আজকের দিনে রবীন্দ্রসংগীত কতটা প্রাসঙ্গিক
ঋতুপর্ণা রুদ্র
মন এই বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী আর সর্বত্রগামী বস্তু বলে মহাভারতে জানিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। সেই মনের চোখে দেখি,ছোট ষোল বছরের ছেলেটি নিজের ঘরে একান্তে লিখছে ‘সজনি সজনি রাধিকা লো’ বা,’শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’। বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে ব্রজবুলি ও মৈথিলি ভাষায় রচিত তাঁর পদাবলীর নাম ভানুসিংহের পদাবলী। ভানুসিংহ নাম নিয়ে ছেলেটি নিজেই রোমাঞ্চিত।
এই সব ছাড়াও পিতৃদেব পছন্দ করেন ব্রহ্মসংগীত,একের পর এক লিখে চলে ছেলেটি। পিতা ব্যস্ত মানুষ,মাসের পর মাস পশ্চিমে চলে যান। তবে সেখান থেকে ফিরলেই রবির ডাক পড়বে।
ছোটবেলায় রবির কবিতা পড়ে হেসে ফেলেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ,সেই তিনিই এখন পুত্রের সৃষ্টিতে মুগ্ধ। ধীরে ধীরে ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশনেও রবিকে গান গাইতে হয়। মাঘোৎসবের অধিবেশনের জন্য লিখলেন ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছো নয়নে নয়নে’। উৎসবে নিজেই গাইলেন সেই গান। পিতা সেইসময়ে কলকাতায় ছিলেন না, কিন্তু খবর পেয়ে ফিরে সেই গান শুনতে চাইলেন। সেদিন রবির পিতা এক আরাম কেদারায় আসীন,জ্যোতিদাদা হারমোনিয়ামে,রবি গাইছেন সেই গান,
নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায়না জানিতে,হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।।
বাসনার বশে মন অবিরত,ধায় দশ দিশে পাগলের মতো
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে।
সবাই ছেড়েছে নাহি যার কেহ তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ-
নিরাশ্রয় জন,পথ যার গেহ,সেও আছে তব ভবনে।
গান শেষ হতে চোখ মেললেন রবি,তাঁর চোখের কোণ চিকচিক করছে। স্তব্ধ পিতা বলেন,“দেশের রাজা যদি এ গানের ভাষা,এ গানের কদর বুঝতেন,তবে কবিকে তিনিই পুরস্কৃত করতেন। রাজার তরফ থেকে যখন সে সম্ভাবনা নেই,তখন সে কাজ আমাকেই করতে হবে।” এই বলে পুত্রের হাতে দিলেন পাঁচশ টাকার এক চেক,সে যুগে যার মূল্য ছিল অপরিসীম।
জীবৎকালের প্রায় ৬১ বছর ধরেই তিনি গান লিখে গেছেন,জীবনের প্রথম কয়েক বছর বাদ দিলে প্রায় সারা জীবনই। আড়াই হাজার গানের সম্ভার বড় কম কথা নয়। চারপাশের মানুষের তাগিদেও গান লিখতেই হোত। যে কোনও বিষয়ে,যে কোনও উপলক্ষ্যে লোকে এসে ধরত যে তাঁকে। আজ নলকূপ খনন হবে,শান্তিনিকেতনে অসহ্য জলের কষ্ট, গুরুদেব লিখলেন,‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল’। জাপানি যুযুৎসু পালোয়ান টাকাগাকি বোলপুরে আসছেন,ছেলেমেয়ের এই শিক্ষায় উৎসাহ দিতে গুরুদেব সেই অনুষ্ঠানের জন্য লিখলেন ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’।
গ্রামবাংলা পরিভ্রমণ কালে চাষী ঘরের ছোট এক মেয়েকে ভারি ভালো লাগল, সঙ্গে করে তাকে নিয়ে এলেন শান্তিনিকেতনে। সেই মেয়েটির নৃত্য পরিবেশন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্য করে লিখলেন,‘দুই হাতে কালের মন্দিরা’’ গানটি। এমনি আরও অজস্র উদাহরণ আছে। এছাড়াও নিজের মনের তাগিদে লিখে যেতেন একের পর এক গান। একবার ঠান্ডা লেগে গলা ভেঙে যেতে লিখলেন,”আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে”। তাই যে কোনও অনুষ্ঠানের জন্যই তাঁর গান খুঁজে পাই আমরা।
প্রথম কুড়ি বছর গানগুলিতে রাগাশ্রয়ী প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ভাঙা গানের প্রভাবও আছে। শেষ কুড়ি বছরে তিনি দিয়ে গেছেন পরিপূর্ণ রাবীন্দ্রিক গান,অন্যান্য সঙ্গীতের প্রভাব মুক্ত। সুর তাল লয় অপেক্ষাকৃত সহজ,কেবল গানের ভাব আর ব্যাপ্তি বড় গভীরে ছড়িয়ে যাবে শ্রোতার।
বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করি আড়াই সহস্র গানের দু’শ থেকে তিনশটি গান বহুল প্রচলিত। বাকি গানগুলি কম শ্রুত, গীত হয় কম। তাই বলে কম প্রাসঙ্গিক তা বলা যায় না। সেই তিনশটি গানের মধ্যেই দুঃখ,আনন্দ, বেদনা, হাসিকান্না সব অনুভূতি লীন হয়ে থাকে। জীবনে যখনই কঠিন ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছি,মনে হয়েছে এর পরে কী? জীবনদেবতা নতুন করে ঘট পূর্ণ করেছেন, মনে পড়েছে গুরুদেবেরই গান
‘আমারে তুমি অশেষ করেছো, এমনই লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব।’
আহা সে যেন আমার জন্যই লেখা।
মস্ত এই পৃথিবীতে ক্ষুদ্র সংসার রচনা করে,কী অপরিসীম আনন্দ,”খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি,আমার মনের ভিতরে”,কদিনের বিরহের পরে প্রিয়র সঙ্গে দেখা,মনে পাক দিচ্ছে আনন্দ “কেটেছে একেলা,বিরহের বেলা আকাশ কুসুম চয়নে,সব পথ এসে মিলে গেল শেষে,তোমার দু’খানি নয়নে।”
বিপুল এই বিশ্বে কত তুচ্ছ কত ক্ষুদ্র আমার অস্তিত্ব,আমি কে? কেনই বা? সেই একই প্রশ্ন যেন ছিল কবিরও।
আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি, পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।
এমনি আরও কত কী, সুখ দুঃখ আনন্দ,বিরহে বারেবারে ফিরেছি তাঁরই গানে। আশ্রয় পেয়েছি,উদ্দীপনা পেয়েছি। কারুর কারুর লেখায় দেখেছি,তাঁরা মনে করেন,শহুরে শিক্ষিত মানুষের কাছেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গ্রহণযোগ্য,গ্রামের মানুষ বা দরিদ্র মানুষের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত তেমন জনপ্রিয় নয়,যদিও আমি এই বিষয়ে সহমত নই। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস,তাঁর গল্প,প্রবন্ধ,নাটক অনেক ক্ষেত্রেই পরিশীলিত,বুদ্ধিমান,এবং বিদগ্ধ পাঠকের জন্য,যাকে বলে বিদগ্ধ মানুষের জন্য,সর্বসাধারণের জন্য নয়।
কিন্তু গানের ক্ষেত্রে সেকথা খাটে না। আপামর বঙ্গভাষী জনতা তাঁদের সুখে দুখে আনন্দে,বিরহে,বিবাহে,জন্মদিনে,মৃত্যুতে,কনে দেখায়,লেখায়,আঁকায়,বর্ষবরণে,বৃক্ষরোপণে এই গানকে বাদ দিয়ে ভাবতে পারেন না। ট্র্যাফিক আলোতে,পাড়ার পুজোয়,ফেসবুক লাইভ থেকে সাহিত্যসভায়,প্রভাত ফেরী থেকে স্মরণসভায়,হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিখুঁত স্বরলিপিতে বা গিটার বাজিয়ে একলা তরুণী কলেজ ফেস্টেও গাইছেন সেই সব পরিচিত গান।
গাইছেন,’আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’ বা ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। ফুলশয্যায় গান গাওয়ার অনুরোধে নতুন কনে লজ্জা লজ্জা মুখে গাইছে ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’।
একবার একটি অন্যরকম রেস্টুরেন্টে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার,জায়গাটি এয়ারপোর্ট এর কাছে। ও অঞ্চলে এরকম বেশ কিছু আছে,উঠতি প্রোমোটার,রাজনৈতিক নেতা,সবাই সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আনন্দ করতে চলে আসেন,খানাপিনা চলে,সাথে গানও শোনেন। ছোট একটা মঞ্চে গান হয়,গায়ক গায়িকাদের গান ভালো লাগলে সরাসরি টাকাও দেওয়া হয় তাদের,টাকার মালা বা টাকার বৃষ্টির মত। আমি গিয়েছিলাম সহকর্মীদের সঙ্গে,এমন পরিবেশ কাছ থেকে দেখতে। ভেবেছিলাম বিড়ি জ্বালাইলা বা কাঁট লাগা ইত্যাদি গান টান হবে। সন্ধ্যা সাতটায় গান শুরু করলেন এক তরুণ,এবং ওরকম পরিবেশে তাঁর প্রথম গান ছিল “তুমি রবে নীরবে”। তাবৎ অর্ধশিক্ষিত,অর্ধমাতাল জনতা চোখ বুঁজে বুঁদ হয়ে সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছিল,এ আমার নিজের চোখে দেখা।
জীবনের বেশ দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এসে মনে হয়,আমাদের সমগ্র জীবনকে এমন করে কেই বা বুঝেছেন,
“বিপুল তরঙ্গ রে,গগন উদ্ভাসিত,
মগন করি,অতীত অনাগত,আলোকে চঞ্চল,জীবনে উজ্জ্বল,একি আনন্দতরঙ্গ,বিপুল তরঙ্গ রে।”
টিভির জনপ্রিয় সিরিয়াল থেকে,বিদগ্ধ সাহিত্যসভা,একাকী মানুষের নিঃসঙ্গ দিনযাপনের দিনলিপি থেকে,বন্ধুদের জমাটি আড্ডা,রবীন্দ্রসঙ্গীত তাই প্রাসঙ্গিক ছিল ও আছে,থাকবেও আবহমান।
*****************************
ঋতুপর্ণা রুদ্র
বিদ্যসাগর পল্লী
কলকাতা ৮
গঙ্গা জলেই গঙ্গা পূজো করে বলি–“সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি,দুঃখে তোমায় পেয়েছি প্রাণ ভরে”🙏🙏🙏🙏❤️❤️❤️❤️
Kichu bolar bhasha nei Didi. ,💖💖💖