উড়ান
সুজয় দত্ত (ক্লীভল্যান্ড, ওহায়ো, যুক্তরাষ্ট্র)
টার্মিনালের এদিকটা এতক্ষণ বেশ নিরিবিলি ছিল। ডিপার্চার গেটগুলো ফাঁকা,সামনে পাতা সারি সারি চেয়ারেও অল্প দুচারজন,আশপাশের খাবারের দোকান আর স্যুভেনির শপে সকালের সেই লম্বা লাইন আর ভীড়ভাট্টা অদৃশ্য। কিন্তু আর বেশীক্ষণ নয়। একটু পরেই শুরু হবে দুপুরের ব্যস্ততা। পাশাপাশি অনেকগুলো গেটে এসে দাঁড়াবে একের পর এক বিমান—দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রী নিয়ে। আর তারই প্রস্তুতিতে টার্মিনালের বিমানকর্মীদের মধ্যে দেখা যাবে তৎপরতা,ঘন ঘন নির্দেশ আসবে ওয়াকিটকিতে,মানুষের পদশব্দে আর ক্যারিঅন লাগেজের চাকার শব্দে জমজমাট হয়ে উঠবে চারিদিক। ডাক পড়বে লায়লারও। অমুক গেটে তমুক জায়গা থেকে আসা ফ্লাইটে একটা হুইলচেয়ার লাগবে সাড়ে বারোটায়,তারপরেই উল্টোদিকের গেটে অপেক্ষমান প্লেনটায় যাত্রী ওঠার ঠিক আগে আরও একটা,সেটা মিটতে না মিটতেই হয়তো ছুটতে হবে একটু দূরে অন্য কোনো গেটে। বেশ অনেকক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাবে না। প্রথম প্রথম একটু দিশাহারা লাগত এরকম চাপের মুখে,কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে লায়লা। দেখতে দেখতে অনেকদিন কেটে গেল এই কাজে। চলৎশক্তিহীন বয়স্ক বা প্রতিবন্ধী যাত্রীদের হুইলচেয়ার পরিষেবা দেওয়ার মধ্যে একধরণের পরিতৃপ্তি আছে। ভালই লাগে ওর। দিনে অন্ততঃ কয়েকটা মুহূর্ত নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়—যেন ওকে ছাড়া চলবে না কিছু অসহায় মানুষের। সেটাই বা কম কী?
গুরুত্ব জিনিসটার স্বাদই তো পেল না তার এই একুশ বছরের জীবনে লায়লা হুসেইনি। এমন দেশে জন্মেছে,যেখানকার সমাজে নারীর মূল্য আর অধিকার খুঁজতে যাওয়া এমনিতেই মরুভূমিতে জল খোঁজার মতো। তার ওপর আবার ওরা সংখ্যালঘু হাজারা—ওদের আদি বাড়ী মধ্য–আফগানিস্তানের বামিয়ানে। ছিল। এখন আর নেই। দেশের কট্টরপন্থী জঙ্গীদের রোষে অসংখ্য হাজারাকে সর্বস্ব হারিয়ে স্বদেশেই উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। একবার নয়,বারবার। দেশের অতীত ইতিহাস যেমন তার সাক্ষী,তেমনি সাম্প্রতিক বর্তমানও। আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশেক আগে তালিবানরা যখন তাদের ক্ষমতা দখলের প্রাক্কালে বল্খ প্রদেশের বিখ্যাত শহর মাজার–এ–শরীফ জিতে নিল,তখন লাগোয়া হাজারিজৎ বা হাজারিস্তানের নিরীহ মানুষও রেহাই পায়নি। ভিটেমাটি–ছাড়া হয়ে একবস্ত্রে চলে আসতে হয়েছিল লায়লার ঠাকুরদাকে তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে কাবুলের শহরতলীতে। রুটিরুজির জন্য। লায়লার জন্ম সেখানেই। ওর দুই বোন নাজিয়া আর ফেরেবাও তাই। জ্যাঠতুতো দাদা খালেদের জন্ম অবশ্য হেরাটে–সেখান থেকে উৎখাত হয়ে তাদের পরিবার অচিরেই এসে জুটেছিল ওদের সঙ্গে। ওর বাবা-জ্যাঠার তখন জোয়ান বয়স, দিনরাত গতরে খেটে অমানুষিক পরিশ্রম করে পরিবারটাকে দাঁড় করাল কোনোরকমে। যাহোক একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটল,দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার সংস্থান হল। ব্যস,ঐটুকুই। এর বেশী আবার কী থাকবে একদল অবাঞ্ছিত উদ্বাস্তুর?
কিন্তু না–ছিল আরও কিছু লুকনো সম্পদ। লায়লার মা জাহরা-র বুকের মধ্যে। সযত্নলালিত সামান্য কিছু আশা-স্বপ্ন। তার তিন মেয়েকে নিয়ে। লেখাপড়া শিখবে তারা,স্বনির্ভর হবে একদিন,মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কিন্তু হায়,এ পোড়া দেশের অতি-রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীশিক্ষার অধিকার তো কারাগারে বন্দী আসামীদের মুক্ত বায়ুসেবনের অধিকারের মতো। প্রশ্নই ওঠে না। তবে ইচ্ছে আর সংকল্পটা যদি পবিত্র আর আন্তরিক হয়,আল্লাহতালা একটা না একটা রাস্তা ঠিকই খুলে দেন। এক্ষেত্রেও তাই হল। আমেরিকার মদতপুষ্ট সরকারের তত্ত্বাবধানে আর আমেরিকার টাকায় সারা দেশে যে মেয়েদের স্কুলগুলো খোলা হয়েছিল তালিবানদের ক্ষমতাচ্যূতির পর,তারই একটায় ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেল লায়লা–হাজারা হওয়া সত্ত্বেও। তার জন্য অবশ্য ওর বাবাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি,কম তদ্বির করতে হয়নি। বিবি জাহরার মুখ চেয়ে আর মেয়েটার অদম্য উৎসাহকে নস্যাৎ করে দেওয়ার মতো কঠিনহৃদয় হতে না পেরে হামিদ হাল ছেড়ে দেয়নি। তারপর দিদির দেখাদেখি দুই বোনও ভর্তি হল স্কুলে। অংক,বিজ্ঞান,ভূগোল,ইতিহাসের পাশাপাশি চলল ইংরেজী শেখা। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একটা বিদেশী ভাষাকে আত্মস্থ করা চাট্টিখানি কথা নয়,তবে এই কঠিন চ্যালেঞ্জটার মধ্যে একধরণের মজাও আছে, আর আছে তাৎক্ষণিক উপযোগিতা। এই যেমন,জ্যাঠতুতো দাদা খালেদ স্কুলের গন্ডী পেরোতে না পেরোতেই সেখান থেকে শেখা চলনসই ইংরেজীর দৌলতে কাছাকাছি একটা আমেরিকান সেনা ছাউনিতে দোভাষীর কাজ পেল। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে আসা লায়লা অবশ্য দোভাষী-টোভাষী হতে চায়না। তার মনে তখন উঁকি দিচ্ছে জীবনে আরও অনেক বড় কিছু করার বাসনা। ডাক্তার হওয়ার।
স্বপ্নভঙ্গ হতে অবশ্য খুব বেশী সময় লাগেনি। দীর্ঘ দু-দশক ধরে যুদ্ধ আর আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের ব্যর্থ চেষ্টার পর হঠাৎ কয়েকবছর আগে আমেরিকা যেই সিদ্ধান্ত নিল পাততাড়ি গুটোনোর,ঝপ করে আচমকা অন্ধকার নেমে এল লায়লাদের জীবনে। শুধু ওদের তিন বোনের লেখাপড়া শেখায় ইতি তো নয়,আরও বিরাট খাঁড়া ঝুলছে মাথার ওপর। ক্ষমতায় ফিরে তালিবানরা বেছে বেছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবেই তাদের ওপর যারা আমেরিকান বাহিনীর হয়ে কাজ করত। খালেদ বাঁচবে না,ওরাও সম্ভবতঃ না। এই পরিস্থিতিতে একটাই রাস্তা–খালেদের দোভাষী সার্ভিসের প্রতিদানে আমেরিকানদের কাছে ওদেশে শরণার্থী হয়ে যাওয়ার অনুমতি ভিক্ষা। সে পাওয়া কি অতই সোজা? প্রাণভয়ে ভীত হাজার হাজার আফগান যে তাদের বিপন্ন হাত বাড়িয়ে রয়েছে ওই একই আর্তি নিয়ে। আর আমেরিকা মোটেই উদারহস্ত নয় এ-ব্যাপারে।
শেষ অবধি ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল ওদের। আমেরিকার এক উদ্ধারকারী প্লেনের এককোণে জায়গা হয়েছিল ওদের পরিবারের। না,ভুল হল–পুরো পরিবারের তো নয়। তালিবানদের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি আইসিস কাবুলের বাগরাম এয়ারবেসের কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে আত্মঘাতী বোমাবিস্ফোরণ ঘটিয়ে তেরো জন আমেরিকান সৈনিকের সঙ্গে যে বিপুলসংখ্যক নিরীহ আফগানকেও মারল,তার মধ্যে ছিল লায়লার জ্যাঠা আর জ্যাঠতুতো দাদা খালেদ। সেই ছিন্নভিন্ন রক্তস্নাত দেহদুটো আজও তার দুঃস্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে,ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় ওকে। কিছু মানুষের জীবনে এমন কোনো কোনো মুহূর্ত আসে যখন মনটা পাথরের মতো নীরব,নিথর,অনুভূতিহীন হয়ে যায়–চোখ ভুলে যায় অশ্রু ঝরাতে। ওটা ছিল সেইরকম একটা মুহূর্ত। সবাই বুঝবে না।
যাইহোক,শেষ অবধি প্লেন মাটি ছেড়ে আকাশে উঠেছিল ওদের। জীবনের প্রথম উড়ান লায়লার। চোখেমুখে অপার বিস্ময়,মনে একরাশ আশংকা আর অনিশ্চয়তা,বুকের ভেতর গুমরে ওঠা কান্না–পিছনে ফেলে আসা জন্মভূমির জন্য। আর কোনোদিন ফেরা হবে কি? কে জানে?
তারপর নতুন দেশে এসে অনেক নিয়মকানুনের বেড়াজাল পেরিয়ে শেষে মিশিগান রাজ্যের ডিয়ারবর্ণ শহরে এক ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ওঠা,কাছেই শরণার্থীদের জন্য তৈরী বিশেষ স্কুলে নাজিয়া আর ফেরেবার ভর্তি হওয়া,এবং বহুকষ্টে দুটো ওয়ার্ক পারমিট জুটিয়ে নিয়ে হামিদ আর লায়লার জীবিকার সন্ধান। সেই সূত্রেই ডেট্রয়েট এয়ারপোর্টে এই বিমানকর্মীর চাকরি।
হঠাৎ কাছের রানওয়েটা থেকে একটা বিশাল বোয়িং ৭৭৭ ভীষণ গর্জনে মাটি ছেড়ে ওঠার শব্দে চমক ভাঙে লায়লার–এক ঝটকায় স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফেরে। কিন্তু মাটির সঙ্গে কোণাকুণিভাবে ক্রমশঃ আকাশের দিকে উঠতে থাকা প্লেনটার দিকে তাকিয়েই আবার মনে পড়ে যায় সেই ভয়ঙ্কর,অবর্ণনীয় দৃশ্যের কথা–দেশ ছেড়ে চলে আসার দিন বাগরাম এয়ারবেসে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার মানুষের সঙ্গে ওকেও যা দেখতে হয়েছিল। তালিবানের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া বেশ কিছু আফগানকে পেটের ভেতর নিয়ে আমেরিকান বিমানবাহিনীর একটা বিশাল প্লেন রানওয়ের দিকে রওনা দিয়েছে ওড়ার প্রস্তুতিতে। নিরাপত্তা রক্ষীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে তার পিছনে পিছনে ছুটছে আরও অসংখ্য আফগান–যেন বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটাকে কিছুতেই ফস্কে যেতে দেবেনা। হঠাৎ তাদের মধ্যে থেকে একজন প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে চলন্ত প্লেনের চাকার কাছটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল। খুব চেনাচেনা লাগছে ছেলেটাকে–কী যেন নাম? কী যেন নাম? মনে পড়েছে ! জাকি আনওয়ারি। খালেদ ভাইয়ের ছোটবেলার বন্ধু। এ কী,প্লেনটা যে মাটি ছেড়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছে–জাকি ভাই এখনো চাকা থেকে ঝুলছে? খানিকটা ওঠার পর প্লেন তার চাকা গুটিয়ে নিল। আর জাকি ভাই? ওই যে দ্যাখো–কেমন আকাশ থেকে মাটির দিকে নেমে আসছে ওর শরীরটা। তীব্রবেগে আছড়ে পড়ল টারম্যাকে। জীবনে অনেক উঁচুতে ওঠার স্বপ্ন দেখত তো–সে সাধ ওর অপূর্ণ রইল না। খুব ভাল ফুটবল খেলে ছেলেটা–খুব ভাল। না না,ভুল হল। খেলে না। খেলত।
“হেই লেইলা–“,হঠাৎ কাঁধে মৃদু টোকা। চমকে তাকায় ও। ভেরোনিকা ডাকছে। ভেরোনিকা লোপেজ–এই টার্মিনালে ওর সহকর্মী। মেক্সিকান–কথায় তাই স্প্যানিশ টান। “ইউ আর নীডেড অ্যাট গেট টোয়েন্টিসেভেন”। সাতাশ নম্বর গেটে প্যারিসের ফ্লাইটে বোর্ডিং হবে এবার। তাই ডাক পড়েছে লায়লার। অনেকগুলো হুইলচেয়ার দরকার। সেখানকার প্যারা-অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে যাচ্ছে একদল প্রতিবন্ধী অ্যাথলিট। সোনা জেতার লক্ষ্য নিয়ে উড়ে যাবে ওরা। স্বপ্নের হাতছানিতে।
****************************
সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প,বড় গল্প,প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।