Shadow

চেনা অচেনা – রেশমি দত্ত


p.c. ব্রতী ঘোষ

চেনা অচেনা

রেশমি দত্ত


আজ বেসরকারি হাসপাতালের রিসেপশন এরিয়াতে বসে গালে হাত দিয়ে কি যেন গভীরভাবে ভাবছে অনু। অনসূয়া মন্দিরা দুই বন্ধু একই বয়সী,এক অফিসে চাকুরীরতা। এক সঙ্গে চাকরি জয়েনও করেছিল তারা,প্রায় আঠাশ বছর এক সঙ্গে কাজ করছে,চাকরি পাওয়ার পরপর বিয়ে করেছিল তারা,তারপর সংসার,ছেলে মেয়ে মানুষ করতে করতে দুজনেরই চুলে পাক ধরল,হাঁটুর ব্যথা ধরল,তবে একজনের  বাঁ হাঁটু আর আরেকজনের ডান। এত কিছুর মধ্যেও দুজনের বন্ধুত্ব  দিনদিন বেড়েছে বৈ কমেনি। সংসার সামলে দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে যখন সকাল সাড়ে নটার চার্টার্ড বাসটা ধরতো মন্দিরা,আর উঠেই দেখতো অনু তার পাশের সিট টা রেখে দিয়েছে তখন একটা স্বস্তির হাসি হাসতো সে,আর সারা রাস্তা কথা বলতে বলতে কখন যে ফুরিয়ে যেতো রাস্তাটা। তারপর একসঙ্গে টিফিন খাওয়া,অফিসের পর সংসার ভুলে গিয়ে দুজনে মিলে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখা,রেস্টুরেন্টে খাওয়া এগুলো তাদের মধ্যে চলতেই থাকতো। হঠাৎ করে ছন্দ পতন ঘটলো,মন্দিরা যে শুধু বলতো,কে যেন নজর দিয়ে দেবে ওদের  বন্ধুত্বে,তাই যেন সত্যি হলো এবার। 

গত মঙ্গলবার অফিসে টিফিন আওয়ার্স চলছিলো,হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পরে গেলো মন্দিরা। অফিস স্টাফেরা ধরাধরি করে ভর্তি করেছিল সামনের বেসরকারী হসপিটালে, অ্যাডমিট করা হলো আই সি ইউ তে,সেরিব্রাল অ্যাটাক | সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয়েছিল মন্দিরার স্বামী প্রণব বাবুকে। দৌড়তে দৌড়তে প্রণব হাসপাতালে এলে,এসেই দুম্ করে বলতে লাগলেন,মন্দিরাকে আপনারা এই হাসপাতালে কেনো ভর্তি করলেন,কেন তার সঙ্গে পরামর্শ করলেন না আগে,এসব বেসরকারি হাসপাতাল লম্বা লম্বা বিল বানাবে,কতগুলি টাকা বাজে খরচ হবে। এই কথায় সবাই একটু অস্বস্তি বোধ করল | অনুও একটু অবাক হলো বৈকি।
মন্দিরার মনপ্রাণ জুড়ে ছিলো প্রণব দা আর ওর নিজ হাতে গড়া সংসার। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে,খুব হাসিখুশি আর প্রণবদাকে ভালোবাসতো অপরিসীম। তবু বলতোপ্রণবদা তাকে যতটা ভালোবাসে,সে নাকি প্রণবদাকে অত ভালোবাসতে পারেনি।কখনো কখনো অনু ঠাট্টা করে মন্দিরাকে বলতোবর সোহাগী একটা। অনু যখন ইয়ার্কি করে বলতো,”রাখ্ তো তোর কিপ্টে বরের কথা আর বলিসনা“,মন্দিরা বলতোকিপ্টে হলে কি হবে,ভালো তো বাসে“,অনু বলতো,” তোকে খুশি করা তো,বুঝেছি,শাড়ী চাইনা,গয়না চাইনা,দুটো রসগোল্লার বদলে শুকনো মুখে ভালোবাসি বললেই ব্যস
প্রসঙ্গে বলি,প্রণবদার ছিলো ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজমের ব্যবসা | শুরুতে এই ব্যবসা দাঁড় করাতে গিয়ে অফিস থেকে অনেকবার লোন নিয়েছিল অনু,আস্তে আস্তে দাঁড়িয়েছে ব্যবসাটা। তবে প্রণবদা কোনোদিন কোনো কৃতজ্ঞতা জানায়নি মন্দিরাকে,বলতো লোন নিলে কি হবে টাকাতো আমি শোধ করেছি,বার বার এই কথাটা বলে সে কি প্রমান করতে চাইতো? বোধহয় পৌরুষত্ব।
একদিন অনু ইয়ার এন্ডিং এর সময় ট্যাক্স রিটার্নের ফর্ম ভরছে আর তখুনি মন্দিরা পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “আমার এসব ঝামেলা নেই বাবা, আমার হাতে একদম টাকা পয়সা থাকেনা,তাই মাইনের টাকাটা পুরো প্রণবের হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত,যা খরচা করার,সেভিংস করার,ট্যাক্স দেওয়ার সব দায়িত্ব প্রণবের
দেখতে দেখতে সাত সাতটা দিন কেটে গেল,মন্দিরা আই সি ইউ তে ভর্তি,রোজ আসে অনসূয়া হসপিটালে,আজও এসে বসে রয়েছে একটা কোনে,যদি মন্দিরার জ্ঞান ফেরে,যদি ডাক্তার একবার দেখতে দেয়,আজ বসে বসে মন্দিরার কথা গুলোই ভাবছিলো। কোথায় যেন বাস্তবের সঙ্গে তার কথাগুলি বড়ো বেমানান। মন্দিরার ভালোবাসার মানুষটা যেন বড়ো অচেনা। যাইহোক অনু দেখল প্রণব বাবু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছেন,দৌড়ে গেল অনু,প্রণব বাবু অনুকে দেখে একটু বিরক্তই হলো,তবুও ডাক্তার কি বললেন জানতে চাওয়ায়, প্রণব বাবু বললেন,”কতদিন এইভাবে  আই সি ইউ তে রাখবেন মন্দিরাকে তা বলা যাচ্ছেনা“। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে প্রণব বাবু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন আর এখানে নয়,মন্দিরাকে নিয়ে যাবে সরকারি হাসপাতালে,মন্দিরার যা মেডিক্লেইম ছিলো সব নাকি এবার শেষ। অনু নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করে | তার বলতে ইচ্ছা করছিলো,এতদিন মন্দিরার ইনকাম,ফিক্সড ডিপোজিটস,এল আই সি এগুলো কি হবে,বোধহয় মন্দিরা মরে গেলে এল আই সি থেকে যা পাবে সেটা এই মুহূর্তে অনেক লাভদায়ক,চিকিৎসার খরচের থেকে। কিন্তু তার এখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জোর নেই | তার প্রিয়  বন্ধু মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সে টাকা দেবে | বাড়িতে একবার বলেও ছিলো সে,শুনে তার স্বামী,ছেলে রেরে করে উঠেছিল। আচ্ছা মেয়েদের কি এইটুকু স্বাধীনতা নেই,তার রোজগারের টাকা সে নিজের প্রয়োজন মতো,ইচ্ছা মতো খরচ করবে?
সেই দিনই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলো প্রণব,হাসপাতালে বন্ড সই করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো মন্দিরাকে। মন্দিরার পাশে বসলো অনু, প্রণব বাবু ড্রাইভার এর পাশে। অনেক দিন পর বন্ধুকে একটু ছুঁতে পারছে অনু,তার অসার,ঘুমন্ত,স্নিগ্ধ মুখটায় হাত বোলাচ্ছিল অনু,হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে বললো,”মন্দিরা এই তো আমি অনুআর ঠিক তখনি কি আশ্চর্য তার হাতটা যেন শক্ত লাগছে,মন্দিরার শরীরটা যেন কেঁপে উঠছে,প্রথমে মনে হলো অ্যাম্বুলেন্স এর ঝাঁকুনি,তারপর অনু বুঝতে পারলো,মন্দিরার পুরো শরীরটা কাঁপছে, হাতটা শক্ত করেই ধরা,অনু চিৎকার করার আগেই কাঁপুনি থেমে গেলো,এখনো হাতটা শক্ত করে ধরা,অনু ভাবলো কনভালশন | ডাক্তার বলেছিলো হাসপাতালে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার হয়েছে,তারপরই জ্ঞান হারিয়ে যায়,হসপিটাল ঢুকছে তারা,ট্রিটমেন্ট শুরু হলে হয়,ইমার্জেন্সি তে নিয়ে যেতেই ডাক্তার বললো সি পাসড্ অ্যাওয়ে মানে,এইতো একটু আগে অনুর হাতটা শক্ত করে ধরেছিল,বিশ্বাস করতে পারছিলোনা অনু। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো অনুর,বার বার বলতে ইচ্ছা করছিলোমন্দিরা তোর ভালবাসা ভুল,তুই সত্যটা জানতেই পারলিনা,শুধু মিথ্যাটাকে সত্য ভেবে চলে গেলি। জীবন্ত মন্দিরার চেয়ে,জীবন বীমার মূল্য অনেক বেশি,অনুর মনে হলো এও একপ্রকার খুন,যার সাক্ষী হয়ে রয়ে গেলো সে |কোনো প্রতিবাদ করতে পারলোনা,দেশের কোনো আইন এটাকে খুন বলবেনা,এখানে কারুর কোনো শাস্তি হবেনা,শুধু অনু মনে মনে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলনা,মন্দিরার নিথর দেহটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,মনে মনে বললো,”তোর এই মেরুদন্ডহীন বন্ধু টাকে ক্ষমা করে দিস,তোর মধ্যে চিরসত্য বিরাজ করুক” |

অসতো মা সদগময়

তমসো মা জ্যোতির্গময়

মৃত্যুর্মাঅমৃতমগময়

ওম শান্তি শান্তি শান্তি।
**********************************

লেখিকা-রেশমি দত্তঃ
জন্ম ও পড়াশোনা কোলকাতায়৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর-পেশায় শিক্ষিকা রেশমির অবসরের বিনোদন হলো বইপড়া ৷ শৈশব থেকে  বাবার অনুপ্রেরণায় গল্প ও কবিতা লেখার শুরু৷ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ভ্রমণ ওর প্রিয় বিষয় ৷

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!