বিপ্লব ও আধ্যাত্মিকতার পীঠভূমি প্রবর্তক সংঘের দেবী দুর্গা ও ভারতমাতা আরাধনা
অনির্বাণ সাহা
দুর্গাপূজা;বাঙ্গালীদের কাছে একটি মহোৎসব,একটি মিলন উৎসব। কিন্তু এই দুর্গাপুজোর সাথে যখন দেশাত্মবোধ,আধ্যাত্মিকতা,বেদান্তবাদ,তন্ত্রসাধনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এবং যখন সেই দুর্গাপূজাটি বৈষ্ণব রীতিতে পালিত হয়,তখন সেই দুর্গাপুজাটির মাহাত্ম্য এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। তখন এটিকে শুধু দুর্গাপুজো না বলে দেশ মাতৃকার আরাধনা বলাই সম্ভবত ভালো। ব্রিটিশদের সামরিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে দেশবাসীর মনস্তাত্ত্বিক শক্তির সঞ্চয় ও তাদের বিরুদ্ধে লড়ার যে মানসিক অবলম্বনের প্রয়োজন হতো তার শক্তি তৎকালীন সময়ে এই সকল পুজো থেকেই মানুষ বা বিপ্লবীরা পেত। ঠিক এরকমই একটি পুজো অনুষ্ঠিত হয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত চন্দননগরের প্রবর্তক সংঘে। চন্দননগরের প্রবর্তক সংঘের কথা এলেই সবার আগে যাদের কথা মনে পড়ে তারা হলেন সংঘগুরু মতিলাল রায়,ঋষি অরবিন্দ ঘোষ,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বোস,বোমা বিশারদ মনীন্দ্রনাথ নায়েক,শহীদ কানাইলাল দত্ত,শ্রীশচন্দ্র ঘোষ,বিপ্লবী অরুণচন্দ্র দত্ত,কালাপানি জয়ী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নাম । এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়… ।এই পূজাটির সূচনাকাল সঠিকভাবে জানা না গেলেও প্রবর্তক সংঘের একটি শাখা প্রবর্তক আপনালয়ের বর্তমান সম্পাদক শ্রীযুক্ত প্রদীপ ব্যানার্জি মহাশয়ের মতে পুজোটি আনুমানিক আঠারো শতকের আশির দশকে শুরু হয় । যার অর্থ এই দুর্গাপুজোটি সার্ধ শতবর্ষ পালনের খুব নিকটে পৌঁছে গেছে। আসুন আজ এই পুজোটি সম্পর্কেই আমরা কিছু জানার চেষ্টা করব। তবে পুজো নিয়ে বলার আগে এই সংঘ এবং সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল রায়ের পরিবারকে নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন তাহলেই প্রসঙ্গটির যথার্থ সূচনা হবে। বিপ্লবী সাধক মতিলাল রায়ের পিতামহ শ্রীযুক্ত গোলকনাথ রায় ছিলেন উত্তরপ্রদেশের আদি বাসিন্দা। উত্তরপ্রদেশে আগ্রা থেকে প্রায় ৮৩ মাইল দূরে অবস্থিত মইনপুরে ছিল তাদের বাসস্থান প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো ওঁরা ছিলেন ক্ষেত্রী বংশীয়, সূত্রধর সম্প্রদায় ভুক্ত। গোলকনাথের যুবকবেলায় মইনপুরে একটি ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। পেটের দায়ে গোলকনাথের বাবা অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় ব্রিটিশদের সহায়তায় চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বাকিপুর নামক একটি অঞ্চলে। সময়টা তখন আনুমানিকভাবে ১৮৩০ সাল। তৎকালীন সময়ে বাকিপুর নৌশিল্পের জন্য ছিল একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ধীরে ধীরে বাল্যবয়স থেকেই গোলকনাথ বাকিপুরের নৌশিল্পের সাথে জড়িয়ে পরেন এবং পরবর্তী সময়ে এটাকেই তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে নৌশিল্পী বা নৌব্যবসায়ী হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ব্যবসায়িক সূত্রেই তৎকালীন এক ফরাসি নীলকর বণিকের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সেই ফরাসি নীলকর বণিকের নাম ছিল কিয়্যের সাহেব। ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক সূত্রেই ঐ কিয়্যের সাহেবের সাথে গোলকনাথের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখনই সেই ফরাসি সাহেব তাকে বাকিপুর ছেড়ে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে এসে ব্যবসা পাতার পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে গোলকনাথ সেই ফরাসি সাহেবের পরামর্শের মতো চন্দননগর উপস্থিত হন। ক্ষেত্রী বংশীয় ও সূত্রধর সম্প্রদায়ভুক্ত গোলকনাথের চন্দননগরেও নৌশিল্পের আসর জমাতে খুব বেশি দিন সময় লাগে নি। ততদিনে তার পুত্র বিহারীলাল রায়ও নিজেকে পিতার ব্যবসায় যুক্ত করেন এবং কাষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেন । শুধু পারিবারিক নৌশিল্প বা কাষ্ঠ ব্যবসায়ীই নয়,বিহারীলাল রায় রাস্তা তৈরীর কাজেও যথেষ্ট সুপরিচিত ছিলেন। চন্দননগরের গোস্বামীঘাটের নিকট বোড়াইচন্ডীতলায় গোলকনাথ রায় একটি ছোট ঠাকুরঘর ও ঠাকুরদালান সহ দ্বিতল বিশিষ্ট নিজ ভবন প্রস্তুত করেন । এই বাড়িতেই তিনি নিজের কাষ্ঠশিল্পের কারখানা প্রস্তুত করেন । যা পরবর্তী সময়ে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র ব্যবসা এবং তার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনই নয় গোলকনাথ রায় এই বাড়িতেই তার পিতার প্রস্তুত করা ঠাকুরদালানে শুরু করেন দুর্গাপূজা।
এই পূজাটি ঠিক কত সালে বা কবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা সঠিক অর্থে জানা না গেলেও প্রবর্তক আপনালয়ের বর্তমান সম্পাদক শ্রীযুক্ত প্রদীপ ব্যানার্জি মহাশয়ের দেওয়া তথ্য ও কিছু নথি থেকে আনুমান করা যায় যে, ১৮৮০ সাল নাগাদ যথেষ্ট ধুমধাম সহকারে ঢাকের বাদ্যি সহযোগে বৈষ্ণব মতে এক কাঠামো প্রতিমা মূর্তির উপাসনার মাধ্যমে সূচনা হয় এই রায় পরিবারের দেবী আরাধনার । বৈষ্ণব মতে এই পরিবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হওয়ায় কোনরূপ বলি দেবার প্রথা প্রারম্ভিক সময় থেকেই চালু নেই। তৎকালীন সময়ে এই ঠাকুরদালানেই শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে মৃৎশিল্পীরা এসে এককাঠামোর দেবী প্রতিমা প্রস্তুত করতেন। প্রথম বর্ষ থেকেই মহালয়ার প্রভাতে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে এই দেবী আরাধনার সূচনা করা হত। এরপরে সপ্তমী থেকে নবমী দুবেলা যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে ফল, নৈবেদ্য ও ভোগ সহযোগে বৈষ্ণব মতে দেবী আরাধনা করা হত। পরিবারের সকল সদস্য–সদস্যরা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল তথা শহরের অনেকেই মেতে উঠত এই পুজোর সাথে। সমৃদ্ধশালী ও প্রভাবশালী এই রায় পরিবারের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র দুর্গাপূজায় করা হত না,এই পূজা উপলক্ষে পরিবার ও কারখানার সাথে জড়িত সকলকে তো বটেই এছাড়াও স্থানীয় মানুষদেরও নতুন বস্ত্রদান করা হত। বিজয়া দশমীর দিন অপরাহ্ণে স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের মানুষদের (অনেকের মতে) সহযোগিতায় কাঁধে করে এই এককাঠামো দেবী মূর্তিকে গঙ্গার জলে বিসর্জনের মাধ্যমে পূজার পরিসমাপ্তি ঘটানো হত। প্রতিমা বিসর্জনের পর এই রায় পরিবারের ঠাকুরদালানে চলতো মিষ্টিমুখ ও বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা আদান প্রদান। এহেন পরিবারেই মাতৃ আরাধনা শুরুর তিন বছর পরেই অর্থাৎ ১৮৮৩ সালে বিহারীলাল রায়ের পরিবারে জন্ম হয় মতিলাল রায়ের। যিনি পরবর্তী সময়ে চন্দননগর তথা বাংলা তথা ভারতের এক অন্যতম বিপ্লবী এবং বিপ্লবী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও সংঘগুরু ছিলেন।
চন্দননগরের গোস্বামীঘাট অঞ্চলের নিবাসী বিহারীলাল রায়ের ব্যবসা ও প্রভাব প্রতিপত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে তার বাড়ির কারখানায় নির্মিত বিভিন্ন নিত্যনতুন কাঠের আসবাবপত্র কলকাতাতেও রপ্তানি হতে থাকে রাস্তা তৈরিতেও বিহারীলাল রায় যথেষ্ট নাম করেন। শুধু তাই নয় বস্ত্র শিল্পেও অল্পবিস্তর প্রভাব বিস্তার করেন তিনি । এভাবেই রায় পরিবারের দেবী আরাধনা চলছিল যথেষ্ট আড়ম্বরের সাথে। কিন্তু বিধিবাম…! ঘড়ির কাঁটার মত সময় ঘুরে চলে। আলোর পরে আসে অন্ধকার। ঠিক সেই ভাবেই আঠারো শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে (আনুমানিক ১৮৯৩ সালে) তার বাড়ির কাঠের কারখানায় আগুন লাগে। ভস্মিভূত হয়ে যায় সেই কারখানা। প্রভূত লোকসানের মুখোমুখি হন বিহারীলাল বাবু। এই লোকসানের প্রভাব তার রাস্তা নির্মাণের কাজে এবং বস্ত্র শিল্পেও পরে। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি মাথায় নিয়েও নিজ ব্যবসা, নিজ পরিবারকে যথাসম্ভব সচল রেখেছিলেন । সচল রেখেছিলেন মাতৃ আরাধনাও। কিন্তু বার্ধক্যের ভারে এবং ক্রমাগত বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় একসময় তার আর্থিক অনটন এতটাই প্রবল হয়ে পড়ে সে ১৯১৩ সালে শুধুমাত্র প্রতিমা পূজোর মাধ্যমেই নয়,ঘট–পটে পূজার মাধ্যমেও মাতৃ আরাধনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। বিহারীলাল বাবুর এই দুঃসময় তার পাশে এসে দাঁড়ান উত্তর চব্বিশ পরগনা নিবাসী স্থানীয় জুট মিলের ম্যানেজার সাগরকালী ঘোষ ও তার পত্নী। বিহারীলাল বাবুর সাথে তাদের পরিচয় ব্যবসায়িক সূত্রেই কিন্তু সেখান থেকেই তাদের পরিচয় পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সাগরকালী ঘোষ ও তার পত্নীর আর্থিক সহযোগিতায় রায় পরিবারের মাতৃ আরাধনায় ছেদ পড়েনি,শুধুমাত্র প্রতিমা পূজোর বদলে বাড়ির ঠাকুরদালানেই শুরু হয় পিতলের ঘটে ও পটে মাতৃ আরাধনা। কিন্তু ঠিক তার পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯১৪ সালে এই রায় পরিবারে নেমে আসে এক চরম দুঃসময়। বয়সের ভারে পরলোক গমন করেন বিহারীলাল রায়।
এই পুজোর সাথে বিপ্লবীদের যোগাযোগ আলোচনা করতে গেলে আবার কিছুটা পিছনে ফিরে যেতে হয়। পিতার মৃত্যুর সময়ে বিপ্লবী মতিলাল রায়ের বয়স প্রায় একুশ বছর। ততদিনে মতিলাল রায় চরমপন্থী বিপ্লবী আন্দোলনে প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছেন। তার সাথে যোগাযোগ হয়েছে অরবিন্দ ঘোষ ও তার ভাই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ,অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়,কানাইলাল দত্ত,শ্রীচন্দ্র ঘোষ,মনীন্দ্রনাথ নায়েক,উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ তরুণ তুর্কি বিপ্লবী যুবকের। বারীন্দ্রকুমার ঘোষের অনুপ্রেরণায় মতিলাল রায় ১৯০৭ সালে অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়,শ্রীশচন্দ্র ঘোষ,কানাইলাল দত্ত ও নগেন্দ্রনাথ ঘোষদের নিয়ে চন্দননগরে বিপ্লবী কার্যকলাপের সূত্রপাত করেন। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে শুধু উদ্বুদ্ধই করেননি তাঁকে জাপানে পালাতে অর্থ সাহায্যও করেছিলেন এই মতিলাল রায়। এছাড়াও চন্দননগরের স্থানীয় বিপ্লবী যুবকদের সাথে নিজ বাড়িতে এবং নিকটবর্তী বর্তমানের প্রবর্তক সংঘে বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে আলাপ আলোচনায় বসতেন এবং সেখানে বিপ্লবচর্চাও চলতো। ফলত চন্দননগরের স্থানীয় বিপ্লবী যুবকদের মতিলাল রায়ের বাড়িতে প্রায় সারা বছরই আনাগোনা লেগে থাকত। মোটামুটি সমসাময়িক সময়েই স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মতিলাল রায় স্থানীয় তরুণ তুর্কি যুবকদের নিয়ে “সৎপথাবলম্বী সম্প্রদায়” নামে একটি দল প্রস্তুত করেন। যার মূল কাজ ছিল মানুষদের সেবা প্রদান। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে এর বেশকিছু বছর আগে থেকেই বিভিন্ন স্থানে মাতৃ আরাধনার শুরু হয়। এই সৎপথাবলম্বী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত যুবকেরাও মাতৃশক্তির আরাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা সকলেই শরতের পুণ্য তিথিতে মতিলাল রায়ের বাড়িতে আয়োজিত দুর্গাপূজায় কোনো না কোনোভাবে কখনো না কখনো যুক্ত ছিলেন।
তবে এখানে উল্লেখ্য যে,পন্ডিচেরির প্রবর্তক আশ্রম থেকে প্রকাশিত “নিজের কথা” নামক একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে–১৯১০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি কর্মযোগীন দপ্তর থেকে আকস্মিকভাবেই শ্রী অরবিন্দ ঘোষ নৌকা যোগে চন্দননগরে এসে উপস্থিত হন আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে। তিনি প্রথমে নৌকাযোগে চন্দননগরের রানীঘাটে এসে উপস্থিত হন। সেখানে বেশকিছু সময় নৌকাতেই অপেক্ষা করার পর চন্দননগরের সুপরিচিত বিপ্লবী মতিলাল রায়ের সহযোগিতায় গোস্বামীঘাটে এসে পৌঁছান। শ্রী মতিলাল রায় তার নিজ বাড়িতেই শ্রী অরবিন্দ ঘোষকে আত্মগোপন করতে সহায়তা করেন। প্রায় এক মাসেরও কিছু বেশি সময় ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে চন্দননগরে আত্মগোপন করে থাকার পরে তিনি এখান থেকেই সোজা পন্ডিচেরির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন “যতীন্দ্র মিত্র” ছদ্মনামে। তারপরে ১৯১০ সালের মে মাসে পুণ্য অক্ষয়তৃতীয়ার দিন একটি চিঠি মতিলাল রায়ের হাতে এসে পরে। এই চিঠিতে তিনটি মূল মন্ত্র লেখা ছিল। এই তিনটি মূল মন্ত্র ছিল শ্রী অরবিন্দের তরফ থেকে শ্রী মতিলালের দীক্ষা। আর এই দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েই পরবর্তী কালে ১৯১৩–১৪ সাল নাগাদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রবর্তক সংঘ। যা পরবর্তীকালে বিপ্লবী আন্দোলন এবং আধ্যাত্মিক চেতনার মূল পীঠস্থান হয়ে ওঠে। আর তখন থেকেই এই রায় পরিবারের ঘটে–পটে দুর্গাপূজা প্রবর্তক সংঘের দুর্গাপূজা হিসেবেও পরিচিত হতে থাকে জনমানুষের মধ্যে। চন্দননগর হেরিটেজের ডিরেক্টর শ্রীযুক্ত করলেন চক্রবর্তী মহাশয়ের থেকে জানা যায় যে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা শ্রী বারীনচন্দ্র ঘোষ যখন চন্দননগরে চারুচন্দ্র রায় এবং মতিলাল রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন,সেই সময়টা ছিল পুজোর সময়। তিনি চারু বাবুর বাড়িতে এবং পরবর্তী সময় মতিলাল রায়ের বাড়িতে বিভিন্ন কার্যকলাপের বিষয়ে বসেন। শুধুমাত্র শ্রী অরবিন্দ ও তাঁর ভ্রাতা শ্রী বারীনচন্দ্র ঘোষই নন। এই পুজোর সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন আরো বহু বিপ্লবী তথা বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। তাঁরা হলেন যথাক্রমে বিপ্লবী অরুণচন্দ্র দত্ত,বিপ্লবী তিনকড়ি ঘোষ,বিপ্লবী বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়,বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,কালাপানি জয়ী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,বোমা বিশারদ মনীন্দ্রনাথ নায়েক প্রমুখ। এছাড়াও মতিলাল রায়ের সাথে চন্দননগরের বাইরের ও বহু মানুষের সহজ যোগসূত্র ছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উত্তরপাড়া অঞ্চলের তৎকালীন জমিদার শ্রীযুক্ত অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। তিনিও এই দেবী আরাধনার সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায় এবং পুজো উপলক্ষে তিনি এখানে উপস্থিত হন। তবে কত সালে তিনি এই পুজো উপলক্ষে এখানে আসেন তার সঠিক উল্লেখ পাওয়া যায় না।
১৯১৩ সালে “রায় পরিবারে” অর্থাভাবের তাড়নায় ঢাকের বাদ্যি ছাড়া যে ঘটে–পটে দুর্গাপূজার রীতি প্রচলিত হয়,প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠার পর সেই পূজাটি প্রবর্তক সংঘের দুর্গা পূজা নামে পরিচিত হয়। প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠার পরেই একটি বিশাল ঘট নেপাল থেকে আনয়ন করা হয় এবং সেই ঘটের উপর “ওঁ” প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের আধ্যাত্মিকতার মূল লক্ষ্য ও রীতি হল নিরাকার বন্দনা। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিমা পুজো করার মতো যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও এই কারণে এখনো অব্দি এই প্রতিষ্ঠানে দুর্গাপূজাতে ঘটে ও পটে আয়োজিত হয় কোনরকম বাদ্য যন্ত্র ছাড়াই।
মহালয়ার দিন ভোর পাঁচটায় প্রবর্তক সংঘের সকল অন্তরঙ্গ ও সহযোগী সদস্যরা (এছাড়াও এই প্রবর্তক সংঘে আরও দুই রকম সদস্যপদ দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলি হল যথাক্রমে আজীবন সদস্য এবং সাধারণ সদস্য) সমবেত উপাসনা করেন এবং তারপরে স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বীর বিপ্লবীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রবর্তক আশ্রমের সংঘ মাতার মূর্তির সামনে তিল তর্পণ করেন । তিল তর্পণের উপকরণ গুলি হল যথাক্রমে তিল,দূর্বা,যব এবং জল। তারপর চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী বন্দনার সূচনা হয় এই প্রবর্তক সংঘে। বর্তমানে বিগত ১৫ বছর ধরে শ্রীযুক্ত স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এই পুজোর সাথে পুরোহিত হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। এই পুজোটি আধ্যাত্মিক বেদান্ত ও বৈষ্ণব মতে পালিত হয় ফলে এই পুজোতে কোনরূপ বলির প্রথা প্রচলিত নেই। সপ্তমী থেকে নবমী প্রত্যহ ভোরে সংঘগুরু মতিলাল রায়ের বাণী পাঠ করা হয় এবং সন্ধ্যাবেলায় ঠিক ছটার সময় সমবেত উপাসনা করা হয়। তারপরেই দেবী মায়ের আরাধনা শুরু হয়। প্রবর্তক আপনালয়ের বর্তমান সম্পাদক শ্রীযুক্ত প্রদীপ ব্যানার্জি মহাশয়ের মতে,এখানে দেবী দুর্গার পূজার যে মন্ত্র উচ্চারিত হয় তা প্রথাগত দুর্গা পূজার মন্ত্রের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। সপ্তমী অষ্টমী এবং নবমীর পূজায় দেবীর উদ্দেশ্যে কোনরকম অন্নভোগ দেবার রীতি এখানে প্রচলিত নেই। তবে সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যা আরতির সময় লুচি এবং ভাজা দিয়ে শীতল দেওয়া হয়। দেবী মায়ের উদ্দেশ্যে অন্নভোগের রীতি না থাকলেও মহা নবমীর দিন দুপুরে–মাছ ভাত খাবার রীতি দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে। সম্ভবত এই রীতি আনুমানিক ১৯০৫ সাল থেকে রায় পরিবারে প্রচলিত ছিল। আর সেখান থেকেই এই রীতি প্রবর্তক সংঘে চলে আসে। তৎকালীন সময়ে পারিবারিক সদস্যরা তো বটেই স্থানীয় বেশকিছু মানুষ রায় পরিবারে এই মহানবমীর দুপুরের মাছ–ভাত খাওয়া দাওয়ায় উপস্থিত থাকতেন। পুজো সম্পর্কিত অন্যান্য রীতি–নীতির পরিবর্তন না ঘটলেও বর্তমানে মহানবমীর দিন দুপুরবেলার এই খাওয়া–দাওয়া প্রবর্তক সংঘের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিজয় দশমীর দিন সকালেই পূজা সমাপ্তি হওয়ার পর প্রথাগতভাবে সংঘের বর্তমান সভাপতি দেবীর ঘটটিকে কাঁসর–ঘন্টা সহযোগে নিয়ে যান বিসর্জনের উদ্দেশ্যে। প্রবর্তক সংঘের দেবী দুর্গার ঘটটিও আনুমানিক ১০০ বছরের প্রাচীন এবং বহু স্মৃতির জীবন্ত স্বাক্ষর। বিজয়া দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের পর ঠাকুরদালানে ফিরে এসে দেবী অপরাজিতার পূজার মাধ্যমে দেবী দুর্গার আরাধনার সমাপন ঘটে। প্রবর্তক সংঘের নিয়ম অনুযায়ী এরপরেই সদস্যদের মধ্যে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছার আদান–প্রদান তো চলেই,সাথে চলে সিরদ্ধি পান।
শুধু দুর্গাপূজায় নয়,এই একই সময় একই তিথিতে এই প্রবর্তক সঙ্গে আয়োজিত হয় ভারত মাতার আরাধনা। সনাতন হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র ও পরম্পরায় বিশ্বের পাঁচটি প্রধান উপাদানের অর্থাৎ ‘পঞ্চভূতের’ অন্যতম হলো ‘ক্ষিতি’ অর্থাৎ ভূমি। এই ক্ষিতি/ভূমি হচ্ছেন এক নারী রূপ,তিনি ‘ভূমিদেবী’ হিসেবেও পরিচিত। এই ভূমিদেবী একজন হিন্দু দেবী,যাকে আরো অনেক নামে ভূষিত করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন,পৃথ্বী,বসুন্ধরা,ভূদেবী,ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এই ভূমিদেবীর সন্তান। পৃথিবীর সমস্ত ধরনের সম্পর্কের মধ্যে প্রধানতম সম্পর্কই হচ্ছে ‘মা–সন্তানের সম্পর্ক’,যা ভারতীয় জীবন সংস্কৃতিতে এক অনন্য রূপ পেয়েছে। ভারতীয় সমাজে ধর্মীয়–সাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে জন্মদাত্রী মার স্থান অদ্বিতীয়। ভারতভূমির সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান ধারা হচ্ছে শাক্তধারা,যা প্রাচীন কাল থেকেই বহমান। যেখানে ‘শক্তি’ই মূল ধর্মতত্ত্ব। এই শক্তিকে পরমা নারীপ্রকৃতি সৃজনীশক্তি হিসাবে দেখা হয়েছে, যাকে হিন্দু ধারায় ‘পরমা মাতৃশক্তি’ বলা হয়েছে। যেহেতু ধার্মিক বিশ্বাসধারায় ভূমি তথা প্রকৃতিকে দেবী–মা হিসাবে পূজা করা হয়,তাই আমাদের জন্মভূমি তথা ভারতবর্ষ ভারতীয়দের কাছে পূজার্হ–ভারতমাতা হিসেবে। এই কল্পিত জন্মদাত্রী নারীশক্তি তথা ভারতমাতা কোথাও কোথাও দুর্গা,জগৎধাত্রী,কালী এমনকি অম্বা নামেও পূজিত হয়ে থাকে। আবার বেশ কিছু ঐতিহাসিকদের মতে এই ভারতমাতার আরাধনা দেশাত্মবোধের প্রতীক। তাঁদের মতে,এই ভারতমাতার আরাধনা তৎকালীন বিপ্লবীদের মধ্যে বিপ্লবী,ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করার একটি মাধ্যম।
তবে প্রবর্তক সংঘে এই ভারতমাতার পূজার প্রচলনের পটভূমি একটু ভিন্ন। আসুন এখন আমরা সেই পটভূমি নিয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করি। ১৯১০ সালে এক গভীর রাত্রে যখন শ্রী অরবিন্দ ঘোষ আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে চন্দননগরের গোস্বামীঘাটে এসে উপস্থিত হন,তখন মতিলাল রায় তাঁকে নিজ বাড়িতে ঠাকুর ঘরের পাশে একটি ছোট্ট গুদামঘরে আত্মগোপনের ব্যবস্থা করে দেন সকলের অগোচরে। এমনকি প্রারম্ভিকপর্বে তাঁর সহধর্মিনীকেও এ কথা জানতে দেন নি তিনি। সংঘগুরু মতিলাল রায় রচিত জীবনসঙ্গিনী বইয়ের প্রথম খন্ড থেকে জানা যায় যে,পরদিন সকালে মতিলাল রায়ের সহধর্মিনী শ্রীমতি রাধারানী দেবী দুইখানা গামছা পরে ঠাকুরঘর ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল পরিষ্কার করতে গেলে এক অপরিচিত মানুষকে দেখতে পান। সেই মুহূর্তে তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হন এবং অরবিন্দ বাবুও লজ্জায় জিহ্বা নির্গমন করেন। পরবর্তী সময়ে মতিলাল রায়ের সাথে আলাপচারিতায় শ্রী অরবিন্দ ঘোষ তাঁর পত্নীকে “দিব্য লক্ষ্যণা মাতৃমূর্তি” হিসাবে উল্লেখ করেন। পরবর্তী সময় এই মতিলাল রায়ই প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯২৫ সালে তিনি এই সংঘের সংঘগুরু পদে উপবিষ্ট হন। তখন থেকেই তার সহধর্মিনী শ্রীমতি রাধারানী দেবীও সংঘজননী বা সংঘমাতা হিসেবে পরিচিত হন। প্রবর্তক সংঘের সমস্ত সদস্য ও অনুগামীদের মধ্যে তৎকালীন সময় থেকেই সংঘজননী হলেন এক নারী শক্তির প্রতিরূপ,তিনি হলেন দেবী,আবার তিনিই হলেন “পরমা মাতৃশক্তি“। কিন্তু আকস্মিকভাবেই ১৯২৯ সালে সংঘজননী রাধারানী দেবী ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন। সংঘগুরু মতিলাল রায় পত্নী হারানোর প্রবল শোকে আচ্ছন্ন হন। আর প্রবর্তক সংঘের সকল সদস্য ও অনুগামীদের মধ্যে নেমে আসে মাতৃ শোকের কালো ছায়া। তার পরবর্তী সময় থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে সংঘজননীর ছবিতেই দুর্গা,কালী,লক্ষ্মী,জগদ্ধাত্রীর মিলিত নারীশক্তির প্রতিরূপ হিসেবে দেবী “পরমা মাতৃশক্তি“-এর আরাধনা শুরু হয় ভারতমাতার বন্দনার মাধ্যমে। সংঘমাতা রাধারানী দেবীর ছবির সাথে সাথে একটি ভারতমাতার ছবিও এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। দুর্গাপুজোর এই চারটি দিনে ফুলে মালায় সজ্জিত করা হয় সংঘমাতার ছবিকে। বিগত ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে পূজা করে চলা পুরোহিত শ্রীযুক্ত স্বপন কুমার চ্যাটার্জি মহাশয় জানান,দেবী দুর্গার ঘট এবং কলা বউ ভারত মাতার সামনেই প্রতিস্থাপন করা হয়। এবং তারপরেই প্রবর্তক সংঘের নির্দিষ্ট কিছু মন্ত্র ও স্তোত্রপাঠের মাধ্যমে কাঁসর–ঘন্টা সহযোগে শুরু হয় সংঘজননী তথা ভারতমাতা ও দশভূজার বন্দনা। এই রীতি আজও অমলিন ।
তথ্যসূত্র :
– সংঘগুরু মতিলাল রায় লিখিত জীবনসঙ্গিনী (প্রথম খন্ড)।
– পন্ডিচেরির প্রবর্তক আশ্রম থেকে প্রকাশিত “নিজের কথা” নামক একটি গ্রন্থ।
– bondesh.com ওয়েবপেজে ৬ই নভেম্বর,২০২০ তারিখে প্রকাশিত সুজিৎ রায় লিখিত “মা,মাতৃভূমি ও ভারত মাতা: ভারতীয় জীবনধারায় একসূত্রে বাঁধা” শীর্ষক প্রতিবেদন।
– উইকিপিডিয়া ওয়েবপেজ।
– সংঘগুরু মতিলাল রায় প্রতিষ্ঠিত প্রবর্তক সংঘের অপর এক শাখা প্রবর্তক আপনালয়ের বর্তমান সম্পাদক শ্রীযুক্ত প্রদীপ ব্যানার্জি মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
– বিগত পনেরো বছর ধরে প্রবর্তক আপনালয়ের দুর্গাপূজা করে চলা পুরোহিত শ্রীযুক্ত স্বপন কুমার চ্যাটার্জি মহাশয় এর সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী।
– “চন্দননগর হেরিটেজের” ডিরেক্টরের শ্রীযুক্ত চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
– ভারত সরকারের মানব কল্যাণ দপ্তর থেকে পুরস্কৃত হওয়া প্রাক্তন শিক্ষিকা তথা ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু শ্রীমতি সুলগ্না চক্রবর্তী মহাশয়ার সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।
***************************
অনির্বাণ সাহা – ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক