মহাভারতের মাধবী
অজন্তা প্রবাহিতা
মহাভারতের উদ্যোগপর্বে নারদমুনি দুর্যোধনকে অতিরিক্ত আগ্রহী বা জেদি হওয়া কেন ভালো নয় তা বোঝাতে গালবের কাহিনী বলেছিলেন ।
ধর্মরাজ একদিন বিশ্বামিত্র মুনির পরীক্ষা নেবার কথা ভেবে বশিষ্ঠ মুনির রূপ ধারণ করে বিশ্বামিত্র মুনির কুটিরে অতিথি হিসেবে হাজির হন। বশিষ্ঠ মুনির আগমনে বিশ্বামিত্র অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁকে বিশ্রাম করতে বলেন এবং তিনি ক্ষীর বানাবার আয়োজন করতে শুরু করেন ।
বশিষ্ঠ রূপী ধর্মরাজ কোনরকম অপেক্ষা না করে অন্য আশ্রমে গিয়ে ভোজন সেরে নেন। এদিকে বিশ্বামিত্র মুনি ক্ষীরের পাত্র বশিষ্ঠ মুনিকে পরিবেশন করলে,উনি বলেন যে ইতিমধ্যে উনি ভোজন করে নিয়েছেন, এখন ক্ষীরের প্রয়োজন নেই। এই বলে তিনি আশ্রম ছেড়ে চলে যান।
অতিথিকে অন্ন দান করতে না পেরে ঋষি বিশ্বামিত্র সেই ক্ষীরের পাত্র মাথায় নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যতক্ষণ না এই অতিথি ফিরে এসে এই পরমান্ন গ্রহণ করবেন,ততক্ষণ তিনি নড়বেন না।
কাল গড়িয়ে যায় তিনি ঠায় দাড়িয়ে থাকেন। তাঁর আশেপাশে লম্বা লম্বা ঘাস জন্মাতে শুরু করে,শরীরের চারিদিকে পিঁপড়ে বাসা বানাতে শুরু করে। কিন্তু তিনি অটল। শিষ্য গালব গুরুর এই অবস্থা দেখে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তাঁর সেবা শুরু করেন। ধর্মরাজ দেখেন যে বিশ্বামিত্র তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার জন্য অনড় এবং অটল,তখন তিনি আবার ঋষি বশিষ্ঠের রূপ ধারণ করে সেখানে আসেন এবং ক্ষীর খান। বিশ্বামিত্র মুনির তপোবলে সেই ক্ষীর তখনও তাজা,বাসি হয়ে যায় নি।
ঋষি বিশ্বামিত্র,শিষ্য গালবের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ঘরে ফিরে যেতে বলেন। গুরুর প্রতি কৃতঞ্জতা‚শ্রদ্ধা আর অবিচল ভক্তিতে আপ্লুত গালব স্থির করলেন যে গুরুদক্ষিণা না দিয়ে তিনি কোনভাবেই আশ্রম ত্যাগ করবেন না | নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী কিছু না কিছু দক্ষিণা তিনি দেবেন বলে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন | বিশ্বামিত্র গালবের মনের এই কথা আগেই জানতে পেরেছিলেন|
রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের পার্থিব কোনকিছুর প্রতি আসক্তি ছিল না। তিনি দরিদ্র এই ব্রাহ্মণপুত্রের কাছ থেকেও কোন গুরুদক্ষিণা নিতে অস্বীকার করেন | তিনি গালবের সব অনুরোধ–উপরোধ অগ্রাহ্য করেন এবং তাঁকে বারবার গৃহস্থ আশ্রমে প্রবেশ করার জন্য বলেন। কিন্তু,গালব গুরুদক্ষিণা দেবার গোঁ ধরে থাকায় বিশ্বামিত্র ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন |
“বেশ,তবে,গুরুদক্ষিণা স্বরূপ কৃষ্ণকর্ণযুক্ত এমন আটশো অশ্ব প্রদান কর‚যাদের গাত্রবর্ণ চন্দ্রকিরণের ন্যায় শুভ্র | “আচার্য্য‚আপনার আদেশ শিরোধার্য্য | কৃপা করে আমায় কিছু সময় প্রদান করুন যাতে আমি আমার গুরুদক্ষিণা প্রদানে সমর্থ হই | সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত না হই |” বিশ্বামিত্র স্বীকৃত হন সময় দিতে |
কোথায় পাবে গালব এমন বিরল অশ্ব? অত্যন্ত কঠিন এই শর্ত | গালব চিন্তায় পড়ে যায়। গালবের একান্ত প্রিয়বন্ধু ছিলেন বিষ্ণুবাহন গরুড় | গরুড়‚গালবকে এমন বিষণ্ন‚চিন্তামগ্ন দেখে তার কারণ জানতে চায়। গালব‚গরুড়কে সব খুলে বলেন | গরুড় বন্ধু গালবকে পিঠে বসিয়ে নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। উদ্দেশ্য,আটশ বিরল অশ্ব জোগাড় করা | কিন্তু অনেক খুঁজেও এমন কোন অশ্ব তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না | হতাশ গালবকে গরুড় নিয়ে আসে রাজা যযাতির কাছে গঙ্গা–যমুনার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানপুরে। প্রজাপালক‚হিতৈষী‚পরোপকারী রাজা হিসেবে যযাতির খুব সুনাম ছিল। বিষ্ণুবাহন গরুড় ও ব্রাহ্মণ পুত্র গালবের আগমনবার্তা পেয়ে যযাতি যথোপযুক্ত সন্মানপ্রদর্শনপূর্বক আগমনের কারণ জানতে চাইলে গরুড় বলেন‚”হে রাজন‚এই ধরাধামে আপনার মত উপযুক্ত‚প্রজাবৎসল‚অতিথিপরায়ন রাজন খুব কমই আছে | আমার এই মিত্র গালব বিশ্বামিত্রমুনির প্রিয়তম শিষ্য | গুরুদক্ষিণাবাবদ গালবকে এমন আটশো অশ্ব প্রদান করতে হবে‚যাদের কর্ণ কৃষ্ণবর্ণ আর দেহ চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র।”
গরুড়ের যাচনা শুনে যযাতি বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন | সম্প্রতি রাজসূয় আর অশ্বমেধ যজ্ঞে তিনি নিজের সমস্ত অর্থভান্ডার উজাড় করে দিয়েছেন | এক্ষণে আটশো বিরল অশ্ব ক্রয় করবার মত অর্থও ভান্ডারে নেই| অনেকক্ষণ চিন্তভাবনা করার পর তাঁর কন্যা মাধবীর কথা মনে পড়ল | ত্রিলোক সুন্দরী মাধবী দৈবগুনসম্পন্না ছিলেন | দৈববাণী অনুযায়ী মাধবীর দ্বারা ভারতভূখন্ডে এমন চারটি বংশের প্রতিষ্ঠা হবে যারা ভবিষ্যতে ইতিহাস নির্মাণ করবে | কিন্তু তাঁর কুমারীত্ব আর দৈহিক সৌন্দর্য্য অম্লান থাকবে |
তিনি কন্যা মাধবীকে ডেকে গালব ও গরুড়ের হাতে সমর্পণ করে বললেন‚”হে ঋষি গালব‚বর্তমানে আমি এমন পরিস্থিতিতে নেই যে আপনার ঈপ্সিত আটশো অশ্ব আমি আপনাকে প্রদান করি| তাই আমি আমার এই ত্রৈলোক্য সুন্দরী কন্যাকে প্রদান করছি | শুল্কস্বরূপ একে বিশিষ্ট রাজাদের কাছে গচ্ছিত রেখে আপনি আটশো অশ্ব অনায়াসেই আহরণ করতে পারবেন | কিন্তু অশ্বপ্রাপ্তির পরই আপনি আমার কন্যাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন |”
অতঃপর,যযাতির কন্যা মাধবীকে নিয়ে গরুড় ও গালব প্রথমে অযোধ্যার রাজা হরয়শ্ব্যের দ্বারস্থ হলেন | রাজা হরয়শ্ব্য ছিলেন ন্যায়পরায়ণ‚পরদুঃখকাতর‚সমৃদ্ধশালী রাজা | সেই সঙ্গে তিনি তেজস্বী নির্বাচিত সুবিশাল অশ্বশালার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন | গালবের উপস্থিতির কারণ জানতে পেরে তিনি দুশোটি কৃষ্ণকর্ণ চন্দ্রবদনা অশ্ব দিতে রাজি হলেন। তার সাথে মাধবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁর মাধ্যমে একটি পুত্র প্রাপ্তির ইচ্ছা রাখেন।
গালব আর গরুড় সম্মত হলেন | দুশো অশ্ব প্রাপ্ত হলেন গালব | বেশ কিছুদিন পর হরয়শ্ব্যের সঙ্গে সর্বগুণসম্পন্ন ‘বসুমনা’ নামে এক পুত্রের জন্ম দিলেন মাধবী | পরবর্তীকালে এই বসুমনা অযোধ্যার একজন প্রসিদ্ধ রাজা হয়েছিলেন |
শর্ত মতে,সময় অতিক্রান্ত হতেই গালব আর গরুড় রাজার দরবারে গিয়ে মাধবীকে ফিরিয়ে নিয়ে হাজির হন কাশীরাজ দিয়োদাসের দরবারে | সেখান থেকেও দুশোর বেশি অশ্বপ্রাপ্তি হয় মাধবীকে কররূপে গচ্ছিত রেখে | সময় অতিক্রান্ত হলে মাধবীর গর্ভে ‘দিয়োদাসের’ পুত্র ‘প্রতর্দনের’ জন্ম হয় | কালে তিনি কাশীরাজ্যের পুনরুদ্ধারক হয়েছিলেন|
এবার মাধবীকে নিয়ে ভোজরাজ উশীনরের দরবারে হাজির হন গরুড় ও গালব | দৈবশক্তিবলে মাধবীর রূপ আর যৌবন চির নতুন | উশীনরের দানশীলতা ছিল পৃথিবী প্রসিদ্ধ | সেই সঙ্গে তার বিশাল ধনসম্পদও ছিল উশীনরের দরবারে হাজির হবার কারণ | মাধবীকে দেখে উশীনরের কামনা জাগ্রত হয়ে উঠল | তিনি তার অশ্বশালা থেকে দুশোটি অশ্ব মাধবীর পরিবর্তে গালবকে দিলেন এবং পুত্র ‘শিবির’ জন্ম হল মাধবীর গর্ভে। এই শিবির দানশীলতা পৃথিবীখ্যাত |
মোটা ছয়শোটি কৃষ্ণকর্ণ–চন্দ্রবদন অশ্বের প্রাপ্তির পর আর কোন ঐরূপ অশ্ব পৃথিবীতে ছিল না | অতএব গরুড়ের পরামর্শে গালব ঐ ছয়শোটি অশ্ব আর মাধবীকে নিয়ে বিশ্বামিত্রের কাছে হাজির হয়ে নিবেদন করলেন‚”হে আচার্য্য‚আপনার আদেশানুসারে‚আমি ছয়শোটি শ্যামকর্ণ–চন্দ্রের ন্যায় গাত্রবর্ণের অশ্ব জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছি | বাকি দুশোটি অশ্বের পরিবর্তে করস্বরূপ মাধবীকে গ্রহণ করলে আমার গুরুদক্ষিণা পূর্ণ হবে | কৃপা করে আপনি মাধবীকে গ্রহণ করুন|” বিশ্বামিত্র পূর্বেই মাধবীর সম্পর্কে অবহিত ছিলেন| তাই তিনি মাধবীকে গ্রহণ করলেন | মাধবীর গর্ভ হতে জন্ম নিলেন বিশ্বামিত্রের পুত্র অষ্টক। অষ্টক পিতা বিশ্বামিত্রের অনুমতিক্রমে বিশ্বামিত্রের ফেলে আসা রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করলেন আর ঐ ছয়শো কৃষ্ণকর্ণ–চন্দ্রবদন অশ্বের অধিকারীও উনিই হলেন |
চারটি পুত্রের জন্ম দেবার পরও সে একইরকম রূপবতী ছিলেন | গালব এবং গরুড় পুর্বপ্রতিশ্রুতিমত তাঁকে পিতা যযাতির কাছে ফিরিয়ে দিলেন | যযাতি এবার কন্যার স্বয়ংবর সভার আয়োজনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে মাধবী বিবাহ করতে অস্বীকৃত হয় | তাঁর জন্মের উদ্দেশ্য জীবনের প্রাপ্ত কর্তব্য সমাধান হয়েছিল তাই তিনি তপশ্চর্যার মাধ্যামে বাকি জীবন অতিবাহিত করার ইচ্ছা প্রকট করেন | রাজা যযাতির অনুমতিক্রমে মাধবী তপোবনে গমন করেন|
এই আখ্যান বর্ণিত মাধবীকে যতক্ষণ মানবীয় জীব এবং রক্তমাংসের দেহ বিশিষ্ট নারী বা কন্যা মনে করা যায় ততক্ষণ বড়ই অদ্ভুত গল্প মনে হতে পারে। বিষ্ণুর অপর নাম যে মাধব। মাধবী হলেন বিষ্ণুভক্তির প্রতীক বিষ্ণুর শক্তি সত্তা। বিষ্ণুভক্তির পরাকাষ্ঠা রচনা করে বিষ্ণুর আরব্ধ কর্ম চারটি বিষ্ণু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত নিয়েই মাধবীর মর্ত্যলোকে অবতরণ।গালব রাজকন্যা মাধবীকে তিনজন রাজা এবং একজন ঋষির হস্তে সমর্পণ করার তাৎপর্য হল, তিনজন প্রসিদ্ধ প্রভাবশালী রাজা এবং বিশ্বামিত্রের মত মহর্ষিও বিষ্ণুভক্তি অর্থাৎ সর্বব্যাপক ব্রহ্মচৈতন্যের উপাসনার ধারাকে গ্রহণ,প্রবর্তন ও প্রচার করেছিলেন এবং মাধবীর তপোবন গমন তাঁর নির্ধারিত কর্মের সমাপ্তিকে নির্দিষ্ট করেছে। মহর্ষি নারদ প্রাচীন গল্প কথার মাধ্যমে দুর্যোধনকে বোঝাতে চেয়েছিলেন,নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য মানুষকে সাধারণ জীবনের আচরণ বিধি থেকে সরে যেতে হয় , যার ফল সবসময় ভাল হয় না। মাধবী এখানে তার পিতা যযাতির দানী প্রতিমূর্তি রক্ষার একটি উপায় মাত্র ।
*******************************
অজন্তা প্রবাহিতাঃ
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।