মন ভালো নেই
বাদল বসু
শীতের সকালে হালকা মিষ্টি রোদে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে খবরের কাগজ পড়া আমার বহুদিনের অভ্যাস।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকালের মিষ্টি রোদে গা এলিয়ে কাগজে চোখ রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই লক্ষ্য করলাম একটা ছোট্ট পাখি জানালার কাছে এসে বসলো। তারপর একটু একটু করে পাশে থাকা ডিশের দিকে খুব সন্তর্পণে এগিয়ে আসতে লাগলো | বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ডিশে রাখা বিস্কুটের লোভেই ওর এই গুটিগুটি পদচারণ। এরপর ইচ্ছে করেই চোখটাকে খবরের কাগজের দিকে মনোনিবেশ করলাম | কয়েক সেকেন্ড পরেই চোখ ঘোরাতেই দেখলাম ডিশের উপর রাখা বিস্কুট দুটো নেই। কোথায় গেল বিস্কুট ? আর পাখিটাকেও তো দেখতে পাচ্ছি না ! তবে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম রাস্তার ওপারের বাড়ির জানালার উপর সানসেটে বসে পাখিটা মহা আনন্দে ব্রেকফাস্ট সারছে | মা কাপ ডিশ নিতে এসে দেখলেন আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি | মা একটু এগিয়ে এসে আমার চোখের নিশানার দিকে তাকিয়ে বললেন,’কি সুন্দর পাখিটা ! লেজের দিকটা কি সুন্দর সাদা !’
দুদিন পর সেই পাখিটার সাথে আরও একটা পাখি এলো | এসেই ডিশের উপর রাখা বিস্কুট নিয়ে কিচিরমিচির শব্দে কাড়াকাড়ি শুরু করল। কয়েকদিন পর পাখির সংখ্যা পাঁচ এ গিয়ে দাঁড়ালো। বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রথমদিনে আসা পাখিটাই ওদের বন্ধুদের নিয়ে এসেছে | এসেই সবাই মিলে কিচির মিচির শব্দে বৃন্দগান শুরু করলো | প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও পরে আনন্দই পেতাম ওদের এই কলকাকলি দেখে | মা ও প্রথম প্রথম ওদের ওপর বিরক্ত হতেন–সকাল হতে না হতেই কেবল কিচিরমিচির ! দুদিন পর দেখলাম মা ও বোধহয় ওদের এই শব্দে সন্তুষ্ট হতেন এবং দুটোর বদলে সাত আট খানা বিস্কুট আলাদা একটা ডিশে জানালার কাছে রেখে দিতেন এবং যথারীতি মুহূর্তের মধ্যেই ডিশটা ফাঁকা হয়ে যেত |
এরপর হঠাৎ একদিন ওদের আসা বন্ধ হয়ে গেল | ওদের দেখতে না পেয়ে সকালটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো | প্রতিদিনের রুটিন বাঁধা বৃন্দগানের আনন্দ হঠাৎ বন্ধ হতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কর্মস্থলে গেলাম | এক সহকর্মী আমার দিকে তাকিয়েই বলল,’কিরে? চুপচাপ? শরীর ঠিক আছে তো?’
বললাম,’শরীর ঠিক আছে কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না।‘ |
‘তাহলে বাড়ি চলে যা,আমি এদিকটা সামলে নেব |’
তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বললাম,’এমনিই চলে এলাম |’
পরদিন সকালে অনিচ্ছুক মন নিয়ে সেই জানালার কাছে খবরের কাগজ নিয়ে বসলাম | একটু পরে মা চা নিয়ে এলেন। সঙ্গে আলাদা করে প্রতিদিনের মতো কয়েকটা বিস্কুট। সেই জানালার কাছে রেখে গেলেন। মা ভেবেছিলেন গতকাল খাবারের লোভে হয়তো অন্য কোথাও গেছে, আজ নিশ্চয়ই আসবে | চা খাওয়া শেষ হলো কিন্তু ওরা এলো না। এত দেরি তো কখনো করে না? গতকালও এলো না | ভাবতে ভাবতেই দেখলাম পাঁচটা নয় একটা পাখি এসে বসলো যার লেজের দিকটা সাদা,যে প্রথম দিন এসেছিল | সে কিন্তু আগের মতো কিচিরমিচির শব্দ করল না | এমনকি বিস্কুট নেবার কোন উৎসাহ ও দেখালো না। কি হলো ওর? আর অন্য পাখিগুলো এলো না কেন?
হঠাৎ শুনতে পেলাম ভেতরের ঘরে আমাদের কাজের মাসি মাকে বলছে,’মা কাল আপনাদের বাড়ি থেকে কাজ করে বাড়ি যাচ্ছিলাম,দেখলাম আপনাদের গেটের ওপারের দোতলা বাড়ির নিচে রাস্তার উপর দুটো পাখি মরে পড়ে আছে | হয়ত ইলেকট্রিক তারে জড়িয়ে গিয়েছিল | দেখে মনে হলো রোজ দাদার চা খাওয়ার সময় যে পাখিগুলো আসতো তারই দুটো |’
পরদিন থেকে ওই জানালার কাছে বসা বন্ধ করে দিলাম।
*********************************
কলকাতা নিবাসী বাদল বসু দীর্ঘদিন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন | বর্তমানে বাংলা সাহিত্য সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন |