আগুনের পরশমণি
ব্রতী ঘোষ
আজও ভোরের আলো ফুটতেই দেবাশ্রিতার ঘুম ভেঙ্গে যায় | জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আভাস পাওয়া যায় অল্প অল্প | কিন্তু এই ভোরের আলো রাতের চেয়েও বেশি কালো বলে মনে হয় ওর। বুকের ভেতর ভারী পাথর চাপিয়ে দিলে যে ভার অনুভূত হয় সেই ভার অনুভব করে দেবাশ্রিতা | গত দুদিন আগে কলকাতায় নৃশংস ভাবে ঘটে যাওয়া অভয়ার মৃত্যু দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের মত ওকেও অত্যন্ত ব্যথিত করেছে | ও ভাবতে পারছে না মানুষ এত নৃশংস ও হতে পারে ? হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা খোলে | নেট অন করতেই সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের পর্দায় ভেসে আসে কতগুলি কুৎসিত মেসেজ। আবার ? আবার পাঠিয়েছে সন্দীপ ? ইতর একটা। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটা ফরওয়ার্ড করে সুদীপ্তকে। তাকিয়ে দেখে পাশে সুদীপ্ত অকাতরে ঘুমোচ্ছে । এই নিয়ে পাঁচ দিন হলো | নিজের বৌদিকে কেউ এত জঘন্য ইঙ্গিত পূর্ণ মেসেজ পাঠাতে পারে ? অথচ সুদীপ্ত সব জেনেও কিচ্ছুটি বলবে না ? শুধুমাত্র আদরের ভাই বলে ? সুদীপ্তর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ওকে ভীষণ স্বার্থপর মানুষ বলে মনে হয় দেবাশ্রিতার | অথচ দেবাশ্রিতা যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসে বছর পঁচিশেক আগে তখন সন্দীপের কতই বা বয়স? বছর দশেক ! সব সময় বৌদির পাশে পাশে ঘুরতো ও | দেবাশ্রিতাও কি স্নেহই না করতো ওকে ! অথচ সেই ছেলে কি অদ্ভুত ভাবে বদলে গেল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে | কতবার ও শাশুড়ি মাকে বলার চেষ্টা করেছে সে কথা | সুদীপ্ত কে ও বহুবার বলেছে ওর কুৎসিৎ দৃষ্টির কথা | অথচ সুদীপ্ত কোনদিন ওর কথা পাত্তাই দেয়নি। বলেছে,
-তোমার সবেতেই বেশি বেশি আসলে তুমি ওকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাও |
মুখে কিছু না বলেও শুধুমাত্র দৃষ্টি দিয়ে যে যৌন নিপীড়ন করা যায় সে কথা আজ পর্যন্ত সুদীপ্তকে ও বুঝিয়ে উঠতে পারেনি | আর দিনের পর দিন সেটা সহ্য করেও ওই ইতরটাকে খেতে দেওয়া,তার জন্য রান্না করা কি যে কি যন্ত্রণার !! কিন্তু গত সপ্তাহে যেদিন সন্দীপ প্রথম ঐ কুৎসিত মেসেজটা পাঠালো তখন সঙ্গে সঙ্গে ও সুদীপ্তকে দেখিয়েছে সেটি অথচ সুদীপ্ত সেটা পাত্তাই দিল না। আজ আবারও পাঠিয়েছে। কোন মানুষ তার স্ত্রীর এই অপমান কি মেনে নিতে পারে দিনের পর দিন ? নাকি দেবাশ্রিতা এতদিন যা স্বামীর ভালোবাসা বলে ভেবে এসেছে তা আসলে ভুল? সবই জীবনের হিসেব নিকেশ ? হয়তো দেবাশ্রিতা এত ভাল চাকরিটা না করলে আর সংসারের অর্ধেক দায়িত্ব না নিলে এই ভালোবাসাটুকু ওর শিকেয় ছিড়তো না। না : আজ ও একটা কিছু করবেই | ভাবতে ভাবতে প্রাত্যহিক কাজগুলো শুরু করে দেয় |
চা এর কাপটা রেখে সুদীপ্তকে বেশ রাগত স্বরেই বলে,
—তুমি সন্দীপকে আজও কিছু বলবে না ?
— আজ আবার কি হলো ?
দেবাশ্রিতার কথায় পেপারের দিকে তাকিয়ে নিরুদ্বেগ গলায় কথাগুলি বলে সুদীপ্ত |
—তোমাকে আজও ওর নোংরা নোংরা মেসেজগুলো পাঠিয়েছি । তুমি সেগুলো দেখেছো অথচ শান্ত গলায় কথাগুলো বলছো |
—দেখো ও আমার একমাত্র ছোট ভাই | বাবা মা নেই,তুমি কি চাও আমি ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই ? ও যাবে কোথায় ?
দেবাশ্রিতার মুখে কথা বেরোয় না,এই মানুষের সঙ্গে ও পঁচিশটা বছর কাটাল কি করে? নিজের প্রতি অসম্ভব ঘৃণা হয় ওর |
অনিন্দিতার ফোন এসে যাওয়ায় দেবাশ্রিতার চিন্তার স্রোত বয়ে যায় অন্যদিকে |
—তাহলে কটায় বেরোবি?
—এই ধর্ সাড়ে দশটায় |
—যতসব লোক দেখানো ব্যাপার স্যাপার | আবেগ ! হু: ! এসব মোমবাতি জ্বালিয়ে,রাত দখল করে কি আর নারী মুক্তি,নারী নিরাপত্তা,সুবিচার আসবে?
সুদীপ্তর কথাগুলো শুনে দেবাশ্রিতার কোন উত্তর দিতে প্রবৃত্তি হয় না |
১৪ই আগস্ট এর রাত ঘনিয়ে আসে | ঘড়িতে তখন ঠিক রাত বারোটা | শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে তখন জ্বলছে হাজার হাজার মোমবাতি | সেই প্রতিটি মোমবাতির আলো প্রতিটি মেয়ের অন্তরের ব্যথা,জ্বালা,যন্ত্রণার,বঞ্চনার লেলিহান শিখা হয়ে জ্বলছে | প্রতিটি মোমবাতির আলো যেন বলতে চাইছে মেয়েটির অজানা কোন যন্ত্রণার কাহিনী,যে কাহিনী সেই মেয়েটি কোনদিন কাউকে বলতে পারেনি। আজ সে চিৎকার করে বলবে সে কথা | আর সে চিৎকারে আকাশ কেঁপে উঠবে,বাতাস স্তব্ধ হয়ে যাবে | টিপটিপ করে বৃষ্টি নামে কিন্তু বৃষ্টির জল ও সেই মোমবাতির শিখাকে স্পর্শ করতে পারে না | স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও যে নিকষ অন্ধকার ঢেকে রেখেছে প্রতিটি নারীর বুকের ব্যথা, যন্ত্রণা আজ তা আলোর মুখ দেখবে । আকাশ বাতাস ধ্বনিত হতে থাকে প্রতিটি নারীর হাহাকারে | অথচ দেবাশ্রিতার গলা দিয়ে আজ একটিও আওয়াজ বেরোয় না | তার মোমবাতির শিখাটি জ্বলতে জ্বলতে ক্রমশ: এগিয়ে আসতে থাকে ওর বুকের মাঝে | শিখাটি এসে বুকের মাঝের ব্যথা যন্ত্রণাগুলোকে পুড়িয়ে দিতে থাকে | যে অমর্যাদা,ব্যথা,যন্ত্রণা নিয়ে ও পঁচিশটি বছর কাটিয়েছে সেগুলো আজ আগুনের তাপে পুড়ে আরো দৃঢ়,শক্ত হয়ে ওর বুকের ভেতরে চেপে বসতে থাকে | রাস্তার ধারে গিয়ে বসে পড়ে ও | ওর বুকের মাঝে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে | মোমবাতি রেখে দু হাতে চেপে ধরে নিজের কানদুটো | ও শুনতে পায়,
— আমি তিলোত্তমা,শুনতে পাচ্ছো ? পাশবিক অত্যাচারে,রক্তাক্ত দেহে,যন্ত্রণায়,বিধ্বস্ত মনে তোমাদের বুকের মাঝে আমার চিতার আগুন জ্বালিয়ে রেখে গেলাম | তোমরা সে আগুন নিভে যেতে দিও না যতদিন না তোমরা এই অন্যায় বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাচ্ছো | এই আগুনের শিখাকে দুহাতে আগলে রেখো |
টলোমলো পায়ে দেবাশ্রিতা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে | সে মানসচক্ষে দেখে কলকাতার প্রতিটি রাস্তায় লক্ষ লক্ষ তিলোত্তমা যেন হেঁটে চলেছে |
রাত দুটো বাজে | সদর দরজায় দেবাশ্রিতা ধাক্কা দিতে থাকে পাগলের মত। সুদীপ্ত চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেশ বিরক্ত ভাবেই দরজা খোলে |
—এই মুহূর্তে তুমি সন্দীপকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে | কোথায়? কোথায় সেই শয়তানটা ?
সুদীপ্ত দেবাশ্রিতাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু দেবাশ্রিতা ছুটে এসে সন্দীপের ঘরে ঢোকে | কলার ধরে টানতে টানতে ধাক্কা দিতে দিতে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেয় |
সন্দীপ বাধা দেবার চেষ্টা করে কিন্তু সে পারবে কেন ? এখন যে দেবাশ্রিতাকে ও দেখছে তাকে ও চেনে না,কোনদিনও দেখেনি।
সুদীপ্তও হতবাক ! এই দেবাশ্রিতা ওর এতোদিনের চেনা কোমলমনা মেয়েটি নয় | তবু পৌরুষের মর্যাদা বজায় রাখতে গলার স্বর চড়িয়ে বলে,
— তোমার এত সাহস ! তুমিও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও |
দেবাশ্রিতা এবার ঘুরে তাকায় স্বামীর দিকে |
— কি জানো ! তোমার ভাই সন্দীপ তো শয়তান। তার এই কাজ করা সাজে,কিন্তু যে অপমান আজ পর্যন্ত ও আমাকে করার সাহস পায়নি তুমি তা আমাকে করেছো দিনের পর দিন | আমার বিশ্বাস,ভালোবাসা মর্যাদার দু পায়ে নিষ্পেষণ করেছো তুমি। এর মূল্য তোমাকেও দিতে হবে।
যে মানসিক দৃঢ়তার অভাবে পঁচিশটা বছর দেবাশ্রিতার বিশ্বাসের,ভালোবাসার,মর্যাদার ধর্ষণ হয়েছে ও আর তা মেনে নেবে না,তিলোত্তমা যে ওর বুকের ভেতর মুক্তির আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে |
*****************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷
সাম্প্রতিক পৈশাচিক ঘটনার প্রতিবাদে লেখা তোমার এই গল্প মনে খুব গভীর রেখাপাত। তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে আমাদের অনেকেরই অসম্মানের প্রতিভূ। তুমি সেই ব্যাপারটিকে ভারী সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছ। অশেষ সাধুবাদ এবং ধন্যবাদ তোমায়…
লেখাটা মনে দাগ কেটেছে। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, প্রায় সমস্ত পুরুষ জাতিকে শয়তান বানানো মেনে নিতে কষ্ট হয়।
স্পর্শকাতর লেখা।