
ভাইফোঁটা
চন্দ্র কান্তি দত্ত
গল্পটা গত শতকের আটের দশকের শেষ বা নয়ের দশকের শুরুর দিকের। তখনও আমরা, মানে দূর মফস্বলের মানুষ,আজকের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠিনি। ধর্ম বা ধর্মীয় আচার–আচরণ সম্পর্কে একটা ভীতি,একটা শ্রদ্ধা সবার মনেই ছিল। বড় শহরের কথা বলতে পারব না। রূপনারায়ণের ধারে অবস্থিত ছোট্ট মফস্বল শহরের ছেলে আমি। ছেলেবেলা আমার সেখানেই কেটেছে। আমাদের শহরে পালা–পার্বণ নিয়ে মানুষের মধ্যে যে নিষ্ঠা দেখা যেত,বড় কোন শহরে সেরকম নিষ্ঠা বা শ্রদ্ধা দেখা যেত কিনা জানি না। আমরা দুর্গাপুজো,লক্ষ্মীপুজো,কালীপুজো যেমন শ্রদ্ধা–ভক্তি নিয়ে পালন করতাম,তেমনি,দোল,ভাইফোঁটা এসবও একইরকম নিষ্ঠার সাথে মানতাম। ভাইফোঁটার ধর্মীয় তথা সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে সকলেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলাম। সেই ভাইফোঁটার প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা নিয়েই আজ একটা গল্প বলব।
টুটুদির সাথে যে পরেশদার বিয়ে হতে পারে একথা পাড়ার কেউই বিশ্বাস করতে পারে নি। আর শুধু পাড়া কেন,খবরটা কোনভাবে ছড়িয়ে পড়ামাত্র পুরো শহরেই একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরী হল। কারণ,ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয়, টুটুদি গতবছর পরেশদাকে ভাইফোঁটা দিয়েছিল। ঘটনাটা যেহেতু মাত্র এক বছরের পুরনো,তাই সেটা সবার স্মৃতিতে বেশ তাজা রয়েছে। সে অর্থে পরেশদার আমাদের টুটুদিকে বোনের দৃষ্টিতে দেখার কথা। কারণ, টুটুদি যেহেতু পরেশদাকে ফোঁটা দিয়েছে তাই পরেশদা তার ভাই। চিরকালের জন্য ভাই। আর ভাই হিসেবে তার কতগুলো অধিকার বা কর্তব্য নির্দিষ্ট করা আছে। তার দায়িত্ব বোনকে দুষ্ট লোকের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচানো,তার অধিকার বোনের বিয়েতে অতিথি আপ্যায়ন করা আর প্রয়োজনে গামছা জড়িয়ে পরিবেশন করা,আর তার একান্ত কর্তব্য বোনের বিয়েতে পিড়ি ধরা। তাই পরেশদা কোনভাবেই টুটুদির সাথে লুকিয়ে প্রেম করতে বা টুটুদিকে বিয়ে করতে পারে না।
নানা মহলে এই একটা বিষয় নিয়েই নানারকম আলোচনা শুরু হল। টুটুদির বাবা হারাধন সরকার জাঁদরেল লোক হিসেবে পরিচিত। তাই এ পাড়ার আর অন্য পাড়ার উঠতি বয়সের কিছু ছেলে,যারা টুটুদির রূপে মুগ্ধ,তারা,ইচ্ছে থাকলেও,টুটুদিকে সাইকেলে চাপাতে পারে না বা টুটুদির বাড়ির সামনে দিয়ে বারবার সাইকেল নিয়ে ঘুরতে পারে না। কারণ,হারাধন সরকার জানতে পারলে ভাইফোঁটার দিন নিজের দু–তিনটে ডাকসাইটে চামচেকে দিয়ে ধরে এনে টুটুদিকে দিয়ে ফোঁটা দিইয়ে দেবেন। ট্যাঁ ফোঁ চলবে না। এদের ধরে এনে ফোঁটা দেওয়ানো আর হাঁড়িকাঠে মাথা গুঁজে দেওয়া সমার্থক। টুটুদির বিয়ের খবরে এদের দুঃখ সবার চেয়ে বেশী। সুকুমার, রতন, পার্থ,এরা বুঝতেই পারছে না,পাড়ার এতগুলো যোগ্য ছেলে থাকতে,তাদেরই মত ভাইফোঁটা নেওয়া বেপাড়ার পরেশ,সব নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে,কি করে ব্রাজিলের জিকোর মত ড্রিবল করে বেরিয়ে গেল। হারাধন সরকারের মত জাঁদরেল লোকই বা কি করে রাজি হল?
রামতনু বাঁড়ুজ্জে সরখেলদের রক্ষাকালী মন্দিরের পুরোহিত। তিনি সারা বছর রক্ষাকালী মায়ের পুজো করেন। এছাড়াও রামতনুর অনেক চাহিদা। যে কোন বাড়ির পুজো হোক বা বারোয়ারী পুজো,প্রথমে সবাই রামতনু বাঁড়ুজ্জেকেই খোঁজে। কথিত আছে,রামতনু পুজো করলে নাকি মনস্কামনা পূর্ণ হবেই। কোন কারণে তাঁকে না পাওয়া গেলে তখনই একমাত্র অন্য পুরোহিতের খোঁজ পড়ে।
সেদিন বাজারে দেখা গেল,পুরোহিত মশাই বেশ জোরে জোরে হারাধন সরকারের উপর নিজের উষ্মা প্রকাশ করছেন। রামতনু বলছেন,”এই করে দেশটা রসাতলে যাবে। এ জন্মে আর কি কি দেখার বাকি আছে কে জানে? ভাই বোনের পবিত্র সম্পর্ককেও এরা বিষিয়ে তুলল। আমি আজও ভাবতে পারছি না হারাধন এই কাজটা করল কিভাবে। ও কি ধম্ম—কম্ম– কিছুই মানে না?”
ক্ষুদিরাম পার্কের পশ্চিম কোনায় আচ্ছাদন দেওয়া বাঁধানো কয়েকটা বসার জায়গা আছে। তার মধ্যে একটা আচ্ছাদনের নিচে কয়েকজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক সকাল সন্ধ্যে এসে বসেন। এঁরা সকলেই বর্তমানে চাকরী,ব্যবসা বা অন্য কাজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত এবং মোটামুটি কর্মহীন। নিজের নিজের সংসারে এঁদের কারো কারো এখনও যথেষ্ট দাপট রয়েছে। যেমন,ভোলাদার জ্যাঠা আদিনাথ মজুমদার। তাঁর অনুমতি ছাড়া নাকি গাছের একটা পাতাও নড়ে না। আবার এমন মানুষও আছেন যাঁরা নিতান্তই গোবেচারা পরজীবি। যেমন অবসরপ্রাপ্ত কম্পাউন্ডার রতন তালুকদার। বাকিদের মধ্যবর্তী বলা যায়। এই মধ্যবর্তীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এঁদের এখন আর সংসারে সেরকম দাপট নেই ঠিকই কিন্তু পরমুখাপেক্ষীও বলা চলে না। নিজের নিজের সংসারে এঁরা যথোচিত শ্রদ্ধা,ভক্তি,আদর,যত্নের মধ্যেই আছেন।
এই সব ধরণের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা ক্ষুদিরাম পার্কে এসে বসেন, একে অন্যের শরীর–স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নেন,দেশ–বিদেশের খবরাখবর নিয়ে আলাপ–আলোচনা করেন,কিছুক্ষণ দেশোদ্ধার করেন,আবার সময় সময় পি–এন–পি–সিও করেন। পরেশদা–টুটুদির বিয়ের খবরটা এঁরাও পেয়েছেন। অতএব,এই ঘটনা নিয়ে এখানেও যে আলোচনা বা সমালোচনা হবে,সেটা খুবই স্বাভাবিক। দাপুটে আদিনাথ মজুমদার এই ব্যভিচার মানতে নারাজ। তিনি প্রথমে বললেন,”হ্যাঁ গো অবনীদা! তোমার তো পাশের বাড়ি। খবরটা কি সত্যি?”
অবনী দত্ত একটু অন্যমনস্ক ছিলেন। বিষয়টা ঠিক ধরতে পারেন নি। জিজ্ঞাসা করলেন,”কোন খবরটা বলো তো?”
আদিনাথ জ্যাঠা বললেন,”সে কি দাদা? খবর তো এখন একটাই। হারাধনের মেয়ের নাকি কোন এক ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে? দেশটা রসাতলে গেল বুঝলে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যত সমস্ত ধর্মীয় রীতিনীতি শ্রদ্ধার সাথে মেনে এসেছে,আজ কতগুলো অর্বাচীন,প্রেম না পিরিতি,এসব করতে গিয়ে সব আচার–আচরণ জলাঞ্জলি দিতে বসেছে। ছিঃ,ছিঃ। কি গতি হবে আমাদের সনাতন ধর্মের? কি গতি হবে সমাজটার?”
রাজেন চৌধুরী শুনে বললেন,”আরে দাদা! তুমি আমি হায় হায় করলে হবে? হারাধন নিজেই তো মেনে নিয়েছে।“
-“সেটাই তো সবচেয়ে আশ্চর্যের। আমার কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না যে,হারাধনের মত এমন জাঁহাবাজ একজন লোক,কি করে এই অনাচারটা মেনে নিল? আমি তো মানতেই পারছি না। কিছু একটা করতেই হবে।“
সাতজন প্রবীণ নাগরিকের একটা দল একদিন বিকেলে হারাধন সরকারের বাড়িতে এলেন। বাড়িতে সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। আমাদের শহরে অনেকের একসাথে কারও বাড়িতে আসাটা সচরাচর ঘটে না। একমাত্র দুর্গাপুজোর পরে বিজয়ার সময় আর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনই সাধারণত এই দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া,বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো থাকলেও অবশ্য প্রতিবেশী মানুষজন সিন্নি গ্রহণ করতে আসেন।
কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই সাত সাতজন প্রবীণ নাগরিক একসাথে এসে হারাধন সরকার ও তাঁর পুরো পরিবারকে সমস্যায় ফেলে দিলেন। প্রথম সমস্যা হল বসতে দেওয়া নিয়ে। আর পাঁচজন প্রতিবেশীর মতই হারাধনের বাড়িতেও বসতে দেওয়ার জন্য সোফা জাতীয় কোন আসবাব নেই। বৈঠকখানায় একটা চৌকি আছে যেখানে সারা বছর হারাধন বিরাজ করেন। এছাড়া আছে গোটা দুয়েক কাঠের চেয়ার। কিন্তু সাতজনকে একসাথে বসতে দেওয়ার কোন উপায় নেই। ভিতরের ঘর থেকে আর পাশে বুলুদের বাড়ি থেকে মোড়া চেয়ে নিয়ে এসে সে সমস্যা মেটানো হল। দ্বিতীয় সমস্যা হল চা দেওয়া নিয়ে। এক্ষেত্রেও একসাথে আটটা ভাল কাপ–প্লেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য বুলুদের শরণাপন্ন হতে হল ।
প্রাথমিক কিছু কুশল বিনিময়ের পরে আদিনাথ জ্যাঠা বললেন,”ভাই হারাধন,যে সব কথাবার্তা শুনছি, সেগুলো কি সত্যি?”
হারাধন কাকা আমতা আমতা করে বললেন,”না আদিদা। কথাগুলো যে সত্যি,সেটা এখনও বলতে পারছি না। এগুলোকে ঠিক ঘটনা না বলে রটনা বলতে পারেন।“
আদিনাথ জ্যাঠা ক্ষেপে গেলেন। বললেন,”সে কি হে? যদি রটনাই হবে,তাহলে এখন তখনের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? এমন হেঁয়ালি করে কথা বলছ কেন?”
হারাধন কাকা কিছুটা মচকালেন কিন্তু ভাঙ্গলেন না। বললেন,”কথাটা বললাম এই কারণে যে,যদিও এখনও সেরকম কিছু হয় নি,তবে আমার মেয়ে যদি ভবিষ্যতে পালপাড়ার ঘোষেদের ওই ছেলেকে বিয়ে করতে চায়,তখন আমি হয়ত না করব না। কারণ,আমার একমাত্র মেয়েকে তো আমি অসুখী করতে পারি না! তাই না দাদা?”
আদিনাথ জ্যাঠাসহ বাকি প্রবীনরা সকলেই বুঝলেন,এই কদিন যা শুনে এসেছেন,কিছুই মিথ্যা নয়। হয়ত তলায় তলায় এই জাতীয় আলোচনা চলছে।
আদিনাথ জ্যাঠা বললেন,”কিন্তু হারাধন,তা–ই যদি হয় সে তো ঘোর অনাচার। এত অনাচার কি সইবে?”
“সইবে না সে আমি জানি“,হারাধন কাকার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। “আর সেই জন্য আমি মানসিক ভাবে বেশ চাপে আছি দাদা। কিন্তু কি করব বলুন? একমাত্র কন্যার বাবা হওয়ায় আমার যে হাত–পা বাঁধা।“
প্রবীণেরা উঠলেন। যাবার আগে বললেন,”যে অনাচার করছ তাতে আমাদের কিন্তু পাশে পাবে না।“
ঠিক এই সময় হারাধন কাকা বোমাটা ফাটালেন। বললেন,”দাদা,একটা কথা বলি,যেটা না বললে সত্যের অপলাপ হবে। যত রটনাই হোক,আমার টুটু কিন্তু ঘোষেদের ওই ছেলেকে ভাইফোঁটা দেয় নি।“
“সে কি?” প্রায় সমস্বরে সকলে বলে উঠলেন। যাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন,তাঁরা আবার বসে পড়লেন। বীরেন জ্যাঠা বললেন,”কি আবোলতাবোল কথা বলছ হারাধন? মাত্র গত বছরের ঘটনা। এখনও বছর ঘোরেনি। এরই মধ্যে মানুষকে বোকা বানাচ্ছ? ভাইফোঁটা দেয় নি? কতজন সাক্ষী আছে জানো?”
হারাধন কাকা জোরের সাথে প্রতিবাদ করলেন,”না দাদা। কোন সাক্ষী নেই। এরকম ঘটনা ঘটেই নি,তো সাক্ষী থাকবে কোথা থেকে?”
তর্ক থামল না। আদিনাথ জ্যাঠা বললেন,”একটু ঝেড়ে কাশো তো হারাধন। প্রকৃত সত্যিটা কি? একবার বলছ,সে তোমার মেয়ের ভাই নয়। আবার বলছ,তুমি অনাচারের ভয়ে ভীত। আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।“
হারাধন কাকা বললেন,”কথাটা কি জানেন দাদা,আমার টুটু পালপাড়ার ঘোষেদের ছেলেকে ফোঁটা দেয় নি। সে এসেছিল ঠিকই। কিন্তু ফোঁটা তাকে দেওয়া হয় নি। অথচ,পাড়া–প্রতিবেশী সবাই ধরেই নিয়েছে যে ঘটনাটা ঘটেছে। আমি ভয় পাচ্ছি এই কারণে যে,আমি জনে জনে বলতে গেলেও কতজনকে সত্যি কথাটা বলতে পারব? সমাজে আমার বদনাম তো ঘুচবে না?”
বিষয়টা অমীমাংসিত রয়ে গেল। রমেন ঘোষ মন্তব্য করলেন,”হারাধন সত্যি কথা বলছে কিনা,সেটা ঠিক করার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ থাকা দরকার। অন্ততঃ একজন সাক্ষী। তা না হলে হারাধনের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। তাই না আদিনাথবাবু?”
সময় ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। টুটুদির সাথে পরেশদার বিয়ের কোন তোড়জোড় না থাকায় বাইরের আলোচনা ক্রমশ থিতিয়ে আসতে লাগল। সবাই না হলেও অনেকেই ভাবলেন ওটা নিছক একটা রটনাই ছিল। হারাধন সরকার ওটাকে রটনা বলে ভুল কিছু করেন নি।
আবার ভাইফোঁটা এল। পাড়ার সবার তীক্ষ্ণ নজর থাকল সরকার বাড়ির দিকে। অনেককেই দেখা গেল সরকার বাড়িতে ঢুকতে। তবে,পরেশকে দেখা গেল না।
মাস দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন দেখা গেল হারাধন কাকা কাকিমাকে সাথে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ করছেন। আগামী ১৪ই অগ্রহায়ণ টুটুর বিয়ে। পাত্র পালপাড়ার মন্মথনাথ ঘোষের প্রথম পুত্র শ্রীমান পরেশচন্দ্র।
থিতিয়ে পড়া আলোচনা আবার দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। স্বপক্ষে ও বিপক্ষে নানা মতামত মুখে মুখে ফিরতে লাগল। তবে নিমন্ত্রণ পাওয়ার পর অনেকেই ভাইফোঁটার সামাজিক দিকটাকে আর গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। ভোজ বলে কথা। সহজে কি ছাড়া যায়? প্রবীণদের দলটার মধ্যেও বিভাজন দেখা দিল। অন্ততঃ চারজন হারাধন সরকারের কথায় বিশ্বাস করা উচিত বলে মত দিলেন। বাকিরা কি করতে চান, এ বিষয়ে একটা ধোঁয়াশা থেকে গেল। আদিনাথ জ্যাঠা এই দ্বিতীয় দলভুক্ত।
আদিনাথ মজুমদার ভোজনরসিক হিসেবে খ্যাত। বয়সকালে ডাকসাইটে খাইয়ে ছিলেন। এখন,এই পড়ন্ত বয়সে মাংসটা আর তত খান না। তবে,এখনও গোটা পঞ্চাশেক রাজভোগ হেলায় উড়িয়ে দিতে পারেন। যে সময়কার কথা বলছি, তখনও যে কোন গৃহকর্তা অতিথি সৎকারের আয়োজন করার জন্য যতই কষ্ট বা কৃচ্ছসাধন করুন না কেন,অতিথিদের খাওয়ানোর ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করতেন না। বরং দু–একজন নামকরা খাইয়েকে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে খাওয়াতেন।
এদিকে,আদিনাথ জ্যাঠা বেঁকে বসেছেন। হারাধনের কথা মিথ্যা প্রতিপন্ন হলে তিনি কোনভাবেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করবেন না। তবে যাবেন। স্নেহাস্পদ টুটুকে তাঁর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করবেন না। টুটু তার বিবাহিত জীবনে সুখী হোক। তাই তিনি যাবেন। কিন্তু ভোজনে অংশগ্রহণ করবেন না। তা সে ভোজন যত আকর্ষকই হোক না কেন।
আদিনাথ জ্যাঠার এই কঠোর সিদ্ধান্ত জানতে পেরে হারাধন কাকা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আদিনাথের মত বিখ্যাত খাইয়েকে না খাওয়াতে পারলে সমাজে মান–ইজ্জত থাকবে না। উপায় কিছু একটা বার করতে হবে। শুধু টুটুকে আশীর্বাদ করে আদিনাথদা চলে যাবেন, এটা হতে দেওয়া যায় না।
আলোকমালায় সজ্জিত বাড়ি। সানাই বাজছে। অতিথি অভ্যাগতরা এসে পড়েছেন। আদিনাথ জ্যাঠাও এসেছেন। সন্ধ্যা লগ্নে বিয়ে। তাই বর–কনে বিয়েতে বসে পড়েছে। আদিনাথ জ্যাঠা তাই এখনও আশীর্বাদ করতে পারেন নি। অপেক্ষা করছেন। এমন সময় দুটি ছেলে সামনে এসে জ্যাঠার পায়ের ধুলো মাথায় নিল। জ্যাঠা চিনতে পারলেন। পাড়ারই চক্রবর্তী আর চৌধুরীদের ছেলে পার্থ আর গোপাল। আদিনাথ জ্যাঠা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। এই ভরা বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ দুজনের প্রনাম আশা করেননি। বললেন,”কি ব্যাপার? হঠাৎ প্রনাম করলে?”
গোপাল বলল,”জ্যাঠামশাই,আপনি নাকি খাবেন না?”
আদিনাথ জ্যাঠা এদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠলেন। সরাসরি জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,”কেন বলো তো? হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
পার্থ বলল,”হারাধন কাকা বলছিলেন,আপনি নাকি ভাইফোঁটার ব্যাপারে রেগে আছেন। কেন জ্যাঠামশাই? ভাইফোঁটা নিয়ে কি হয়েছে?” আদিনাথ জ্যাঠা তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন,”জানো না কি হয়েছে? যত সব অনাচার। সমাজ ধর্ম,কিছুই কি মানবে না তোমরা?”
পার্থ আবার বলল,”জ্যাঠামশাই, আপনি তো জানেন,গত তিন বছর ধরে আমরা দুজন টুটুর কাছে ফোঁটা নিচ্ছি। কাকাই জোর করে এটা করেছিলেন। আমরা কিন্তু জানি যে পরেশ টুটুর কাছে ফোঁটা নেয় নি।“
জ্যাঠা এখনও রেগে আছেন। বললেন,”তাহলে সেদিন সে ওখানে কি করছিল? ডুগডুগি বাজাচ্ছিল?”
“না জ্যাঠামশাই, হারাধন কাকা ওকে ধরে আনিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু টুটু ওকে ফোঁটা দেয় নি। কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কাকা তাই জোর করতে পারেননি।” গোপাল বলল।
জ্যাঠা বললেন,”তোমরা যে সত্যি কথা বলছ,এটা বুঝব কি করে?”
“কি বলছেন দাদা?” পাশ থেকে মন্তব্য করলেন ষষ্টিচরণ গাঙ্গুলী। আর এক নিমন্ত্রিত অতিথি। বললেন,”আপনাকে মিথ্যা কথা বলবে, এতবড় বুকের পাটা ওদের আছে? নেই দাদা নেই। তাই আপনি নিশ্চিন্তে ওদের কথা বিশ্বাস করতে পারেন।“
আদিনাথ জ্যাঠা নরম হলেন। বললেন,”ঠিক আছে। মানলাম,অনাচার কিছু হয়নি। কিন্তু হারাধন সেটা আমাকে বুঝিয়ে বলতে পর্যন্ত পারে নি। হারাধনকে ডাকো তো। ওটা একটা অর্বাচীন। মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। এদিকে বুদ্ধিতে বৃহস্পতি।“
আদিনাথ জ্যাঠা হাসিমুখে খেতে বসলেন। মাংস আজকাল বেশী খান না। মাত্র আধসের মত খেলেন। কিন্তু রাজভোগ খেলেন প্রায় চুয়ান্ন–পঞ্চান্নটা আর সব শেষে আধসের খানেক দই খেয়ে যাবার আগে মেয়ে–জামাই দুজনকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলেন।
হারাধন সরকার পার্থ আর গোপালকে আড়ালে ডেকে কনেযাত্রী হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন আর অতিথি বিদায় করে প্রাণখুলে হাসলেন।
*******************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও,প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।