয়। জোড়া লাগানোর জন্য কিছুটা অতিরিক্ত তৈরি করা শক্ত মাটির প্রয়োজন হয়। ঘোড়ার লেজ ও দুটো কান মাটি দিয়ে আলাদা করে তৈরি করা হয়। সেগুলো ঘোড়ার দেহে বসানোর জন্য লেজের কাছে একটা ছিদ্র ও কানের কাছে দুটো ছিদ্র রাখা হয়। তারপর মসৃন ও অলঙ্করণ করার কাজ শেষ হলে গাদ ও বনকের প্রলেপ দেওয়ার পর ভাটিতে পুড়িয়ে নিলেই হয়ে গেল। তবে পোড়ামাটির ঘোড়া শুধু ‘রাঙা’ অর্থাৎ লাল রঙেরই হয় না। কালো রঙেরও হয়। ভাটিতে প্রথম দফায় পুড়িয়ে লাল রং হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ভাটির ভিতর প্রচুর পরিমাণে ঘুঁটের ধোঁয়া তৈরি করে সেই ধোঁয়া বেরোনোর সব পথ বন্ধ করে দিলে ঘোড়াসহ ভাটিতে থাকা সব মাটির জিনিসই কালো হয়ে যায়। ভূতনাথবাবু তাঁদের একটা ভাটি আমাদের দেখালেন। যদিও তাতে তখন কোনো কিছু পোড়ানোর কাজ হচ্ছিল না। পাশে ডাঁই করে রাখা ছিল শুকনো পাতা বোঝাই গোটা দশেক বস্তা। গরমে জ্বলন্ত ভাটির সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করা যে কত কঠিন ভেবে কষ্ট হচ্ছিল। যদিও প্রাচীন প্রথানুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির পর থেকে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে বন্ধ রাখা হয় এখানকার মাটির কাজ। এই এক মাস এখানে কুমোরের চাকা ঘোরে না। কোনো ধরনের মাটির জিনিসপত্র তৈরি করা হয় না। চৈত্র সংক্রান্তির দিন চাকার উপর মাটি রেখে চাকাকে মাত্র এক পাক ঘুরিয়ে সেই মাটিকে একটি শিবলিঙ্গের আকৃতি দেওয়া হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের কোনো এক বিজোড় শনিবারে সেই শিবলিঙ্গকে পুজো করার পর ফের কাজে হাত দেন শিল্পীরা। একে বলা হয় ‘চাক পূজা’। শিল্পীরা মনে করেন,বৈশাখ মাসের প্রচন্ড গরমে ভাটিতে কাজ করা দুরূহ। তাছাড়া ওই সময় কাজও ভালো হয় না। কাঁচামাটির তৈরি শিল্পসামগ্রী দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যা,এমনকি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এইসব বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত কারণেই চাকা বন্ধের এই রীতি-রেওয়াজ ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। তবে আমার মতে এভাবে শিবলিঙ্গ গড়ে পূজা অবশ্যই উর্বরতা-নির্ভর একটি আচারের (Fertility cult) পরিচয় দেয়। শিবলিঙ্গ উর্বরতার  প্রতীক। চাকার উপর শিবলিঙ্গ গড়ে পুজো করলে চাকার উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসবে-এই বিশ্বাস থেকেই পুজো করা হয়
ভাটি দেখার পর আমরা ভূতনাথবাবুর সাথে গেলাম রাসবিহারী কুম্ভকারের বাড়ি। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে রাসবিহারীবাবুর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার আনন্দঘন মুহূর্ত। ঘরে অগণিত শিল্পদ্রব্যের মাঝে নজর কাড়ে দুটো পোড়ামাটির শঙ্খ ফুঁ দিলে সমুদ্রজাত শাঁখের মতোই বাজে। এই আশ্চর্য শিল্পকর্মের আবিষ্কারক রাসবিহারীবাবুর পুত্র রাজ্যপুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী গণপতি কুম্ভকার। রাসবিহারীবাবুর বড় ছেলে মদনমোহন কুম্ভকার ও সেজ ছেলে পশুপতি কুম্ভকার-ও রাজ্যস্তরে পুরস্কার পেয়েছিলেন। মদনমোহন কুম্ভকার ভূতনাথবাবুর ঠাকুরদা। তিনি জীবিত নেই। পরিচয় হল পশুপতি কুম্ভকারের সাথে। নবতিপর এই বৃদ্ধ প্রবল উৎসাহ নিয়ে তাঁর নিজের এবং তাঁর রাজ্যপুরস্কারপ্রাপ্ত দুই ছেলে বাউলদাস কুম্ভকার ও চন্ডীদাস কুম্ভকারের হাতের শিল্পকাজ দেখালেন। অত্যন্ত গর্বের সাথে Jane Perryman-এর ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘Traditional Pottery of India’ খুলে দেখালেন সেই বইয়ের একটি পাতায় আঙুলে টিপে ষষ্ঠী পুতুল গড়তে ব্যস্ত তাঁর স্ত্রী পরাণী কুম্ভকারের ছবি। স্ত্রী ও ছেলে চন্ডীদাসের সঙ্গে পরিচয়-ও করিয়ে দিলেন। বাউলদাস কুম্ভকার বাড়িতে ছিলেন না। Jane Perryman-এর বইটিতে প্রচুর ছবিসহ বাউলদাসের শিল্পকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। বাউলদাস আমেরিকা,রাশিয়া ও লন্ডনে আয়োজিত শিল্প উৎসবে যাওয়ার সুযোগ-ও পেয়েছেন। অনেক কথার শেষে এবার কিছু কেনাকাটার পালা। ভূতনাথবাবুর কাছ থেকে একজোড়া রাঙা ঘোড়া কিনেছিলাম। চন্ডীদাসবাবুর কর্মশালা থেকে সংগ্রহ করলাম হরপ্পা সভ্যতার সীলমোহরের পোড়ামাটির প্রতিরূপ ও কয়েকটি গৃহসজ্জার সামগ্রী। বিকেলের পড়ন্ত রোদে জয়পুর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়িতে বাড়ির পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম আমাদের গর্বের শতাব্দীপ্রাচীন এই শিল্পধারাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে এমনিতেই কাচ,প্লাস্টিক ও বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি পণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মৃৎশিল্পীদের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই সর্বতোভাবে উদ্যোগ নিয়ে বাংলার মানুষকে থাকতে হবে শিল্পীদের লড়াইয়ের পাশে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই শিল্পের গুরুত্ব বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক বেশি করে প্রচার করতে হবে। প্যাকেজিং ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে অনলাইন বিপণনের মাধ্যমে এখানকার শিল্পকর্ম দেশ-বিদেশের শিল্পপ্রেমী মানুষের কাছে যাতে সহজেই পৌঁছায় তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় কাজের ক্ষেত্রে দৈহিক শ্রম কিছুটা কমানোর উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তুলে নবীন প্রজন্মকে এ কাজে উৎসাহিত করতে হবে। ভূতনাথবাবুর কাছে একথা জেনে ভালো লাগল স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের এই শিল্পকর্মে আগ্রহী করে তুলতে এবং নতুন নতুন শিল্পসামগ্রী তৈরির উৎসাহ দিতে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। তিনি তাঁর কর্মশালায় শ্রীকান্ত দে নামে এক ছাত্রের হাতে তৈরি পোড়ামাটির নাগরা জুতো দেখালেন যাতে পালকি ও নৌকায় সওয়ার এক রাজার জীবন তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আয়োজিত রাজ্যস্তরের হস্তশিল্প প্রতিযোগিতা (২০২৩-২৪)-য় সেটি দ্বিতীয় স্থান পায়। ইউনেস্কো ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি এবং বস্ত্র শিল্প দফতরের সহায়তায় পাঁচমুড়ায় মৃৎশিল্পীরা গড়ে তুলেছেন টেরাকোটার রুরাল ক্রাফট হাব। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বার্ধক্য ভাতা পাচ্ছেন বয়স্ক শিল্পীরা। পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদের সহায়তায় মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতি পাঁচমুড়ায় প্রতি বছর শীতকালে টেরাকোটা মেলার আয়োজন করে থাকে। এই মেলা ছাড়াও সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত রাজ্যের বিভিন্ন মেলায় পাঁচমুড়ার মৃত্‍‌শি‍‌ল্পীদের ডাক পড়ে৷ এই মেলাগুলোতে তাঁদের সামগ্রী বিপণনের সুযোগ থাকে। ভাবছিলাম আবার আসব ফিরে পাঁচমুড়ায়। এক শীতের সকালে। টেরাকোটা মেলার সময়।তথ্যসূত্রঃ
(১) নিজস্ব ঘরানায় সমৃদ্ধ পাঁচমুড়ার টেরাকোটা-গণপতি কুম্ভকার
(২) পূজা পার্বণের উৎসকথা-পল্লব সেনগুপ্ত
তথ্য প্রদানের জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি পাঁচমুড়ার মৃৎশিল্পী ভূতনাথ কুম্ভকার,ধীরেন্দ্রনাথ কুম্ভকার, পশুপতি কুম্ভকার ও চন্ডীদাস কুম্ভকারের প্রতি।
ছবি:সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়
***********************************

সুতপা  বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন’-এ স্নাতকোত্তর সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম আগ্রহের বিষয় লেখালেখি। ‘কালান্তর’, ‘সুস্বাস্থ্য’,’উৎস মানুষ’,’টপ কোয়ার্ক’,’যুক্তিবাদী’,’এখন বিসংবাদ’,’মানব জমিন’,’আবাদভূমি’,’সাহিত্য সমাজ’,’অভিক্ষেপ’ ইত্যাদি বেশ কিছু পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা,নিবন্ধ,প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র প্রকাশিত। তাঁর সম্পাদনায় ‘র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন’ প্রকাশন থেকে ড. পবিত্র সরকারের ভূমিকা সহ প্রকাশিত ‘ছোটোদের কুসংস্কার বিরোধী গল্প’-র দুটি খন্ড। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে মরণোত্তর দেহদান-আন্দোলন ও উত্তরণ’ বইটি বিশেষভাবে প্রশংসিত। একটি ‘ফেসবুক পেজ’-এ চলচ্চিত্রাভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী কানন দেবীর জীবনভিত্তিক তাঁর একটি গবেষণামূলক কাজ-ও পাঠকমহলে সমাদৃত। লেখার জগতের বাইরে সংগীতশিল্পী এবং বিজ্ঞান ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী হিসাবে তিনি সমধিক পরিচিত।                 

2 Comments

  • চিন্ময় চক্রবর্তী

    কি অপূর্ব তথ্যসম্বৃদ্ধ অথচ মনমুগ্ধকর রচনা। আমার খুব খুব ভাল লাগলো। বাঁকুড়া থেকে বাড়ীতে আনা রাঙাঘোড়াটা আজ আমার চোখে জীবন্ত হয়ে উঠলো। ভাল থাকো সুতপা আরও লেখো। কত কি জানিনা তাই ভাবছি শুধু। কত কিছু আছে আমাদের।

  • Dr. Swayamdipta Bag

    অসাধারণ! লেখার ধরনটি খুব সুন্দর…পাঠককে টেনে রাখে একেবারে শেষ পর্যন্ত।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!