শিকড়ের খোঁজে
সাথী সেনগুপ্ত
‘কোথায় যাইবেন?’- ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করে।
‘কিশোর গঞ্জ।‘
‘কিশোর গঞ্জের কোথায়?’
‘একটা গ্রামে। গ্রামটার নাম চারপাড়া।‘
ড্রাইভার জিভ দিয়ে একটা চিড়িক করে শব্দ করে,‘কতই তো গ্রাম আছে।‘
হ্যাঁ,তাইতো। স্মৃতির পাতা হাতড়ে বেড়াই। ঠাকুমার মুখে শোনা অজস্র নাম। জেলা ময়মনসিংহ,মহকুমা কিশোর গঞ্জ। আর, আর হ্যাঁ থানা কইট্যাদি (কটিহাদি),গ্রাম–চারপাড়া। আর হ্যাঁ,আরো মনে পড়ে,আশে পাশের গ্রামের নাম ‘আচমিতা‘ আর ‘মসুয়া‘।
মসুয়া হল সত্যজিৎ রায়ের দেশের বাড়ি।
এবার ড্রাইভার বলে ‘বেশ,চলেন। কিশোর গঞ্জের দিকে যাই। তারপর জিগাইয়া লমু।‘
চলতে শুরু করি। মাথার মধ্যে বিজ বিজ করে অসংখ্য ছেঁড়া ছেঁড়া কথা। ঠাকুমার মুখে শোনা কত ঘটনা, কত মানুষের নাম,কত স্থানের নাম। ইস্ তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন। অথচ গত হয়েছেন তাও বাইশ বছর হয়ে গেল। আমারই তো কত বয়স হয়ে গেল। যেসব কথাগুলো এই বয়সে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছেনা সেগুলো সব জিজ্ঞেস করে নিতাম। বুড়ির যে কি অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ছিল। তার কিছুটাও যদি পেতাম।
গাড়ি কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করে। দুপাশে অসংখ্য ঘর বাড়ি,খামার,ধানক্ষেত,গাছপালা। মাঝখান দিয়ে চওড়া গাড়ি যাবার মত ঝকঝকে বাঁধানো সড়ক।
ড্রাইভার বলে ‘এইবারে জিজ্ঞাস কইরা লন।‘
জিজ্ঞেস করি। পথচারী মানুষ আরো এগিয়ে যেতে বলে। চলতে থাকি। দুচোখ ভরে গিলতে থাকি চারপাশের দৃশ্য।
এক আশ্চর্য ভ্রমণ। স্বপ্নদেশে যাত্রা। চারপাড়া গ্রাম কি বাস্তবে আছে ? সেতো শুধু ঠাকুমার গল্পে ছিল। সেখানেই নাকি ছিল আমাদের পিতৃপুরুষের ভিটে মাটি। ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল কিছু মানুষের পায়ের তলার মাটি। নিজের দেশের শেকড় ছিঁড়ে এদেশে এসে নতুন করে বসত শুরু। এদেশে তারা নিঃস্ব,সহায় সম্বলহীন। চারিদিকে শুধু নেই নেই রব। বাড়ি নেই,ঘর নেই,জমি নেই,অর্থ নেই,খাদ্য নেই,নেই সম্মানও। শেকড় ছেঁড়া মানুষেরা তো পরগাছা। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তখন তাদের প্রতি বিরক্ত। উড়ে এসে জুড়ে বসা,ঘাড়ে চাপা মানুষকে কেই বা পছন্দ করে। দলে দলে মানুষ এসেছে শরণার্থী হয়ে। উদ্বাস্তু,রিফিউজি শব্দগুলি এদের নামের সঙ্গে পরিচয় হিসেবে সেঁটে গিয়েছিল। যাদের তারা দয়া করে থাকতে দিয়েছে এদেশে,তাদের রীতি নীতি,আদব কায়দা সবই যে এদের কাছে ভিন্নরীতির,কেমন যেন গোত্র ছাড়া। তারপর দিন রাত হাঁ–হুতোশ,রাজা উজির মারা গল্প,আমাদের হ্যান ছিল আর ত্যান ছিল। আবার এদের জন্যেই তো দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। কাজ কারবার,খাদ্য,সবেতেই টানাটানি। দেশের অর্থনীতির অবস্থার হাঁড়ির হাল।… আর ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষের কঠোর সংগ্রামী দিনাতিপাত। পায়ের তলার মাটিটুকু প্রতিষ্ঠা করতে দিবারাত্র পরিশ্রম। আর আমরা,যাদের জন্ম স্বাধীন ভারতবর্ষে তারা ছোটবেলায় বাবা কাকাদের লড়াই দেখেছি,মা ঠাকুমার চোখের জল আর মুখের গল্পকথা শুনেছি অথচ আমাদের স্মৃতিতে কোন ফেলে আসা শস্য শ্যামলা বঙ্গভূমি নেই।…সময় এগিয়েছে আমাদের আগের প্রজন্ম অপসৃয়মান আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো বিশ্ব নাগরিক। তখন নেহাতই ভ্রমণ বিলাসীর ঔৎসুক্য নিয়ে যাত্রা করেছিলাম প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। সেখানে এসে যোগাযোগ হয়েছে দেশ ভাগের পরও ওপার বাংলায় থেকে যাওয়া আত্মীয় স্বজন এবং ওদেশেই বড় হয়ে ওঠা আমাদের সমপ্রজন্মর ভাই বোনদের সঙ্গে। এ এক অদ্ভুত অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এদের কথা শুনেছি। কখনো সখনো কারুর কারুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু এমন আন্তরিক ভাবে একত্র হবার মুহূর্ত কখনো আসবে সে কথা কখনো ভাবিনি।
তখনই মনে হল ছোটবেলায় ঠাকুমার কথা। তাকে দিনরাত ক্ষ্যাপাতাম ‘হ্যাঁ,তোমাদের তো সবই ছিল। তোমরা সবাই রাজা জমিদার ছিলে।‘
ঠাকুমা রেগে যেতেন,বলতেন ‘হ,তোরা কি বুঝবি? হগল কিছু ছাইড়্যা আওনের দুঃখু তরা বুঝবি না।‘
সেই স্বপ্ন দেশের বৃত্তান্ত জানবার উদ্দেশ্যেই যাত্রা।
চলতে চলতে অবশেষে চোখে পড়ল সাইনবোর্ড,তাতে বাংলায় লেখা ‘আচমিতা‘। নামটা চেনা। কিন্তু শব্দের অর্থ জানা নেই। ‘এই তো,এই তো এসে পড়েছি। এই তো চেনা নাম।‘ উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠি। পথ চলতি মানুষকে আবার জিজ্ঞাসা। তখন ভর দুপুর,খাওয়া নেই দাওয়া নেই। নেহাতই ডিসেম্বর মাস তাই,তাই পথ যতই সুদীর্ঘ হোক,রৌদ্র প্রখরতর নয়। বরং রোদ্দুরের বেশ নরম ঢিমে ভাব।….আরো এগিয়ে চলি। অবশেষে ছায়া সুনিবিড়,শান্তির নীড়ের মধ্যেই আরেকটি সাইন বোর্ড। লেখা ‘মৎস প্রজনন কেন্দ্র‘ গ্রাম চারিপাড়া। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না। বানান করে যে নামটা পড়ছি সেটা সত্যি তো। নাকি দৃষ্টি বিভ্রম। আরেকটু এগিয়ে যাই। চারিদিকে গাছপালায় সবুজ। পুকুর পাড় ঘেঁসে প্রচুর কলাগাছ।
বাংলাদেশে শীত বেশ জাঁকিয়েই পড়ে কিন্তু গাছপালা সেভাবে পর্ণমোচী নয়। খানিকটা আমাদের উত্তর বঙ্গের প্রকৃতির মত।
রাস্তার ধারে ছোট ঝোপড়ি চায়ের দোকান। দোকানে একটি বছর বারো তেরোর ছেলে এঁটো চায়ের কাঁচের গেলাস ধুচ্ছে। তাকেই জিজ্ঞেস করি ‘এ গ্রামের নাম কি চারপাড়া?’ সে অবাক হয়ে বলে ‘হ্যাঁ।‘
আমি তাকে বলি আমার পূর্ব পুরুষের নাম। জিজ্ঞেস করি তাদের বাড়ির কথা। ছেলেটি বলে-‘আব্বা জানে।‘
আব্বা এলেন। চল্লিশোর্ধ বয়স। আমার কথা শুনে বললেন-‘হ্যাঁ জানি। তবে আমার আব্বাজান আরো ভাল বলতে পারবেন।‘ তারপরই ছোট ছেলেটিকে পাঠালেন ডেকে আনবার জন্য। আমরা দোকানের সামনে পাতা কাঠের বেঞ্চে বসি। মধ্যবয়সী মানুষটিকে চায়ের অর্ডার করি। উনি খুব যত্ন করে গরমজলে কাঁচের গ্লাস ধুয়ে আমাদের চা দেন। আমরা তৃপ্তি করে চা খাই।
ওরা ডেকে আনে একজন বৃদ্ধ মানুষকে। উনি এসে সালাম জানান। আমরাও প্রতি নমস্কার করে তাকে জিজ্ঞেস করি আমার পূর্বপুরুষের নাম। বাবা কাকাদের নাম। উনি চিনতে পারেন। বলেন এক সময় এ অঞ্চলে রায় পরিবারের বিস্তৃত জায়গা জমি এবং আধিপত্যর কথা। সময়টা ভর দুপুর হলেও জুটে যায় দু চারজন গ্রামের মানুষ। আমাদের প্রতি সকলের কৌতুহলের দৃষ্টি। একজন বলল ‘উনাগো দালান খান তো অহনও (এখনো) আসে,দ্যাহাইয়া দাও। ‘প্রসঙ্গত উচ্চারণ করলেন আমার বাবার ঠাকুর্দার নাম। ঠাকুমার কাছে শুনেছি দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল তাঁর। প্রতাপ মানে শুধু বুদ্ধিবল নয় নিশ্চয়,সেই সঙ্গে বাহুবলও। উভয় বলের দ্বারাই তিনি বিশাল জমি জায়গার অধিকারী হয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে ক্রয় করেছিলেন তালুকদারির স্বত্ত্ব | তাঁর তৈরি দালানটা রয়ে গেছে এখনো? আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি। ঠাকুমার মুখে শুনেছি যে তাঁর শ্বশুর মশাই এক লাখ ইট তৈরি করিয়ে মস্ত এক দশ কোঠার দালান বাড়ি বানিয়েছিলেন সেই আমলে। সেই বাড়িরই কথা বলছে নাকি এরা? আছে সেটা এখনো? ‘তারা মাস্টার‘ নামের এক ভদ্রলোককে কে যেন ডেকে আনলেন। তারা মাস্টার এক মুসলমান ভদ্রলোক, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। একটা বড় সড় মুসলিম নাম ও আছে তার। আমাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি দেখান বিস্তৃত জমি জায়গা,পুকুর,শস্যক্ষেত্র। বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেই রায়েদের দালানবাড়ি। ভগ্ন দশা, তবু এতেই এরা সপরিবারে বসবাস করেন। বাড়ির একদিকে গোয়ালঘর। গাই বাছুর বাঁধা আছে। তারা মাস্টার বলতে থাকেন – ‘ওই দিকটাতেই আপনাগো দুর্গামন্ডপ আছিল,দুর্গা পুজা হইত। ‘আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। মনের মধ্যে নানা ছবি আঁকা হতে থাকে। এই বাড়ি,পুকুর,জমি,জায়গা,বাগান সব কিছুর গল্প আমি জানি। ঠাকুমার মুখে শোনা গল্প। স্বপ্নে আমি কতবার এখানে এসেছি। একটার পর একটা নাম ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। আর আশ্চর্য আমার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের কি মিল। সময় যেন থমকে আছে এখানে। এখানে এই গাছপালার ভিড়ে আমি যেন খুঁজে পেতে পারি আমার ঠাকুমার হাতে লাগানো আমগাছটিকে। আমি স্বপ্ন তাড়িতের মত লোকটির পিছু পিছু হাঁটতে থাকি,কখনো দীঘির পাড় দিয়ে,কখনো বা জমির আলপথ বেয়ে। লোকটি আঙুল নির্দেশ করে কত কথাই বলতে থাকে। দুপুরের খর রোদে ভদ্রলোকের পিছু পিছু পথ হাঁটছি। ভুলে গেছি খিদে,তেষ্টা,পায়ের ব্যথা। পিছিয়ে পড়েছে আমার সঙ্গীরা,আমার স্বামী,ছেলে,মেয়ে। আমি পেছন ফিরে দেখছি না। তারা মাস্টার আমায় কি বলছেন তার সবটা আমার কানে ঢুকেও ঢুকছেনা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি অন্য জগৎ। অন্য মানুষ জন। —আমার আত্মীয় স্বজন পূর্ব পুরুষেরা। কানে শুনতে পাচ্ছি তাদের কথা বার্তা। বাড়ির পেছন দিককার গাছ পালার ছায়া ঘেরা পুকুরটিকে দেখে মনে হল এই ঘাট বেয়ে নীলাম্বরীর ঘোমটা টানা যে বালিকা বধূটি স্নান করতে আসত,সেই আমার ঠাকুমা। তারা মাস্টার দিগন্ত বিস্তৃত খোলা শস্যক্ষেত্র দেখিয়ে বলতে থাকেন ‘এই সমস্তই আপনেদের জমি আছিল। রায়দের প্রজারা থাকত,চাষ বাস করত।‘ মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ,পায়ের তলায় সবুজ ক্ষেত্রভূমি, তার ওপর হালকা শীতরোদের আস্তরণ,সবকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বিমিশ্র অনুভূতি হয় মনেহয় ঠিক কতটা জমি মানুষের প্রয়োজন? যে বিশাল সম্পদের অধিকারী ছিলেন আমার পূর্বপুরুষেরা সবটাই তাদের প্রয়োজন ছিল? এই ভূ সম্পত্তি সবটাই তারা কি ন্যায়ের পথে অধিকার করেছিলেন? এমন নানাবিধ প্রশ্ন জাগে,আবার মনে হয় তাদের পরবর্তী পুরুষেরা আমাদের আগের প্রজন্ম দেশভাগের ফলে,মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হয়ে দুই পুরুষ ধরে ভোগ করলেন সেটাও কি তাদের পাওনা ছিল? এমন বহুতর প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে।
পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে একটি প্রণাম রাখি। এক টুকরো ভূমি খন্ড দুহাতে নিই,পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার হিসেবে নয় যেন শুধুই আমার শিকড়ে ফেরার চিহ্ন হিসেবে।
***************************
সাথী সেনগুপ্ত পরিচিতি:
প্রায় দু দশকের ওপর ছোটগল্প লিখছেন। প্রকাশিত হয়েছে দেশ,সাপ্তাহিক বর্তমান,উনিশ কুড়ি,ফেমিনা বাংলা,তথ্যকেন্দ্র,আনন্দমেলা,সন্দেশ,শুকতারা প্রভৃতি বিখ্যাত বানিজ্যিক পত্রিকায় এবং বিভিন্ন অবানিজ্যিক ছোট পত্রিকায়। প্রকাশিত গল্প সংকলন দুটি। সুহা এবং গুপি চোরের কান্ড। ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষকতা করেন। শখ-আবৃত্তি চর্চা,বইপড়া,ভ্রমণ এবং অবশ্যই লেখালেখি।
কি ভালো লাগল রে… কত কিছু খুঁজে পাওয়ার ভালোবাসাময় স্মৃতিবেদনা…
খুব ভালো লাগলো। মায়ের কাছে শোনা দেশ মনে হচ্ছিল স