টংকাবতির পাহাড়ে
মোতাজিদ খুররম
নদী–পাহাড়–অরণ্য মানুষকে টানে,পিন্টুকে টানে একটু বেশি। আমরা যাচ্ছি পিন্টুর রবার বাগান দেখতে। বাগানটা জঙ্গলের গভীরে।
জীপ গন্তব্যে পৌঁছে গেল। জায়গাটার নাম টংকাবতি। নামটা সুন্দর। নামের পিছনে একটা কিংবদন্তি আছে,সেটা আরও সুন্দর।
সম্রাট শাহজাহানকে বন্দি করার পর তার ছেলে আওরঙ্গজেব ভাইদের হত্যা করতে শুরু করে একে একে। প্রাণের ভয়ে মেজো ভাই সুজা রওনা দেন আরাকানের দিকে। পথে পড়ে এই ঘন অরণ্যের রাজ্য। এখানে তিনি কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। সেই সময় এক সুন্দরী মারমা নারীর প্রেমে পড়েন সুজা।
আরাকানে চলে যাওয়ার আগে সেই নারীকে তিনি উপহার দিয়ে যান বাদশাহি মোহর আর মূল্যবান অলঙ্কারে ভরা এক সিন্দুক। অলঙ্কারগুলো সেই নারী ব্যবহার করেছেন নিজের কাজে আর মোহর ভরা সিন্দুকটি পুঁতে রেখেছেন এই অরণ্যভূমির কোনো এক পাহাড়ে।
‘কোন্ পাহাড়ে আছে সেই সিন্দুক–কেউ জানে না’ পিন্টু মজা করে বললো,‘সেই গুপ্তধনই আমি খুঁজতে এসেছি এখানে,বুঝলেন ভাই? ঐ মারমা সুন্দরীর নামে জায়গাটার নাম হয়েছে টংকাবতি।‘
কিরণের সঙ্গে পরিচয় হলো। সে পিন্টুর ভাতিজা। বয়স সাতাশ–আঠাশের মতো। লেখাপড়া তার ভালো লাগেনি,তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে অল্প বয়সেই মধ্যপ্রাচ্যে চলে গিয়েছিল,ভাগ্যের সন্ধানে। সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। পিন্টু তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে নিজের কাছে। সেই থেকে সে চাচার সঙ্গেই আছে ছায়ার মতো।
এই গভীর জঙ্গলে প্রথমে থাকারও কোনো জায়গা ছিল না ওদের। এখানে একদিন দেখা মিলে গেল ইমান আলির। ইমান আলি একজন শিকারি। ফাঁদ পেতে পাখি ধরে ইমান। ময়না পাখি। সেই পাখিকে কথা শিখায়। মজার মজার কথা। তারপর কথা বলা পাখি নিয়ে ঢাকা শহরে বিক্রি করে। গভীর জঙ্গলে ইমান আলির কুটিরে ঢুকে ওরা অবাক হয়ে গেল। খাঁচায় ঝুলছে অনেক ময়না পাখি। দাওয়ায় পা দিতেই একটা পাখি তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করলো ‘তুমি কে? তুমি কে,অ্যাঁ…??’
কোথা থেকে বেশ কয়েকজন লোক জোগাড় করে আনলো ইমান আলি। তাদের সাহায্যে খুব দ্রুত একটা চালাঘর তৈরি হয়ে গেল। চালাঘরে থাকতে শুরু করলো তিনজনে। রাবার বাগানের কাজ এগোতে থাকে।
…দুপুরে খাওয়ার পর গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে আছি আমরা সবাই। চা তৈরি হচ্ছে। ইলিয়াস পিন্টুকে বললো-‘আচ্ছা,অ্যাডভেঞ্চারের গল্প তো অনেক হলো। প্রেম–ট্রেম কিছু করনি? তোমার প্রেমের গল্পটা শুনি এবার।‘
পিন্টু হো হো করে হাসলো কিছুক্ষণ,তারপর বললো,’ঠিক আছে,আগে অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা বলে নিই। তারপর প্রেম কাহানি শোনাবো।‘ এইসময় চা এসে গেলো। লেবু দেওয়া লাল চা। চায়ে চুমুক দিয়ে পিন্টু ওর গল্প শুরু করলো–
বাগানের প্ল্যান প্রোগ্রাম হয় রফিকের বাসায়। রফিকের মা নাই। ছোট বোন ইতিই সংসার সামলায়। একদিন পিন্টু যখন বেরিয়ে আসছে ইতি সামনে এসে দাঁড়ালো-‘পিন্টু ভাই,আপনারা এবার ক‘দিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন?’
– বেড়াতে এসেছি?
– না তো কী! জঙ্গলই তো আপনাদের ঘরবাড়ি। আপনার আর ভাইয়ার।
– তা অবশ্য ঠিক। তবে শোনো,এবার তোমাকেও নিয়ে যাবো–
– সে তো কবে থেকেই শুনছি। ভাইয়াও বলে। নেওয়া কিন্তু হয় না।
– এবার ঠিক হবে। নতুন চালাটা তৈরি হোক,তারপরই–
– এবার যদি না নিয়ে যান,আপনার একটা জংলি নাম দিবো আমি ঠিক করেছি। কি নাম জানেন?
– না তো,কী নাম?
– হটেনটট!
– হটেনটট আবার কী?
– আফ্রিকার একটা জংলি ট্রাইব…।
হিহি করে হাসতে থাকে ইতি। পিন্টুর মনে হয় ইতির হাসিটা টংকাবতি পাহাড়ের ঝর্ণার মতো। তারপর ভাবে হটেনটট নামটাও তো খারাপ না।
ছুটির আমেজে যাচ্ছিলো দিনগুলি। পিন্টুর ইচ্ছা ছিল সপ্তাহ দুয়েক ছুটি কাটাবে। কিন্তু তিন দিনের দিন ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো। কিরণের ফোন। কাঁদো কাঁদো গলায় ও বললো, ‘কাকা এখানে সমস্যা,তাড়াতাড়ি একবার আসেন।‘
– কী সমস্যা?
–পাহাড়িরা ঝামেলা করছে। ওদের গরুগুলো চারাগাছ খেয়ে নিচ্ছে।
চারাগাছ খেয়ে নিলে বাগানই তো শেষ! সেদিনই বান্দরবানের বাস ধরলো পিন্টু আর রফিক। পরদিন সকালেই ওরা তিনজন রওনা দিল পাহাড়িদের মোড়ল হেডম্যানের বাড়ির দিকে। দূরের পাহাড়ে তার বাড়ি। বেলা এগারোটার দিকে সেখানে পৌঁছে গেল ওরা। গিয়ে শুনলো দুদিন আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে হেডম্যান। এখন পাশের টংঘরে বসে আনন্দ করছে বন্ধুদের সঙ্গে। রফিক বললো,’ভালোই হলো। ব্যাটা ফেসটিভ মুডে আছে। আমাদের ঝামেলা মিটে যাবে সহজেই।‘
কিন্তু ঘটলো ঠিক উল্টো। ঘরে ঢুকতেই সেটা টের পেল ওরা–খুব শীতল অভ্যর্থনা জুটলো ওদের। নমস্কার দিয়ে দাঁড়ালো ওরা। কেউ উত্তর দিল না, বসতেও বললো না।
নিজেরাই বসলো ওরা। বাইরে থেকে এসে ঘরে একটু অন্ধকার মনে হচ্ছিলো। চোখ সয়ে গেলে দেখলো চার–পাঁচজন লোক বসে আছে একপাশের বেড়ায় হেলান দিয়ে। সবার সামনে পানপাত্র। পাশে একটা কলসি। ঘরের ভিতরে বিশ্রী একটা ঝাঁঝালো গন্ধ। গন্ধটা পিন্টুর চেনা–পাহাড়ি চুল্লু খাচ্ছে ব্যাটারা।
মাঝখানের বলিষ্ঠ চেহারার গোলমুখের লোকটা হেডম্যান। একনজরেই তাকে আলাদা করে চেনা যায়। আগেও দু‘একবার দেখেছে তাকে পিন্টু। তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে পিন্টু জিজ্ঞেস করলো,’হেডম্যান সাহেব,কেমন আছেন?’
কয়েক মুহূর্ত কোনো উত্তর নাই। তারপর গমগমে রাগি গলায় উত্তর এলো– ‘ভালো নাই। ভালো থাকবো কীভাবে? আপনারা তো আমাদের ভালো থাকতে দিচ্ছেন না।‘ পিন্টু দেখলো লক্ষণ খারাপ,প্রথমেই আক্রমণ।
মুখে হাসি ধরে রেখে ও বললো ‘কেন,কী হয়েছে?’
– ‘হয়নি কী? আপনারা পাহাড়গুলো সব কিনে নিচ্ছেন।‘ রেগেমেগে বললো হেডম্যান। ‘গাছ কেটে সব সাফ করে দিচ্ছেন!’
– গাছ কাটছি,সেই জায়গায় আবার নতুন গাছ লাগাচ্ছি, হেডম্যান সাহেব। আর পাহাড় আপনাদেরই আছে, আমরা শুধু লিজ নিয়েছি,বাগান করার জন্য।
– ‘বাগান করবেন আপনারা– তাতে আমাদের কী লাভ? আমাদের কী লাভ… বলেন!!’ বেশ চেঁচিয়েই শেষের কথাগুলো বললো হেডম্যান।
পিন্টু বুঝলো লোকটা নেশার ঘোরে আছে। ওকে চটানো যাবে না। অমায়িক হাসি দিয়ে ও বুঝাতে চেষ্টা করলো,’লাভ আছে হেডম্যান সাহেব। এখানে রবার বাগান হলে আপনাদের বেকার যুবকরা কাজ পাবে। বাগান হলে মানুষের বসত হবে– বাচ্চাদের স্কুল হবে,টিউবওয়েল বসবে,দোকানপাট হবে,কেনাবেচা চলবে– এসব তো আপনারাই করবেন-‘
হেডম্যানের পাশে সাদা মাথার লোকটা এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। বাটি তুলে চুমুক দিচ্ছিলো বারবার। হাত তুলে সে পিন্টুকে থামিয়ে দিল। বাটি নামিয়ে রেখে পাহাড়িদের টানা টানা উচ্চারণে সুন্দর বাংলায় বললো, ‘এসব ছেলেভুলানো কথা। আপনারা এসেছেন আমাদের রক্ত চুষে খেতে।‘
একটু থমকালো পিন্টু। অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। লোকটা হেডম্যানের কানে কানে কী যেন বললো। হেডম্যান রফিকের সামনে রাখা গিটারের ব্যাগটা দেখিয়ে বললো ‘ওর মধ্যে কী আছে? দেখতে পারি?’
এতক্ষণ এই ভয়ই করছিল পিন্টু। এগুলো ও আনতে চায়নি। কিন্তু রফিকের যুক্তির কাছে হার মেনে আনতে হয়েছে। যাই হোক,সেসব ভেবে আর লাভ নাই,মারাত্মক খেলাটা শেষ পর্যন্ত খেলতেই হবে।
জোর করে ধরে রাখা হাসিটা মুছে গেল পিন্টুর মুখ থেকে। তবু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ও বললো,’হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, দেখেন না।‘ বলে ব্যাগটা এগিয়ে দিলো। গিটারের ব্যাগ থেকে বের হলো রফিকের বাবার লাইসেন্স করা শটগান। হেডম্যানের সঙ্গীরা একটু অবাক হলো,চমকালোও কেউ কেউ,কিন্তু হেডম্যান নির্বিকার।
শটগানটা নেড়েচেড়ে দেখলো সে,তারপর হেসে বললো,’বাহ্ সুন্দর জিনিস তো! কিন্তু এগুলো তো পুলিশ মিলিটারির কাছে থাকে। আপনারা সঙ্গে রাখেন কেন?’
উত্তর রেডি ছিল। পিন্টু বললো,’এদিকে হাতির কেমন উৎপাত আপনি তো জানেন হেডম্যান সাহেব। মাস ছয়েক আগেও একবার বাগান তছনছ করেছিল। আপনাদের একটা ঘরও তখন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।‘
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে।‘ হাসলো হেডম্যান। চতুর হাসি। জিজ্ঞেস করলো,’গুলি আছে?’
– ‘আছে।‘
– ‘দেখতে পারি?’
পকেট থেকে গুলি বের করে দিল পিন্টু। ওর বুকের ভিতরে এখন হাতুড়ির শব্দ। কী ঘটতে যাচ্ছে কে জানে! হাত বাড়িয়ে গুলিটা নিল হেডম্যান। বন্দুকে ভরলো। তারপর অভ্যস্ত হাতে এক ঝটকায় ব্যারেলটা সোজা করেই পিন্টুর দিকে তাক করে বললো-‘গুলি করি?’
সাদা মাথার লোকটা চুমুক দিচ্ছিলো বাটিতে। তার হাত স্থির হয়ে গেল। এপাশে কেঁপে উঠলো রফিক– খুব ধীরে তার হাতটা এগিয়ে গেল বন্ধুর হাঁটুর উপর। হাতটা কাঁপছে টের পেল পিন্টু। ওর নিজের ভিতরটাও কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো সে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না।
হাহা করে হেসে উঠলো হেডম্যান। বললো ‘ভয় পেয়েছেন? পাহাড়ে এসেছেন বাগান করতে আর এইটুকুতেই ভয়?’ ব্যারেলটা সরিয়ে নিল সে। এবার তাক করলো ডানদিকের বড় জানালাটার দিকে। তারপর টিপে দিল ট্রিগার। বজ্রপাতের মতো শব্দ হলো ঘরের ভিতরে। শাদা চুলের বুড়োর বাটি থেকে ছলকে পড়লো পানীয়। হেডম্যান জিজ্ঞেস করলো,’আর গুলি আছে?’
– ‘আছে।‘
– ‘কয়টা?’
– ‘সাতটা। দেবো?’ পকেটে হাত দিল পিন্টু।
– ‘না থাক।‘ শটগানটা নিজের সামনে রাখলো হেডম্যান। ‘আপনারা কেন এসেছেন,বলেন।‘
– ‘আমাদের নতুন চারাগুলো খেয়ে নিচ্ছে আপনাদের গরু। সেটা জানাতে এসেছিলাম,যদি কোনো বিহিত হয়।‘ পিন্টুর ভিতরটা তখনো কাঁপছে।
– ‘কী বিহিত হবে?’ ধমকে উঠলো হেডম্যান। ‘এই গরু আমাদের জীবিকা। গরুগুলো পাহাড়ের নির্দিষ্ট রুট ধরে ঘাস লতাপাতা খেতে খেতে যায়–যেমন নির্দিষ্ট পথে যায় দলবদ্ধ হাতি, সেইরকম। গরুর চলার পথে আপনারা চারা পুঁতেছেন,বেড়া দিয়েছেন।‘
– ‘কিছু একটা ব্যবস্থা যদি করা যেত, আমাদের চারাগুলি বাঁচতো।‘ বিনীতভাবে বললো পিন্টু।
ও লক্ষ্য করেছে গুলির শব্দের পর ঘরের দুদিকের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে দুজন সশস্ত্র মানুষ। পিছনের দরজাতেও একজন। শান্তিবাহিনী কিনা কে জানে! রফিক আর কিরণও দেখেছে। রফিকের মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। গুলি হওয়ার পর পরই পিন্টুর পিছনে গা ঘেঁষে এসে বসেছে কিরণ। এখান থেকে প্রাণ নিয়ে আজকে ফিরতে পারলে হয়।
হেডম্যান রাগি গলায় বলতে লাগলো-‘আপনারা বাঙালিরা পাহাড়কে সম্মান করেন না। পাহাড়ের মানুষদের সম্মান করেন না। আমাদের শত শত বছরের রীতিনীতিকে অসম্মান করেন। আমাদের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয়-‘
পিন্টু বাধা দিল। বললো ‘আমার বাগানে পাহাড়ি মেয়েরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়–কাঠ কুড়ায়। সেখানে আজ পর্যন্ত কোন ঘটনা ঘটেনি। প্রত্যেকটা বাঙালি শ্রমিককে এবং কর্মচারীকে বলা আছে–যদি কোনো পাহাড়ি মেয়ে কোনো অভিযোগ করে,তাহলে তার কথাই সত্যি বলে ধরে নেওয়া হবে। টিজিং–এর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ছেলেকে শাস্তি দিয়ে সাথে সাথে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।‘
– ‘হ্যাঁ,আমি শুনেছি ঘটনাটা।‘ হেডম্যান বললো,’সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আপনারা আমাদের সমান মনে করেন না। বন্ধু মনে করেন না।‘
– ‘কেন করবো না?’ পিন্টু জোর দিয়ে বললো,’বন্ধু মনে করি বলেই তো আপনার কাছে এসেছি। আপনার বাসায় এসেছি কথা বলার জন্য,আলাপ করার জন্য।‘
এবার কৌতূকের হাসি খেলে গেল হেডম্যানের মুখে। ‘বন্ধু মনে করেন?’
পিন্টু উপর–নিচে মাথা নাড়তে লাগলো জোরে জোরে,মুখে বললো,’অবশ্যই করি।‘
হেডম্যান বললো,’তাহলে আসেন,পান করেন আমার সঙ্গে।‘
চায়ের কাপের মতো ছোট ছোট তিনটা বাটিতে কলসি থেকে পানীয় ঢাললো হেডম্যান। তারপর এগিয়ে দিল পিন্টুদের দিকে। হেডম্যানের সঙ্গীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। পিন্টু একটা কাপ দিল রফিককে। একটা দিল কিরণকে। একটা নিজে নিল। ঠোঁটে ছোঁয়াতে যাবে পিছন থেকে কিরণ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো ‘কাকা করেন কী! খাইয়েন না।‘
পিছনে না তাকিয়ে পিন্টু খুব মৃদু কন্ঠে জবাব দিল-‘হারামজাদা! দরজায় কারা খাড়ায় আছে,দেখছো? তাড়াতাড়ি খাও!’ বলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পুরো তরলটা গলায় ঢেলে দিল। রফিক মুখে ছুঁইয়ে মুখ বিকৃত করে নামিয়ে রাখলো। পিছনে কিরণের গলা শোনা গেলো–ইয়াল্লা! গলা তো পুড়ে গেল!
…সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নেমে যাচ্ছে। আমাদের এবার ফিরতে হবে। পিন্টু বললো,’চলেন,গল্প আর বেশি নাই। যেতে যেতে বাকিটা বলবো।‘ কিরণের কাছে বিদায় নিয়ে জিপে উঠলাম আমরা। পাহাড়ের গায়ে কমলা রঙের রোদ। আঁকাবাঁকা পথে জিপ ফিরে চললো চড়াই–উতরাই পার হয়ে বান্দরবান শহরের দিকে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর হোটেলের বারান্দায় বসে আড্ডা হচ্ছিলো। আমি বললাম,’তোমার হেডম্যানের গল্পটার শেষে কী হলো পিন্টু?’
– ঐ তো–বন্ধুত্ব হয়ে গেল হেডম্যানের সঙ্গে। তারপর হেভি খানাপিনা হলো। খেতে খেতে মৌখিক চুক্তি হয়ে গেল যে আমি বাচ্চাদের স্কুল,টিউবওয়েল এইসব করে দেবো। বিনিময়ে ওরা ওদের গরু সামলাবে। তবে হেডম্যানের ওখান থেকে ফিরবার সময় একটা মজা হয়েছিল। জিপে উঠবো এমন সময় হেডম্যান বললো,‘বন্ধু তোমাকে একটা কথা বলি।’
– বলেন।
– কখনো নিজের অস্ত্র কাউকে দিবা না।
– দিই নি তো।
– শটগানটা যে আমাকে দিয়েছিলে? গুলিও তো দিয়েছিলে।
– আমার অস্ত্র আমি আপনাকে দিইনি।
– সেটা কোথায়?
আমার পকেটে ছিল জিনিসটা। রফিকের বাবার সেভেন শ্যুটার রিভলভার। সেটা পকেট থেকে বের করে হেডম্যানকে দেখালাম। হেডম্যান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর অবাক হয়ে বললো– ‘সেইজন্যই ডান হাতটা তুমি সারাক্ষণ পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলে?’
আমি চুপ করে থাকলাম। হোহো করে হাসতে লাগলো হেডম্যান। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,’তুমি ওস্তাদ আছো। তুমি পারবে বন্ধু।‘ এরপর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তেমন কোনো ঝামেলা আর হয়নি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,’তোমার প্রেম কাহানির কী হলো?’
– ‘ইমান আলির কাছ থেকে আমি একটা অর্ডারি পাখি কিনেছিলাম। কথা বলা ময়না পাখি। অনেকেই কিনতো। একেকজন একেকরকম কথা শেখাতো পাখিকে। আমি শেখাতে বললাম– ‘ইতি,পিন্টু তোমাকে ভালোবাসে।‘
ইমান আলিকে নিষেধ করেছিলাম কথাটা যেন সে কাউকে না জানায়। কালো কাপড়ে খাঁচা মুড়ে পাখি ডেলিভারি দিল ইমান আলি। এভাবে মোড়ানো থাকলে পাখি চুপচাপ থাকে। হৈচৈ করে না।
পাখি নিয়ে ঢাকায় এলাম। এটা অনেক পরের কথা। রফিক ততদিনে বিদেশে চলে গেছে। দু‘একটা কথা বলে ইতি গেল আমার জন্য চা আনতে। আমি ভাবলাম দারুণ সারপ্রাইজ দিবো ইতিকে। চা নিয়ে এসে ও শুনবে পাখি বলছে– ‘ইতি,পিন্টু তোমাকে ভালোবাসে।‘
আচ্ছা,কেমন হবে তখন ওর মুখটা– খুশি হবে,নাকি রেগে যাবে…! এইসব ভাবতে ভাবতে খাঁচাটা ঝুলিয়ে দিলাম কাপড় শুকানোর দড়িতে। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলাম– ইতি যখনই আসবে,খাঁচার উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিবো–
ঐ তো আসছে ইতি। ওর হাতে চায়ের ট্রে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! একটানে কাপড়টা সরিয়ে দিলাম। পাখি চেঁচিয়ে উঠলো ‘আনিসা! পিন্টু তোমাকে ভালোবাসে।‘
আমি চমকে উঠলাম–এ কী! আনিসা কে? এই নাম কোত্থেকে এলো? পাখিকে বলি চুপ! চুপ!! পাখি আরও জোরে চেঁচায় ‘আনিসা! পিন্টু তোমাকে ভালোবাসে!’
পাখির কথা শুনে থমকে গেল ইতি,ওর সুন্দর মুখে কালো মেঘের ছায়া। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে টেবিলে ট্রে রাখলো ইতি। ভুরু কুঁচকে কঠিন গলায় আমাকে প্রশ্ন করলো,’আনিসা কে,পিন্টু ভাই?’
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,’ইমান আলি…ইমান আলি…!’
ইতির ভুরু আরও কুঁচকে গেল-‘ইমান আলি??’
আমি কোনোমতে বললাম ‘ইমান আলি ভুল করেছে!’
বলে আর অপেক্ষা করিনি। ইতিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। আজকেও একটা রিক্সা পেলাম। রিক্সাওয়ালাকে বললাম যেদিকে খুশি যান…।
——-
পিন্টুর গল্প শেষে একচোট হেসেছি সবাই। তারপরও কিছুক্ষণ গল্প হলো। বাইরে রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে। একে একে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো। ইতির কথাটা আর জিজ্ঞেস করা হলো না– কী হলো ইতির শেষে?
পরদিন সারাটা দিন আমরা ট্যুরিজম করলাম। স্বর্ণমন্দির দেখলাম,নীলাচল গেলাম,সাঙ্গু নদী আর চিম্বুক পাহাড় দেখলাম। রাতের বাসে ঢাকার দিকে রওনা দিলাম সবাই। প্রশ্নের উত্তরটা আর জানা হলো না। মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগলো।
অন্ধকার ভেদ করে ছুটছে বাস। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি। তন্দ্রার ভিতরে শুনলাম পিছনের সিটে মোবাইল বাজছে। পিন্টু ধরলো। আমার কানে ভেসে এলো পিন্টুর গলা,’হ্যাঁ ইতি, সকালেই পৌঁছে যাবো। তোমার জন্য মজার একটা গিফট কিনেছি…।‘
ঘুমের রাজ্যে ডুবে যেতে যেতে আমি একটু হাসলাম,স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম–
যাক,ইতিকে পাওয়া গেছে।
****************************
মোতাজিদ খুররম – জিও ফিজিসিস্ট,বাংলাদেশ